“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৫৭
গুরুম গুরুম বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো। গভীর শোকে আকাশ যেনো ভেঙে পড়লো। নিচে ঝাপিয়ে পড়ার ঠিক আগমুহূর্তে হঠাৎ থেমে গেলো নীলাংশ। না! কোনো ভয় বা দ্বিধায় নয়। এমন একটা কথা মাথায় খেলে গেলো যা তাঁকে থামতে বাধ্য করলো। পা নামিয়ে ছাঁদের সদ্য ভেজা মাটিতে বসে পড়লো। মাথায় হাত চেপে বিরবির করে বললো –
‘ইশ! কী ভুলটাই না করতে যাচ্ছিলাম! ‘
কিছু কথার হিসাব মিলাতে মিলাতেই ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসির রেখার সৃষ্টি হলো। আনমনে ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়ালো। আকাশের ঘনঘটা মেঘ দেখে জ্বলজ্বলে চোখে তাকিয়ে বললো-
‘ধন্যবাদ! ‘
সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করলো নীলাংশ। অমিলিত হিসেবগুলোর কয়েকটি মিললেও বাকিগুলো সে নিজেই মিলিয়ে নিবে। কারণ সে বুঝতে পারলো,
“জীবনের জটিল সমীকরণ মিলানোর দায়িত্ব মাঝে মধ্যে নিজেকেই নিতে হয়।”
_________________
হোটেল কামরায় পিনপতন নীরবতা। না, এটি ঝড়ের পূর্বাভাস নয়। বরংচ, ঝড় বয়ে যাওয়ার পরের অবস্থা।
ছোট খাটো ঝড়ই বলা চলে। ফ্লোরের প্রতিটি কোণায় কোণায় কাঁচের টুকরো। ফ্লোরেই একপাশে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছে পায়রা। দৃষ্টি সম্পূর্ণ নিষ্প্রাণ, মলিন
। হাতের তালু থেকে টুপটুপ করে রক্ত ঝড়ছে। বাম
হাতের মুঠোয় এখনো একটা কাঁচের টুকরো ঢুকে অর্ধেক বের হয়ে আছে। ওখানে থেকে এসে রুমের কাঁচের সব জিনিস ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে সে। রাগে এতক্ষণ ভাঙচুর করলেও একসময় গিয়ে রাগ নিঃশেষ হয়ে দুঃখগুলো আছড়ে পড়লো।
রুমের দরজা খুলে ভেতরে আসলো আভাস। পায়রা লক করে দিয়েছিলো। আভাস রিসিপশনের একজন মেয়ের থেকে ডুবলিকেট চাবি এনে দরজা খুললো। চোখে মুখে অস্থিরতা। মাথায় দুশ্চিন্তা ভর করছিলো। রাগের মাথায় নিজের কিছু করে ফেললো না তো!
পায়রাকে কোণায় বসে থাকতে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো। পায়ে জুতা থাকায় কাঁচ বিঁধল না। কিন্তু পায়রার রক্তাক্ত, কাটা হাত দেখতেই আঁতকে উঠলো। পায়রার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো-
‘হোয়াট দা হেল ইজ দিস! পায়রা, আমি কী এতগুলো বছর তোমাকে এসব শিখিয়েছি? ‘
পায়রা নিথর বাকশূণ্য। তার দৃষ্টি সিলিং ফ্যানের দিকে। আভাস গভীর দীর্ঘ শ্বাসে উঠে দাঁড়ালো ৷ ফার্স্ট এইড বক্স থেকে তুলো আর স্যাভলন দিয়ে মুছে ব্যান্ডেজ করে দিলো। বামহাত থেকে ধীরে ধীরে কাঁচটা বের করলো। পায়রা টু শব্দও উচ্চারণ করেনি। ব্যাথা যেনো হারিয়ে সে অবশ হয়ে গেছে। আভাস জোড় করে টেনে বিছানায় বসালো। সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো-
‘মিস ইন্টেলিজেন্ট?’
পায়রা এক পলক তাকালো। ভেতরের ক্রমাগত স্রোতের মতো কষ্টের ঢেউগুলো বেরিয়ে আসতে লাগলো। স্বশব্দে কেঁদে উঠলো সে। আভাসের মন ব্যাথিত হলো। সাত বছর যাবৎ মেয়েটাকে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখেনি৷ চোখের পানিগুলো নিজের অন্তরালে লুকিয়ে রেখেছিলো যেনো। পায়রা হাত মুখে চেপে কাঁদল অবিরাম। এতগুলো বছরে এতো কষ্ট সে প্রথম বার পেলো ৷ সব ছেড়ে চলে যাওয়ার সময়, নীলাংশকে অন্য নারীর সঙ্গে দেখেও এতোটা কষ্ট লাগেনি। পায়রা মনে মনে ভাবলো, নীলাংশ তো সেদিনই অন্য কারো হয়ে গেছিলো যেদিন অন্য একজনকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছিলো। আজ সেই ধোঁকা বেইমানি গুলোর সাক্ষী ছোট মেয়েটা। সাক্ষীই তো! আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো, পায়রা কখনো নীলাংশের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ছিলোইনা। পায়রা ছিলো সত্যিই এক খাঁচায় বন্দী পায়রার মতো। যে উড়ে গেলে দুইদিন দুঃখ পেলেও তৃতীয় দিন সে জায়গায় নতুন কেউ দখল করে নেয়। নিজের সঙ্গে নিজের মনের যুদ্ধে রক্তিম হলো হৃদয়।
আভাস তার পাশেই বসে আছে। পায়রার দিকে তাকিয়ে বললো-
‘আমি একজন শিক্ষক হিসেবে ব্যার্থ পায়রা?’
পায়রার সচেতনী উত্তর –
‘এসব কেনো বলছেন?’
‘কী বলবো! কারাতে,আর্ট, বিজ্ঞান শিক্ষা সবকিছুতেই আমি চেয়েছি তুমি পারদর্শী হও৷ আজ সামান্য একটা ব্যাপারে ভেঙে পড়লে!’
‘তো? বেইমান লোকটা নিজের মেয়ে থাকা সত্ত্বেও কী দারুণ অভিনয় করছিলো। আমি কী করে সহ্য করছি এসব?’
ঠোঁট কাঁপছে পায়রার। কান্না এতসময়ে কিছুটা কমে এসেছে। আবারও রাগী স্বরে বললো –
‘আমি বাংলাদেশে আর এক মুহূর্তও থাকবো না। আজই আমি জুরাইখ রওনা হবো৷ ‘
আভাস স্মিত হাসলো। শান্ত গলায় বললো –
‘পালিয়ে যেতে চাও?’
পায়রা অবাক হয়ে বললো-
‘মানে!’
‘পালিয়ে যায় ভীতুরা। সত্যের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা যার নেই সে খুব দুর্বল। তার চেয়ে দুর্বল প্রাণী পৃথিবীতে আর একটাও নেই। ‘
‘আপনি কী বলতে চাইছেন? এখানে রোজ রোজ আমি ঐ লোকটার মুখোমুখি হবো!’
‘হ্যা হবে। পৃথিবী গোল। আজ পালিয়ে গেলেও, ভাগ্যক্রমে আবারও তোমাদের দেখা হতে পারে। বারবার পালাতে পারবেনা তুমি। আমরা যে কাজে এসেছি, অর্থাৎ ব্যবসার কাজ শেষ না হওয়া অব্দি আমরা এখানেই থাকবো। ‘
‘কিন্তু.. ‘
‘কষ্ট হবে তাইতো? সাত বছরে প্রতিটা সেকেন্ড তুমি তা-ই পেয়ে এসেছো। কয়েকটা দিন সহ্য করতে পারবে না? ‘
পায়রা মাথা নিচু করে ভাবতে থাকলো। আভাস যেতে যেতে একবার পিছনে ফিরে মুচকি হাসলো। আভাসের প্রস্থানের পর উঠে দাঁড়ালো পায়রা। নিজেকে শক্ত করলো। ঠিক করলো, কাজ সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া মুখোমুখি হবেনা লোকটার। বিরবির করে গালি দিয়ে বললো-
‘সামনে এসে আর একটা উল্টো পাল্টা কথা বলুক, ঠাসিয়ে চর বসিয়ে দিবো ৷ চেনেনা তো আমাকে! ‘
________________
পরদিন ভীষণ দ্বিধাদন্দে অফিসে আসলো পায়রা। আভাসের সঙ্গে আসলেও সে পরে ভেতরে ঢুকলো। বাহিরে দাঁড়িয়ে অস্থিরতা সামলে নিলো। এখানে যতদিন কাজ হবে ততদিন অফিসেই বেশিরভাগ থাকতে হবে। আলাদা কেবিনে ঢুকে মাথা চেপে বসে থাকলো। কিছুক্ষণ পরই মিটিং-এর ডাক পড়লো।
গোল টেবিলটায় আগের দিনের মতোই সবাই বসেছে।
ব্যতিক্রম নীলাংশ। অন্যান্য দিনের চেয়ে উজ্জ্বল লাগছে তাকে। প্রোজেক্টর অন করে কিছু প্রোডাক্ট ডিজাইন দেখাচ্ছে। হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আদর্শ মুখভঙ্গিতে বোঝাচ্ছে। পায়রা না চাইলেও লক্ষ্য করলো, নীলাংশের সুঠাম দেহ আগের তুলনায় বেড়েছে। আগের মতো হালকা পাতলা শরীরটা প্রাপ্ত বয়স্কে পরিণত হয়েছে। গালের হালকা চাপদাড়ির সঙ্গে হালকা লালাভ ঠোঁট কথা বলার সময় মৃদু কাঁপছে। আশেপাশের কিছু খেয়াল করেনি পায়রা। নীলাংশ আচমকাই তার দিকে ফিরে তাকালো। গাঢ় চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইতস্তত হয়ে গেলো পায়রা। দৃষ্টি সরানোর আগেই নীলাংশ অদ্ভুত কাজ করলো। বাঁকা হেসে চোখ টিপ দিলো। ভড়কে মুখ হা করে ফেললো পায়রা। নীলাংশ প্রজেক্টেরের কাজ শেষ করে ধপ করে পায়রার পাশে বসলো। ঠোঁট উচিয়ে চুমুর ইঙ্গিত করতেই পায়রা ফস করে উঠলো। রাগে খিটমিট করে বললো-
‘বুড়ো অশ্লীল ব্যাটা! ‘
চলবে-
(নীলাংশের নতুন রূপ কেমন লাগলো?)