স্বয়ম্বরা (১০ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি
১০
কথাটা শুনে যতটা চমকে উঠবে ভেবেছিলাম, ততটা চমকালো না। বরং শান্তভাবে বলল
— আপনি লিভিং রুমে গিয়ে বসুন। আমি আসছি।
কিছুটা অবাক লাগল। আমার গেসটা কি ঠিক হয়নি? নাকি ওভারস্মার্ট? যেটাই হোক, মনে হচ্ছে, এবার পর্দা উঠবে। মেনে নিলাম। কানটা খালি খালি লাগছে। দ্রুত বেডরুমের অ্যাটাচ বাথে গিয়ে দুলটা কানে দিয়ে নিলাম। আসবার আগে ঝট করে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলাম। মেয়েলি স্বভাব, ইউ নো। যাই হোক, ভালই লাগছে।
এগিয়ে গেলাম লিভিং রুমের দিকে। সোফায় বসে টিভি ছাড়লাম। হ্যান্ডসামের খাওয়া শেষ হয়েছে। ধীরে সুস্থে উঠে রান্নাঘরে গেল। পানির আওয়াজ পাচ্ছি। এক্ষুনি আসবে।
বেশ রোমাঞ্চ ফিল করছি। খেলাটা ধরে ফেলেছি। শুধু তাই না, খেলা আমি জিততে চলেছি। এই প্রথমবারের মত মনে হচ্ছে, দ্যা গেম ইজ ইন মাই ফেভার। আসিফের কিংবা ইশতিয়াকের প্ল্যানটা এবার স্পস্ট বুঝতে পারছি। প্ল্যান ছিল প্রথমে আমাকে অপহরণ করা হবে। এরপরে দেখানো হবে, ইশতিয়াক অন্য একজন কেউ। আর আসল ইশতিয়াক আসিফ নাম নিয়ে একজন কিডন্যাপার সেজে সামনে আসবে। জানাবে, দিন ছয়েকের ভেতর আমি বিয়েতে রাজী না হলে গর্দান যাবে। আর এই কদিন, পাহারা দিতে সারাক্ষণ আমার সাথে আসিফের বেশে থাকবে ইশতিয়াক।
এই সময়ে চলবে বিভিন্নভাবে আমাকে ইম্প্রেস করার চেস্টা। আমার কি পছন্দ, কি অপছন্দ সবই রিসার্চ করা আছে। পছন্দের খাবার দিয়ে শুরু। এরপরে ইশতিয়াকের ক্যারিয়ারের গল্প। উল্টোটাও করল। আসিফকে সেমি নেগেটিভ হিসেবে প্রেজেন্ট করল। যদি দেখে আমি আসিফকে বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছি, তখন আসিফ নিজে থেকে টোপটা দেবে। জানাবে, সে আমাকে পছন্দ করে। প্ল্যান ছিল, এই অবস্থায় আমি ওকে অনুরোধ করব, ডাবল ক্রস করার জন্য। তখন, বেশ কিছু অ্যাক্টিং করে, আসিফ রাজী হবে আমাকে ছেড়ে দিতে। ওর এই মহানুভবতা আর এই কদিনের ইম্প্রেসিভ বিহেভে আমি বলে বসব, তুমি এসব পথ থেকে ফিরে আস। আমি তোমার পাশে থাকব। ‘শান্ত কেন মাস্তান’ টাইপ ফিল্মের কাহিনীতে নায়িকারা সচরাচর যা করে।
প্ল্যানটা প্রায় কাজ করেই ফেলেছিল। অফারটা আমি আজ কিংবা কাল হয়তো দিতামই। অপেক্ষা করছিলাম, ওর মনের অবস্থা বোঝার। ভুলটা করে ফেলল গল্পটা বলে। অতি ড্রামাটিক গল্প না বললে হয়তো বিশ্বাস করতাম। কিংবা শুধু যদি একটু অপেক্ষা করত, আমাকে ফাঁদে প্রায় ফেলেই দিয়েছিল। যাইহোক, খেল খতম হতে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণের ভেতরে। খুব ভুল যদি না করে থাকি, আসিফ অর ইশতিয়াক, যা ই নাম হোক এই ব্যাটার, এখানে এসে বসার কিছুক্ষণ পরেই এই নাটকের যবনিকার পতন ঘটবে। দ্যা গেম ইজ ওভার।
আসিফ এসে বসল। আমার দিকে সরাসরি তাকাল। হি ইজ লুকিং কনফিডেন্ট। কনফিডেন্স আমারও তুঙ্গে। মাইন্ড গেম শুরু হতে যাচ্ছে। কনফিডেন্সই এখানে মহার্ঘ অস্ত্র। শুরু আসিফই করল
— বলুন, কি জানতে চান।
— আসল ইশতিয়াক কে? আপনি? না ফোনে যার সাথে কথা বলছি, সে?
আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। বোঝার চেস্টা করল, প্ল্যান আমি কতটা আঁচ করে ফেলেছি। চোখে একটা বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বুঝিয়ে দিলাম, ‘তোমার খেল খতম, ডিয়ার। এখন তোমার কাজ শুধু কনফেস করা।’ বোধহয় কথাটা বুঝল। বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল
— আমিই ইশতিয়াক চৌধুরী।
বিংগো। আই ডিড ইট। খেল খতম। এখন কাজ শুধু গল্পটা জানা। শুরু করলাম। জানতে চাইলাম
— আর ফোনে যে ছিল? ফ্রেন্ড?
আবার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। আমিও নিস্পলক দৃষ্টি দিলাম। কামঅন ম্যান, কনফেস ইট। ইউ হ্যাভ নো অপশান। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে ফেলল। আবার চোখ তুলল, তবে এবার চোখে বাঁকা একটা হাসি। বলল
— ওটা একটু পরে বলব। আই মিন, ব্যাপারটা একটু কমপ্লিকেটেড।
নিজের অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে গেল। এখনও চালাকি? আমাকে গাধা পেয়েছে নাকি? নাকি ফ্রেন্ডকে সেফ করার চেষ্টা? লাভ নেই চান্দু, তোমার চালাকী আর কাজ করবে না। বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বললাম
— ডোন্ট ওরি, ইয়োর ফ্রেন্ড ইজ সেফ। প্রতিশোধ যা নেয়ার তা আমি আপনার এগেইন্সটেই নেব।
কথাগুলো শুনে ভয় পেল বলে মনে হল না। আমার চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল
— ভয় আমি পাচ্ছি না। উত্তরটা আপনি বিশ্বাস করবেন না, তাই বলছি না।
— মানে?
— মানে, ওটাও আমি। কথাগুলো আমার, বাট ভয়েস সিন্থেসাইজারের মাধ্যমে চেঞ্জ করা।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। ওর চোখ বলছে, মিথ্যে বলছে না। কিন্তু কিভাবে সম্ভব? কোন টেকনোলজি? হতে পারে। ব্যাপারটা তাই জানতে চাইলাম
— কিভাবে পসিবল। আপনি তো এখানেই, আমার সামনেই ছিলেন। তাহলে ফোনের ভয়েস আপনার কিভাবে হবে?
— টেকনোলজি।
ব্যাপারটাকে মেনে নিলাম। হতে পারে। ভয়েস সিন্থেসাইজারের কাজ? বাট…। কনফিউজিং। আচ্ছা, এমন হতে পারে আগে থেকে কিছু অ্যানসার রেকর্ড করে রেখেছিল। কাউকে বলে দিয়েছিল, ওটা চালিয়ে দিতে। কাজটা রিস্কি ছিল। যেসব উত্তর রেকর্ড করে রেখেছিল, লাক ফেভার করে যায়। আমার প্রশ্নগুলো ওর উত্তরের সাথে ম্যাচ না করলে হয়তো ফেঁসে যেত।
কিছুটা রিসার্চও কাজে দিয়েছিল হয়তো। স্পেশালি এই কদিন আমার সাথে থেকে হয়তো বুঝে গেছে আমি কি কি জিজ্ঞেস করতে পারি। ব্যাপারটা নিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে, বাট এই মুহুর্তে একটাই কথা সবার আগে জানতে চাইছি, কেন এই কাজটা করল। প্রশ্নটা করতে যাব এমন সময় ইশতিয়াক বলত শুরু করল
— দ্যাট ইজ মাই ইনভেনশান।
ব্যাপারটা ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। অবাক হয়ে আসিফের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলাম
— কোনটা?
— থট অ্যাক্টিভেটেড সিস্টেম।
এই নতুন জাতের সফটওয়ার টফটওয়ার নিয়ে আলাপ এড়াতে চাইলাম। আসলে এসব জানবার মুডে খুব একটা আমি এখন নেই। মূল গল্প আমাকে টানছে। বললাম
— এমন ইডিওটিক একটা কাজ কেন করলেন?
— থট অ্যাক্টিভেটেড সিস্টেম ইডিওটিক কাজ?
মাথা দুদিকে নেড়ে না সুচক ইঙ্গিত করলাম। স্মিত হেসে বললাম,
— না। ওটা নিঃসন্দেহে দুর্দান্ত আবিস্কার।
কথাটা বলে মনে হল, শুনেই ফেলি ব্যাপারটা। আসল গল্প তো পালিয়ে যাচ্ছে না। সামনে ফোনটা রাখা ছিল, সেটার দিকে ইঙ্গিত করে বললাম
— কিভাবে কাজ করে আপনার এই সিস্টেম?
স্মিত হাসল। বলল
— এটা না। থট অ্যাক্টিভেটেড সিস্টেমটা ইন্সটল করা আছে আমার ল্যাপটপে। আমার শরীরে একটা একটা মাইক্রোচিপ ঢোকানো আছে। সেটার সাথে কানেক্টেড আছে আমার ল্যাপটপ। আমার থট ট্রান্সমিট হয়ে যাচ্ছে আমার ল্যাপটপে। এরপরে আমার কাজ শুধু চাওয়া। আমি যে নম্বরে ফোন করতে চাই, আমার ল্যাপটপ সেই নম্বরে ফোন করতে পারে। আমি যা বলতে চাই, যার ভয়েসে বলতে চাই, সব আমার ল্যাপটপ আমার হয়ে করে দেয়।
ইন্টেরেস্টিং তো? ব্যাপারটা বোধহয় বুঝতে পেরেছি। বললাম
— আপনি এখান থেকে ইচ্ছে করেছিলেন, আপনার এই ফোনে ফোন করার। আপনার ল্যাপটপ ফোনটা করে, রাইট?
মাথা ওপর নীচে করে ব্যাপারটা মেনে নিল। এরপরে বলল
— অ্যান্ড এরপরে আমার কথার উত্তরে আপনি যা বলতে চান, তা আপনার ব্রেন থেকে চলে যায় আপনার ল্যাপটপে। ল্যাপটপে সেটাই আমাকে মোবাইলে ফোনে জানায়।
— ইয়েস। আপনার কথার উত্তরে যেসব উত্তর শুনতে পেয়েছেন, সেসব আমার ব্রেন থেকেই এসেছে। আমার ব্রেন থেকে চলে গেছে ল্যাপটপে আর সেখান থেকে ভয়েস সিন্থেসাইজার হয়ে আপনার কানে।
দারুণ তো। এই ব্যাটা তো আসলেই জিনিয়াস। ভালোই লাগছে ছেলেটাকে, বাট, আমার সাথে যা করল, এরপরে, নট পসিবল। এই নোংরা পথে কেন এগোলো? এভাবে কি কোন মেয়ের মন পাওয়া যায়? এমন সময় ইশতিয়াক হঠাৎ বলে উঠল
— না যায় না।
অবাক হয়ে জানতে চাইলাম
— কি যায় না?
আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে ঠোঁটে বাঁকা একটা হাসি এনে উত্তর দিল।
— কোন মেয়ের মন পাওয়া যায় না।
এবার ভয়ংকর রকমের অবাক হলাম। আমার মুখ দেখে কি আমার সব মনের কথা বুঝতে পারছে? এমন সময় ব্যাপারটা মাথায় আসল। ওহ নো। এই লোক তো আমার মন পড়তে পারছে।
মাই গড, তার মানে আমার শরীরেও মাইক্রোচিপ ঢোকানো হয়েছে। তাই তো বলি, এই লোক কিভাবে বুঝে যাচ্ছিল আমি কি ভাবছি। আর আমি ভেবেছিলাম সব কোইনসিডেন্স। আর নয়তো রুমে সি সি ক্যামেরা লাগানো আছে। আর আমার মুখ দেখে বুঝে যাচ্ছে আমার চিন্তাগুলো।
— ইয়েস। কোন রুমে কোন সি সি ক্যামেরা নেই। বুঝতেই পারছেন, সেটার কোন দরকারই ছিল না।
আমি তখন হতবাকের চরমে পৌঁছে গেছি। তার মানে, আমি যে পালাবার মতলব করছিলাম, হি নিউ ইট। আমি যে মনে মনে ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছি, প্ল্যান কষছি ওকে ডাবল ক্রস করার অফার দেব, সেটাও ও জানত। আর সেজন্যই ও গল্পটা ফেঁদেছিল। বুঝিয়েছিল আসলে ইশতিয়াক আর আসিফ রাইভাল। ইঙ্গিতে দিয়েছিল, সুযোগ পেলে ও ইশতিয়াককে হারাতে চায়। যেন আমার মনে প্ল্যানটা আসে, ‘চলো, ইশতিয়াকের প্ল্যান ফেইল করি। আমরা পালিয়ে যাই।’
হঠাৎ সবকিছু এলোমেলো হতে শুরু করল। অ্যাই অ্যাম ট্রাপড। নো ওয়ে টু এস্কেপ। আমার ব্রেনকে সারাজীবনের মত বন্দী করে ফেলেছে। যে কনফিডেন্স নিয়ে খেলা শুরু করেছিলাম, ঠাস করে সেটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। বুঝতে দেরী হল না, খেলা এখনও ওর কন্ট্রোলে। যদিও অনেকটাই সিওর, তারপরও কথাটা জিজ্ঞেস করলাম, বললাম
— আমার শরীরেও মাইক্রোচিপ ঢোকানো হয়েছে?
আমার দিকেই তাকিয়ে ছিল। আমার মুখের ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা দেখে যে কেউ বলতে পারবে, আই অ্যাম স্যাটার্ড। কিছু কি বলব? এই লোক আমার ব্রেন তো পড়তেই পারছে। মনের কথা শুনে সেই কিলার স্মাইল দিল। এর মানে হচ্ছে ‘ইয়েস’। পরের প্রশ্নটা করলাম
— আর সেজন্যই কিডন্যাপটা করেছেন?
আবার সেই স্মাইল। তবে এবার উত্তর দিল
— ঠিক তা না। আমাকে নিজেকে ইন্ট্রোডিউস করার ব্যাপারও ছিল।
বেশ কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এবার আমি পরের প্রশ্নটা করলাম
— হোয়াট’স নেক্সট?
চলবে
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1312986629216361