#স্বর্ণাভ_সুখানুভূতি। (৩৫ তথা অন্তিম পর্ব)
আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা
নিজের ঘর, কিচেন গুছিয়ে শ্বাশুড়ির কাছে গেল মুশরাফা। শ্বাশুড়ির রুম ও গুছালো। মায়মুনার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। মুশরাফা বলল,
‘আপনার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। আমি তেল দিয়ে আঁচড়ে দিই, মা?’
মায়মুনা ছেলের উপর বিরক্ত হলেন। ছেলে কেন ওকে নিষেধ করল না। তিনি বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘লাগবে না। ‘
মুশরাফা জোর করল না। মায়মুনা এখনো ওকে পছন্দ করেন না। এখন জোর করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। মুশরাফা রুমে চলে গেল। খানিক বাদে কুরআন শরীফ নিয়ে ফিরে এলো। বলল,
‘আপনার এখানে বসে কুরআন পড়লে, আপনার কোন অসুবিধা হবে?’
মায়মুনা নিজের স্বর বজায় রেখে বললেন, ‘নিজের রুমে যাও।’
‘ আপনাকে একা রেখে যাবো! বাসায় কেউ নেই। আমি ও যদি চলে যাই, তবে আপনার কিছুর দরকার হলে দেয়া যাবে না। তারচেয়ে বরং আমি এখানে বসি, নিঃশব্দে পড়ব। আপনার কোন সমস্যা হবে না। আপনার কিছু দরকার হলে আমাকে ডাক দিয়েন।’ ভয়ে ভয়ে কথাগুলো বলে থামল মুশরাফা। মায়মুনা তৎক্ষনাৎ কিছু বললেন না। রয়েসয়ে বললেন,
‘এই অবেলায় কিসের কুরআন পড়া?’
‘সকালে সময় পাই নি মা। আর কুরআন পড়ার তো নির্দিষ্ট সময় নেই। যখনতখন পড়া যায়।’ ধীর স্বরে বলল মুশরাফা। সকাল সকাল উঠেই আজ কাজে লেগে পড়েছিল। ওর চেহারায় ভাসা ক্লান্তির চাপ মায়মুনাকে ওর কথা বিশ্বাস করাতে বাধ্য করল। তিনি নিশ্চুপ রইল।
মুশরাফা চেয়ারে বসে কুরআন পড়তে লাগল। মায়মুনা চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কখন ঘুমিয়ে গেলেন টের পেলেন না। ঘুম ভাঙল মুশরাফার ডাকে। নামাজের জন্য ডাকছে। বালতি ভরে পানি নিয়ে এসেছে। যেহেতু শুধু পা নাড়াতে পারবেন না। তালুতে পানি লাগাতে পারবেন, পানিতে তার সমস্যা নেই, সেহেতু তিনি তায়াম্মুম করতে পারবেন না। মুশরাফা নিজ উদ্যোগে অযু করিয়ে দিল। পা মেলে বসে নামাজ পড়ার নিয়ম শিখিয়ে দিল। মায়মুনা নামাজ পড়েন। তাই দ্বিরুক্তি করলেন না। পড়ে নিলেন। তারপর মুশরাফা খাবার নিয়ে এলো। মায়মুনার হাত সচল থাকার পরও মুশরাফা সব করল। গ্লাসে পানি ঢেলে দিল, বক্স থেকে ওষুধ নিয়ে হাতে দিল। সারাবেলা শ্বাশুড়ির সেবায় কাটাল।
সন্ধ্যায় জাওয়াদ ফিরল। মুশরাফা দরজা খুলে সালাম দিল। উত্তর নিয়ে জাওয়াদ বলল,
‘সব ঠিকঠাক? শ্বাশুড়ির বকা টকা পড়েছে?’
মুশরাফা হেসে বলল,
‘ বকা টকা পড়েনি। সব চকচকে।’
জাওয়াদ হাফ ছাড়ল। ফ্রেশ হতে রুমের দিকে পা বাড়াল। মুশরাফা বলল,
‘ আগে মাকে দেখে আসুন। তারপর রুমে যান।’
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল, ‘আগে রুমে গেলে কী হবে?’
মুশরাফা ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
‘মায়ের ধারণা জন্মাতে পারে, আপনি বউ পেয়ে অসুস্থ মাকে ভুলে গেছেন। তাই আপনার আগে মায়ের সাথে দেখা করা উচিত।’
স্ত্রীর কাছে মায়ের প্রাধান্য পাওয়ার কথাটা একটা ছেলের জন্য সুখকর। আজকাল শ্বাশুড়িকে শত্রুভাবা বউয়ের সমাজে এমন কথা ক’জন ছেলে শুনে? জাওয়াদ মনে মনে নিজের ভাগ্যের তারিফ করল। ওর বউভাগ্য চমৎকার। জাওয়াদ কৌতুকের সুরে বলল,
‘ এত খুশি হওয়ার কিছু নেই। যত যাই হোক আমি মাকে ভুলছিনা। বলে না? বউ গেলে বউ পাওয়া যায়, কিন্তু মা গেলে মা পাওয়া যায় না। ‘
মুশরাফা ও হেসে বলল, ‘আমি ও ভুলতে বলছি না। মা তো মা’ই হয়। তার সাথে কারো তুলনা হয়? হয়না। বউয়ের সাথে তো নয়ই। কোন বুদ্ধিমান পুরুষ, স্ত্রীকে মায়ের সাথে তুলনা করে না। কারণ একটা শ্রদ্ধার, আরেকটা ভালোবাসার। একজন তার মা, একজন তার সন্তানের মা। দুজনই জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দুজনকেই জীবনে দরকার, একসাথে পাশাপাশি। কাউকে ফেলে নয়, দুজনকেই রেখে। তবেই জীবন সার্থক।’
জাওয়াদ শুনল বুঝল ও। হাসল কেবল। তারপর মায়ের রুমের দিকে এগুলো। মায়ের পাশে বসে জিজ্ঞেস করল,
‘ আসসালামু আলাইকুম মা।’
মায়মুনা অবাক হলেন। ছেলে তো তাকে সালাম দেয়না। ‘বেয়াদব’ ট্যাগ নিয়ে বড়ো হওয়া ছেলেটার মুখে নীতিবাক্য ফুটেনি কখনো। আজ হঠাৎ সালাম দেয়ায় চমকে তাকালেন। হেসে উত্তর নিলেন,
‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম। অফিস থেকে এসে ফ্রেশ হস নি কেন?’
‘ভাবলাম আগে তোমাকে দেখে যাই। তাই সোজা এখানে এসেছি। এবার বলো কী অবস্থা তোমার?, এখন শরীর কেমন? ব্যাথা কমেছে? ‘
ছেলের প্রাধান্যতা পেয়ে খুশি হলেন মায়মুনা। বললেন, ‘ আগের থেকে কমেছে।’
মায়ের মুখে ভাসা খুশিটা দেখল জাওয়াদ। এর মাঝে কোথাও মুশরাফার কথার মিল পেল। সে হাসল। মায়মুনা নিজ থেকেই বললেন,
‘তোর বউ সারাদিন জ্বালিয়েছে। নিষেধ করিস নি কেন?’
‘ আমি তো ওকে বলেছি। ও না শুনলে কী করার বলো?’ জাওয়াদ বিরস স্বরে বলল। মায়মুনা কড়া স্বরে বলল,
‘কেমন বেয়াদব, স্বামীর কথা শুনে না। ধমকে বলবি। শাসন করলে ঠিক শুনবে।’
জাওয়াদ মায়ের আরও কাছে গিয়ে ধীর স্বরে বলল,
‘ভয় পাই, কিভাবে ধমকাব?’
মায়মুনা চোখ কপালে তুললেন, ‘ ছোটোবেলা থেকে এত শাসন, এত মারের পরে ও তুই তোর বাবাকে ভয় পেলিনা, আমাকে ভয় পেলিনা। অথচ সেই তুই বিয়ে করে দুইদিনের বউকে ভয় পেতে শুরু করেছিস! এটাও বিশ্বাস করতে বলছিস আমায়?’
জাওয়াদের স্বর নরম হলো, ‘আমি ওকে ভয় পাই না। ওর আল্লাহকে ভয় পাই। ওর সাথে যখন কেউ খারাপ ব্যাবহার করলে ও প্রতিত্তোর করে না। তোমার কথা গিয়ে আমার কাছে অভিযোগ করে না। নিরবে সহ্য করে। তারপর তাহাজ্জুদ পড়ে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করে।
শুনেছি মানুষ যখন তার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার নিজে না করে আল্লাহর কাছে দেয়। তখন আল্লাহ স্বয়ং ওকে নিজের জিম্মায় নেয়, এবং তার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার করে। ও সেটাই করে। আমার ভয় হয়, ওর দোয়া যদি কবুল হয়ে যায়?আল্লাহ যদি আমাদের শাস্তি দেন, তখন কোথায় যাবো আমরা। তাই আমি ভয় পাই। ‘
মায়মুনা বিরক্তিঘন স্বরে বললেন, ‘আল্লাহ কী ওর একার? আল্লাহ তো সবার। ও আমাদের সাথে যা করছে তাতে আমরাও ওর বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতে পারি। ‘
জাওয়াদ খানিক ভেবে বলল, ‘আচ্ছা বলো তো, আমাদের ভাইবোনদের মাঝে বাবার সবচেয়ে পছন্দের সন্তান কে? ‘
মায়মুনা উত্তর দিতে সময় নিলেন না, ‘যায়েদ। ‘
‘কিসের ভিত্তিতে?’
‘কারণ যায়েদ ছোটোবেলা থেকে আমাদের বাধ্য সন্তান। আমাদের সব কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে আসছে সে। ‘
জাওয়াদ হাসল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘এই জন্যই ছোটোবেলায় ভাইয়া মুখ ফুটে কিছু চাইলে তোমরা সাথে সাথে হাজির করতে, তাইতো?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু এসবের মাঝে ওকে টানছিস কেন?’ মায়মুনা ভ্রু কুঁচকালেন।
জাওয়াদ হেসে বলল,
‘ তোমরা বাবা মা। আমাদের চার ভাইবোনকেই পৃথিবীতে এনেছো। লালন পালন করেছো। তাও আমাদের সবার মাঝে সেই সবচেয়ে পছন্দের যে তোমাদের অনুগত। যে তোমাদের কথা শুনেছে, তোমরাও তার কথা শুনেছো। তো ভাবো, আল্লাহ তো আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। একটা উদ্দেশ্য নিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। আল্লাহর সেই উদ্দেশ্য সবাই পূরণ করে না, সবাই আল্লাহর বিধান মানে না। সৃষ্টি কিন্তু সবাইকে করেছেন। মানে কেবল গুটিকয়েক মানুষ। যারা মানে তারাই আল্লাহর পছন্দের বান্দা। এখন পছন্দের বান্দা কিছু চাইলে আল্লাহ যত তাড়াতাড়ি কবুল করবেন এটাই স্বাভাবিক। আর তার বিধান অমান্যকারীর দোয়া তো তত তাড়াতাড়ি কবুল হবে না। মুশরাফা আল্লাহ সব বিধান মানে। আমরা কটা মানি?’
মায়মুনা সারসংক্ষেপ বুঝতে পারলেন। তারপর বললেন,
‘ আমরাও মানি। তোর বউ বেশি বাড়াবাড়ি করে। আমরা আল্লাহকে এগুলো বলতে পারি না? ও যে বেয়াদবি করে?’
জাওয়াদ চাপা শ্বাস ফেলল। বলল,
‘পারো। তার আগে বলো, মুশরাফা তোমার অপছন্দ হওয়ার মূল কারণটা কী?’
মায়মুনা বিরক্ত মাখিয়ে বললেন, ‘তুই কি বউয়ের তরফদারি করতে এসেছিস!’
‘না, মা। আমি কারো তরফদারি করতে আসিনি। শুধু চাইছি তোমাদের মধ্যকার সমস্যাটা যাতে মিটে যায়। ‘ জাওয়াদ ধীর স্বরে বলল। মায়মুনা রেগে তাকালেন, ‘ওই মেয়েকে আমার না আজ পছন্দ, আর না কখনো পছন্দ হবে। কোন সমস্যা সমাধান হওয়া লাগবে না। ‘
‘কারণটা তো বলো!’ জাওয়াদ অনুরোধ করল। মুখে বিতৃষ্ণা ফুটিয়ে মায়মুনা উত্তর দিতে গেলেন। সেই ক্ষণে রুমের দরজায় এসে দাঁড়াল মুশরাফা। খোলা দরজায় নক দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকাল,
‘দাঁড়িয়ে আছো কেন?’
‘আসবো?’
‘ অনুমতি নিতে বলেছে কেউ?’
মুশরাফা হেসে বলল,
‘আমার রাসূল বলেছেন, ‘ অনুমতি চাইতে হবে তিনবার, যদি অনুমতি দেয় তবে ঘরে প্রবেশ করবে নতুবা ফিরে যাবে।’ (বুখারি, মুসলিম)’
মায়মুনা মুখ কুঁচকাল। জাওয়াদ চমৎকার হেসে বলল, ‘আসো। ‘
মুশরাফা কয়েল হাতে ভেতরে এলো। কয়েল রেখে মায়মুনার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আপনার কিছু লাগবে মা?’
মায়মুনা উত্তর দিলেন না। জাওয়াদ তাকাল ওর দিকে। বলল, ‘মায়ের কিছু লাগলে আমি আছি। তুমি যাও, আমার জন্য কফি নিয়ে আসো।’
মুশরাফা চলে গেল। মায়মুনা ওদের পরখ করে বিরক্তিঘন স্বরে বলল,
‘তুই এই মেয়েকে মেনে নিয়েছিস!’
জাওয়াদ সে কথার উত্তর দিল না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘কোথায় ছিলাম আমরা? ও হ্যাঁ ওকে অপছন্দের কারণে। তোমার কারণটা আমিই বলি। ওকে অপছন্দ করার কারণ হলো ওর পর্দা তাই তো? ‘
মায়মুনা বললেন, ‘সংসারে পা রেখে ও যা শুরু করেছে তাতে কারইবা পছন্দ হবে। ‘
‘ওর কাজগুলোকে বিশ্লেষণ করি। প্রথমত, ও বোরকা পরে এসেছে। এটা কিন্তু পর্দার অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম নারীকে পর্দা করে চলতে বলেছে।’
‘তাই বলে বিয়ের দিনও? মায়মুনার স্বরে ক্ষণে ক্ষণে বিরক্তি বাড়ছে।
জাওয়াদ বলল, ‘আমি পর্দা সম্পর্কে পড়েছি। জানতে পেরেছি, ইসলামে নারীদের মাহরাম বা যাদের সাথে দেখা দেয়া জায়েজ তাদের সংখ্যা ১৪জন বলা হয়েছে। তারা হলো, বাবা, চাচা, মামা, শ্বশুর, সহদর ভাই, নিজ দাদা, নিজ নানা, নিজ নাতি
দুধ-ভাই, ছেলে, ভাই-এর ছেলে, বোনের ছেলে, মেয়ের জামাই, দুধ-ছেলে। এই ১৪জন ছাড়া কারো সাথে দেখা দেয়া হারাম। এটা ইসলাম বলেছে। বিয়ের দিন যেহেতু বাইরের অনেক ছেলে ছিল তাই ওর পর্দা করাটা বাধ্যতামূলক। ও আল্লাহর বিধান মেনেছে। তাই এখানে ভুল ধরে আল্লাহর কাছে অভিযোগ করা কি ঠি হবে?’
‘ইসলাম এত বাড়াবাড়ি করতে বলেনি। পর্দার কথা বলেছে ঠিকই? বাইরের মানুষের সাথে। ঘরের মানুষের সাথে কিসের পর্দা?’
জাওয়াদ চাপা শ্বাস ফেলে বলল, ‘মাহরামের তালিকায় কিন্তু দেবর নেই। মুশরাফা জিশানের সাথে দেখা দিবে না বলে গাইগুই করল, তখন তোমার মতো আমি ও বিরক্ত হয়েছি, কয়েকবার রেগে ধমক ও দিয়েছি। কিন্তু তারপর একদিন কৌতুহলী হয়ে এই ব্যাপারে ইন্টারনেটে সার্চ করলাম যে, ইসলাম কি আসোলেই দেবরের ব্যাপারে এত কঠোর হতে বলেছে না কি! সার্চ করার পর আমি কি জানতে পারলাম জানো?’
মায়মুনা আগ্রহ নিয়ে বললেন, ‘কী?’
জাওয়াদ পকেট থেকে ফোন বের করে বলল, ‘আমি বললে হয়তো তোমার বিশ্বাস হবে না। তুমি নিজেই দেখো।’
বলে দেবর সম্পর্কে এক স্কলারের বক্তব্য তুলে ধরল। যিনি রেফারেন্স সহ কথা বলছেন। মায়মুনা দেখলেন, পড়লেন, শুনলেন। যেখানে বলা হচ্ছে, দেবরকে মৃত্যুর মতো ভয় করতে বলা হয়েছে। তার কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখতে বলেছেন।
রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মহিলাদের নিকট একাকী যাওয়া থেকে বিরত থাক। এক আনসার জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহ্র রসূল! দেবরের ব্যাপারে কি হুকুম? তিনি উত্তর দিলেন দেবর হচ্ছে মৃত্যুতুল্য। [মুসলিম ৩৯/৮, হাঃ ২১৭২, আহমাদ ১৭৩৫২] (আধুনিক প্রকাশনী- ৪৮৪৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৪৮৫২)’
মায়মুনা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলেন। জাওয়াদ বলল,
‘সেই সাথে বলা হয়েছে, পর্দার ব্যাপারে স্বামী বাবা মা কেউ বাধা দিলেও তাদের কথা মানা যাবে না। তারা এ ক্ষেত্রে কেউ না। পর্দা ফরজ। এটা মানা লাগবে। এমনকি কেউ যদি বাধা দেয়, তবে তাদের শাস্তি হবে।
এর মাঝে জিশানের সাথে দেখা না করার হুকুম আল্লাহ দিয়েছেন ওকে। ও শুধু মেনেছে। ও আল্লাহর বিধান মেনেছে বলেই আমাদের কাছে শত্রু হয়েছে। আমরাই বরং ওকে বাধা দিয়েছি। আমরা গুনাহের কাজ করেছি, আমরাই ভুল পথে আছি। একে তো আল্লাহর বিধান মানছি না। আবার অন্যকে ও মানতে দিচ্ছি না। ইসলামের বিধানকে সম্মান করতে হবে, সম্মান করতে না পারলেও অসম্মান করতে পারবে না। আমরা অসম্মান করছি। এত কিছুর পরও তোমার মনে হয়, আল্লাহ ওর বিরুদ্ধে আমাদের কোন অভিযোগ নিবেন?’
মায়মুনা চুপ রইলেন। জাওয়াদ বলল, ‘আজ অবধি ও তোমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেছে?’
মায়মুনা উত্তর দিতে পারলেন না। ভেবে দেখলেন, আসোলেই তিনি একাই বলে গেছেন, এই মেয়ে কোন প্রতিত্তোর করেনি। জাওয়াদ বলল,
‘মুশরাফা তোমার বিরুদ্ধে আমার কাছে একটা অভিযোগ ও করেনি। জিহান বলতো তুমি ওকে বকেছো, ও কখনোই বলতো না। তোমার প্রতি ওর রাগ ও নেই। কাল তোমাকে হাসপাতালে নেয়ার পর ও সেজদায় লুটে তোমার সুস্থতার জন্য কেঁদেছে, এত কিছুর পর ও দিনরাত জেগে তোমার সেবা করছে। পর্দার ব্যাপার বাদ দিয়ে এতসবের মাঝে তোমার কোথাও ওকে খারাপ মনে হচ্ছে?’
মায়মুনা এবার ও চুপ রইলেন। তার মুখের রঙ পালটে গেছে। জাওয়াদ খুশি হলো। মৃদু হাসির রেখা ফুটল ওর মুখে। মায়ের হাত ধরে বলল,
‘ ওকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। মানুষ হিসেবে খারাপ না ও। জাস্ট কয়েকদিন ওকে তোমার কাছে রাখো মা। কাছ থেকে দেখো। তারপর যদি তোমার চোখে ওকে খারাপ মনে হয়, তবে আমি আর কখনো ওকে তোমার সামনে পাঠাব না। তোমাদের দুজনের মাঝেই আমার সুখ আটকে আছে। আমি তোমাদের দুজনকে একসাথে, হাসিখুশি দেখলেই সুখী হবো। সারাদিন অফিস থেকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে একজনকে রেগে থাকতে দেখলে আমার ক্লান্ত মনটা মলিন হয়ে যায়। আমার খারাপ লাগে। আমি তোমাদের উপর খুশি, আমি চাই তোমরা একে অপরের উপর খুশি হও। মা, পর্দাকে আল্লাহর বিধান ভেবে সম্মান করো। ওকে সম্মান করো। একটু নরম চোখে তাকিয়ে দেখো, ওকে তোমার আপন লাগবে। সবচেয়ে সুন্দর মানুষ হিসেবে পাবে তুমি। প্লিজ মা!’
জাওয়াদ আকুতি করল। ওর ক্লান্ত মুখখানায় অনুরোধের আভা। চোখে আশা, স্বপ্ন, সুখ, বিষন্ন সব মিলেমিশে একাকার। মায়মুনা ছেলের চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা ও দেখতে পেলেন। স্ত্রীর জন্য সম্মান ও দেখতে পেলেন। তার বাউণ্ডুলে ছেলেটাকে আজ অন্য রূপে দেখলেন। এ যেন একজন দায়িত্বশীল স্বামী, আদর্শ সন্তান রূপে উদয় হলো অন্য এক জাওয়াদ। এই ছেলেটা বড্ডো অচেনা তার। জয়নাল আবেদীন থেকে শুনেছেন, জাওয়াদ এখন নিয়মিত নামাজ পড়ে, সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে, রাত করে বাড়ি ফিরে না। অযথা টাকা খরচ করে না। ভালো হয়ে গেছে ছেলে। জয়নাল আবেদীন বলেছিলেন, একটা ভালো মানুষের সংস্পর্শে থাকলে মানুষ ভালো হতে বাধ্য। মেয়েটা দায়িত্ববান। ওর সাথে থেকেই কি ছেলেটা দায়িত্ববান হয়েছে? তার এত অমুল পরিবর্তনের কারণ ও কি ওই মেয়ে?
আরেকটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিয়েছে, ‘মেয়েটাকে কি আমি খারাপ ভাবলাম? মেয়েটা কি আসোলেই এমন?’
মায়মুনা ভাবুক হলেন। জাওয়াদ মাকে ভাবনায় ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল,
‘আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।’
বলে বেরিয়ে গেল। মুশরাফাকে ডেকে বলল, ‘ আজ রাতে মায়ের সাথে থাকো।’
মুশরাফা থাকল। মাঝরাতে এর কান্নার আওয়াজে ঘুম ভাঙল মায়মুনার। পর্যবেক্ষণ করে ছেলের কথার সত্যতা পেলেন। ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হলো তার, এই প্রথম। তিনি নিশ্চুপ চেয়ে রইলেন। যখন নিজের কৃতকর্ম ভাবলেন তখন আরও অনুতাপ হলো তার। একটা ভয় কাজ করল তার মনে। ওকে জানতে দিলেন না।
•
সকালে জাওয়াদ নাস্তা করতে গিয়ে টেবিলে বসল না। প্লেট হাতে নিয়ে মায়ের রুমে গেল। মাকে সালাম দিল। মায়মুনা হেসে উত্তর দিলেন। জাওয়াদ জিজ্ঞেস করল,
‘নাস্তা করেছো মা?’
মায়মুনাকে একটু আগেই মুশরাফা নাস্তা করিয়ে গেছে। তিনি বললেন,
‘করেছি। সবার খাওয়া শেষ? ‘
‘ সবাই বসেছে টেবিলে। খাওয়া চলছে।’ খেতে খেতে বলল জাওয়াদ। মায়মুনা রয়েসয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোর বউ খেয়েছে?’
জাওয়াদ খাওয়া থামিয়ে চমকে তাকাল। মায়ের চোয়ালে আজ রাগ নেই এত। এটা রাতের ভাবনার ফল। মা বোধহয় তার মতো আটকাতে শুরু করেছেন। করারই কথা। এই মেয়ে নিজেই বশীকরণ। সে মানুষকে বশ করতে জানে। জাওয়াদ তো বশ হয়েই গিয়েছে, এবার মায়ের পালা। জাওয়াদ অন্যদিকে তাকিয়ে মুখটিপে হাসল। হাসি থামিয়ে মায়ের পানে চেয়ে দায়সারা জবাব দিল,
‘ তোর বউ তোর সেবায় দিনরাত এক করছে। তোমার কাছে ওর খবরাখবর থাকার কথা। আমি কিভাবে জানব? আমার সাথে তো ওর দেখাই হয়নি আজ।’
‘জিজ্ঞাস কর, যা।’ বলে অন্যদিকে তাকালেন। জাওয়াদ তৎক্ষনাৎ গেল না।
কিছুক্ষণ পর প্লেট হাতেই উঠে গেল। মুশরাফা এদিকে নেই। রুমে বোধহয়। জাওয়াদ ‘রাফা, রাফা?’ ডাকতে ডাকতে রুমেই গেল। মুশরাফা রুম গুছাচ্ছে। জাওয়াদ গিয়ে বিছানায় বসল। মুশরাফাও বসাল। তারপর বলল,
‘ তুমি আমার মাকে চিনি গোলা খাইয়েছো?’
মুশরাফা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। জাওয়াদ বলল, ‘এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। সত্যটা আমি জেনে গেছি । তোমাকে ভালো ভেবেছিলাম, রাফা।’
ডাকটা এবার খেয়াল হলো। ‘রাফা’ ডাকে মুশরাফা অবাক হলো। এতদিন পর হঠাৎ ডাক বদল হলো! অবশেষে। মুশরাফা হাসল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘কী করেছি আমি?’
‘চিনিগোলা খাইয়ে আমার মাকে বশ করেছো।’
‘ একদম না।’ প্রতিবাদ করল মুশরাফা। জাওয়াদ বলল,
‘ চিনিগোলা না খাওয়ালে মা আজ হঠাৎ তোমার খাওয়ার চিন্তা কেন করবে? কেন আমাকে পাঠাবে তোমার খাওয়ার খোঁজ নিতে?’
মুশরাফা থ বনে গেল। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে বলল,
‘মা আমার খোঁজ নিচ্ছে!’
জাওয়াদ পরোটা দিয়ে মুরগীর মাংস খাচ্ছিল। আধখাওয়া পরোটা থেকে এক টুকরো ছিঁড়ে নিয়ে আধখাওয়া মাংস থেকে একটু নিয়ে মুশরাফা মুখের সামনে ধরল,
‘ তা নয়তো কী? মা বলল, যা বউকে গিয়ে খাইয়ে আয়।’
মায়মুনা ওকে দেখতে পারেনা। ও না খেলে উনার কিছু যায় আসে না। উনি এ কথা কিছুতেই বলবে না। নিশ্চিত এই লোক বানিয়ে বলছে। মুশরাফা অনুসন্ধানী চোখে চেয়ে বলল,
‘ আপনি বানিয়ে বলছেন।’
জাওয়াদ খাবারটা ওর মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,
‘ রাফা, তুমি মেয়েটা তো সুবিধার না। একে তো আমার মাকে বশ করেছো, এখন আবার আমাকে অবিশ্বাস করছো? মা না বললে, আমি তোমাকে খাইয়ে দিতাম? এর আগে খাইয়েছি?’
মুশরাফা ভেবে দেখল সেদিন কেক খাওয়ানোর পর আর কখনো কিছু খাইয়ে দেয়নি। এবার কথাটা বিশ্বাস হলো ওর। ও বিস্মিত হয়ে চেয়ে রইল স্বামীর পানে। জাওয়াদ হাসল কেবল। বলল,
‘ আজ আবার আমার এঁটো খেলে।’
মুশরাফা খাবার গিলে হেসে ফেলল। হেসেই বলল,
‘ আপনার এঁটো খাওয়া চমৎকার ফলাফল দিয়েছে।’
‘কী ফলাফল দিয়েছে?’ ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল জাওয়াদ। মুশরাফা বিজয়ী হেসে বলল,
‘ভালোবাসা বেড়েটেড়ে একাকার। আপনি আমাকে ‘রাফা ‘ ডাকতে শুরু করেছেন।’
জাওয়াদ নির্বিকার। কপালে বিরক্তির ভাজ ফেলে বলল,
‘তোমার এত বড়ো নাম ডাকতে কষ্ট হয়, তাই ছোটো করেছি। আর কিছু নয়। সবসময় দুই লাইন বেশি বুঝা ভালো নয়।’
মুশরাফা হেসে বলল, ‘বেশি হওয়া দুইলাইনে যদি উপচে পড়া ভালোবাসার আঁচ থাকে। তবে তা বুঝার চেয়ে ভালো আর কিছু হতেই পারেনা। সত্য কথা হলো, আপনি ও আমাকে ভালোবেসে ফেলেছেন। ‘
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে তাকাল ওর দিকে। বিড়বিড় করে বলল, ‘উপায় তো রাখো নি।’
আবার পরোটা ছিঁড়ে স্ত্রীর মুখে তুলে দিয়ে বলল,
‘ কথা না বলে চুপচাপ খাও।’
মুশরাফা ওর চোখে চোখ রেখে খাবার চিবোতে চিবোতে হাসছে। সেই হাসি একসময় এসে ভর করল জাওয়াদের ঠোঁটে। আনমনেই হেসে ফেলল ও। সোনারাঙা সুখানুভূতি ঘিরে ধরল ওদের।
(সমাপ্ত)
প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি এখানেই।
ফুট নোট:
১. অমীমাংসিত জায়গায় ইতি টানার বেশ কয়েকটা কারণ আছে। তারমধ্যে অন্যতম একটা কারণ হলো পান্ডুলিপি। পান্ডুলিপির চাপ অনেক। ফেসবুকে নিয়মিত লেখা আর পান্ডুলিপি, একসাথে দুটো কন্টিনিউ করতে পারছিনা। অনেক বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছে। তাই এই গল্পটাকে পরিচ্ছেদ আকারে নিতে হচ্ছে।
এ ছাড়া ও কিছু কারণে আমি ডিস্টার্ব আছি। খানিকটা অসুস্থ ও। পাঠকের কথা চিন্তা করে শেষ কয়েকটা পর্ব এক প্রকার নিজের সাথে যুদ্ধ করে দিয়েছি। হাজার ব্যস্ততার মাঝে ও প্রতিদিন গল্প দিয়েছি। সব বিষন্নতা ঠেলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে বড়ো করে পর্ব দিয়েছি। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি দ্রুত শেষ করার, কিন্তু এই ক্ষণে এসে দেখি কাহিনি অনেক বাকি এখন ইতি টানা যাবে না। নিজেকে কিছুটা সেরে উঠানো এবং পান্ডুলিপির জন্য তৈরি করার জন্য সময় প্রয়োজন।
গল্প আরও অনেকটা বাকি। লায়লার মুখে অনুতাপের পরেই গল্প শেষ হবে। পান্ডুলিপি শেষ হলে ইনশা আল্লাহ আবার গল্প নিয়ে ফিরব। দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ অর্থ্যাৎ এর পর থেকেই দিব। গল্পটা ফেসবুকে দিব পুরোটা ইনশা আল্লাহ।
২. মুশরাফার সাথে আমার মিল নেই, একবারেই না। বাস্তবে কোন এক পর্দাশীল মেয়েকে বুলিংয়ের শিকার হতে দেখে মুশরাফার চরিত্র তৈরি করেছি। মুশরাফারা বাস্তবে আছে, তবে সে আমি নই । কাল্পনিক এই চরিত্রকে আমার বাস্তবিক জীবন ভাববেন না। দুটো আলাদা।
এই গল্পের মাধ্যমে আমি জানাতে চেয়েছি, পর্দাকে সম্মান করতে হবে, পর্দাশীল মেয়েকে হেয়জ্ঞান করার অবকাশ নেই। তার সম্মানার্থে এই চরিত্র রচনা করেছি। এটা আমার লেখা প্রথম ইসলামিক জনরার গল্প। অনেকটা আনাড়ি হাতের লেখা ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। এই গল্প লিখতে গিয়ে অনেক পড়েছি, অনেক কিছু জেনেছি। সবার মতো আমি ও ইসলামকে চিনেছি নতুনভাবে। প্রতি পদে পদে মনে হয়েছে আমার ইসলাম সুন্দর। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার তাওফিক দিক।
৩. সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন। যাতে আল্লাহ আমার সব সমস্যা সমাধান করে দেন। আমাকে সুস্থ করে দেন, পান্ডুলিপি সুন্দরভাবে শেষ করে তাড়াতাড়ি গল্পে ফেরার তাওফিক দেন। (আমিন)
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ পাশে থাকার জন্য। ইসলামিক জনরায় লেখা প্রথম গল্পটা সবার কাছে এতটা গ্রহনযোগ্য হবে আমার ভাবনাতীত ছিল। পুরো গল্প ভ্রমণে পাশে থাকার জন্য আল্লাহ আপনাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিক।
জাঝাকুমুল্লাহু খায়রান।