#স্বর্ণাভ সুখানুভূতি। (পর্ব-১৪)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে তাকাতেই যারপরনাই অবাক হলো মুশরাফা। জাওয়াদ চেয়ারে দাঁড়িয়ে একটা ফটোফ্রেম খোলার চেষ্টা করছে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল মুশরাফা। অস্ফুটস্বরে বলল,
‘ আপনি কি সত্যি ছবি গুলো সরাবেন?’
সে কথা জাওয়াদের কানে যেতেই রুক্ষ চোখে তাকাল ওর পানে। বিরক্তিভরা গম্ভীরমুখে বলল,
‘ তুমি মেয়েটা একটু বেশি কথা বলো। এখানে আসতে বলছি না? আসো, ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছো কেন?’
মুশরাফা ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করল। চেয়ারের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই জাওয়াদ পাখির ক্যাপচার করা একটা ফটোফ্রেম খুলে মুশরাফার হাতে ধরিয়ে দিল। গমগমে গলায় বলল,
‘ কোন কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো এখানে।’
মুশরাফা বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছল যেন। বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল জাওয়াদের পানে। জাওয়াদের ঘুম জড়ানো ফোলা মুখে বিরক্তির আভা। সেই বিরক্তির মাঝে ও দু’চোখের গভীর মনোযোগ দেয়ালের দিকে। বেশ মনোযোগ দিয়ে এক এক করে ছবি নামাতে লাগল। মুশরাফার চোয়ালে বিস্ময়ের সাথে যোগ দিয়েছে খুশি, আনন্দ। উৎফুল্ল হয়ে উঠছে মুখখানা। লোকটা তার কথা ভাবতে শুরু করেছে!
জাওয়াদ চার পাঁচটা ফ্রেম নামিয়ে মুশরাফার হাতের উপর রাখল। বেশ ভারি ফ্রেমগুলো। হাত ব্যাথা করছে। আরেকটা রাখার আগে জাওয়াদ বলল,
‘আমার খুব পছন্দের ফ্রেম এগুলো। খুব সাবধানে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে আসো। একটু আঁচ যেন না লাগে। ‘
মুশরাফা মনে মনে মুখ ভেংচাল, বউয়ের চিন্তা নাই আছে, শুধু ফ্রেমের চিন্তা।
খুব সচেতনভাবে ফ্রেম রাখল টেবিলে। তারপর ফিরে এলো। একে একে সব জীব জন্তুর ছবি সরাল জাওয়াদ। চেয়ার থেকে নেমে এলো ও। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘আপনার ছবি…?
জাওয়াদ কিছুটা বিরক্তির সাথে জিজ্ঞেস করল,
‘আমি থাকলেও সমস্যা?’
মুশরাফা আলতো স্বরে জবাব দিল, ‘ আপনি নয়, আপনার ছবি থাকলে সমস্যা।’
‘ আমি আর আমার ছবি কি আলাদা? তুমি মেয়েটা সুবিধার না। আমার রুম থেকে আমাকেই বিদায় করার পায়তারা করছো।’ দাঁত কিড়মিড় করে বলল জাওয়াদ।
মুশরাফা হেসে ফেলল। ও সাধারণত মুচকি হাসে। দাঁত দেখা যায় না। আজ দাঁত দৃশ্যমান হলো, কিন্তু শব্দ হলো না। ভারি সুন্দর দেখাল ওর হাসিটা। হেসেই বলল,
‘ জলজ্যান্ত আপনিটা থাকতে আপনার ছবি কী কাজ? আপনার ছবি বিদায় হোক। আপনি থাকুন আমার পাশে, অজীবন। তারপর আল্লাহ চাইলে আমরা একসাথে জান্নাতে যাব।’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল এক পলক। তারপর বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে আবার চেয়ারে উঠল। রাগ নিয়ে দ্রুত বাকি ছবি গুলো সরাল। নিজেই রাখল সেন্টার টেবিলে।
দেয়ালে আর কোন জীব জন্তুর ছবি নেই। পুরো রুমে চোখ বুলাতেই আনন্দে মনটা নেচে উঠল মুশরাফার। ইবাদতের সুন্দর একটা পরিবেশ পেয়েছে অবশেষে! দ্বীনের কাজে কারো থেকে পাওয়া একটু সাহায্য ও ওর কাছে আকাশসম। এটা সবচেয়ে বেশি আনন্দের। চোখে মুখে খুশির আভা ছড়িয়ে জাওয়াদের সামনে এসে দাঁড়াল। আকস্মিক জাওয়াদকে জড়িয়ে ধরল। উৎফুল্লতার সাথে বলল,
‘আল্লাহ, এর বিনিময়ে আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিক।’
জাওয়াদ ওকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে গম্ভীরমুখে বলল,
‘ এগুলো কোন ধরণের আচরণ!’
মুশরাফা ওকে ছেড়ে দিল। তার গালদুটো লজ্জায় লাল। দৃষ্টি অন্যদিকে। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। মুশরাফা লজ্জা কাটিয়ে বলল,
‘ইসলাম স্বামীকে ভালোবাসতে বলেছে। আমি আপনাকে ভালোবাসার চেষ্টা করছি। এগুলো হালাল আচরণ। ‘
এরপর কী বলা যায়? জাওয়াদ উত্তর খুঁজল, পেল না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘সরো, আমি ঘুমাব।’
‘ নামাজের জন্য অযু করে নামাজ না পড়ে ঘুমাবেন! নামাজটা পড়ে ঘুমান? জাস্ট পাঁচ মিনিটের ব্যাপার। প্লিজ!’ অনুরোধ ঝরে গেল মুশরাফার স্বর থেকে।
জাওয়াদ বিরক্তভরা স্বরে বলল,
‘আমি মন থেকে নামাজ না পড়লে, নামাজ হবে না। জোর করিয়ে ক’দিন পড়াবে তুমি?’
মুশরাফা ধীর স্বরে উত্তর দিল,
‘একদিন, দু’দিন তিনদিন আপনি আমার সাথে পড়ুন অনিচ্ছা সত্ত্বেও। পড়তে পড়তে একদিন দেখবেন নামাজের প্রতি আপনার একটা টান কাজ করছে, নামাজ পড়ার মজাটা ধরে ফেলেছেন। সেদিন থেকে আপনি নিজ থেকেই মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বেন। শুধুমাত্র সেই দিনের জন্য আমি আপনাকে জোর করছি। আমার বিশ্বাস, দিনটা খুব তাড়াতাড়ি আসবে। আসুন এখন নামাজে দাঁড়ান। ‘
জাওয়াদ শুনল না সে কথা। পাশ কাটিয়ে যেতে নিল। মুশরাফা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জাওয়াদের হাত ধরে শান্ত স্বরে বলল,
‘আপনি কিন্তু আপনার ওয়াদা খেলাপ করছেন!’
জাওয়াদ খাটে বসে তীক্ষ্ম গলায় বলল,
‘কী ওয়াদা খেলাপ করেছি আমি?’
মুশরাফা সামনে এসে দাঁড়াল। আলতো স্বরে মনে করিয়ে দিল,
‘কাল সকালে আপনি আমাকে বিয়ের উপহার হিসেবে ওয়াদা দিয়েছিলেন, যে আপনি আমাদের দুজনের বর্তমান ভবিষ্যতে কোন প্রকার ক্ষতি করবেন না। ‘
জাওয়াদের মনে পড়ল কথাগুলো। সে ভ্রু কুঁচকাল, ‘নামাজ না পড়ার সাথে ওয়াদার কী সম্পর্ক?
মুশরাফা যেন এরি অপেক্ষায় ছিল। কাল বিলম্ব না করে তড়িৎ উত্তর দিল,
‘ বে-নামাজি জান্নাতে যাবে না। এক ওয়াক্ত নামাজ ইচ্ছেকৃতভাবে ছেড়ে দিলে জাহান্নামের আগুনে জ্বলতে হবে। আপনি ইচ্ছেকৃতভাবে নামাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। এর শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুর পর আল্লাহ আপনাকে জাহান্নামের আগুনে জ্বালাবেন, জান্নাত থেকে দূরে রাখবেন। আপনি নামাজ ছেড়ে দেয়ার মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যতের ক্ষতি করছেন। যা আপনার ওয়াদার খেলাপ। ‘
জাওয়াদ হতভম্ব হয়ে বসে রইল। মাথা ঘুরছে ওর। মেয়েটা কীভাবে আটকে দিল ওকে! এই মেয়ে তো ধুরন্ধর! আল্লাহ জানে, এই ওয়াদার মধ্যে কী কী বেধেছে। ভয় হলো জাওয়াদের। রেগে তাকাল মুশরাফার পানে। মুশরাফা ধীর স্বরে বলল,
‘ ওয়াদা খেলাপ করা মুনাফিকের আলামত। আমি এখন আর আপনাকে নামাজের জন্য জোর করব না। আপনার যদি স্ব-ইচ্ছায় মুনাফিকের তালিকায় নিজের নাম লিখাতে চান, তবে নামাজ না পড়ে ঘুমান।’
মুশরাফা ঠোঁট চেপে হেসে বারান্দার দিকে এগুলো। জায়নামাজ নিয়ে এসে নামাজে দাঁড়াল। একটাবার জাওয়াদের দিকে তাকাল না, নামাজের জন্য বলল ও না।
জাওয়াদ তখন ভাবনায় ডুবন্ত। ওর মনে হচ্ছে, মুশরাফা ওকে জালে আটকে ফেলেছে। কঠিন জালে আটকেছে। একেতো ওয়াদা ভঙ, তার উপর মুনাফিকের ট্যাগ লাগাচ্ছে। বলে কি না, মুনাফিকের তালিকায় নাম লেখাতে চাইলে, নামাজ না পড়ে ঘুমান। কী কঠিন কথা! কোন মানুষ জেচে নিজেকে মুনাফিক প্রমাণ করতে পারে! পারে না।
মেয়েটা না রেগে কথা বলছে, না কেঁদেছে। যে কথায় আটকিয়েছে সেই কথায় অনুরোধ ও ছিল না। ঠান্ডা মাথায় সাপের মতো পেচিয়ে ধরেছে। জাওয়াদ কটমট করে তাকাল স্ত্রীর পানে। মুশরাফা তখন নামাজে মগ্ন। একধ্যানে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। মুশরাফা দু’রাকাত সুন্নত শেষ করল। সালাম ফিরিয়ে ফরজের জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। আকস্মিক জাওয়াদ উঠে দাঁড়াল। হনহন করে কেবিনেট থেকে জায়নামাজ বের করে আনল। মুশরাফা জায়নামজে দাঁড়িয়ে হাসছে ঠোঁটচেপে। জাওয়াদ জায়নামাজ বিছানোর ফাঁকে ওর হাসি দেখল। রাগে চোখ লাল হলো ওর। চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘আল্লাহ, তোমার বিচার করুক।’
মুশরাফার হাসির গতি কমল না, বরং বাড়ল। সে হাসতে হাসতে বলল,
‘আল্লাহ, আপনার বিচার না করুক। আপনাকে বিনা হিসেবে জান্নাত দিক। ‘
বদদোয়ার পরিবর্তে কেউ দোয়া দেয়? তাও এত সুন্দর? জাওয়াদ আর কিছু বলতে গিয়ে বলতে পারল না। চুপচাপ নামাজে দাঁড়াল। নামাজ শেষ করে সবে সালাম ফিরিয়েছে। আকস্মিক মুশরাফা এসে বসল তার জায়নামাজে, তার পাশে। একবারে গা ঘেঁষে।
জাওয়াদ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল। মুশরাফা স্বামীকে পরখ করল অন্তর্ভেদী চোখে। তারপর চঞ্চল গলায় বলল,
‘নামাজ পড়লে আপনাকে ভীষণ সুন্দর দেখায়। মাশা আল্লাহ! টুপ করে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করছে আপনার গালে। খেয়ে ফেলি?’
জাওয়াদ ধাক্কা খেল। কী আবেদন মেয়েটার! চোখে চোখ পড়তেই চোখ সরাল মুশরাফা। কেমন যেন লজ্জা পেল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘এই মেয়ে, তুমি সারাদিন আমার সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করো কেন?’
‘আপনি আমার জন্য হালাল তাই ফ্লার্ট করছি, ভালোবাসার চেষ্টা করছি। বিশ্বাস করুন, হারাম হলে আমি আপনার দিকে তাকাতাম ও না। যাক গে, অনুমতি দিবেন? নইলে কিন্তু আমি অনুমতি ছাড়াই খেয়ে নিব। আমার ইসলাম আমাকে অনুমতি দিয়েছে। ‘
শান্ত স্বরে মিটিমিটি হেসে বলল মুশরাফা।
জাওয়াদ ধমকে বলল,
‘তুমি মেয়েটা ভারি অসভ্য।’
মুশরাফা হাসি থামাল। টুপ করে অধরে অধরে ছুঁয়ে দিল। হেসে সরে গেল। জাওয়াদের কানে কানে ফিসফিস করে বলল,
‘ইসলামে স্বামী স্ত্রীর জন্য সবধরনের ভালোবাসা জায়েজ। এভাবে চুমু খাওয়াও।’
মুশরাফা জাওয়াদে কাধে মাথা রাখল। জাওয়াদ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। তৎক্ষনাৎ মনে পড়ল সাদাফের কথা, এরা রোমান্টিক হয় না।
এটা রোমান্টিকতা নয়! তবে কি সাদাফের ভাবনা ভুল!
কত মেয়ের সাথে রিলেশনে গিয়েছে, রোমান্টিকতার দিক দিয়ে সেই এগিয়ে ছিল। মেয়ে গুলো লজ্জায় আগাতেই পারতো না। বিয়ের পরদিন মুশরাফার পোশাক আশাক দেখে, সাদাফের মতো জাওয়াদের ও মনে হয়েছে, এই মেয়ে একবারেই রোমান্টিক হবে না। সে না আগালে আগাবেই না। কিন্তু এই মুহুর্তে এসে ভুল প্রমাণ হলো তার। এই মেয়ে শুধু রোমান্টিক না, সাংঘাতিক ধারণের রোমান্টিক। এ মেয়েতো সোজা….
হারাম, না বলে বলছে, এসব না কি জায়েজ!
নাহ, সাদাফের ভাবনা ভুল। এরা ও বোধহয় রোমান্টিক হয়।
হলে হোক, এই অসুবিধাজনক মেয়ের কাছে আপাতত থাকা যাবে না।
জাওয়াদ কিছু না বলে উঠে যেতে ধরল। মুশরাফা হেসে বলল,
‘আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন! ‘
জাওয়াদ বিব্রতবোধ করল। উঠে চুপচাপ শুয়ে পড়ল। খানিক বাদেই কানে এলো, সুমিষ্ট স্বর। সুরেলা কন্ঠে কেউ পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করে যাচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই কুরআন হাতে জায়নামাজে বসা মুশরাফাকে চোখে পড়ল ওর। জাওয়াদ ঘাড় ফিরিয়ে চোখ বন্ধ করল। নিস্তব্ধতার মাঝে কুরআনের সুরটা বুকে হিমেল হাওয়ার মতো বিধছে, মন্দ লাগছে না।
•
ফজর নামাজের পর ঘুমায় না মুশরাফা। নামাজ পড়ে কুরআন তেলাওয়াত করে কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে। কুরআন তেলাওয়াত শেষে উঠে দেখল জাওয়াদ ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাতেই হেসে ফেলল মুশরাফা। আজ লোকটা একটু বেশিই জব্দ হয়েছে। কীভাবে তাকিয়েছিল ওর দিকে, পেট পাঁকিয়ে হাসি পাচ্ছিল। কত কষ্টে যে আটকে রেখেছে সেই জানে। জাওয়াদ থেকে চোখ ফিরিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। ফ্লোরে বসে সূর্যোদয় দেখল। বারান্দাটাকে পুরোপুরিভাবে রোদ গ্রাস না করা অবধি বারান্দায় বসে রইল। সোনালি রোদ গিয়ে তীক্ষ্ণ রোদের চটা গায়ে পড়তেই উঠে দাঁড়াল। রুমে গিয়ে ঘড়ি দেখল, ৬টা বেজে ৪০ মিনিট। বড়ো ওড়নায় গা ঢেকে রুম থেকে বের হলো ও। ইতিউতি করে প্রবেশ করল কিচেনে। শ্বশুর শ্বাশুড়ির রুমে লাইট জ্বলছে। তারা নামাজ পড়তে উঠেছেন বোধহয়। বাকি সবাই ঘুমে। মুশরাফার জন্য সুবিধাই হলো। সে সিদ্ধান্ত নিল,সকালের নাস্তা সে বানাবে। নিজের বাসায় রান্না করতো সে। শখের বশেই।
পরিকল্পনা মাফিক আগে পরোটা, দুই পদ ভাজি করল। যখন পরোটা ভাজছিল তখন মায়মুনা এসে হাজির হলেন রান্নাঘরে। শ্বাশুড়িকে দেখেই লম্বা করে সালাম দিল মুশরাফা। মায়মুনা সালামের উত্তর নিলেন কি নিলেন না বুঝা গেল না। তিনি গম্ভীরমুখে বললেন,
‘কী করছো এখানে?’
মুশরাফা ধীর স্বরে বলল, ‘নাস্তা বানাচ্ছি।’
মায়মুনা গমগমে গলায় বললেন,
‘নাস্তায় সবাই কী খায়, না খায় জানো তুমি? আন্দাজে বসে যে এসেছো, কেউ যদি তোমার এসব নাস্তা না খায়! নাস্তা বানানোর আগে আমাকে জিজ্ঞেস করোনি কেন?’
মুশরাফা নম্রতার সাথেই উত্তর দিল,
‘আমি আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। ‘
‘কী বানাচ্ছো এখন?’ প্রসঙ্গ ঘুরালেন মায়মুনা। মুশরাফা বলল,
‘পরোটা আর ভাজি। ‘
‘খাওয়া যাবে?’
কেমন তিরস্কারের চটা মায়মুনার কথায়। মুশরাফা ধরতে পেরেও চুপ রইল। খানিক বাদে বলল,
‘ইন শা আল্লাহ। ‘
মায়মুনা ঢাকনা উলটে দেখলেন কী কী রান্না হলো না। খেয়ে ও দেখলেন একটু। তারপর হন হন করে বেরিয়ে গেলেন রান্নাঘর থেকে। যাবার আগে বলে গেলেন,
‘চা করবে সবার জন্য।’
মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলে কাজে মন দিল। নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে দিল। এক কাপ চা হাতে রুমে এলো। জাওয়াদকে ডেকে তুলল। জাওয়াদ ফ্রেশ হয়ে এলে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘আপনার চা।’
জাওয়াদ ভাবল হয়তো মা বোন কেউ পাঠিয়েছে। চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিল। চায়ের স্বাদে ভিন্নতা ধরতে পারার পরপরই বলল,
‘চা কে বানিয়েছে?’
‘আমি। কেন ভালো হয়নি?’ আগ্রহভরে জানতে চাইল মুশরাফা। জাওয়াদ চায়ের কাপ রেখে মুখ কুঁচকে বলল,
‘ এজন্যই তো চিনি বেশি। আমি চায়ে চিনি কম খাই।’
বলে বেরিয়ে গেল জাওয়াদ। মুশরাফা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দেখল, চিনি ঠিক আছে। লোকটা খুঁত ধরল কেন?
মুশরাফা রুমে বসে রইল। জিশান নাস্তার টেবিলে আছে কি না ভেবে গেলে না। জেরিন এলো ডাকতে।
‘মুশরাফা, নাস্তা করবে না? আসো।’
মুশরাফা ইতস্ততভাবে কিছু বলতে চাইল। জেরিন হেসে বলল,
‘ জিশান দুইদিনের ট্যুরে গেছে। যায়েদ ভাই অফিসে চলে গেছে। আসো। ‘
মুশরাফা হাফ ছাড়ল। যাক, এবার নিশ্চিন্ত থাকা যাবে। সে উঠে দাঁড়াল। জেরিন ওকে টেবিলে নিয়ে গেল। জাওয়াদ খাচ্ছে বসে। মুশরাফাকে জাওয়াদের পাশে বসাল। জাওয়াদের কোন হেলদোল নেই, সে একমনে খাচ্ছে। জেরিন খেতে গিয়ে বলল,
‘মুশরাফা, তোমার রান্নার হাত দেখি ভালোই। ‘
বিপরীতে মুশরাফা হাসল শুধু। এক পলক তাকাল জাওয়াদের পানে। জাওয়াদ খাওয়া থামিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে আছে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলে মুশরাফা ধীর স্বরে, অনেকটা ফিসফিস করে বলল,
‘ আমার রান্না শুনে খুঁত ধরতে যাবেন না, চায়ের মতো। ধরা পড়ে যাবেন। এতক্ষণ বেশ মজা করেই খাচ্ছিলেন, আমি কিন্তু দেখেছি। তাই বলি কী? চুপচাপ খান।’
একটা মেয়ে এত ধুরন্ধর হয় কী করে! কী করে সব টের পেয়ে যায়? জাওয়াদ বিরক্ত হলো, রেগে তাকাল পাশে। বিনিময়ে মুশরাফা হাসল কেবল।
.
জাওয়াদের অফিস ছুটি আরও একদিন বাকি। আজ সারাদিন বাড়িতে সে। সন্ধ্যায় বসার ঘরে গল্পের আসর জমেছে। সেখানে কথা বলছে জেরিন, কাকন, মায়মুনা, জাওয়াদ। মুশরাফা ও আছে সেখানে। কথা বলছে না, চুপচাপ কথা শুনছে সবার। কথার মাঝে জাহিন এসে বায়না ধরল, আইসক্রিম খেতে যাবে। জাওয়াদ রাজি হলো। জাহিনকে তৈরি হতে পাঠাল। জেরিন বলল,
‘ভাই, এক কাজ কর, মুশরাফাকে নিয়ে যা। সে ও ঘুরে আসুক। ‘
জাওয়াদ হতাশ চোখে তাকাল স্ত্রীর পানে। সেই চাহনি দেখে নিরব নিঃশ্বাস ফেলল মুশরাফা। হেসে বলল,
‘ থাক আপু। একটু পরেই এশার আজান দিবে। এখন বের হলে নামাজের দেরি হয়ে যাবে। অন্য কোনদিন যাব। আজ ওরা যাক।’
মায়মুনা বেজায় নারাজ হলেন। অসন্তোষটা বাড়ল তার। কেমন অসামাজিক মেয়ে ও! মুখের সামনে মানা করে দেয়!
জাওয়াদ খুশিই হলো। হাফ ছেড়ে বলল,
‘ও যখন যেতে চাইছে না, তাহলে না যাক।’
জাহিন এসে হাজির হলো। জাওয়াদ ভাতিজাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মুশরাফা তাদের যাওয়ার পানে তাকাল এক পলক। চোখ ফিরিয়ে কথায় মন দিল।
.
তখন এশার নামাজ পড়ে দোয়া পড়ছে মুশরাফা। আকস্মিক জাহিন এলো ঘরে। মুশরাফার উদ্দেশ্যে বলল,
‘চাচী, আমরা আইসক্রিম নিয়ে এসেছি। মা আপনাকে আইসক্রিম খেতে ডাকছে। ‘
মুশরাফা ভ্রু কুঁচকাল। আকস্মিক হেসে ফেলল।
চলবে…
বিঃদ্রঃ -১ ইদ আনন্দে চোখ না ভেজানোর প্রয়াসে আজকের পর্বটায় দুঃখালাপ করিনি।
বিঃদ্রঃ-২ ইসলামিক মাইন্ড মানুষের রোমান্টিকতা নিয়ে মানুষের তোলা প্রশ্নের জবাব দিতেই কিছু দিক একটু গভীরভাবে আলোচনা করতে হচ্ছে। অত্যাধিক রোমান্টিক রূপ দিতে হচ্ছে। কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই লিখছি আমি।