স্বপ্নচূড়ার আহবান ‘ পর্ব-৭০

0
2964

“স্বপ্নচূড়ার আহ্বান”
পর্ব-৭০
(শেষ) ১ম অংশ।

মোটা ডায়েরিটার প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই পিলে চমকে উঠলো পায়রার। মাথা ঘুরে গেলো। রক্ত ছলকে দ্বিগুণ বেগে ছুটে চললো। পায়রা ডায়েরির ভেতরের থেকে ছবিটা হাতে নিলো। সেখানে শাড়ি পরিহিতা এক শ্যাম রঙা দুই বেঁণীর কিশোরী পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে আছে।
খিলখিল করা হাসিতে হেলে পড়ছে। তার পাশেই একটা পাঁচ বছরের ফর্সা মতোন মেয়ে পেয়ারা কামড়ে খাচ্ছে। ছবিটা খুব দক্ষতার সঙ্গে ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে। গাছের আড়াল থেকে সোনালী সূর্য লাল বর্ণ ধারণ করছে। ছবিটা যেনো কথা বলছে। পায়রার ছবিটাতে থাকা দু’জনকে চিনতে একবিন্দুও সমস্যা হয়নি। পায়রা চোখ বুঁজে বলতে পারবে, এটা তাকে মাতৃস্নেহে বড় করে তোলা তাঁরা বুবু! আর পাশে ছোট মেয়েটা পায়রা।

পায়রার বুঝতে কষ্ট হয়না, ছবিটায় দুইজন মানুষ থাকলেও মুখ্য উদ্দেশ্য শ্যাম রাঙা কিশোরী । অর্থাৎ তাঁরা বুবু। পায়রার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, কী করে আভাস বোসের ডায়েরিতে তাঁরা বুবুর ছবি! আর আভাস স্যার শুরুতেই কেনো এখানে রেখেছে! হন্তদন্ত দৃষ্টিতে পরের পাতা উল্টায় সে। প্রথমের অনেক গুলো পৃষ্ঠাতে নানাবিধ বিষয়ে লেখা আছে। যেমন,মা বাবা, বন্ধু, স্কুল। কিন্তু একটা পৃষ্ঠায় পায়রা এসে থমকে গেলো।

ডায়েরির পাতা ~

০৪ তারিখ,
এই গ্রামের সঙ্গে সঙ্গে, মানুষ গুলোও ভীষণ সুন্দর। কী অপূর্ব দৃশ্যপট! ভাগ্যিস! বাবা জোড় করে ঘুরতে পাঠালো!

০৫ তারিখ,
কে তুমি মনোহরণী? তোমার কিশোরী চোখের মায়ায় জড়িয়ে গেছি আমি। সন্ধ্যার গাঢ় নীল আকাশে যেমন ধীরে ধীরে তাঁরার আবির্ভাব ঘটে, ঠিক তেমন করেই তোমার খিলখিল হাসি আমার হৃদয়ের মাঝে নিজের অস্তিত্ব ছিটাচ্ছে। তোমার ছবিটা প্রিন্ট করে আমার মানিব্যাগের মাঝে রেখে দিয়েছি। বিশ্বাস করো! এমন মনোরম দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি। আমি কলকাতা দেখেছি, কানাডা দেখেছি, আমেরিকা দেখেছি কিন্তু তার মাঝে ছোট্ট একটা গ্রামের এলোমেলো শাড়িতে কিশোরীর খিলখিল হাসির দৃশ্য আমার চোখে সেরা!
তোমার অজান্তে যে আমি মোট দুইশত ছবি তুলেছি, এতে কী তুমি রাগ করবে?

১০ তারিখ,
ব্যাপারটা একটু আধটু নয়, বেশিই অদ্ভুত। আমার দেয়া নামের সঙ্গে তোমার কত মিল! তাঁরা! তুমি জানো, আমি তোমার একটা নাম রেখেছি?যে নামটা শুধু আমার দেয়া। তুমি আমার ব্যাক্তিগত মানুষ।

আমার হৃদয়ের চোক্ষু তুমি। আমার চোখের তাঁরা। তুমি আমার তাঁরাক্ষী!

৩০ তারিখ,
খুব খারাপ লাগছে তাঁরাক্ষী,তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। এই গ্রামের সঙ্গে আমার এতোটা সখ্যতা গড়ে উঠবে, আমি ভাবতেই পারিনি। এই গ্রামটা আমাকে তুমি পুরো ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছো! কিন্তু হায়! আমি তো গ্রামের অলিগলির চেয়ে তোমাকে বেশি মুখস্থ করেছি। তোমার হাসতে হাসতে পেট চেপে ধরা,শ্যাম বর্ণের মুখে হুট করেই লজ্জায় মিইয়ে যাওয়া। সবচেয়ে বেশি কীসে মুগ্ধ হয়েছি জানো? মা না হয়েও মা হওয়া। তোমার ছোট্ট বোনটা, কী যেনো নাম! ওহ হ্যা, পায়রা। খুব চঞ্চল। তোমার ঠিক বিপরীত। তোমার সঙ্গে মিলও আছে চেহারায়। তুমি যখন কথায় কথায় বলো,’পারু আমি ছোট বোন না, আমার আত্মা!’ তখন তোমার চোখে মুখে যে মাতৃত্বের ছাপ স্পষ্ট হয়, কী যে সুন্দর দেখায়! কে বলে তুমি কালো! তুমি আমার শ্যামাঙ্গী।

আমার পড়াশোনাটা শেষ হলেই আমি তোমাকে বিয়ে করে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো। ছোট বুকপকেট থেকে আমার বিশাল শামিয়ানার রাণী করে রাখবো। কখনো হারিয়ে যেতে দেবো না।

তোমার ভালোবাসার প্রয়োজন নেই। আমার একার জমানো ভালোবাসাই দুজনের জন্য যথেষ্ট। ‘

দুই বছর পর ~

১২ তারিখ,
‘সত্যিই তুমি কী আমার হবে না, তাঁরাক্ষী! আমি যে তোমায় ঘিরে নতুন স্বপ্ন বুনলাম! আমার স্বপ্ন গুলো বুঝি এতোই ঠুনকো? একটা দিনও এমন যায়নি,আমি তোমাকে মনে করিনি। সবসময় তোমাকেই ভেবেছি।
আমি কীভাবে বিশ্বাস করি! তুমি আমাকে না, অন্য কাউকে ভালোবাসো! ছেলেটা কী তোমাকে আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে তাঁরাক্ষী! সে কী আমার চেয়েও বেশি মুগ্ধ হয় তোমার দিকে তাকিয়ে!

কত কত দেয়াল আছে আমাদের মাঝে! ধর্ম, জাত- পাত, টাকা পয়সা, আর সবশেষে মনের। সব কিছু পেরিয়ে গেলেও তোমার মনটা কী করে আমি পাবো!

তবুও ভালো থেকো তাঁরাক্ষী! অন্য কারো সঙ্গে ঘর বাঁধলেও সুখে থেকো! আমি তোমার স্মৃতি আঁকড়ে বেশ আছি। ‘

পায়রার মস্তিষ্ক দপদপ করছে। এতসব লুকিয়ে ছিলো অতীতে! কাঁপা হাতে আরও কিছু পৃষ্ঠা উল্টায় সে। আরও এমন লেখা আছে। সব জায়গায় শুধু তাঁরাক্ষী, তাঁরাক্ষী! অসংখ্য পৃষ্ঠার পর একটা পৃষ্ঠায় এসে থেমে যায়।

‘এতটা যন্ত্রণা না দিলেও পারতে বিধাতা। ভালোবাসাকে ভালো রাখতেই তো আমার এতো ত্যাগ! তারপরও কেনো এমন হলো! কাকনকে গ্রামে খোঁজ নিতে পাঠিয়েছিলাম, আমার তাঁরাক্ষী আর নেই। কীসের এতো কষ্ট ছিলো তোমার তাঁরাক্ষী! আত্মহত্যা করার কারণ আমি জানিনা। তবে, তুমি যে নিজের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা মানুষকে মেরে ফেললে!
তুমি ভালো আছো জেনে আমি নাহয় কোনোরকম বেঁচে ছিলাম। এবার কী করে বাঁচব বলতো! ‘

পৃষ্ঠায় অশ্রু শুকিয়ে যাওয়ার ছাপ। হয়তোবা এক প্রেমিকের অপূর্ণ প্রেম বুকে জমানোর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ!

‘জানো তাঁরাক্ষী, তোমাকে আজ নতুন রূপে একবার দেখলাম। তুমি ঠিকই বলেছিলে মেয়েটা তোমার আত্মা। স্কুলে চেঁচামেচির আওয়াজে গিয়েই হাড় হিম শীতল হয়ে গেছিলো আজ। ছোট মেয়েটার মুখের কী করুণ দশা! চোখে দারুণ তেজ। তুমি তো নরম তুলোর মতো ছিলে। অথচ তোমার বোনটা ধানি লঙ্কা। তোমাকে বাঁচাতে পারিনি তাঁরাক্ষী। কিন্তু তোমার বোনটার যেকোনো বিপদে আমি পাশে থাকবো। তোমার আত্মাটাকে ভালো রাখবো। তুমি কী এতে খুশি হবে? ‘

‘পায়রা মেয়েটা ভুল বুঝেছে আমাকে আজ। জয়ী আমার স্কুল ফ্রেন্ড। মেয়েটার কাণ্ডজ্ঞান এতো কম!
আমি বুঝতে পারতাম আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করতো। এতদিন ওয়েস্টার্ন কালচারে থেকে উশৃংখল হয়ে গেছে। এসেই বাঘিনীর মতো ঝাপিয়ে পড়লো।
করেছে তো করেছে, আবার স্কুলের মতো একটা জায়গায়। কে জানে! পায়রা আমাকে কি-না কী ভাবছে! ‘

‘ক্ষমা করে দিও পায়রা, আমি কিছুটা নিজের স্বার্থের জন্যই বাবা আর ঠাকুমার কাছে মিথ্যা বললাম। কী করতাম বলো! তারা দুজন যখন তোমাকে আমার স্ত্রী বললো,আমার মাথায় একটা ব্যাপার আসলো। গত তিন চারটে বছর ধরে বিয়ের জন্য খুব চাপ দিচ্ছিলো।
ঠাকুমাকে তো কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না। তাদের কী করে বলি,আমি কখনো বিয়ে করবো না। আমার তাঁরাক্ষীকে ভালোবেসেই এই জীবন পাড় সেই ফেলবো। হঠাৎই মনে হলো, যদি কোনো রকম তোমাকে নিজের স্ত্রী বলে দেই৷ তাহলে আর এ ঝামেলা পোহাতে হবে না। আর তুমিও নিরাপদ থাকবে আমার বাড়িতে। তা-ই করলাম৷ সুইজারল্যান্ড যাওয়ার পর, আমি জানতাম তুমি প্রখর আত্মসম্মান নিয়ে কিছুতেই আমার টাকায় কিছু নিবে না। কারণ ওখানে গিয়ে তো আর কোন বাধ্যবাঁধকতা নেই। কিন্তু আমি যে আমার তাঁরাক্ষীকে কথা দিয়েছি,তোমাকে ভালো রাখবো, তোমার দায়িত্ব নেবো। ওখানে তুমি একা মেয়ে মানুষ কোথায় থাকবে, কী করবে!

দুনিয়াটা আমরা যতটা সহজ ভাবি, তার চেয়েও বেশি কঠিন। স্বার্থ ছাড়া কেউ দুই টাকা খাওয়াবে না।

পায়রা, তুমি সবসময় জানতে চাইতে না? কেনো আমি তোমার জন্য এতোকিছু করছি! তবে শোনো, আমার তাঁরাক্ষীকে মানে তোমার বড় বোনকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। সেই ভালোবাসার পরিমাপ হয়না। আমি জানি না কতটা ভালোবাসলে সে আমার হতো! হায় সে আমার হয়নি। কিন্তু তার স্নেহের অংশ টুকুকে ভালো রাখতে পারলে শান্তি পাবো আমি। সেই শান্তি টুকুর আশায় আমি এসব করেছি। মেয়েলি মন তোমার, কখনো হয়ত মনে হতেই পারে, আমি তোমাকে পছন্দ করি কিনা! কিন্তু তোমার তাঁরা বুবুর পর এই মনটায় কেউ পদ্ম ফোটাতে পারেনি। আমি তোমার চেহারার দিকে মাঝে মাঝে নিগুঢ় চাহনিতে তাকিয়ে থাকতাম, কারণটা হচ্ছে তোমার তাঁরা বুবুও এমনই চেহারার ছিলো। শুধু তুমি ফর্সা আর সে শ্যাম বর্ণের। ‘

সর্বশেষ পাতা-

গহীন বনে, তোমার মাঝে,
হাতরে বেরাই সুখ।
হারিয়ে গেলেও, যতন করে
রাখি তোমার মুখ।

নিশাপুরে কুহুক ডাকে,
ছলকে ওঠে বুক,
তোমার মাঝে বসত করে,
আমার প্রতিরূপ!

-(শেষ পর্বের ১ম অংশ)

দ্বিতীয় অংশ ইনশাআল্লাহ কালকে পেয়ে যাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here