“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৬১
ড্রইং রুমে আবছা আনন্দের রেশ। বহুদিন পর সবাই একত্রিত। দুটো বাচ্চার কলকল ধ্বনি মুখরিত করছে পরিবেশ। রূপসা নীলাংশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। চোখের কোণে জল, তবে তা দুঃখের নয় সুখের। নীলাংশ কিছুক্ষণ আগেই সবাইকে জানিয়েছে বহু আকাঙ্খিত রমনীর দেখা সে পেয়েছে। পায়রা বাড়ি ছাড়ার পর সুখপায়রাও যেনো হারিয়ে গেছিলো। সাতটা বছর শোকের ছায়া আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিলো।
পায়রার দেখা পাওয়া এখন সবার কাছেই বড় সুখের খবর। রায়ানা পাশের সোফায় বসে আছে। মুখে একগাল হাসি। তাঁর চোখও ভেজা। ভাইটাকে সাতটা বছর কী নিদারুণ যন্ত্রণা উপভোগ করতেই না দেখেছে! পাশেই তাঁর স্বামী ফাহিম। তাঁর ভালোবাসা পূর্ণতা পেয়েছে বছর পাঁচেক আগে। কলেজ লাইফ থেকেই রায়ানার সাথে প্রেম ছিলো ফাহিম মাহমুদের। পড়াশোনা একসাথেই শেষ হয়েছে। পেশায় এখন দু’জনেই ডাক্তার। দুই বছর আগে তাদের ঘর আলো করে এসেছে আনাম। ডাক্তারি ও সংসারের কাজকর্ম নিয়ে ভালোই যাচ্ছে দিনকাল। সব থেকেও যে জায়গাটা অপূর্ণ ছিলো তা যেনো পূর্ণ মনে হচ্ছে। নীলাংশের মুখে স্বচ্ছ হাসি। ভাইয়ের হাসি মুখ দেখার লোভে রায়ানাও ছুটে এসেছে। রুশানী আর সাহিরও উপস্থিত। সবার হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে তানজিমা চোখের কোণের জলটুকু মুছে নিলেন। বুকের অপরাধের ভার এক আঙুল কমলো। নিজের দোষেই সব হারালেন তিনি। সবচেয়ে কাছের স্নেহের ছেলেটাও এখন আর আগের মতো মম, মম বলে ডাকেনা। কেউ বলেনা, আমার মম ওয়ার্ল্ডস বেস্ট মম। মৃত্যু যন্ত্রণাও এর থেকে সহজ মনে হয় তাঁর। সাদা কালো মলিন শাড়িটায় নুইয়ে যাওয়া শরীরটা নিজের ঘর থেকে ড্রইং রুম পর্যন্ত টেনে এনে পাশে দাঁড়ালেন। কেউ তখনও তাঁকে খেয়াল করেনি। তিনি হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন-
‘নীল, পায়রাকে একদিন বাসায় নিয়ে আয়না বাবা। ‘
সবাই চকিতে তাকালো। নীলাংশ কথাটা শোনা মাত্রই তাচ্ছিল্য হেঁসে বলল-
‘কেনো? যাতে পিচ্চিকে কানপড়া দিয়ে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারেন?’
হাসি মিলিয়ে কালো মেঘ মুখে ছেয়ে যায় তাঁর। চোখ টলমলে হয়ে আসে। তাঁর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে নীলাংশ উঠে দাঁড়ায়। যেতে যেতে একবার পেছনে ফিরে শক্ত করে বলে-
‘পিচ্চি কে আমি তো আমার জীবনে ফিরিয়ে আনবোই। কিন্তু তা এ বাড়িতে নয়। পায়রা একবার আমার জীবনে ফিরে আসুক। তারপর এ বাড়ি কেনো? এ দেশ ছেড়েই চলে যাবো আমি। বলা তো যায়না, আবার কোন কালোছায়ার নজরে পড়ে আমার শেষ অবলম্বনকেও মেরে ফেলেন আপনি। ‘
নীলাংশ চলে যেতেই ধপ করে সোফায় বসে পড়েন তানজিমা। ডুকরে কেঁদে ওঠেন। মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে নিলেন। রূপসা আর রায়ানা দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাঁকে সামলাতে। কিন্তু কান্নার পরিমাণ আরও বাড়লো। পাপের বোঝা যে তাঁর বড্ড ভারি।
____________________
হাঁটুতে মুখ গুঁজে কেঁপে কেঁপে কাঁদছে নীলাংশ। সবচেয়ে যাকে বেশি ভালোবাসতো। সেই মায়ের সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করতে খুব কষ্ট হয় তাঁর। কিন্তু ঐ মা নামক মানুষটার জন্যই জীবন থেকে দুই দুইটা মানুষকে হারিয়েছে নীলাংশ। একজনকে হয়তো ফিরে পেলেও আরেক জন না ফেরার দেশে চলে গেছে। বুক চাপড়ে গুমরে কাঁদল অবিরাম। কে জানে! কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে সে। সাত বছর আগে একজন নয় বরং ছয় মাস অন্তত তাঁর প্রাণপ্রিয় বাবাকেও হারিয়ে ফেলে নীলাংশ। সারাজীবন বটবৃক্ষের ছায়ার মতো ছিলো যে। তাঁকে হারিয়ে নীলাংশ হয়ে গেছিলো পাগলপ্রায়। পায়রা জীবন থেকে হারানোর পরও মায়ের সঙ্গে টু শব্দ করেনি। দোষ সম্পূর্ণ মায়ের হওয়া সত্ত্বেও। প্রণয়ীর জন্য কী করেই বা মা’কে কষ্ট দিবে!
দশ মাস দশ দিন যে মা তাঁর গর্ভে তাঁকে লালন করেছে। সে তো সবচেয়ে বেশি মা’কেই ভালোবাসতো। পায়রাকে দূরে সরানোর চেয়েও বেশি আঘাত তখন পেয়েছিলো সে। যখন বাবাও পৃথিবী ত্যাগ করেন। মা’কেই তো খুশি রেখেছিলো। মা’কে দুঃখ দিতে চায়নি বলেই তো কত নাটক সাজিয়েছিলো। পদে পদে নাটক করে ছিলো। অথচ, জীবনটাই এখন নাটকের রঙ্গমঞ্চে পরিণত হলো। নাটকের শুরুটা ছিলো সাত বছর আগে সৌদি আরব থেকে।
মা যখন নীলাংশকে সৌদি আরবে দ্রুত আসতে বললো নীলাংশ কোনো কিছু না ভেবেই রওনা হয়েছিলো। কিন্তু তখনও সে জানেনা, জালে জড়িয়ে পড়েছে। যে জাল এতোটাই দৃঢ়ভাবে তাঁকে আঁকড়ে ধরেছে তা কাটিয়ে উঠতে এখনও পারেনি। এখনও চোখে ভাসে হাসপাতালের রুমটা। যেখানে শায়িত আছেন আনভীর চৌধুরী। অর্থাৎ রুশানীর বাবা। রুশানী বাবার হাত ধরে হুমড়ি খেয়ে কাঁদছে। পাশেই মা ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। ঘন্টা খানেক পরই লাশ দাফন করা হলো। রুশানীদের বাড়ি এখন ফাঁকা। বাড়ি পৌঁছাতেই জরুরি তলবে রুশানী ও নীলাংশকে ডাকলেন তিনি। রুশানী মলিন মুখে পাশে দাঁড়িয়ে। নীলাংশের মুখে কৌতূহল। তানজিমার হঠাৎ একটা কথায় বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হলো দু’জনেই।
‘আমি চাই তোমাদের দুজনের চারহাত এক করতে। ‘
নীলাংশ চমকে উঠলো। মাথা ভো ভো করে ঘুরে উঠলো যেনো। তড়িৎ গতিতে বলল-
‘মানে! কী বলছো এসব মম?’
তানজিমা রুক্ষ স্বরে বললেন-
‘মানে, আমি দুজনের বিয়ে করাতে চাই। ‘
রুশানীও কম ঝটকা খেলো না। নীলাংশ বা রুশানী কারো মতামতই যেনো গুরুত্বপূর্ণ নয়। সদ্য বাবা হারানোর শোকও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া তাঁরও একজন ভালোবাসার মানুষ আছে। সামনে থাকা মায়ের সমতুল্য ফুপুকে মুখের উপর কী করে বলবে, তা ভাবতে ভাবতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে তাঁর। নীলাংশ সপ্রতিভ হয়ে বলল-
‘মম, আমি রুশানীকে বিয়ে করতে পারবো না। ‘
‘কেনো?তুমি কী অন্য কাউকে ভালোবাসো?’
ঘাবড়ে গেল নীলাংশ। সে চেয়েছিলো পায়রা ইন্টার পরীক্ষা দেয়ার পর ধীরে সুস্থে মা’কে বুঝিয়ে রাজি করাবে। কিন্তু এখন পায়রার কথা বললে তিনি মোটেও মেনে নিবেননা। তা ভালোই জানে নীলাংশ। পায়রাকেও যে মা পছন্দ করেনা সেসবও অবগত নীলাংশ। কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। কিন্তু এখন না বললে পরিস্থিতি খারাপ হবে ভেবে চটপট বলল-
‘মম, আমি পিচ্চিকে ভালোবাসি। আর বিয়ে করলেও শুধু ওকেই করবো। ‘
আকাশ ভেঙে পড়লো তানজিমার মাথায়। দুধ কলা দিয়ে তাহলে বাড়িতে কালসাপ পুষছিলেন তিনি! রক্ত গরম হয়ে গেছে তাঁর। নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন সঙ্গে সঙ্গেই,এবং তাঁর কালো প্রভাব পড়লো নীলাংশের ওপরই।
চলবে-