#স্বর্নাভ_সুখানুভূতি। (পর্ব-৩৩)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
ঘুরে ঘুরে লেডিস শু দেখছে জাওয়াদ। আড্ডায় যাবার কালে ক্যাফের পাশের শপিংমলের জুতা কিনতে দোকানে ঢুকেছে অনিক। কেবিনেটে সাজিয়ে রাখা ক্যাজুয়াল শু দেখে মুশরাফার ট্রেডমিলে হাঁটার দৃশ্যটা চোখে ভেসে উঠল উঠল জাওয়াদের। কক্সবাজার থেকে এসেছে সপ্তাহ হয়ে গেল, এখনো ট্রেডমিল নামিয়ে দেয়া হয়নি। মাথা থেকে সরে গিয়েছিল। এখান থেকে গিয়েই নামিয়ে দিবে বলে মনস্থির করল।
হুট করে মাথায় এলো, আচ্ছা এক জোড়া জুতা নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে চমকে দিলে কেমন হয়? ভালোই হয়। স্ত্রীকে চমকে দেয়ার আশায় জাওয়াদ ওর জন্য এক জোড়া শু পছন্দ করতে লেগে গেল। সাইজটা সেদিন চোখে পড়েছিল ওর। তাই খুব একটা অসুবিধা হয়নি। অনিক ওকে লেডিস জুতা কিনতে দেখে টিপ্পনী কেটে বলল,
‘ তোকে এখন লাগছে বিয়াত্তা পুরুষ। ‘
জাওয়াদ কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ‘ নিজে বিয়ে করিয়ে দিয়ে এখন বলছিস বিয়াত্তা লাগছে!’
‘আমি করিয়েছি! ‘ অবাক স্বরে চেঁচিয়ে বলল অনিক । আশপাশের দুই একজন ক্রেতা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। জাওয়াদ সেদিকে লক্ষ করে বলল,
‘ আচ্ছা আমিই করেছি। এবার থাম। মানুষ তাকাচ্ছে।’
থেমে বলল,’ তুই অন্যদিকে গিয়ে নিজের জুতা দেখ। আমাকে বিরক্ত করবি না। জুতা এদিক ওদিক হলে মান ইজ্জত থাকবে না।’
অনিক থেমে হিসহিসিয়ে বলল, ‘ দুই দিনের বউয়ের জন্য বন্ধুকে ভাগাচ্ছিস! শালা মীরজাফর। একবার খালি আমাকে বিয়েটা করতে দে, তারপর দ্যাখ, তোকে কিভাবে আমার সামনে থেকে ভাগাই। ‘
‘আগে বিয়া কর। তারপর বলতে আসিস।’
অনিক ভ্রু উঁচাল, ‘তুই আমাকে বিয়ে করতে বলছিস? কদিন আগেই না বলছিস, ভাই জিন্দেগিতে বিয়ার নাম নিস না। আবিত্তা আছিস, ভালা আছিস।’
জাওয়াদ জুতা দেখতে দেখতে বলল, ‘ এখন ও আমিই বলছি, বিয়া হলো টক ঝাল মিষ্টি ফ্লেভারের একটা অধ্যায়। অনুভূতি খারাপ না। একটা ট্রাই মারতেই পারিস। জীবন তো একটাই, আবিত্তা মরা ঠিক হবে না।’
জাওয়াদ জুতা দেখতে দেখতে অন্যদিকে চলে এলো। অনিক বন্ধুর কথার পরিবর্তন দেখে হা করে তাকিয়ে রইল। তার থেকে ও বেশি অবাক হলো, জুতা কিনে বিল দেয়ার সময় যখন জাওয়াদ নিজেই ওর জুতার দাম মিটিয়ে দিল। অনিক কপট রেগে জিজ্ঞেস করল,
‘ দামটা তুই দিলি ক্যান?’
জাওয়াদ হেসে বলল,
‘ উকিল বাবাদের কত কিছু দিতে হয়। রাখ, আড়ংয়ের পাঞ্জাবির সাথে পরিস। ‘
এই কথার মাঝে জাওয়াদের সন্তুষ্টি টের পেল অনিক। জুতা কিনে আড্ডায় ফিরল। ততক্ষণে ক্যাফেতে জমজমাট আড্ডা বসে গেছে। আটজনের গ্রুপটা গোল হয়ে বসেছে মেঝেতে। সামনে গোল টেবিল। ক্যাফেতে বড়ো বন্ধুমহলের আড্ডার জন্য আলাদা সাইট আছে। যেখানে টেবিল পাতিয়ে নিচে বসার জায়গা করা হয়েছে। জাওয়াদ অনিককে দেখে হৈ হৈ পড়ে গেল। কতদিন বাদে দেখা। রবিন এগিয়ে এসে কাধ চাপড়ে বলল,
‘ বিয়ে করে ভুলে গেছিস। কল টল ও দিস না। ‘
জাওয়াদ হেসে বলল,
‘ ভুলি নাই। বিজি ছিলাম, কল দিব করে ও দেয়া হয়নি।’
সাদাফ ওকে পরখ করে বলল,
‘ মামা, বিয়া কইরা মানুষ সুন্দর হয়। তুই তো দেখি আরও কয়লা হইয়্যা গেছোস। জঙ্গলি বিয়া কইরা জঙ্গলি হইয়া যাইতাছোস। এইজন্যই কইলাম, ছাইড়া দে। দিলি না, এখন প্যারা খাইয়া জীবনটারে কালা করতেছিস।’
জাওয়াদের হাতে মুশরাফার জুতোর প্যাকেট। শপিংমলের পাশেই ক্যাফে। সোজা এদিকে এসেছে, গাড়ির দিকে যায়নি আর। জাওয়াদ প্যাকেট সাইডে রেখে বসল। সাদাফের কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকাল। তৎক্ষনাৎ উত্তর দিল না। ফুয়াদ ওর পাশে বসা ছিল। প্যাকেটটা দেখে ভ্রু কুঁচকাল।
‘জুতা নিছোছ? দেখা তো!’
বলে নিজেই খুলে দেখল। লেডিস শু দেখে বাঁকা চোখে তাকাল। কুটিল হেসে বলল,
‘ মাইয়্যা গো জুতা? কাহিনি কী মামা? এই জুতা কার? ‘
সাদাফ চট করে বলল, ‘ ওর হুজুরনী বউ তো এসব পরবে না। গাইয়্যা টাইপ মানুষ, এসব পরে না। নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ডের। শালা, নতুন মাইয়্যা পটাইছোস! বউ রাইখ্যা এসব করোস! অবশ্য, যা বউ, তা দিয়া তো জীবন চলবো না। গুড ডিসিশন । একটা কাজের কাজ করছোস।’
সাদাফকে খুশি দেখাল। জাওয়াদের একপাশে অনিক বসা। ও আড়চোখে তাকাল জাওয়াদের দিকে। দেখা যাক যাওয়া কী উত্তর দেয়। কিন্তু জাওয়াদের চোখে ভাবাবেগ রাগ নেই। অনিক যেন হতাশ হলো। তবে কি ওর মনের ভাবনা ভুল!
জাওয়াদ ঠিকঠাকভাবে বসে পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বলল,
‘ আজাইরা বকিস না। বিয়াত্তা পোলার জীবনে মাইয়্যা বলতে বউই থাকে। ওসব গার্লফ্রেন্ড টালফ্রেন্ডের দিন শেষ। জুতাও ওর।’
ফুয়াদ কুটিল হেসে বলল,
‘ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করো না বন্ধু। আমরা তোমারে চিনি, এত মাইয়্যার লগে প্রেম কইরা এখন হুজুরনি নিয়া জীবন কাটাবা,তা আমারে মাইরা পালাইলে ও আমি বিশ্বাস করুম না। নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ড আছে।’
জাওয়াদ বিরক্তিমাখা স্বরে বলল,
‘ না জেনে আজাইরা প্যাচাল মারিস না।’
সাদাফ বলল, ‘আজাইরা না হইলে বল, তুই এত কালা হইছস ক্যান? কিসের প্রেশার তোর? আর এই জুতা কার? সত্যি কইরা ক।’
জাওয়াদ নড়েচড়ে বসল। প্যাকেটটা ফুয়াদের হাত থেকে নিয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে বলল,
‘ কালা হইছি কারণ, কদিন আগে কক্সবাজার গেছি। রোদে ঘুরছি, সানব্লকে হইছে এমন। আর জুতা তার, যারে নিয়া কক্সবাজার হানিমুনে গেছি। এখন বলিস না প্লিজ, গার্লফ্রেন্ড নিয়া হানিমুনে গেছি। ‘
সাদাফ অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
‘ তুই মিথ্যা বলতেছিস। দেখি, তোদের দেখি ছবি দেখা তো!’
জাওয়াদ শান্ত চোখে বলল,
‘ ধার্মিক মেয়েরা শুধু স্বামীর জন্য রিজার্ভড হয়। স্বামী ছাড়া বাইরের কোন ছেলে দেখার অনুমতি নেই। সুতারাং, আমাদের ছবি দেখাতে পারছিনা। চাইলে আমার ছবি দেখতে পারিস। ‘
বলে ফোন থেকে কক্সবাজার তোলা ছবি দেখাল ওদের। ফুয়াদ অবিশ্বাস্য চোখে চাইল,
‘তোর বউ ঘুরে ও!’
জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল,
‘ ও আমার চেয়ে দক্ষ ট্রাভেলার। ‘
সাদাফ বলল, ‘ আমার জানামতে ইসলাম এত কিছু এলাও করেনা। ‘
জাওয়াদ হেসে বলল, ‘আমরা আসোলে ইসলামকে ভুলভাবে চিনি। আমরা মনে করি, একটা মানুষ ধার্মিক মানেই তার জীবনে শখ আহ্লাদ নেই, সে রসকষহীন কাঠখোট্টা একটা মানুষ। আমার ভাবনাও তেমন ছিল। কিন্তু এই সময় এসে মনে হচ্ছে, ইসলামকে আমরা যেভাবে দেখি ইসলাম তেমন নয়। ইসলামে সব জায়েজ, তবে হালাল পন্থায়। ঘুরাঘুরি, সাজগোজ, রোমান্টিকতা, হাসিঠাট্টা এসব ঠিক নিয়মে করলে নাকি গুনাহ তো হয়না, উলটো সাওয়াব হয়।’
থেমে বলল, ‘আর সাদাফ, ধার্মিক মানুষ সম্পর্কে তোর ধারণা একবারেই ভুল। ওরা সবকিছুতে ‘জায়েজ নেই’ বলে না। বরং সবকিছু যে পন্থায় জায়েজ তা বলে দেয়। এই যেমন, ট্রেডমিলে হাঁটা নিয়েও হাদিস শুনায়। না জেনে ভুল ইনফরমেশন দিছোস তুই আমারে।’
সবাই নিশ্চুপ হয়ে শুনল। জীবনে কখনো মসজিদের কাছ ঘেষতে না দেখা বন্ধুটিকে হঠাৎ ইসলামের বুলি আউড়াতে দেখে যারপরনাই অবাক হলো বন্ধুমহল। সবাই বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল। রবিন ও অবাক হয়ে বলল,
‘ এত প্রেম করে শেষ অবধি একটা ধার্মিক মেয়েকে নিয়ে সারাজীবন কাটাবি!’
‘ yeah! Because, I have met thousands of girls, but I have never seen such a wonderful personality before her . If she had come earlier in my life, I would have been addicted to one woman. ( হ্যাঁ! কারণ আমি হাজার মেয়ের সাথে মিশেছি, কিন্তু ওর আগে এত চমৎকার ব্যক্তিত্ব কারো মাঝে চোখে পড়েনি। সে যদি আমার জীবনে আগে আসতো তবে আমি এক নারীতেই আসক্ত হতাম) ‘
ধীর স্বরে কথাটা বলে আনমনেই হাসল জাওয়াদ। অনিক অবাক হয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইল। বিয়ের প্রথমকার স্ত্রীর প্রতি বিতৃষ্ণ সেই ছেলেটাকে আজ কোথাও খুঁজে পেল না , তার পরিবর্তে এক আদর্শ স্বামী ধরা পড়ল ওর চোখে। কী চমৎকার স্বীকৃতি!
ফুয়াদ সন্দিহান হয়ে তাকিয়ে বলল,
‘ যত যাই বলিস, তোর সাথে আলখাল্লা পরা পরা ধার্মিক কাউকে মানায় না। ইউ ডিজার্ভ ব্যাটার ওয়ান। ‘
জাওয়াদ হেসে বলল, ‘ আমি নই, সে আমার চেয়ে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে।’
বলে থামল। আকস্মিক ওর চোয়াল শক্ত হলো। রাগী গম্ভীর সুরে বলল, ‘ ওয়াইফ, লাইফ দুটোই আমার। আমাকে বুঝতে দে। মানাবে কি মানাবে না আমি বুঝব। তোদের এত পরামর্শ চাইনি আমি।
তোরা অন্যের বউ নিয়ে যদি আমার সামনে যে বাজে মন্তব্য করতে পারিস, তবে আমার বউ নিয়ে অন্যের সামনে ও বাজে মন্তব্য করতে পারবি। ছেলেদের এসব মন্তব্য থেকে বাঁচার জন্য হলেও আমার বউয়ের আলখাল্লা আমি সমর্থন করব। নেক্সট টাইম কেউ এই দুটোর একটাকে নিয়ে ও যদি কিঞ্চিৎ পরিমাণ বাজে মন্তব্য করিস তবে ফলাফল ভালো হবে না।’
বলে কঠিন চোখে ফুয়াদ আর সাদাফের দিকে তাকাল। এই কঠিন ছেলেটাকে দেখেই আরেক দফা অবাক হলো সবাই। কী অধিকারবোধ! চোখই ওর স্বামী হওয়ার স্বীকৃতি দিচ্ছে। সাদাফ, ফুয়াদ ভীত ঢোক গিলল। দ্বিতীয়বার হয়তো কথা বলার সাহস পাবে না।
অনিক আকস্মিক হেসে ফেলল। হো হো করে হেসে বলল,
‘শালা, তুই তো পুরা গেছোস।’
জাওয়াদ স্বর স্বাভাবিক করে বলল, ‘তুই বিয়ে করে তুই ও যা। ‘
থেমে বলল, ‘ধার্মিক মেয়ে বিয়া করিস। লাইফ সেট। ‘
অনিক আগ্রহী গলায় বলল, ‘আগ্রহ ছিল না। তোরে দেখে আগ্রহ বাড়ছে। এবার করতে হবে। ‘
জাওয়াদের মেজাজটা আকস্মিক ত্যক্ত হয়ে গেল। ক্ষণে ক্ষণে রাগ বাড়ছে, রাগে গা কাঁপছে। আড্ডায় যোগ দিতে পারল না। কিছুক্ষণ বসে উঠেই গেল। বন্ধুরা বলল,
‘কিরে, চলে যাচ্ছিস কেন?’
জাওয়াদ গম্ভীরমুখে বলল, ‘আরেকদিন আমার ব্যক্তিগত জীবন ছাড়া অন্য কিছুর আলাপ নিয়ে আড্ডা বসিয়ে ডাকিস, আমি খোশমেজাজে এসে যোগ দিব। আজ যাই। মেজাজটাই খারাপ করে দিলি শালা।’
•
ঘড়ির কাটায় রাত ন’টা। দু’হাত ভর্তি ফলমূল মিষ্টি কিনে হাজির হলো মামা শ্বশুরের বাসায়। জয়নাল আবেদীন বিয়ের পর একদিন আসার সময় বলেছিলেন, ‘কখনো খালি হাতে শ্বশুর বাড়িতে যাবি না। টাকা না থাকলে দেরিতে যাবি, কিন্তু তাও দু’হাত ভরে বাজার করে নিয়ে যাবি। নাহলে, জামাইর দাম থাকে না।’
আসার সময় বাবার কথা মনে পড়ল। মেজাজ তখনো তুঙ্গে। বেল বাজানোর পর দরজা খুলল মুশরাফা। চমৎকার হেসে মিষ্টি কন্ঠে সালাম দিল,
‘আসসালামু আলাইকুম।’
সালামের অদ্ভুত একটা ক্ষমতা আছে। সালাম যে কারো মুখে হাসির রেখা টানতে পারে। হুটহাট কাউকে সালাম দিলে, রাগের সময় ও হেসে ফেলে। রাগ চলে যায়। সালাম দিলে পরিবারে কল্যান আসে। সালামের মাধ্যমে ভালোবাসা তৈরি হয়। অহংকার চলে যায়। সাওয়াব হয়। কত উপকার দিক সালামের ! জাওয়াদের এই রাগমাখা মনে হঠাৎ শীতল হাওয়া বয়ে গেল। কপালের ভাজ মিলিয়ে গেল। দৈবাৎ হেসে ফেলল ও, আনমনে, অজান্তে।
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কী খবর আপনার? যাওয়ার আশা টাশা নেই?’ শান্ত স্বাভাবিক স্বরে বলল জাওয়াদ। সোফার দিকে এগুলো সে।
মুশরাফা ওর হাত থেকে প্যাকেট নিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর রাখল। তারপর দরজা লাগিয়ে এসে পাশে বসল। বলল,
‘আমি যাব, ভেবেছি। মামী তো শুনতেই নারাজ। কোনভাবেই যেতে দিবেন না। আমরা আজ থাকি?’
জাওয়াদ সোফায় হেলান দিয়ে বসে ধীর স্বর বলল,
‘ আপনি যদি আপনার শ্বাশুড়ির কাছ থেকে অনুমতি নিতে পারেন, তবে থাকেন। আমার কোন আপত্তি নেই। আমার কাল অফিস আছে। আমি থাকতে পারব না।’
‘ আমি থাকলে আপনি ও থাকবেন। আপনার মতো আমি ও আপনাকে ছাড়া থাকতে পারব না। ‘ ঠোঁট টিপে হেসে বলল। জাওয়াদ কিছু বলতে গেল। তার আগে ফরিদা চলে এলেন। কুশল বিনিময় করলেন। যাওয়ার কথা বলতেই, তড়িৎ নিষেধ করলেন। কোনভাবেই এই রাতের বেলা মেয়েকে যেতে দিবেন না তিনি। নাজমুল সাহেব নামাজে গিয়েছিলেন। তিনি ফিরে ও জোর করলেন। অগত্যা জাওয়াদকে থাকার জন্য রাজি হতে হলো। এখন কথা হলো মাকে রাজি করাবে কিভাবে!
জাওয়াদ চিন্তায় পড়ে গেল। রাতের খাবার খেয়ে রুমে যাওয়ার পর মুশরাফাকে বলল,
‘তোমার শ্বাশুড়ির কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছো? কাল কিছু বললে আমার কাছে কাঁদতে আসবে না।’
মুশরাফা চোখ ছোটো ছোটো করে বলল, ‘আমি আপনার কাছে কাঁদতে গেছি কখন ও! আমার কান্না আমি আল্লাহকে ছাড়া কাউকে দেখাই না।’
জাওয়াদ বিড়বিড় করে বলল, ‘এই কারণেই আমি ভেঙে চুরমার হচ্ছি।’
মুখে বলল, ‘আসতে কতক্ষণ! ‘
‘ আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে কাঁদা মানে তার সামনে নিজেকে দুর্বল প্রমাণ করা। আল্লাহ ছাড়া কেউ সেই কান্নার সঠিক মানে ধরতে পারেনা, সঠিক মূল্য দিতে পারেনা। তাই আমি দোয়া করি, আল্লাহ যেন আমাকে কারো সামনে কাঁদিয়ে দুর্বল প্রমাণ না করুক।’ ধীর স্বরে বলল মুশরাফা। কথাগুলো মনোমুগ্ধকর। জাওয়াদ শুনল। মনে মনে বলল, ‘এই জন্যই তোমাকে স্ট্রং পার্সোনালিটি বলা হয়।’
প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘যাক গে, এখন শ্বাশুড়িকে কল দাও। ‘
মুশরাফা দূরে ছিল। কাছে এলো। গা ঘেঁষে বসল। হাত ধরে কোমল স্বরে বলল,
‘আমি আর আপনি কি আলাদা? আমি দিলে যে কথা আপনি দিলে ও এক কথা। ‘
জাওয়াদ বাঁকা হেসে বলল, ‘ সুন্দর কথা বলে লাভ নেই। আমি পটছিনা। মাকে ফোন তুমিই করবেন। না হলে, কাল গিয়ে আমি মাকে বলল, তুমি আমাকে চিনি গোলা খাইয়ে রেখে দিয়েছো।’
বলা বাহুল্য, চিনি গোলা তাবিজ পড়ার মতো।
মুশরাফা রাগ রাগ মুখে বলল, ‘আমার ভবিষ্যত বাচ্চার বাপ বলে আপনাকে কিছু বলতে পারছি না। নয়তো কঠিন একটা কথা মনে আসছে।’
জাওয়াদ মজা পেল। হো হো করে হেসে ফেলল। বলল,
‘কী কথা বলো, আমি বাচ্চাদের বলব না। ‘
‘কথা নাই আপনার সাথে। ‘ মিচে রাগের ভান করে বারান্দায় চলে গেল মুশরাফা। জাওয়াদ আনমনেই হাসল। নিজের ফোন রেখে ওর ফোন পকেটে নিয়ে নিল। তারপর বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
‘ আমি চলে যাচ্ছি। দরজা লক করে দাও।’
‘কোথায় যাচ্ছেন!’ আঁতকে উঠল মুশরাফা। জাওয়াদ কাতরতার ভান করে বলল,
‘ তুমি তো অনুমতি নিতে পারলেনা। মা কষ্ট পাবেন। পরের মেয়ে হয়ে আমার মায়ের কষ্ট তুমি বুঝবে না, ছেলে হয়ে আমাকেই বুঝতে হবে। তাই চলে যাচ্ছি।’
মুশরাফার চেহারায় অনুতাপের ছায়া, ‘স্যরি। আচ্ছা, আমি ফোন দিচ্ছি। আপনি বসুন।’
মুশরাফা নিজের ফোন খোঁজায় মন দিল। জাওয়াদ হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেল। অনিকের বাসায় গিয়ে বলল, ‘আমার ফোনে চার্জ নেই। তোর ফোন থেকে মাকে কল দে তো!’
অনিক কল দিল। জাওয়াদ ধরে কথা বলল,
‘মা আমার ফোনে চার্জ নেই। আমি এখনো অনিকদের সাথে আছি। কখন যাব ঠিক নেই। রাত বিরাতে মামার বাসায় গিয়ে মুশরাফাকে নিয়ে ওই বাসায় যাওয়া ঠিক হবে না। এদিক ওদিক হলে মামা সোজা মামলা টুকে দিবেন। তাই বলছি কি, ও ওর মামার বাসায় থাকুক। আমি কাল সকালে ফিরে ওকে বাসায় পৌঁছে দিই। এতে তোমার কোন আপত্তি আছে?’
জাওয়াদ অনুমতি চাইল। অনিকের ফোন থেকে কল করায় মায়মুনা বিশ্বাস করলেন, ও এখনো আড্ডায় আছে। রাত এগারোটা পেরিয়েছে। কখন ফিরবে তার ঠিক নেই। এত রাতে বের হওয়া ঠিক হবে না। পরের মেয়ে, কিছু হলে দোষ এসে ঘাড়ে চাপবে। তাই ছেলের কথা মেনে নিলেন, ‘আচ্ছা। সাবধানে থাকিস। ‘
জাওয়াদ হাফ ছেড়ে ফোন রাখল। অনিক ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ কাহিনি কী?’
জাওয়াদ চাপা শ্বাস ফেলে বলল, ‘বিশ্বাস কর ভাই, বউ আর মা দুজনের মন রক্ষা করতে গিয়ে আমি যত বুদ্ধি খাটাচ্ছি, এত বুদ্ধি যদি ছাত্রজীবনে পড়ালেখার পেছনে খরচ করতাম, তাহলে এতদিনে আমি পড়ালেখাবিদ হয়ে যেতাম। ‘
অনিক ঠোঁট চেপে হেসে বলল, ‘এর পর ও আমাকে বিয়ে করতে বলছিস!’
‘ সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে বাসার দরজায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে চমৎকার হেসে সালাম দিয়ে ক্লান্তিকর অনুভূতি ঝট করে দূর করানোর জন্য হলেও বিয়ে করে বউ আনা উচিত তোর। এক টুকরো অনুভূতির জন্য ওমন এক আধটু বুদ্ধি খরচ করলে লাভ বৈ ক্ষতি হবে না। বিয়া কর।’ বন্ধুর কাধ চাপড়ে বলল জাওয়াদ। তারপর বিদায় নিয়ে ফিরল।
মুশরাফা ফোন খুঁজে হয়রান। ফোন ও নেই জাওয়াদ ও নেই। অনেকক্ষণ পর কারো ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। খুঁজে দেখল জাওয়াদের ফোন। স্ক্রিনে ‘রাফা’ লেখাটা ভাসছে। ওর ফোন জাওয়াদের কাছে! অবাক হয়ে ফোন ধরল। সালাম দিয়ে বলল,
‘আমার ফোন আপনার কাছে! আমি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। আর আপনি ওমন করে চলে গেলেন কেন? আমার চিন্তা হচ্ছিল।’
জাওয়াদ শব্দ করে হেসে দিল। হাসিটা ফোনের সাথে সাথে আশপাশ থেকে ও আসছে। উৎস খুঁজে মুশরাফা পিছু ঘুরল। লোকটা উধাও হয়ে আবার এসেছে! জাওয়াদ হেসে বলল,
‘ এটা আমাকে ইগ্নোর করে বারান্দায় যাওয়ার শাস্তি। আর যাবে?’
মুশরাফা ফোন কেটে অবাক হয়ে বলল, ‘আপনি ইচ্ছে করে ফোন নিয়ে গেছেন!’
জাওয়াদের হাসির শব্দ বাড়ল। বেশ মজা পাচ্ছে, তা ওর হাসিতে বুঝা গেল। বলল, ‘তোমার জানা উচিত, আমি মানুষটা খুব একটা সহজ না। আমাকে ইগ্নোর করলে আমি ছেড়ে দিই না।’
জাওয়াদের প্রাণবন্ত হাসিতে মুশরাফা আসল জাওয়াদকে খুঁজে পেল। জেরিনের বলা সেই জাওয়াদ, যে প্রাণবন্ত, রসিক। সে ফিরে এসেছে! মুশরাফা বিস্ময়ের সাথে সাথে খুশি ও হলো। অবশেষে!
সকালে অফিস যাবার আগে মুশরাফাকে বাসায় নামিয়ে দিল জাওয়াদ। সন্ধ্যা অফিস থেকে ফিরে ট্রেডমিল বের করল। মুশরাফা দেখে হাসল। ওর হাসি চওড়া হলো যখন জাওয়াদ জুতোর প্যাকেট ওর দিকে বাড়িয়ে বলল,
‘ পরে দেখো সাইজ ঠিক হলো কি না।’
মুশরাফা প্যাকেট খুলে চমকে গেল। জাওয়াদ ওর চমকানো মুখ দেখে হাসল। সুখের মাঝে আকস্মিক মায়ের চিৎকার ভেসে এলো। তড়িঘড়ি করে গিয়ে দেখা গেল, মায়মুনা স্লিপ খেয়ে বাথরুমে পড়ে গেছে। অবস্থা বেগতিক।
চলবে…