“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৬২
রাগে অস্থিমজ্জা জ্বলে যাচ্ছে তানজিমার। এই জন্যই তিনি পায়রাকে পছন্দ করতেননা। মনে মনে ঢেড় গালাগাল করলেন। অনাথ একটা চালচুলোহীন মেয়েকে কিছুতেই নিজের ছেলের জীবনে প্রবেশ করতে দেবেন না। মুহুর্তেই এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন তিনি। সমস্ত ক্রোধ একত্রিত করে বলেন-
‘নীলাংশ, তুমি কী অবাধ্য হতে চাচ্ছো? ‘
নীলাংশ আকুল পাথারে পড়ে যাওয়ার মতো হাবুডুবু খাচ্ছে। কী থেকে কী হলো এখনো বোধগম্য হচ্ছে না।
মা কখনো তাঁকে ‘নীল’ সম্বোধন ছাড়া ডাকেনা। আকস্মিকতায় হতভম্ব নীলাংশ। কন্ঠ রোধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিন্তু, এর একটা সুষ্ঠু বিহিত না করে থামবে না সে। নীলাংশ ঢোক গিলে গলা ভেজানোর চেষ্টা করে বলল-
‘মম,আমি কখনো তোমার অবাধ্য হইনি৷ আর হতে চাইও না। কিন্তু রুশাকে আমি ছোট থেকেই বোন মনে করি। এর বেশি কিছু না। ওকে বিয়ে করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে। ‘
তানজিমা লাল হয়ে যাওয়া সুশ্রী মুখে ফট করে বললেন –
‘বোন মানতে, এখন থেকে আর মানবে না। বিয়ে তোমাকে রুশাকেই করতে হবে। তানভীরকে কথা দিয়েছি আমি, ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার। ‘
নীলাংশ অসহায় হয়ে গেলো। মায়ের রাগমিশ্রিত মুখ দেখে তটস্থ হয়ে যাচ্ছে। পায়রাকে ছাড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব না। চোখে অসহায়ত্বর সঙ্গে অশ্রুও জমা হলো।
মা’কে কী করে বোঝাবে, মাতৃভূমিতে নিজের প্রাণভোমরাকে কথা দিয়ে এসেছে। কথা দিয়েছে, যাই হয়ে যাক সে ঐ কিশোরী মেয়েটার হয়েই থাকবে। তানজিমা বিছানায় বসে আছেন। নীলাংশ আচানক অবিশ্বাস্য কাজ করলো। তীব্র অসহায়ত্ব নিয়ে বিছানার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে মায়ের পা চেপে ধরলো। তানজিমা আর রুশানী দুজনেই হতবাক হয়ে গেলো। নীলাংশ মাথা নত করে বলল-
‘মম, তুমি আমাকে ছোট বেলা থেকে যা বলেছো আমি তাই করেছি। আমার স্বপ্ন কখনোই বিজনেস ছিলো না। আমি তো আমার ক্যামেরায় প্রকৃতিকে তুলে আনতে চেয়েছিলাম। বন, পাহাড়ের ঘ্রাণে সিক্ত হওয়ার স্বপ্ন বুনেছিলাম। কিন্তু যেদিন তুমি আমার ক্যামেরা তালাবদ্ধ করলে সেদিন স্বপ্নকেও তালাবদ্ধ করেছিলাম। তোমার কথা মতোই বিজনেস স্টাডিজ নিয়ে পড়লাম। তোমার ইচ্ছে ছিলো আমি পারিবারিক বিজনেসকে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাবো। তুমি যা চেয়েছো আমি তাই তাই করেছি। কিন্তু মম, পায়রা আমার এমন এক স্বপ্ন যা ছাড়া আমার চোখে ঘুম ধরা দেয়না। যার কন্ঠ না শুনলো আমার কলিজা চৌচির হয়ে যায়।
মম, আমি ছোটবেলা থেকে এই ভেবেই বড় হয়েছি যে, আমার জীবনের খাতায় ইচ্ছে, প্রেম, ভালোবাসা সব কিছুই পেন্সিলের খোঁচায় আঁকা। কিন্তু, আমি অজান্তেই পায়রার নামটা কলমের গাঢ় কালিতে লিখে ফেলেছি। নামটা কোনো ভাবেই মোছা সম্ভব নয়। আমি মুছতে চাইওনা। আমি তো ওকে আমার যৌবন থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত সকল পাতায় ওর নাম লেখাতে চাই। পায়রা এখন শুধু আমার প্রেম বা ভালোবাসাই নয়। পায়রা আমার সুন্দর একটা স্বপ্ন, অভ্যাস। যাকে ছাড়া আমি হয়তো মরে যাবো না। কিন্তু ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে যাবো, আত্মার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবো।
তোমার সমস্যা তো এটাই মম, পায়রা গ্রামের মেয়ে, মুখ এসিডে দগ্ধ, আনস্মার্ট, গড়গড় করে ইংরেজি বলতে জানেনা, ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়ে চলাচল করতে পারেনা।
কিন্তু মম, তোমার এই স্মার্ট, স্টাইলিশ, হাই স্ট্যান্ডার্ড বিলং করা ছেলেটার ওই মেয়েটাকে ছাড়া একদমই চলবে না। তোমার ছেলের প্রতিটি ভোর ওই মেয়েটাকে ছাড়া একদমই চলে না। তোমার ছেলের মুখে হাসির কারণটাও ঐ মেয়েটাই। যেদিন মেয়েটা আমার জীবন থেকে দূরে সরবে। সেদিন তোমার ছেলে বেঁচে থাকবে ঠিকই। কিন্তু ভালোভাবে বাঁচবে না। ‘
তানজিমা নির্বাক হয়ে গেলেন। এতগুলো বছর ছেলেকে নিজহাতে মানুষ করার পর এই প্রথম বার এত আকুলতা নিয়ে কিছু চাইতে দেখলেন। নীলাংশের কথাগুলো তানজিমার মন নরম করার পরিবর্তে শক্ত করে ফেললো। নিজের সন্তানের অসহায়ত্ব, আবেগ, অনুভূতি গুলো চোখে তো পড়লোই না বরং মনে হলো, ছেলের এই অধপতনের কারণটা পায়রা নামের বিষাক্ত সাপ। যার বিষ নীলাংশের শিরায় শিরায় বিরাজমান। এই বিষ নামানোর জন্য শক্ত রূপ ধারণ করলেন। নীলাংশের হাতজোড়া পা থেকে নামিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন –
‘তোমাকে আমার কসম। তোমার কাছে দু’টো অপশন আছে। রুশাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হও আর মাকে বেছে নাও। আর যদি ঐ গাইয়া মেয়েটাকে নিয়েই থাকতে চাও তাহলে, তোমার মা বেঁচে আছে এটা ভুলে যাও। ‘
‘মম! ‘
শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে নোনাঅশ্রু গাল বেয়ে ঝরলো। দুই হাতে চোখ মুছে নিলো। পুরুষদের
কাঁদতে নেই তো! নীলাংশ নিঃশব্দে উঠে গেলো।
নিজের গর্ভধারিণী মা-ই যখন তাঁকে বুঝলো না,
সে কাকে নিজের মনের কথা বলবে! যেতে যেতে
শুধু বলল-
‘আমি কালকের সকাল পর্যন্ত সময় চাই। ‘
তানজিমা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন। নীলাংশ আর কিছুর অপেক্ষা না করে চলে গেলো। ঘরের দরজা বন্ধ করে খোলা জানালার পাশে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। ডানহাতে মোবাইল স্ক্রিনে পায়রার একটা ছবি ভাসছে। বারান্দায় বসে হাস্যজ্জ্বল মুখে টবে পানি দিচ্ছে পায়রা । নীলাংশ হুট করেই সেদিন ছবিটা তুলেছিলো। কে জানতো! এতো সুন্দর ছবিটা এই দুঃখের সময়ের সঙ্গী হবে। নিদারুণ নিষ্ঠুর যন্ত্রণায় দুই ফোটা জল গড়ালো স্ক্রিনে। বুড়ো আঙুল দিয়ে জায়গাটা মুছে অধর ছুঁইয়ে দিলো। কিছুই জানা নেই তাঁর। কী রেখে কী করবে, চরম সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। এমনই সময় দরজায় কড়াঘাতে চমকালো। এই সময় বাড়িতে শুধু চারজন উপস্থিত। তানজিমা,রুশানী, নীলাংশ ও একজন সার্ভেন্ট। তানজিমা এসময় আসবেনা তা জানে নীলাংশ। তাহলে কে?
দরজা খুলে দিতেই চোখে পড়লো রুশানীর ফোলা ফোলা মুখ। মেয়েটা যে একটু আগেও কেঁদেছে তা বুঝতে বাকি রইলো না। এতদিন বোন মানলেও, হঠাৎ করে বিয়ের কথা ওঠায় নিজের কাছেই একটা অস্বস্তি হচ্ছে তাঁর। তবুও, রুশানীকে ভেতরে আসতে বললো।
রুশানী এসে সিঙ্গেল সোফায় বসলো। ভাঙা গলায় বলল-
‘নীল দা, আমি কিছু জরুরী কথা বলতে এসেছি। ‘
নীলাংশ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সামনের সোফায় বসলো। মলিন মুখে বলল-
‘বলো, কী বলবে? ‘
‘তুমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। ‘
তড়িৎ গতিতে চমকে উঠলো নীলাংশ। রুশানীর থেকে মোটেও কথাটা আশা করেনি সে। হতভম্বতা নিয়ে বলল-
‘কীহ! ‘
রুশানী ফোলা চোখগুলো অসহায় করে তাকিয়ে বলল-
‘আগে পুরো কথাটা শোনো নীল দা। ‘
‘হ্যা বলো। ‘
‘আমি বলতে চাইছি, বিয়েতে রাজি হও। কারণ রাজি হলেই তো আর বিয়ে হয়ে যাবেনা। তুমি যে মেয়েটাকে ভালোবাসো, কী যেনো নাম! ওহ হ্যা, পায়রা। ফুপুমণি মোটেও মেয়েটাকে পছন্দ করেনা। আমি যতটুকু বুঝতে পারলাম। তোমার কোনো কথাই শুনবে না সে।
এই মুহূর্তে বাঁচার একটাই উপায়, তোমার সম্মতি। ‘
নীলাংশ অবাক হয়ে বলল-
‘বিয়ের সময় কী করবো? তখন তো বিয়ে করা ছাড়া কোনো উপায়ই থাকবেনা। তাছাড়া আমি নাহয় ছেলে, কিন্তু তুমি মেয়ে। তোমার সম্মানেরও তো একটা ব্যাপার আছে। ‘
রুশানী মলিন হাসি দিয়ে বলল-
‘তুমি ভুলে যাচ্ছো নীল দা, ফুপিমণি তোমাকে কসম দিলেও আমাকে দেয়নি। তাছাড়া আমি একজনকে ভালোবাসি। কয়েক দিন বাদেই বাবাকে ওর কথা জানাতাম। কিন্তু তাঁর আগেই..’
চোখের সদ্য নোনাপানিটুকু মুছে নিলো রুশানী। জীবনের মোড় উল্টে গেছে পুরোপুরি। কত স্বপ্ন ছিলো, ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের বাবার সামনে দাঁড় করাবে। বাবা মোটেও ক্রিটিকাল মাইন্ডের নয়। অন্য বাবাদের তুলনায় যথেষ্ট ফ্রি। নীলাংশ চিন্তিত মুখে বলল-
‘বুঝলাম, তোমার প্ল্যান কী বলো?’
রুশানী ঠান্ডা গলায় বলল-
‘ খুব সহজ। তুমি কাল ফুপিমণিকে বলবে, বিয়েতে রাজি তুমি। আমরা বাংলাদেশে যাওয়ার পর, তুমি সবাইকে এটাই বোঝাবে। কেউ যাতে সন্দেহ না করে। বিশেষ করে ফুপিমণি। পায়রার থেকে যতসম্ভব দূরত্ব রেখে চলবে। মাত্র কয়টা দিনের ব্যাপার। বিয়ের দিন, ঠিক কিছুক্ষণ আগে আমি সাহিরের সঙ্গে পালিয়ে যাবো। তোমার উপর চাপ থাকলেও আমার উপর নেই। এতো এতো মেহমান, আত্মীয় স্বজনের মাঝে
মান সম্মান বাঁচানোর জন্য তোমার মা উদ্বীগ্ন হয়ে উঠবে। ঠিক সেই সময়, তুমি পায়রাকে বিয়ে করার কথা বলবে। যেহেতু, তোমার মায়ের ঠিক করা সিদ্ধান্ত একবার ভুল প্রমাণ হবে, তাই তিনি লজ্জায় দ্বিতীয় বার তোমাকে বাঁধা দিতে পারবেনা। আমি সাহিরকে বিয়ে করে চলে যাবো। আর ওদিকে পায়রাকে না মানার কোনো কারণই থাকবেনা। ‘
চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো নীলাংশের। মুখে স্বস্তির হাসি ফুটলো। এক নিমিষেই মনের উপর আরোপ করা পাথর নেমে গেলো। আবেগে আপ্লূত হয়ে নীলাংশ বলল-
‘রুশা, তোমাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেবো বুঝতে পারছি না। ‘
‘ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই নীল দা। তোমাকে বড় ভাই মানি আমি। বড় কোনো ভাই বোন নেই আমার। বাংলাদেশে থাকতেও অনেক বিষয়ে সাহায্য করেছো আমাকে। তাছাড়া, আমিও সাহিরকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা চিন্তাও করতে পারিনা। ‘
রুশানী আরও কিছু কথা বলে চলে গেলো। নীলাংশের মুখে হাসির আভা। ইশ! আর কয়টা দিন বাদেই পিচ্চি মেয়েটা তাঁর বউ হবে। ঘোমটা মাথায় টুকটুক করে ঘুরবে। তাঁর একান্ত ব্যাক্তি হয়ে উঠবে। পিচ্চি থেকে হয়ে উঠবে পিচ্চিবউ। বিয়ের কথাটা শুনে নিশ্চয়ই সারপ্রাইজ হয়ে যাবে। সাইডে রাখা মোবাইলটা তুলে পায়রার ছবির দিকে তাকিয়ে ভীষণ প্রেম নিয়ে বলল-
‘আমার সুখ পায়রা নামক ডানাবিহীন পাখিটাতেই সীমাবদ্ধ। আকাশের নীলাংশে তাঁর পায়রার বিচরণ বাধ্যতামূলক। ‘
চলবে-
(খুব বেশি পর্ব বাকি নেই। দ্রুতই শেষ হবে। আগামী পর্ব গুলো বড় বড় করে শেষ করবো। নতুন গল্পের কাজ করছি। আর কয়েকটা দিন, তারপরই নীলাংশ, পায়রা, আভাস সহ বাকি সবাই বিদায় নিবে। তাই, যা বলতে চান মন্তব্যে বলবেন। পরবর্তীতে কোনো আফসোস যেনো না হয়। কোনো ইচ্ছে হলে সেটাও জানাবেন। আমি কোনো পাঠকের মনকেই অতৃপ্ত রাখতে চাইনা। হ্যাপি রিডিং।)