স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৬৯

0
2495

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৬৯

তৃতীয় বারের মতো বমি করে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেহের ভর ছেড়ে দেয় পায়রা। পাশ থেকে নীলাংশের যত্নশীল হস্তদ্বয় আগলে নেয় তাঁকে। মাথায় কতশত চিন্তা ঘুরে বেড়ায়! অথচ মেয়েটি একদমই নিজের যত্ন নিতে চায় না। বড্ড বেখেয়ালি যে! এই যে, কিছুক্ষণ আগেও, ফুচকা খেলে শরীর খারাপ করবে, শরীর খারাপ করবে বলে বলে ফ্যানা তুলল নীলাংশ। অথচ, পায়রা তাঁকে রাজ্যের সবরকম ভুয়া তথ্য দিয়ে ইমোশনাল ব্লেকমেইলের দ্বারা ফুচকা খেয়েই নিলো। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। নীলাংশ রাগ দেখাতে চায়। কিন্তু বাঁধ সাধে পায়রার পেটের উঁচু অংশটা। যেখানে তারই অস্তিত্বটা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। সাত মাসে নাকি গর্ভবতী নারীর শরীরে অপার্থিব রকমের সৌন্দর্য নেমে আসে। পায়রাকে না দেখলে নীলাংশ ব্যাপারটা বুঝতে পারতো না। কী ভয়ঙ্কর ধরনের সুন্দর যে লাগে পায়রাকে! চাকনচিকন, ফিট পয়তাল্লিশ কেজির শরীরটা গুলুমুলু হয়ে ষাট কেজিতে ঠেকেছে। মোটেও খারাপ দেখায়না। ফর্সা গাল দুটো কিছুটা ফুলে লাল হয়ে টমেটোর মতো লাগে। ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত চুল গুলো এখন পিঠের নিচে। নীলাংশ চুল গুলো খোঁপা বেঁধে দেয়। এতটুকু সে বিয়ের পরপরই শিখে নিয়েছে। চুল থেকে নখের যত্নটাও সেই নেয়।
ঘুম থেকে ওঠার আগের মখমলের জুতোজোড়া গুছিয়ে বিছানার নিচে রেখে দেয়। গোসলের আগে জামা কাপড় গুলো গুছিয়ে, ঘরে ওয়াটার প্রুফ কারপেট বিছিয়ে, ঘরে যা তা করে ফেলে নীলাংশ। বিয়ের একবছরে মোটামুটি সবই তার মুখস্থ। এত তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাও নীলাংশের জন্য। তার মতে, সে ত্রিশের কোঠা পেরিয়ে গেছে। এবার যদি বাচ্চা না নেয়, তাহলে তার বাচ্চার মুখে নানা ডাক শুনতে হবে।
পায়রার দোনোমোনো দেখে, নীলাংশ দৃঢ়ভাবে বলে,
বাচ্চার সব দায়িত্ব নীলাংশের। কথা মতো সাতটা মাস আগলে আগলেই রেখেছে সে ৷ তবে,এখন পায়রার এই দুর্বলতা তাঁকে পোড়াচ্ছে। নিস্তেজ পায়রাকে টেনে গাড়ির ভেতর নিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘তুমি আমার বুকের ভিতর থাকতে পারবে না পিচ্চি? ‘

পায়রা নিচুস্বরে বলল,

‘অতটুকু জায়গা কী দুইজনের হবে? হলে আমি থাকবো! ‘

নীলাংশ গাড়িতে এতে বুকে জড়িয়ে কপালে ছোট করে চুমু বসিয়ে বলে,

‘সারাজীবনের জন্য এই জায়গায়টায় রেখে দিতে পারলে খুব ভালো হতো পিচ্চি। আমার লিটেল প্রিন্সেসটা বাবার কাছে এসে পড়ুক, আর কিছু দরকার নেই। কারণ, কুইনকে সামলাতে সামলাতেই আমার অর্ধজীবন পাড় হয়ে যাবে! ‘

বিনিময়ে প্রশস্ত হাসে পায়রা। বিয়ের এই এক বছর দুই মাস তার জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়। দুঃখের সময়টা ধৈর্য ধরে ছিলো বলেই হয়তোবা বিধাতা এতোটা সুখ তার কপালে লিখে দিয়েছে। মনে মনে, আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নেয়।

বাসার সামনে গাড়ি থামতেই নীলাংশ পায়রাকে ধরে নামায়। ঢুলুঢুলু পায়ে নেমে আসে মেয়েটা। প্র্যাগনেন্সির অর্ধেক সময়টা হয়ত সে ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিয়েছে। অবিন্যস্ত পদে ভেতরে ঢুকে। নীলাংশ গাড়ি গ্যারেজে ঠিক করে পার্ক করে একটু পেছনে পড়ে গেছে। পায়রাকে দাঁড়াতে বললেও সে কথা না শুনে অর্ধঘুমে হেঁটে হেঁটে লিফট বেয়ে চলে এসেছে। দরজা কোনো কারণে খোলাই ছিলো। পায়রা খেয়াল না করেই ভেতরে ঢুকে যায়। কাজের মহিলাটি মাত্রই ঘর মুছে এসেছে। দরজার সামনের জায়গাটার কার্পেট মোছার আগেই উঠিয়ে অন্য জায়গায় রেখে দিয়েছে। পায়রার পা ভেজা টাইলস স্পর্শ করতেই পিছলে পড়ে যেতে নেয়, কিন্তু তার আগেই কেউ ধরে ফেলে। পায়রা রুদ্ধশ্বাসে হাঁপায়। মাথাটাও ঘুরে উঠেছে। তানজিমা ধরে ফেলেছে তাকে। পায়রা তানজিমার হাত ধরে সোফায় বসে। তানজিমা কাজের মহিলাটির উদ্দেশ্য ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন,

‘কলি,তোকে বলেছি না! এভাবে ঘর মুছবি না! ফ্যানটাও অন করিসনি। শুকাবে কীভাবে? এখনই কত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতো! ‘

কলি মেয়েটা ভয়ার্ত চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকে। তানজিমা আরও দুই চারটা ভালো মন্দ শুনিয়ে যেতে থাকলেন। রূপসা আর রায়ানাও ছুটে এসেছে। পানি পান করালো পায়রাকে। বমি করার দরুণ চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে সে।

নীলাংশ এসে পড়লো এর মাঝেই। আগে থেকেই চিন্তায় ছিলো। পায়রাকে ঘিরে থাকতে দেখে একপ্রকার দৌড়ে এসে পড়লো। পায়রার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এই কী হয়েছে তোমার? শরীর খারাপ লাগছে! ‘

রূপসা পিছলে যাওয়ার কথাটা বলতেই ক্ষেপে উঠলো নীলাংশ। এতদিন পায়রার এত বেখেয়ালিপনা মেনে নিলেও আজ ভীষণ রাগ হলো। সে পাশের কাঁচের গ্লাসটা উঠিয়ে আছাড় দিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে উচ্চস্বরে বলল,

‘খুব শান্তি পেলি এবার! আমার বাচ্চাটাকেও মার, আমাকেও মেরে ফেল! আমারই দোষ সব। ‘

নীলাংশের চেচিয়ে বলা শুনে ফুপিয়ে কেঁদে দেয় পায়রা। পাশ থেকে অসহায় মুখে তানজিমা বলেন,

‘নীল! বাবা, ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। ‘

নীলাংশ রাগান্বিত অবস্থাই ঘরে ঢুকে যায়। সেখানেও হয়তো ঘন্টা খানেক তান্ডব চালাবে সে। এতদিনে তানজিমার সঙ্গে পায়রার মজবুত একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। রূপসা, তানজিমা দুজনের আদরে আদরে আগলে আছে। পায়রার প্র্যাগ্নেন্ট হওয়ার পর থেকে আশ্চর্য রকম ভাবেই নীলাংশ তানজিমার সঙ্গে কোনো রূপ দুর্ব্যবহার করেনা। হয়ত, নিজের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা উপলব্ধি করেই তা হয়েছে। সম্পর্কের তেঁতো স্বাদটা ধীরে ধীরে হয়তো ম্লান হবে। তানজিমার সহায়তায় ঘরে আসে পায়রা। তানজিমার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। তিনি আলতো হেঁসে বললেন,

‘ভয় পাসনা, আমার ছেলেটা যত রাগই হোক কিছুক্ষণ পরই শান্ত হয়ে যায়। ঘরে গেলেই দেখবে, ঠিক হয়ে যাবে। ‘

অল্প খানিকটা ভরসা নিয়ে ঘরে আসে পায়রা। উঁকি দিয়ে দেখে নীলাংশ কী করছে। নাহ! ঘরে নেই। বাথরুমে গেছে। গোসল করছে মনে হয়। ঘরের কোনো জিনিস এলোমেলো নেই দেখে অবাকই হয়। সে তো ভেবেছিলো,ঘরের উপর দিয়ে সিডর, আইলা যাবে আজকে। অদ্ভুত তো! দুই পা চালিয়ে বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসলো। মিনিট পাঁচেক পরই ঠাশ করে শব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে নীলাংশ। টাওয়াল দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে বের হয়ে কোনোদিক না দেখে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। পায়রা গাল ফুলিয়ে তাকায়। এত রাগ! আনমনেই বিরবির করে পেটে হাত রেখে। প্রায়শই একা একা কথা বলে সে,

‘দেখেছিস বাবু,বাবা কত পঁচা! আমি কী জানতাম, ওখানে ভেজা থাকবে! তারপরও দেখ। কথায় কথায় বকে আমাকে! এতো এতো বকে আমাকে! আমার কী কান্না পায় না! ‘

জোরে জোরে চেচিয়ে কথাটা বলে, আবার পেটের দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বলে,

‘তবে,বেশি খারাপ না! হার্ট খুব সফ্ট সফ্ট কোকোনাট!’

পায়রার কর্মকাণ্ড দেখে নীলাংশ বুঝতে পারছে না, সে হাসবে নাকি কাঁদবে। এমন করলে মানুষ কীভাবে রাগে! তবুও নিজেকে রাগী বুঝিয়ে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকলো। এহেন আচরণে পায়রা ভেঙচিয়ে দিলো তাকে।

মুখ কালো করে কিছুক্ষণ নিজের অফিসের ফাইল গুলো চেক করে নিলো। উঠে আলমারিতে তুলে রাখতে গেলো। এক ড্রয়ারে রেখে, অন্য ড্রয়ারটা খুলতে নিয়েই হুট করে কিছু একটা মনে পড়ে গেলো।
দ্রুত হাতে খুলে নিলো। বেরিয়ে এলো ভারি ডায়েরি।
পায়রা ভুলেই গেছিলো একপ্রকার। বিয়ের পর পর অনেক জায়গাতেই ঘুরতে গিয়েছে। এসবের মধ্যে ডায়েরির বিষয়টা মাথা থেকেই বেরিয়ে গেছিলো। ডায়েরিটা নিয়ে বসলো পায়রা। কৌতূহল সামলাতে না পেরে প্রথম পৃষ্ঠাই খুলে নিলো। বেরিয়ে এলো, হলুদ রঙের একটি চিরকুট।
গোট গোটা অক্ষরে লেখা,

‘মিস ইন্টেলিজেন্ট, এই ডায়েরির দায়িত্বটা আজ থেকে তোমার। তোমার মনের সকল প্রশ্নের উত্তর পাবে। জীবন নাম উপন্যাসের মূল পয়েন্টটা হয়তো তুমি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনে যাবে। ‘

ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই পায়রা যা দেখলো তা বিশ্বাস করতে পারছিলো না। এটা কীভাবে সম্ভব! পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলো সঙ্গে সঙ্গে।

চলবে-

(ডায়েরিতে কী লেখা থাকতে পারে?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here