স্বয়ম্বরা (শেষ পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি
১৪
ইশতিয়াক বলে চলছে তার প্ল্যানিং। আমি স্তব্ধ হয়ে শুনছি।
— দেখুন মিস অরিন, গল্পের যে অংশটা আমি বলিনি, তা হচ্ছে, হোয়াট হ্যাপেন্ড অন ফার্স্ট মার্চ।
–যেদিন আমাকে ছেড়ে দেন?
–ইয়েস
তাকালাম ইশতিয়াকের দিকে। প্রশ্নটা উচ্চারণ করতে হল না। যে কেউ বুঝবে, আমি জানতে চাইছি, কি হয়েছিল সেদিন?
উত্তর আসল
— থট রিডিং ডিভাইস ডিজাইন করার পরে, মাথায় আসে থট ম্যানিপুলেটিং ডিভাইস ডিজাইন করার। স্পেশালি আপনাকে নিয়ে যখন প্ল্যানিং শুরু করি, তখনই ঠিক করি, এটা বানাব। এর মানে বুঝতে পারছেন?
অবাক হয়ে আমি তখন তাকিয়ে আছি এই কম্পিউটার জিনিয়াসের দিকে। মুখে কথা আসছে না। কোন রকমে মাথা ওপর নিচে নেড়ে কেবল সম্মতি সুচক ইঙ্গিত করলাম।
— এই ডিভাইস আবিষ্কার করতে পারলে, আই ক্যান এন্টার ইন্টু এনি ওয়ানস ব্রেন অ্যান্ড ম্যানিপুলেট ইট। হিপনোটাইজ কিংবা হীরক রাজার দেশের সেই মগজ ধোলাই বলতে যা বোঝায় সেই ডিভাইস আর কি। আমি যাকে খুশি, তাকে দিয়েই আমি আমার ইচ্ছেমত কাজ করাতে পারব।
নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছি তখন। গলায় স্বরও ফিরে এসেছে। অস্ফুটে শুধু বললাম
— পারলেন?
দ্যা জিনিয়াস গেভ দ্যাট কিলার স্মাইল ওয়ান্স এগেইন। মানে পেরেছে। ব্যাপারটায় আনন্দ লাগছে কেন? মনে হচ্ছে ওর জয় মানে আমারও জয়। কিন্তু আনন্দটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পেল না। ইশতিয়াক তখন গল্পের বাকীটা বলতে শুরু করে দিয়েছে
— ইট ওয়াজ নট ইজি। ঈশ্বরের তৈরি সিস্টেমকে হ্যাক করা। রিয়েলি টাফ, বাট আই ডিড ইট। ডিভাইসটা আবিষ্কারের পরে প্রথম যে চিন্তা মাথায় আসল, তা হচ্ছে ভুল হাতে পড়লে, কি অবস্থা হতে পারে? এমন কোন সমস্যায় পড়লে আমি বাবার হেল্প নিই। বাবাকে তাই ব্যাপারটা জানালাম। বললাম, এমন একটা যন্ত্র আমি আবিষ্কার করে ফেলেছি, যা দিয়ে যে কারো ব্রেন হ্যাক করা সম্ভব। প্রশ্ন হচ্ছে, এটা ডিসক্লোজ করব কি না?
বাবা বুদ্ধিমান মানুষ। বারণ করলেন। বললেন, ইট উইল বি অ্যা ডিজাস্টার। ভুল হাতে পরলে, ইট ক্যান ডিস্ট্রয় দ্যা আর্থ। উনি বললেন, ভেবে দেখ, নিউক্লিয়ার ওয়ারহেড আছে এমন কোন সেন্টারের কোন এক কর্মির ব্রেনকেও যদি কেউ এই ডিভাইস দিয়ে ম্যানিপুলেট করে?
গল্পটা শুনছি আর অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ইশতিয়াকের দিকে
— ব্যাপারটা আমিও ভেবে দেখলাম। এটা ইউজ করে ক্রিমিন্যালদের ভেতরের পশুত্বকে কিল করা যেতে পারে। তাদের শুধরাতে এই ডিভাইজ ব্যাবহার হতে পারে। তবে ডেঞ্জারাস ব্যাপার হচ্ছে, এই ডিভাইস ইউজ করে মুহুর্তে সাধারণ মানুষকে ক্রিমিনালও বানিয়ে ফেলা যেতে পারে। আর তেমনটা হলে, পৃথিবী হয়ে উঠবে ভয়ঙ্কর এক জায়গা। তাই ঠিক করলাম, ইনভেনশানটা ডিসক্লোজ করব না। ওদিকে আগের দিন ডিনারের সময়ই আপনি আপনার ফাইনাল ভার্ডিক্ট দিয়েছিলেন, এই বিয়ে হবে না। অ্যান্ড…
— আপনি ঠিক করলেন, ডিভাইসটা আমার ওপর ব্যাবহার করবেন।
— মনে আছে? আমার সাথে, মানে ইশতিয়াকের সাথে প্রথম যেদিন ফোনে কথা হয়, সেদিন আমি বলেছিলাম, তিন তারিখের ভেতরে আপনি আমার প্রেমে পড়ে যাবেন।
— হ্যাঁ।
— আপনি ভেবেছিলেন, আমি একজন ম্যানিয়াক। বারবার আমাকে বোঝাচ্ছিলেন, এভাবে কোন মেয়ের মন পাওয়া যায় না।
— মনে আছে।
— সো? এখন কি বলবেন?
— মানে ইউ উজড ইট? ইউ হ্যাকড মাই ব্রেন?
কিলার স্মাইল ওয়ান্স এগেইন। ‘ইয়েস’।
— এক তারিখে, আপনাকে ছেড়ে দেয়ার ঠিক আগে, আমি আপনার ব্রেন হ্যাক করি। শুধু তা ই না, সেখানে আমার প্ল্যানিং ইমপ্ল্যান্ট করি। আর এরপরের সব ঘটনা আমার ইচ্ছেতে ঘটেছে। যে কারণে আপনি কমিশনার আঙ্কেলকে কমপ্লেইন করেননি। সকালে মাইক্রোবাস যখন আপনার বাসায় যায়, আপনি সে গাড়ীতে চড়ে বসেন। আমার প্ল্যানমত, আমাকে বিয়ে করতে এখানেও চলে আসেন।
— বাট ব্যাপারটা কি জরুরী ছিল? আমি তো রাজী হয়েই গিয়েছিলাম।
— আই রিয়েলি ডোন্ট নো। আমার থট ইমপ্ল্যান্ট করার পরে আপনি যা করেছেন, সেটা কতটা আপনার সিদ্ধান্ত, কতোটা আমার, সেটা বোঝা যাবে সিস্টেম রিস্টোর করার পরে। লাস্টটাইম যখন আপনার থট রিড করি, তখন দেখতে পাই আপনার ভেতরে দুটো থট কাজ করছে, একটা থট চাইছে আমাকে রিজেক্ট করতে। যুক্তি দেখাচ্ছে, আমার কিডন্যাপিং অ্যান্ড আপনাকে ডেথ থ্রেট দেয়া, এসব পয়েন্টকে। আর অন্যটা চাইছে আমাকে ভালবাসতে। এই অংশের হাতে তেমন কোন যুক্তি নেই। শুধু একটাই, হ্যান্ডসাম অ্যান্ড কিলার স্মাইল।
কথাগুলো শুনে লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললাম। ইশতিয়াক ব্যাপারটা লক্ষ্য করল হয়তো। তবে গল্প বলে চলল
— আই দেন ডিলিটেড দ্যা ফার্স্ট থট। এরপরে আপনার আর সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হয়নি। আপনি বিয়েতে রাজি হয়ে। নিজের প্রতিটা অসম্মতির জন্য নিজেকেই বিভিন্ন যুক্তি দেখান, নিজের মতকে আমার পক্ষে নিয়ে আসেন।
অবাক চোখে আমি তখনও ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে আছি। এবার বোধহয় বুঝতে পারছি, বিয়েতে ওর অমতের কারণ। হি লাভস মি, বাট যেহেতু ওর চাপিয়ে দেয়া ইচ্ছের কারণে আমি এই বিয়েতে মত দিয়েছি, তাই ও এই বিয়ে থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে?
মনে হচ্ছে আমার পুরো পৃথিবী কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে। এই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়ে ও ভাল করল, না খারাপ, জানি না। কি বলব, কি করব, কিছুই বুঝতে পারছি না। এমন সময় ইশতিয়াক উঠে দাঁড়াল। বলল
— আর আজ সকালে যখন বাবা মারা গেলেন…
বাকী কথাটা আর বলতে পারল না। কিছুটা সময় নিল নিজেকে সামলে নিতে। এরপরে আবার বলতে শুরু করল
— আপনার জীবনে অনেক ওলট পালট করে দিলাম। জানি ক্ষমা এর সমাধান না, তারপরও, যদি সম্ভব হয়…
হাত জোড় করে ক্ষমা চাইল। এরপরে নিজের ল্যাপটপটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল
— দিস ইজ অ্যা গিফট ফ্রম মি।
ল্যাপটপটা হাতে নিতে নিতে জানতে চাইলাম
— কি এটা?
— দ্যা থট অ্যাকটিভেটেড ডিভাইস। দুলটা যার কানে লাগানো থাকবে, এই ল্যাপটপ তার থট রিড করতে পারবে। আপাততঃ এটা কেবল ফোন করতে পারে। দুল কানে রেখে আপনি যাকে ফোন করতে চাইবেন, তাঁকে যা যা বলতে চাইবেন, শুধু ভাবলেই হবে। এই ল্যাপটপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটা করবে।
কথাটা বলে ইশতিয়াক কোটের পকেট থেকে বক্স বের করল। আমার দিকে এগিয়ে দিল
— আপনার কানের দুলটা।
যন্ত্রচালিতের মত হাত বাড়িয়ে বক্সটা হাতে নিলাম। এমন সময় ইশতিয়াক কথাগুলো বলল
–দুলটা একটু কানে দেবেন? আপনার ব্রেনটা আগের মত করে দিই।
দুলটা কানে পড়লাম। এরপরে আমার হাত থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে সেটায় কিছু করল। এরপরে সেটার ডালা বন্ধ করে আমাকে ফিরিয়ে দিল। সোশ্যাল একটা স্মাইল ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল
— আগামীকাল আমার ফ্লাইট। আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি। হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না। তবে আপনাকে আমার মনে থাকবে। ইউ রিয়্যেলি আর অ্যা চার্মিং লেডি।
কথাগুলো বলে আর থামল না। নিজের কারের দিকে এগিয়ে যেতে উদ্যত হল। এরপরে কিছু একটা মনে পড়ল। ঘুরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে জানাল
— মাইক্রোবাসটা একটু পরেই এখানে আসবে। আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।
এদিকে ইশতিয়াককে চলে যেতে দেখে কাজী সাহেব সেখানে এসে হাজির। অবাক হয়ে জানতে চাইলেন
— বিয়ে কি তাহলে সত্যিই হচ্ছে না? আমি নাম ধাম সব লিখে ফেললাম।
কথাটা ইশতিয়াকের কানে গেল। ও ফিরে এসে কাজী সাহেবকে তার ফি দিল। আর আমার দিকে তাকিয়ে জানাল
— আপনার ব্রেন এখন স্বাধীনভাবে কাজ করছে। আপনাকে যতটা চিনেছি, আপনি একজন স্বয়ম্বরা। ইউ উইল চুজ ইওর পার্টনার ইওরসেলফ। এমন কাউকে বেছে নেবেন, যাকে দেখে মনে হবে, ‘হি ইজ মাই ম্যান।’ আমার তরফ থেকে শুভকামনা থাকল। আর এখানে ফি দেয়া থাকল, চাইলে বিয়েটা এখানেই করতে পারবেন।
এরপরে আর কোন কথা না বলে নিজের গাড়ীর দিকে এগিয়ে গেল। গাড়ীতে উঠে বসল। দ্রুত চিন্তা করছি। কি করব? ওকে থামাব? আমি কি ওকে ভালবাসি? বুঝতে পারছি না। শুধু এটুকু বুঝতে পারছি, খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
ও চলে যাচ্ছে… আর সেটা হলে, দ্যা স্টোরি ইজ ওভার। মানতে পারছি না। ডাকব? চিৎকার করলেও এখন আর ও শুনতে পারবে না। তাহলে কিভাবে? ওর ফোন নম্বরও তো নেই আমার কাছে। আবার এটাও বুঝতে পারছি, যা করার এখনই আমাকে করতে হবে। ইট’স নাও অর নেভার।
এমন সময় চোখ পড়ল হাতের ল্যাপটপের দিকে। থট অ্যাক্টিভেটেড ফোন। আমার ইন্সটিংক্ট বলছে, গো অ্যাহেড। আর সেকেন্ড থট দিলাম না। ল্যাপটপের ডালা খুললাম। কানে এখনও সেই দুল আমি পড়ে আছি। চোখের সামানে মোবাইল ফোনের কি প্যাডের মত একটা কি প্যাডের স্ক্রিন ভেসে উঠল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। দেখলাম নিজে থেকেই কি প্যাডে চাপ পড়ছে। কাকে ফোন করছে? ইশতিয়াককে? সন্দেহের অবসান হল। লেখা উঠল ‘কলিং মি হ্যান্ডসাম’
কেমন লজ্জা পেলাম। ওকে মনে মনে আমি এই নামে ডাকছি?
ওপাশে রিং হচ্ছে। একসময় ফোনটা রিসিভ হল। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করার আওয়াজ হল। এরপরে স্পস্ট শুনলাম আমার মনের কথাগুলো, ল্যাপটপের স্পীকার আমার ভয়েসে বলছে
— হেই হ্যান্ডসাম…
এরপরে যা যা বললাম, সেগুলো আর বলতে পারছি না। লজ্জা লাগছে।
শেষ
অনেকে বিরক্ত হয়েছেন, অনেকে আনন্দ পেয়েছেন, তারপরও এতদিন সাথে থাকবার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ। হয়তো আবার দেখা হবে। ভালো থাকবেন। সবার জন্য শুভকামনা।