স্বয়ম্বরা (১৩ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি
১৩
নিজের কানকে এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। আবার এটাও বুঝতে পারছি, হি ইজ নট জোকিং। ইশতিয়াক যা বলছে, হি মিনস ইট। তারামানে আমাকে কিডন্যাপ করা, আমার মনের কথা বোঝার চেষ্টা, আসিফ সেজে আমাকে ইম্প্রেস করার চেস্টা আর বিয়ের কথা, সবই ছিল পার্ট অফ হিজ প্ল্যান? ভেবেছিলাম, আমাকে বিয়ে করাটা ওর প্ল্যান। এখন বুঝতে পারছি, আসলে তা না। একদম শেষ মুহুর্তে এসে বিয়েতে অমত করাটাই ছিল প্ল্যান। ওকে রিজেক্ট করবার প্রতিশোধ হিসেবে আমাকে রিজেক্ট করা। এভাবে আমাকে ইনসাল্ট করাটাই ছিল ওর আল্টিমেট গোল?
নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে করতে শুধু বলতে পারলাম
— দা স্টোরি ইজ ওভার দেন?
ইশতিয়াক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকাল। এরপরে চোখ নামিয়ে ফেলল। কি বলবে গুছিয়ে নিচ্ছে। ধীরে ধীরে চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল। সেই চোখে ঘৃণা নেই। কিছুটা সহানুভুতি মনে হচ্ছে। সরি টাইপ কিছু বলবে? অপেক্ষা করে থাকলাম।
— নো। আপনি যেটাকে স্টোরি ভাবছেন, দ্যা রিয়েল স্টোরি ইজ ডিফ্রেন্ট ফ্রম দ্যাট।
নিজের অজান্তেই ভ্রু কুঁচকে গেল। জিজ্ঞেস করলাম
— মানে?
বেশ শান্ত একটা দৃষ্টিতে তাকাল আমার দিকে। মুখ বেশ গম্ভীর। মুখে শুধু বলল
— বসুন। গল্পের বেশ কিছু অংশ আপনার অজানা।
উত্তেজনায় কখন দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। বসে পড়লাম। ইশতিয়াকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, হি ইজ ফিলিং অ্যা লিটিল গিল্টি। হয়তো জেদের বশে কাজটা করে ফেলেছে, আর এখন নিজের ভুল বুঝতে পারছে। বুঝতে পারছে, জেদ করে কাউকে বিয়ে করা কোন সমাধান না। কিংবা হয়তো জেদ নেমে গেছে। যুদ্ধ জয়ের পরে, এখন বুঝতে পারছে, এই জয়ে কোন প্রাপ্তি নেই। কিংবা ও হয়ত কখনও আমাকে ভালবাসেই নি।
এনিওয়ে, ওর অনুরোধ মানলাম। বসলাম। ইশতিয়াক বলতে শুরু করল
— গল্পের শুরু আজ থেকে ছয় মাস আগে।
ব্যাপারটা নিয়ে আবার আলাপ শুরু করতে মন চাইছে না। ওকে বাধা দিয়ে তাই বললাম
— আই নো। মাস ছয়েক আগে, আমেরিকা থেকে আপনার বাবা যখন দেশে আসেন, তখন উনি একদিন আমাদের বাসায় আসেন। সেখানে উনি আমাকে দেখে পছন্দ করেন। অ্যান্ড আপনার সাথে বিয়ের প্রপোজাল দেন। হুইচ লেটার আই রিজেক্টেড।
আমার কথাগুলো মনযোগ দিয়েই শুনল। বোধহয় অপেক্ষা করে ছিল কখন আমি থামি, সেজন্য। আমার কথাগুলো শেষ হওয়ার পরে ইশতিয়াক বলতে শুরু করল
— ইয়েস। ইউ রিজেক্টেড। আর আপনার ধারণা, সেই রিজেকশানকে আমি অপমান হিসেবে ধরে নিই। আর জেদ ধরি, যেভাবে হোক, আপনাকে আমি বিয়ে করব। বাট দ্যাট’স নট।
অবাক হলাম। এর মধ্যে অন্য কিছু থাকতে পারে? অবাক হয়ে পুরো ব্যাপারটা জানতে চাইলাম।
— তাহলে?
— সেটাই বলতে চাইছি। দেখুন আপনার রিজেকশান আমার জন্য তেমন কোন সমস্যা ছিল না। ইনফ্যাক্ট, সেই মুহুর্তে আমার বিয়ে করার তেমন কোন ইচ্ছেই ছিল না। আমি তখন হিউম্যান ব্রেন অ্যানালাইসিসে ব্যাস্ত। আর তাছাড়া কিছুদিন আগে, আই লস্ট মাই ফিয়ঁসে ইন অ্যা কার অ্যাক্সিডেন্ট। সেকারণেও, আমি তখন নিজেকে পুরোপুরি রিসার্চে ডাইভার্ট করে রাখতে চাইছিলাম।
— তাহলে? কিডন্যাপ অ্যান্ড অল দ্যাট?
— দ্যাট ইজ দ্যা স্টোরি। সেটা বলার জন্যই আমি এসেছি।
ইশতিয়াকের কন্ঠে কিছু একটা ছিল, বুঝলাম, সামথিং টেরিবিল ইজ কামিং। কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না। আগ্রহী এক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম ওর দিকে। ও আবার বলতে শুরু করল
— সেই সময়ে বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ল। লেট স্টেজ। হাতে আর বড়জোর ছয়মাস সময়। উনার তখন একটাই চাওয়া, আমার বিয়েটা দেখে যেতে চান। বাই দ্যাট টাইম, থট রিডার আবিষ্কার করে ফেলেছি। বাবার ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে জেনে ফেললাম, উনি চাইছেন, আপনার সাথেই আমার বিয়ে হোক।
— অ্যান্ড ইউ ডিসাইডেড, ইউ উইল ম্যারি মি অ্যাট এনি কষ্ট।
সম্মতি সুচক মাথা ঝুকাল। এরপরে বলল
— ‘অ্যাট এনি কস্ট’ না। বলতে পারেন, ইফ ইউ উইশ। আই মিন, যেহেতু থট রিডিং এখন চাইলেই আমি করতে পারি, তাই আপনার পছন্দ বুঝে, সেভাবে নিজেকে ঢেলে সাজানো, আই থট, আমার জন্য কোন সমস্যা হবে না। তবে সেজন্য আমার জানা দরকার ছিল, আপনি কি চান, সেটা জানা।
— আই সি। সেজন্য আপনি আমাকে কিডন্যাপ করে আমার শরীরে মাইক্রোচিপ ইনসার্ট করেন।
স্মিত একটা হাসি দিল ইশতিয়াক। ‘হ্যা’ সূচক কিলার স্মাইল না। এটা ‘না’ সূচক স্মাইল। এরপরে বলল
— মাইক্রোচিপটা আপনার কানে।
অবাক হয়ে কানে হাত দিলাম। কোন কিছুর অবস্থান টের পেলাম না। উচু হয়ে আছে, এমন কিছুর অস্তিত্বও লাগল না। কোন কাটা দাগও ফিল করলাম না। আমার রেস্পন্স দেখে ইশতিয়াক হাসল। এরপরে বলল
— কিডন্যাপের দিন থেকেই ওটা আপনার কানে ঝোলানো ছিল
— সেই নীল রঙের দুলটা?
— ইয়েস। মনে আছে একদিন আপনি বাথরুমে দুলটা রেখে আসেন?
— ইয়েস।
–লক্ষ্য করেছিলেন কি না জানি না, সেদিন আপনার প্রশ্ন উত্তর আগে আগে দিতে পারছিলাম না।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখ ইশতিয়াক সম্মতি সূচক মাথা নাড়ল। বলল
— ইয়েস। দুলটাতে ছোট্ট একটা সেন্সর লাগানো আছে। ওটা আপনার স্কিনের নার্ভের মাধ্যমে, আপনার ব্রেনের সাথে অ্যাটাচড।
কথাটা শুনে অবাক হলেও, মেনে নিলাম, নাইস আইডিয়া। তবে ব্যাপারটা নিয়ে আর কথা বাড়ালাম না। মূল প্রশ্নের উত্তর এখনও পাইনি। ওটা জানা দরকার আগে। বললাম
— এরপরের গল্প, আই গেস, আই নো।
সম্মতি সুচক মাথা ঝুঁকিয়ে বলল
— অলমোস্ট। এক্সেপ্ট ফিউ থিংস। আপনাকে কিডন্যাপ করার পরে যখন আপনার মাইন্ড রিড করা শুরু করলাম, তখন দেখলাম, ইউ আর কোয়ায়েট ইন্টেরেস্টিং অ্যা লেডি, আপনাকে পছন্দ করা শুরু করলাম। ওদিকে আপনার পছন্দ বুঝে সে অনুযায়ী রান্না করতাম। যেসব ব্যাপার আপনার প্রিয়, তেমন কাজ করতে লাগলাম। যখন দেখলাম, আপনি ইশতিয়াককে শিক্ষা দিতে চান, দরকার হলে আসিফকে প্রেমের টোপ দিতেও আপনার আপত্তি নেই, তখন ডিসাইড করলাম, লেট ইট হ্যাপেন। আপনার প্রেম আসিফের সাথেই হোক। ইভেন সেটাই ভাল হবে। ইশতিয়াককে শিক্ষা দেয়াও হবে, আর আসিফের সাথে প্রেমও হবে। আর তাই আসিফ আর ইশতিয়াকের রাইভালরির গল্প ফাঁদলাম। উদ্দেশ্য ছিল আপনাকে একটাই ম্যাসেজ পৌঁছে দেয়া, যে আপনাকে ইশতিয়াকের খপ্পর থেকে বাঁচাতে পারে কেবল একজনই, আসিফ।
এবার নিজের অজান্তেই ঠোঁটে একটা বাঁকা হাসি চলে আসল, এর মানে, ‘আর সেখানেই ধরা খেয়ে গেলেন’। মুখে কিছু বললাম না। ইশতিয়াক নিজের মনে গল্পটা বলে গেল।
— আর সেটা করতে গিয়েই ধরা পড়ে গেলাম। অভিনয় যুতসই হল না, ওদিকে ইউ আইস আর ভেরি শার্প।
এবার আমি খানিকটা অধৈর্য হয়েই বললাম
— দেখুন, এসব গল্প শোনার মুডে আমি এখন নেই। ইনফ্যাক্ট, যেদিন আপনি ধরা পড়ে গেলেন, সেদিনই তো আমি আপনার প্ল্যান বুঝে যাই। তাই না? এরপরও তো আমি… আমাকে ছেড়ে দেয়ার পরও তো আমি… আই মিন আই এগ্রিড টু দিস ওয়েডিং। দেন হোয়ায়? আপনি এখনও কেন অতীতে বসবাস করছেন? সেই প্রত্যাখ্যান এখনও বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন?
কথাটা শুনে ইশতিয়াক কিছুটা থমকে গেল। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। বোধহয় মুখে কোন উত্তর যোগাচ্ছে না। সোজাসুজি বলতে পারছে না, ইট ইজ অ্যা রিভেঞ্জ। বাট উত্তরটা আমি ওর মুখ থেকেই শুনতে চাই। আবার জিজ্ঞেস করলাম
— আই জাস্ট ওয়ান্ট টু নো দ্যা রিজন অফ ইয়োর ‘নো’।
কথাটা শুনে বেশ কিছুটা সময় ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এরপরে বলতে শুরু করল
— দ্যা রিজন ইজ মাই ফাদার।
এবার সত্যিই চমকে উঠলাম। নিজের অজান্তেই প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলাম
— মানে?
ইশতিয়াক সম্মতি সুচক মাথা ঝুঁকিয়ে বলল
— ইয়েস। বাবা আজ সকালে মারা গেছেন।
হতবাক হয়ে ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অজান্তেই হাত আমার মুখে চলে আসে। বলে ফেলি
— ও নো। ইমতিয়াজ আঙ্কেল মারা গেছেন?
আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বোধহয় ব্যাপারটা ইজি করার চেস্টা করল। বলল
— প্লিজ, ডোন্ট ব্লেম ইওরসেলফ ফর দ্যাট। হিজ ডেজ ওয়্যার নামবার্ড।
কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকলাম। কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। ভদ্রলোক আমাকে পুত্রবধু হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। বাবার ইচ্ছে পূরণ হল না দেখে…
— তবে বিয়ে ক্যানসেলের সিদ্ধান্তটা সেজন্য না।
অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। বললাম
— তাহলে?
— বাবার মৃত্যু আমার হুশ ফিরিয়ে দেয়। বুঝতে পারি, জেদের বশে কিংবা বলতে পারেন বাবার ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে, আমি খুব বাজে একটা পথে পা বাড়িয়েছি। আই স্যুড কাম ব্যাক।
ইশতিয়াকের মনের অবস্থা এবার বুঝতে পারলাম। ওর না বলার কারণও। বাট আই থিঙ্ক হি ইজ রং। ব্যাপারটা প্রথমে জেদ বা প্রতিশোধ থাকলেও এখন আর তা নেই। বললাম
— আপনার কি এখনও মনে হয়, আমাদের বিয়েটা কেবল জেদাজেদি থেকেই হচ্ছে?
ইশতিয়াক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। এরপরে বলল
— ইয়েস।
ওর চোখে আত্মবিশ্বাস। যা বলছে বুঝেই বলছে। এতোক্ষণ যে মনে হচ্ছিল, ও হয়তো ওভাররিয়াক্ট করছে কিংবা আত্মগ্লানিতে ভুগছে, ব্যাপারটা তেমন না। এবার সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। অ্যান্ড হি নোজ হি ইজ রাইট। ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম
— ডোন্ট ইউ লাভ মি?
সেই কিলার স্মাইল দিল। এর মানে ‘হ্যা’। তাহলে?
প্রশ্নটা আমাকে করতে হল না। উত্তরটা ও নিজে থেকেই দিল। শুনে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। দ্যা রিয়েল স্টোরি ওয়াজ বিয়ান্ড মাই ইমাজিনেশান।
চলবে