#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-১৫)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
ধূসর আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। মেঘের গর্জনে কেঁপে উঠছে গোটা শহর। সাথে যোগ হয়েছে বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দ। সকাল থেকেই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। চেহারায় বিরক্তির আভা মিশিয়ে বৃষ্টির পানে চেয়ে আছে জাওয়াদ। ছুটি শেষ, আজ অফিসে জয়েন করতে হবে। কদিন ছুটি পেয়ে শরীরে অলসতা ভর করেছে, তারউপর আবার বৃষ্টি! এই বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না ওর।
খাটে বসে এক ধ্যানে বৃষ্টি দেখছে। চারদিকে খেয়াল নেই ওর। নাস্তা গুছিয়ে রুমে এলো মুশরাফা। জাওয়াদকে আনমনা বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘অফিসে যাবেন না?’
জাওয়াদের ধ্যান ভাঙল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল স্ত্রীর পানে। উত্তর দিল না। অলস ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। কাভার্ড থেকে ফরমাল ড্রেসাপ নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকল। বের হয়ে দেখল মুশরাফা রুম গুছাচ্ছে। জাওয়াদকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
‘অফিস কয়টায় শেষ হয় আপনার?’
জাওয়াদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গলায় টাই বাধতে বাধতে ছোটো করে উত্তর দিল,
‘সাতটায়।’
‘ লাঞ্চ কোথায় করেন?’
‘ক্যান্টিনে।’
‘ খিচুড়ি আর গরুর কালা বুনা করেছি। টিফিন দিই?’
কোমল স্বরে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ টাইয়ের নাট টাইট করে উত্তর দিল,
‘ আমি বাসা থেকে টিফিন নিই না। ক্যান্টিনে করি।’
মুশরাফা কিছু একটা বলতে চাইল, কিন্তু বলতে পারল না। থেমে গেল। বোধকরি, এই মুহুর্তে কথাটা বলা অনুচিত মনে হলো ওর। সে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘ আপনাদের বাসার ঠিকানাটা দিন তো?’
জাওয়াদ চুল আঁচড়াচ্ছিল, থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে স্ত্রীর পানে চেয়ে প্রশ্ন করল,
‘কেন?’
‘আমার কিছু জিনিস দরকার ছিল, তা আনাতাম।’ ধীর স্বরে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল,
‘ কোথা থেকে আনাবে?’
‘অনলাইনে অর্ডার করব। ‘
জাওয়াদ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘ অনলাইনে!’
মুশরাফা স্বাভাবিক স্বরেই বলল, ‘হ্যাঁ, আমি তো অনলাইনেই শপিং করি।’
জাওয়াদ কিছুটা অবাক হলো। মুশরাফার মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া দেখতে পেল ও। মেয়েটাকে আঁতেল ভেবেছে সে, কিন্তু মেয়েটা আঁতেল নয়। মুশরাফা আবার বলল,
‘পার্সেল বাসায় এলে, মা কিছু বকবে?’
জাওয়াদ ছোটো করে বলল,
‘না।’
মুশরাফা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, ‘আচ্ছা।
বলে ঝটপট কোথা থেকে একটা ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেল। এ ক’দিনে মুশরাফাকে ফোন, ল্যাপটপ ধরতে দেখেনি জাওয়াদ। এসবের অস্তিত্ব ও চোখে পড়েনি ওর। মাত্র দেখছে। জাওয়াদ প্রথমে ভেবেছে, ল্যাপটপটা ওর, কিন্তু খেয়াল করে দেখল এটা ওর নয়। সম্ভবত মুশরাফার। বাড়ি থেকেই এনেছে। মুশরাফা মনোযোগ ডুবাল ল্যাপটপে। মিনিট খানেক বাদেই ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে ঠিকানা জানতে চাইল। জাওয়াদ বিনাবাক্যে ঠিকানা বলে দিল। নোটপ্যাডে টুকে নিল মুশরাফা। তারপর আবার মনোযোগী হলো। খানিক বাদে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘ অর্ডার ডান। জাযাক আল্লাহু খায়রান।’
জাওয়াদ আবার তৈরি হওয়ায় মন দিল। মুশরাফা রুমেই রইল। বের হলো না। কাভার্ড খুলে ছাতা বের করে রাখল। জাওয়াদ বেরুনোর সময়
ছাতাটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘ছাতা নিয়ে যান। আর লাঞ্চ করে নিবেন, সেই সাথে জোহরের নামাজ ও পড়ে নিবেন।’
জাওয়াদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
‘নামাজ না পড়লে জায়নামাজ নিয়ে কি অফিসে ও হাজির হবে?’
মুশরাফার মনোক্ষুণ্ণ হলো বোধহয়। তার জোর করা বৃথা যাচ্ছে। নামাজে টান আসছে না কেন? মুশরাফা হতাশ শ্বাস ফেলল নিঃশব্দে। তারপর হেসে মনে করিয়ে দিল,
‘ তা হবো না। কারণ আমার আপনার প্রতি বিশ্বাস আছে। আপনি নিজেকে মুনাফিক প্রমাণ করবেন না। নামাজ না পড়ার আগে আপনার নিজের করা ওয়াদা মনে পড়বে, তখন আপনি নামাজ পড়ে ফেলবেন।’
আবার আটকে দিল মেয়েটা। জাওয়াদ বিরক্ত হলো। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। মুশরাফা সেই চাহনির বিনিময়ে হেসে বলল,
‘আল্লাহ, সেইদিন দ্রুত আনুক, যেদিন আমাকে এই ওয়াদার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে না।’
জাওয়াদ কিছু না বলে হাঁটা ধরল। মুশরাফা পিছন থেকে বলল, ‘আল্লাহর কাছে আমানত দিলাম আপনাকে। ‘
জাওয়াদ না থেমেই চলে গেল। বিল্ডিংয়ের নিচে যেতেই ওর ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। চেক করে চোখ বুলাল,
“বিসমিল্লাহি, তাওয়াক্কালতু আলাল্লাহি, ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লা বিল্লাহি।’
কোথাও বের হওয়ার সময় এই দোয়া পড়ে বের হবেন। তাহলে সব রকম বিপদ আপদ থেকে আল্লাহ আপনাকে রক্ষা করবে।”
মুশরাফার ম্যাসেজে চোখ বুলাতে গিয়ে দোয়া পড়া হয়ে গেল জাওয়াদের। জাওয়াদ কোন রিপ্লাই না করে অফিসে চলে গেল।
জিশান আসেনি এখনো। বাসায় মুক্তপাখির মতো ঘুরছে মুশরাফা। দুপুরের রান্না সেই করল। সারাবেলা কাজ করল। জোহরের আজান দিতেই এসে পড়ল রুমে। গোসল করে নামাজে দাঁড়াল। নামাজ শেষে জাওয়াদকে ফোন দিল। দুষ্টুমি চাপল মাথায়। জাওয়াদ ফোন ধরতেই সালাম দিল। জাওয়াদ বলল,
‘ কল দিয়েছো কেন?’
‘আপনি কখন আসবেন?’
‘কেন?’ গম্ভীরমুখে বলল জাওয়াদ।
মুশরাফা আদুরে গলায় বলল,
‘আমি আপনাকে মিস করছি। তাড়াতাড়ি চলে আসুন।’ বাস্তবিকপক্ষে, মিস করছে জাওয়াদকে।
জাওয়াদ কেন যেন আটকাল। এভাবে কিভাবে বলে মেয়েটা! তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। খানিক বাদে বলল,
‘আমার ফিরতে দেরি হবে।’
‘ লাঞ্চ করেছেন?’ প্রসঙ্গ বদলাল মুশরাফা। জাওয়াফ সংক্ষেপে উত্তর দিল,
‘করতেছি।’
‘নামাজ পড়েছেন?’
জাওয়াদ উত্তর দিল না। কল কেটে দিল। মুশরাফা ধরে নিল নামাজ পড়েনি। নামাজের প্রতি স্বামীর গাফেলতি দেখে মুশরাফার কান্না পেল। মোনাজাতে কেঁদেকেটে আল্লাহর কাছে দোয়া করল।
.
জাওয়াদ ফিরল আট’টা নাগাদ। মুশরাফা তখন জেরিনের সাথে বসার ঘরে বসে গল্প করছিল। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে জেরিন উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বলল,
‘জাওয়াদ এসেছে বোধহয়। দাঁড়াও দেখে আসি।’
মুশরাফা অনুরোধের সুরে বলল, ‘আমি যাই?’
জেরিন হেসে ফেলল। কৌতুকের স্বরে বলল, ‘বাহ্বা! স্বামীর জন্য কত টান! যাও। ‘
মুশরাফাও হাসল। দরজার দিকে এগুলো। লুকিং মিররে দেখে নিল আগে। ক্লান্ত অবিশ্রান্ত জাওয়াদকে চোখে পড়ল। দরজা খুলে মিষ্টি হেসে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’
জাওয়াদ বাঁকা চোখে তাকাল এক পলক। তারপর দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেল। সোজা রুমে। মুশরাফা দরজা বন্ধ করে ফ্রিজের দিকে এগুলো। সকালে বৃষ্টি থাকলেও বেলা গড়াতেই বৃষ্টি বিলীন হয়ে রোদ উঠেছে। কাঠফাটা রোদে শহরটাকে রুক্ষ করেছে। মুশরাফা ঘন্টা খানেক আগে লেবুর শরবত বানিয়ে ফ্রিজে রেখেছিল। তা নামিয়ে রুমের দিকে এগুলো। জাওয়াদকে চোখ বন্ধ করা অবস্থায় কাউচে আধশোয়া হয়ে থাকতে দেখল। মুশরাফা তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গ্লাসটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এই ড্রিংকটা নিন। রিফ্রেশ লাগবে। ‘
জাওয়াদ চোখ খুলল। কান্ত স্বরটায় আজ আর দ্বিরুক্তি বেরুল না। চুপচাপ হাতে নিল গ্লাস। ঢকঢক করে গিলে আবার সোফায় গা এলিয়ে দিল। মুশরাফা ওর বাসায় পরিধেয় টি-শার্ট, ট্রাইজার নিয়ে বাথরুমে রাখল। গলায় টাওয়াল ঝুলিয়ে দিয়ে বলল,
‘এবার যান, শাওয়ার নিয়ে আসুন।’
জাওয়াদ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকাল। এই মেয়ে একটু বেশি যত্নবোধ দেখাচ্ছে। এতটা দেখানো ঠিক না। বেশি হয়ে যাচ্ছে।
•
রাত তখন এগারোটা। রাতের খাবার শেষে রুমে এসেছে মুশরাফা। জাওয়াদ ল্যাপটপ নিয়ে বসা। মুশরাফা বিছানা ঝাড়ু দিয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছল। খানিক পরপর জাওয়াদের দিকে তাকাচ্ছে। ওর তাকানোর মাঝে ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে গেল জাওয়াদ। কাভার্ডের কাছে গিয়ে ট্রাউজারের পকেটে কিছু একটা নিল। তারপর দরজার দিকে হাঁটা ধরল। পুরো ব্যাপারটা পরখ করল মুশরাফা। সেদিন কাশি দেয়ার পর থেকে জাওয়াদ মুশরাফার সামনে সিগারেট খায়না। রুম বারান্দায় কোথাও অ্যাশ ট্রে দেখা যায়না। ছাদে গিয়ে খেয়ে আসে। রাতে ঘুমানোর আগে ছাদ যায়, মধ্যরাতে উঠে ও ছাদে চলে যায়। মুশরাফা টের পেয়েছে, কাল। কিছু বলেনি। আজ বাধা দেয়ার অপেক্ষায় ছিল।
পিছু থেকে বলল,
‘সিগারেট খেতে ছাদে যাচ্ছেন, তাই না?’
জাওয়াদ থেমে গেল। বিস্মিত হলো ও। মেয়েটা টের পেল কিভাবে! নিজের বিস্ময় প্রকাশ না করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘যাচ্ছি। তো!’
মুশরাফা বিছানা থেকে নেমে জাওয়াদের সামনে এসে দাঁড়াল। ধীর স্বরে বলল,
‘ সিগারেটটা এবার ছেড়ে দেয়া উচিত, আপনার।’
‘ আমি তোমার কথা শুনতে বাধ্য নই।’ কাটকাট বলল জাওয়াদ।
মুশরাফা হেসে বলল,
‘ নিজের কথা শুনতে তো বাধ্য।’
‘মানে? ‘
‘ ধুমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আপনি জেনেশুনে নিজের ক্ষতি করছেন। ‘
আলতো স্বরে বলল মুশরাফা। জাওয়াদ দায়সারা জবাব দিল,
‘করলে করছি। তাতে তোমার কী?’
মুশরাফাও দায়সারা জবাব দিল,
‘ আপনি যেচে নিজের নামটা মুনাফিকের খাতায় লিখতে যাচ্ছিলেন, স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব আপনাকে সতর্ক করা। আপনাকে মনে করিয়ে দেয়া যে, আপনি আমাকে ওয়াদা করেছিলেন নিজের কোন ক্ষতি করবেন না। মনে করিয়ে দিয়েছি।
আমার দায়িত্ব শেষ। এবার ক্ষতি হলে আপনার হবে, আমার কী?’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল। নিজের করা ওয়াদার সাথে সিগারেটের সংযোগ মেলালো। পেয়ে ও গেল। মেয়েটা ক্ষতির তালিকায় সিগারেটটাকে ও টেনে নিয়েছে! সর্বনাশ! এবার কি ওর সিগারেট খাওয়া বন্ধ করতে হবে? অসম্ভব! একবেলা সিগারেট না খেলে ও তো মরেই যাবে। কোনভাবেই ছাড়া যাবে না। জাওয়াদ রেগে বলল,
‘ সিগারেটের সাথে অন্য কথা জড়াবে না একদম। ভালো হবে না।’
মুশরাফা শীতল স্বরে বলল,
‘ সিগারেট যে খাচ্ছেন, এতেও তো আপনার ভালো হচ্ছে না। আপনাকে না ডাক্তার নিষেধ করেছে?’
জাওয়াদ অবাক হলো, এটা কিভাবে জানল মেয়েটা! নিশ্চয়ই বাবা বলেছে। এবং ওর সিগারেট ছাড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে। তারপরই এই মেয়ে পেয়ে বসেছে। জাওয়াদ দমল না। রেগে বলল,
‘ না হোক ভালো। খারাপ হলে সর্বোচ্চ মরে যাব, তাও একটু শান্তি পাব। ‘
মুশরাফার মুখটা আকস্মিক মলিন হয়ে গেল। সে গম্ভীরমুখে বলল,
‘মরে যাবেন কত সহজে বলে ফেললেন, কবরে গেলে কী হবে একবার ভেবে দেখেছেন? ওখানে কিন্তু আপনার আমলনামা ছাড়া আপনার সাহায্যকারী কেউ থাকবে না। এত বলি, তাও নামাজটা পড়েন না, আমাকে করা ওয়াদাও রাখেন না, নিজের ক্ষতি করেন। এত গুনাহর শাস্তি পেলে থাকবেন আপনি? মরার কথা বলার আগে একটাবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন তো!’
জাওয়াদ আটকে গেলে কোথাও। কবরের কথা ভাবতেই গা শিউরে উঠল। কেমন যেন লাগল। ভেতরে একটা ঝড় বয়ে গেল। তাও প্রকাশ করল না। ঝাঁজালো স্বরে বলল,
‘তুমি আজাইরা আছো, তুমি ভেবে দেখো। আমার সময় নেই এতকিছু ভাবার। তোমার এই প্যারা থেকে মরণটা আমার কাছে ভালো মনে হয়।’
মুশরাফার স্বর আরও মলিন হলো। কেমন কাতর স্বরে বলল,
‘ একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো! ধরুন, আপনার ছোটোভাই আপনার চোখের সামনে আগুনে ঝাপ দিতে যাচ্ছে। আপনি দেখে কী করবেন?’
চলমান কথার সাথে শেষ প্রশ্নের সংযোগ পেল না জাওয়াদ। বিরক্তির সাথে উত্তর দিল,
‘ অবশ্যই ওকে আগুনের কাছ থেকে সরিয়ে আনব।’
মুশরাফা শান্ত স্বরে বলল, ‘ আমি ও তাই করছি। আপনাকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি। এ ছাড়া আর কিছু নয়। আপনি যদি নিয়মিত নামাজ পড়তেন, নিজের ক্ষতি না করতেন, তবে আমি আপনাকে কোন প্রকাশ বিরক্ত করতাম না। বিশ্বাস করুন!’
পরপরই মলিন স্বরে বলল, ‘ আপনি এখন একা নন, আমি ও আছি আপনার জীবনে। আপনার মৃত্যুতে আমার জীবন রংহীন হয়ে যাবে, মৃত্যুর কথা বলার আগে এটা একবার ভাবা উচিত ছিল আপনার। ‘
কেমন কাতরতা ঝরে গেল মুশরাফার মুখ থেকে। জাওয়াদ আবার আটকাল। থমকে গেল ও। মুশরাফার কাতরমাখা স্বর ওর মনে গিয়ে ঠেকল। মনে প্রশ্ন জাগল, ওর মৃত্যুর কথায় মেয়েটার খারাপ লাগল কেন? সে কি তাকে ভালোবাসে? বিস্ময়ের পসরা বইল মুখে। বিস্ময়টা মুশরাফার সামনে প্রকাশ করতে চাইল না। সিগারেটের ক্রেভিং উঠেছে, এখন একটা সিগারেট খাওয়া বাধ্যতামূলক। জাওয়াদ পাশ কাটিয়ে যেতে নিল।
মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলল। এই লোকটাকে নমনীয়তার সাথে বশ করা যাবে না। কঠোর হতে হবে। সে জাওয়াদের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে দরজা লক করে দিল। গম্ভীরমুখে বলল,
‘ একজন ব্যক্তিত্ববান, ভালো মানুষ কখনো নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে না। তাছাড়া ওয়াদা ভঙ্গ করা মুনাফিকের আলামতের একটা। আপনি এখন সিগারেট খেতে গেলেন মানে আপনি ব্যক্তিত্বহীন, মুনাফিকের একটা আলামতে নিজের নাম লেখালেন। নিজেকে এত নিচে নামানো আপনার শোভা পাবে না। যাওয়ার আগে ভেবে দেখুন।’
জাওয়াদ আবার ধাক্কা খেল। ব্যাপারটা এবার আত্মসম্মানে গিয়ে লেগেছে। নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন প্রমাণ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। জাওয়াদ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না। শুধু চোখে রাগের শিখা মিশিয়ে মুশরাফার দিকে তাকাল বারংবার। মুশরাফা হাসল। তার কথা কাজে দিয়েছে। সে হেসেই বলল,
‘ এখন সিগারেট তো খাবেন না। তার বদলে কী পান করবেন? কোন গরম পানীয়? বলুন, আমি বানিয়ে দিব। ? ‘
জাওয়াদের মাথায় আকস্মিক বুদ্ধি এলো। ফন্দি আঁটল মুশরাফাকে আটকানোর। ওর ভাবনা, এই হুজুগে ঘরকোনা মেয়ে আর যায় হোক বাইরের পানীয় বানাতে পারবেনা। সেদিন রেস্টুরেন্টে খাবার ধরণ দেখে আন্দাজ করা যায়, সে বাইরের খাবারে অভ্যস্ত নয়। সেখানে বানাতে পারা তো পরের কথা। যদি না পারে তবে সে নিজের দাবি আদায় করে নিবে। এই প্রয়াশে বলল,
‘ যদি না পারো? ‘
মুশরাফা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘পারব ইন শা আল্লাহ। তবে মনে রাখবেন, তা হালাল হতে হবে এবং বাসায় বানানো যায় এমন হতে হবে। ‘
‘ ঠিক আছে। তবে আমার শর্ত হলো, আমি কয়েকটা হট ড্রিংকের ছবি দেখাব। সেম টু সেম করে দিতে হবে। সময় একঘন্টা। টেস্ট ও ভালো হতে হবে। যদি না পারো তবে ওয়াদা থেকে সিগারেট বের করে নিতে হবে। রাজি থাকলে বলো, নয়তো আমি গেলাম ছাদে।’ জাওয়াদ বাঁকা হেসে বলল। মুশরাফাকে আটকাতে চাইল সে । মুশরাফা ভ্রু নাড়িয়ে বলল,
‘ যদি পারি তবে?’
জাওয়াদ নিশ্চিত মুশরাফা পারবে না। সে হেয়ালি করে বলল,
‘তবে আমি বাসায়, ছাদে গিয়ে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিব।’
মুশরাফা বিস্মিত স্বরে বলল,
‘নিশ্চিত? ‘
‘হ্যাঁ।’
মুশরাফা হেসে বলল,
‘এবার মেন্যু বলুন।’
জাওয়াদ ঝটপট কদিন আগে তিনটা ছবি দেখাল। একটায় ক্যাপাচিনো কফি, দ্বিতীয়তায় কোল্ড কফি, তৃতীয়টায় ক্যারামেল মোহিতো ফ্র্যাপে। মুশরাফা একটু ভয় পাওয়ার ভান করল। আমতা আমতা করল,
‘এগুলো…
জাওয়াদ ধরেই নিল মুশরাফা পারবেনা। সে বিজয়ী হেসে বলল,
‘হার মেনে নাও। সিগারেট তুলে নাও।’
মুশরাফা মলিন স্বরে বলল,
‘চেষ্টা করে দেখি।’
‘যাও।’ জাওয়াদ গিয়ে কাউচে বসল আরাম করে। বিজয়ের একটা ভাব তার মাঝে লক্ষণীয়। মুশরাফা বলল,
‘আপনি ও আসুন। ‘
জাওয়াদ সাফ জানাল,
‘আমি কোন হেল্প করব না।’
‘ আপনার হেল্প লাগবে না। শুধু বসে থাকবেন। রাত বিরাতে রান্নাঘরে জ্বিন থাকতে পারে।’
জাওয়াদ তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘ তোমার বাহানা ফ্লপ, আমি বিশ্বাস করছিনা। রান্নাঘরে না কি জ্বিন আসবে। যত্তসব আজগুবি কথাবার্তা।’
মুশরাফা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
‘ আমি জ্বিন সম্পর্কে অনেক পড়েছি। ভালো জ্বিন মানুষের আবাসস্থলের ছাদে বা আশপাশে থাকে। তারা রাতের আঁধারে রান্নাঘরে ঘুরে বেড়ায়। মানুষের রেখে যাওয়া খাবার খায়। এইজন্যই রাসূল (সাঃ) রাতে ঘুমানোর আগে বিসমিল্লাহ বলে খাবার ঢেকে রাখতে বলেছেন। আর খারাপ জ্বিন থাকে টয়লেটে, নোংরা জায়গায়। তারা নোংরা জিনিস খায়। এইজন্যই টয়লেটে থাকাকালীন সময়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। বিশ্বাস না হলে গুগল করে রেফারেন্সসহ দেখুন।’
মুশরাফার কথা জাওয়াদের বিশ্বাস হলো না। এগুলো সে আগে শুনেনি। প্রথম শুনছে। তাই হেয়ালি করেই বলল,
‘ আমি যাতে রান্নাঘরে যেতে নিষেধ করি, তার জন্য বানিয়ে বলছো এসব। আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি না। যাও রান্নাঘরে। জ্বিন দেখলে ডেকো আমায়। আমি ও দেখব। অনেকদিনের ইচ্ছে।’
মুশরাফা সামনের দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে বলল,
‘যদি আমার কথা বিশ্বাস হয়, তবে আসবেন। রান্নাঘরে একা লাগবে আমার। ‘
‘ইউর টাইম স্টার্ট নাও।’ দায়সারাভাবে বলল জাওয়াদ।
মুশরাফা চলে গেল। মুশরাফা রান্নাঘরে প্রথমে চুলোয় গরম পানি বসাল। গত দু’দিন রান্না করায় রান্নাঘরের সাথে অনেকটাই পরিচিত হয়ে গিয়েছে সে। পানি বসিয়ে কফি, কফিমেট, চিনি, কনডেন্স মিল্ক, চকলেট মিল্ক, ভ্যানিলা এসেন্স, হুইপড ক্রিম, ক্যারামেল সিরাপ এর বৈয়ামগুলো খুঁজে খুঁজে বের করল। কাকন এসব রান্না করে, তাই ঘরে সব সামগ্রী থাকে। মুশরাফার জন্য সুবিধা হলো। ফ্রিজ থেকে দুধ আর বরফের ট্রে ও বের করল। কেবিনট থেকে ইলেকট্রনিক হ্যান্ড বিটার আর ব্লেন্ডার বের করল। তারপর মগ, গ্লাস ও নামাল। ততক্ষণে মাঝে পানি ফুটতে শুরু করেছে।
মুশরাফা ১ কাপ গরমপানিতে কফি, কফিমেট ও চিনি নিল। তারপর বরফ, তরল দুধ ও কনডেন্স মিল্ক একসঙ্গে মিশিয়ে ফেনা ওঠা পর্যন্ত ব্লেন্ড করল। এরপর কেবিনেট থেকে গ্লাসে ঢেলে ফেনার ওপর লাভ শেফের শুকনো কফি ছড়িয়ে ট্রেতে রেখে দিল গ্লাসটা।
তারপর ক্যাপাচিনো তৈরি করতে বসল। এর মাঝে রান্নাঘরে কারো উপস্থিতি টের পেল ও। মুশরাফা তখন কাচের বোতলে দুধ নিয়ে ভালভাবে ঝাঁকিয়ে নিয়ে ফোম তৈরি করছিল। কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে ভয় না পেয়ে হেসে ফেলল। ধীর স্বরে বলল,
‘ বিশ্বাস হলো তবে!’
জাওয়াদ ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে চুলোর দিকে এগুলো। উত্তর দিল না। বাস্তবিকভাবে সে গুগল করে মুশরাফার কথার সত্যতা পেয়েছে। জেনেই কেমন গা ছমছমে করে উঠেছে। মুশরাফার ফোম করা করা শেষ। বোতল রেখে কোল্ড কফির গ্লাসটা জাওয়াদের হাতে তুলে দিয়ে বলল,
‘ স্যার, আপনার কোল্ড কফি তৈরি। ‘
জাওয়াদ বিস্মিত নয়নে হাতে নিল। এত অল্প সময়েই রেড়ি!জাওয়াদকে দিয়ে মুশরাফা পানিতে চিনি, কফি মিশিয়ে নেয়া মগের উপর থেকে এই দুধ ঢালতে শুরু করল।
জাওয়াদ গ্লাসে চুমুক দিয়ে অবাকই হলো। টেস্টটা চমৎকার। এই মেয়ে কিভাবে জানল রেসিপি! বিস্মিত চোখে মুশরাফার দিকে তাকাল। মুশরাফা বেশ দক্ষ হাতে মগের এক দিক দিয়ে কী সুন্দর দুধ ঢেলে ডিজাইন তৈরি করল উপর। দেখেই বুঝা যাচ্ছে এই রেসিপি আজ প্রথমবার করছে না সে। জাওয়াদ প্রশ্ন করল,
‘তুমি কফি বানাতে জানলে কিভাবে?’
মুশরাফা এবার কফির ওপরের অংশে একটু কফি পাউডার চিটিয়ে দিতে দিতে বলল,
‘ ক্যাপাচিনো আমার পছন্দ, মামীর পছন্দ কোল্ড কফি। আর ক্যারামেল মোহিতো ফ্যাপো শখের বসে ট্রাই করেছিলাম কয়েকবার। মামা বাসায় গেলেই আমি অনেক রকমের রান্নার এক্সপেরিমেন্ট করি।’
জাওয়াদের কৌতুহল হলো। সে জিজ্ঞেস করল,
‘কী কী রান্না করতে পারো তুমি? ফাস্টফুড, চাইনিজ, থাই, পারো?’
মুশরাফা উত্তর দিল, ‘ মামার বাসায় পিজ্জা, বার্গার, ফ্যাঞ্চ ফ্রাই, চিকেন ফ্রাই, গ্রীল, কাবাব, থাই স্যুপ, চাইনিজ , স্প্যাগেটি, পাস্তা এগুলো ট্রাই করেছি বেশ কয়েকবার। ‘
মুশরাফা রান্নার হাত বেশ দক্ষ। গত দু’দিন খেয়েই আন্দাজ করেছে জাওয়াদ। এখন ওর দক্ষতার তালিকা দেখে যারপরনাই অবাক হলো। মুশরাফাকে দেখে যতটা ব্যাকডেটেড মনে হয়েছে, এই মেয়ে তেমন নয়। এই মেয়ে আপডেট। তার দক্ষতাও আধুনিক নারীর মতো। পর্দায় থাকা মেয়েরা এত আধুনিক মন মানুষিকতার হয়? এই মেয়ের শুধু গুন বেরুচ্ছে। জাওয়াদ আকস্মিক বলে ফেলল,
‘শুধু মামার বাসায়? তোমাদের বাসায় করতে না?’
মুশরাফার হুশ এলো। উৎফুল্লতায় কত কী বলে দিচ্ছিল সে! ঠিক হয়নি। এখন সে কিভাবে বলবে, তার বাসার কেউ তার প্রতিই আগ্রহ প্রকাশ করতো না, আবার তার রান্নার প্রতি করবে! কার জন্য রান্না করবে সে? সেখানে তাকে মরুভূমিতে একা থাকার অনুভূতি পেতে হতো। মুশরাফা চাপা শ্বাস ফেলল।
ফ্রেশ ক্রিম দিয়ে কফি মগের উপরের অংশে সাজিয়ে দিল। তারপর মগটা জাওয়াদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘ এক মগই বানাচ্ছি। আমার জন্য অর্ধেক রাখবেন। স্বামী স্ত্রী এক পাত্র ভাগ করে খাওয়া সুন্নত।’
জাওয়াদ মুশরাফার কথা ঘুরানোটা ধরতে পারল না। সে কফিতে চুমুক দিল। এটার স্বাদ ও ভালো। মুশরাফা জানতে চাইল,
‘কেমন হয়েছে?’
জাওয়াদ উত্তর দিল না। দ্বিতীয় চুমুক দিল। মুশরাফা তখন তৃতীয় রেসিপি বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। থেমে গিয়ে জাওয়াদের পাশে এসে দাঁড়াল। জাওয়াদের হাতে ধরা মগে চুমুক দিল। তারপর বলল,
‘খারাপ হয়নি। আপনি শর্তে হেরে যাচ্ছেন জনাব!’
জাওয়াদ কফি মগ রেখে মুখ কুঁচকে বলল,
‘তোমার চয়েজ ভালো না। ভালো হয়নি কফি।’
মুশরাফা হেসে বলল,
‘আমার চয়েজ লিস্টে আপনি আছেন। কথাটা সত্য ধরব? ‘
জাওয়াদ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মুশরাফা মোহিতো কফি বানিয়ে সব গুছিয়ে নিয়ে এলো রুমে। মগটা জাওয়াদের হাতে তুলে দিল। বিজয়ী হেসে বলল,
‘ পয়তাল্লিশ মিনিটে তিনটা কফি তৈরি হয়ে গেছে। আজ থেকে সিগারেট খাওয়া বন্ধ।’
জাওয়াদ কাউচে বসা। ল্যাপটপ হাতে তার। ধ্যান ল্যাপটপের মাঝে। কফি মগ হাতে নিয়ে রেখে দিল, চুমুক দিল না। আর না কথা বলল। যেন সে শুনেই নি।
মুশরাফা রান্না করে এসে ঘেমে নেয়ে একাকার। ওড়না খুলে ফ্যানের নিচে বসেছে। চোখ বন্ধ। জাওয়াদের চোখে ঘুম নেমেছে। ল্যাপটপে রেখে উঠে দাঁড়াতেই মুশরাফার দিকে চোখ পড়ল। খানিক সময় নিয়ে পরখ করল। ভ্রু কুঁচকে এলো ওর। মনে কৌতুহল উঁকি দিল। আনমনেই প্রশ্ন করে বসল,
‘তোমার হাতে এগুলো কিসের দাগ?’
মুশরাফা ধ্যান ভাঙলো। নড়েচড়ে বসল। জাওয়াদের দৃষ্টি অনুসরণ করে হাতের দিকে তাকাল। হাতা ছোটো হওয়ায় হাতে কাটা দাগ বেরিয়ে এসেছে। ভীত ঢোক গিলল ও। এবার কী বলবে? ও তো মিথ্যা বলে না। কিন্তু সত্যটা কীভাবে বলবে? কিভাবে বলবে, এগুলো ওর পরিবারের পক্ষ থেকে আসা মারের দাগ?
চলবে…