স্বয়ম্বরা (৮ম পর্ব)
রাজিয়া সুলতানা জেনি
৮
একটা ব্যাপার বুঝে গেলাম, এই কটা দিন এখানেই থাকতে হচ্ছে। দ্যা অনলি অপশান অফ স্কেপ ইজ, বিয়ের দিন। হয়তো বিয়েটা করতে হবে। অ্যাট লিস্ট পেপার ম্যারেজটা সেরে ফেলার আগে, এই লোকের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কোন সুযোগ দেখতে পাচ্ছি না। কমিউনিটি সেন্টারে গিয়ে এই ব্যাটার সাথে স্কোর সেটল করতে হবে। এই পাবলিক হয়তো ধরেই নিয়েছে বিয়ে হওয়া মানে স্বামীকে দেবতা ভাবব। বর যেমনই হোক, শত অত্যাচার করলেও, তাকে মেনে নিয়েই জীবন কাটিয়ে দেব। এখানেই মিস্টার ইশতিয়াক মিস অরিনকে চেনেনি।
মনের ভেতরে যতটা ঘৃণা কাজ করছে, তাতে মনে হচ্ছে এই লোককে ঠান্ডা মাথায় খুন করতে আমার একটুও হাত কাঁপবে না। আমাকে কিডন্যাপ করে যে এই ব্যাটা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছে, এটা ওকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে ছাড়ব। অপেক্ষায় আমিও আছি। আসুক তেশরা মার্চ। ইনফ্যাক্ট ওকে কিভাবে শাস্তি দেব, সেটা নিয়ে আমি প্রতিদিনই ভাবছি। খুব ডেডলি কিছু খুঁজছি।
এর মধ্যে আসিফের সাথে বেশ ফ্রেন্ডলি একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে। একেক দিন একেক রেসিপি করছে। প্রতিটাই ডেলিসাস। সবকিছু বলার আগেই হয়ে যাচ্ছে। যেদিন যা খেতে মন চাইছে, দেখছি সেদিন সেটাই আইটেম। কোইনসিডেন্স? জানি না।
কিছু ব্যাপার রুটিনের মত হয়ে গেছে। সকাল আটটায় নাস্তা। দেন দুজনে মিলে লিভিং রুমে বসে কফি খাই। এরপরে প্রথমেই দেখে নিই বাবা কি করছেন। তারপরে কিছুক্ষণ টিভি দেখি। মাঝে একদিন ভিডিও গেম খেললাম। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইন্টারনেট পেতে পারি কি না। বললাম অনেকদিন ফেসবুক চেক করা হয় না। উত্তরে না সুচক জবাব পেলাম। কখন কাকে ম্যাসেজে জানিয়ে দিই, ‘আমি কিডন্যাপড’। রিস্ক নেয়ার কথা না। হ্যাঁ সুচক উত্তর অবশ্য আমি এক্সপেক্টও করিনি।
গত দুটো দিন এভাবেই হেসে খেলে কাটল। আজ সকালে মজার একটা ঘটনা ঘটল। সকালে এগারোটার দিকে। তখন কেবল ভিডিও গেম খেলা শেষ করেছি। খুব কফি খেতে ইচ্ছে করছিল। রান্নাঘরে আমার প্রবেশে ঠিক নিষেধ নেই, তবে কোন কাজ অ্যালাউ করছে না আসিফ। সেই ‘গেস্ট’ এক্সকিউজ। আসিফকে অর্ডার করতে মন চাইছে না। আচ্ছা, নিজের জন্য কিছু করতে চাইলে কি বারণ করবে? ভাবলাম নিজে গিয়েই বানাই।
উঠতে যাব, এমন সময় আসিফ নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— আমি করে দিচ্ছি।
অবাক হলাম। বুঝে উঠতে পারলাম না কি বোঝাতে চাইল। এমন না যে এই সময় আমি নিয়ম করে কফি খাই। আজকেই কেবল ইচ্ছে করেছে। সিসি টিভি ক্যামেরায় কি আমাকে লক্ষ্য করছিল? বাট…। আচ্ছা দেখিই না, ‘আমি করে দিচ্ছি’ বলতে কি বোঝাল।
অপেক্ষার পালা শেষ হল। দুকাপ কফি নিয়ে আসিফ লিভিং রুমে আসল। আজকে ও কালো একটা টিশার্ট পড়েছে। কেন যেন আজকে অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। কিডন্যাপার না হলে… দুর কি সব ভাবছি।
— ঠিক আছে?
আমার কফিতে চুমুক দেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে ছিল। চুমুকের পরে প্রশ্নটা করল। উত্তরে একটা মিষ্টি স্মাইল দিলাম। এরপরে ব্যাপারটা জানতে চাইলাম
— বুঝলেন কি করে, আমার এখন কফি খেতে ইচ্ছে করছে?
উত্তরে সেই কিলার স্মাইল। নাহ, এই ছেলে তো দেখছি ধীরে ধীরে মনে জায়গা করে নিচ্ছে। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— কি ঠিক করলেন?
ছেলেটার দিকে এবার বেশ মনোযোগের দৃষ্টিতে তাকালাম। বোঝার চেষ্টা করলাম ও কি ভাবছে। বুঝতে পারলাম না। তাই বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম
— কি ব্যাপারে?
— ইশতিয়াককে ভালবাসার ব্যাপারে
— সত্যি জানতে চান?
ছেলেটা কফির কাপে চুমুক দিল। এরপরে মাথা ওপর নিচে ঝুঁকিয়ে সম্মতি বোঝাল। বলল
— ইয়েস।
এবার আসিফের চোখে চোখ রেখে বললাম
— ঠিক করলাম, আপনার ক্লায়েন্টের কথা মত উনাকে তিন তারিখে আমি বিয়ে করব অ্যান্ড দেন, সেদিনই কমিউনিটি সেন্টারে, সবার সামনে ভদ্রলোককে আমি খুন করব। এরপরে আমার কি হবে, এনিয়ে আমি এই মুহুর্তে ভাবছি না।
নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না, তবে আমার ধারণা আমার চোখ দিয়ে তখন আগুন বেরোচ্ছিল। চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনল। কফিতে একটা চুমুক দিল। কিছুক্ষণ ভাবল। এরপরে বলল
— আপনাকে কিডন্যাপের কন্ট্রাক্টটা আমি কেন নিয়েছি জানেন?
এবার বেশ অবাক হলাম। নিজের অজান্তেই ভ্রু কুচকে গেল। আসিফের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অপেক্ষা করে আছি, কি বলে শোনার জন্য। পজটা একটু বেশিই নিচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, কথা গুছিয়ে নিচ্ছে। এবার মুখ তুলল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল
— আপনার জন্য।
আরেকটু হলে হাত থেকে কফির কাপটা পড়ে যাচ্ছিল। বলে কি এই ব্যাটা। আমার হতবাক মুখের দিকে তাকিয়ে আসিফ বাকী কথাগুলো বলা শুরু করল। গল্পটা খুব বিশ্বাস হল না। আবার অবিশ্বাসও হচ্ছে না। কথায় যুক্তি আছে। বাট… একটু বেশি মেলোড্রামাটিক। মনে অবশ্য তখন অন্য প্রশ্ন। জিজ্ঞেস করলাম
— ইশতিয়াকের সাথে পরিচয় কিভাবে?
কফিতে চুমুক দিল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল
— আপনার এই সো কলড প্রেমিক কাম ‘উড বি হাজব্যান্ড’ ছিলেন আমার প্রাক্তন কলিগ। আমেরিকায় একসাথে জব করতাম। একই সিকিউরিটি ফার্মে। হি অলসো ইজ অ্যা জিনিয়াস, লাইক মি। দারুণ সব সিকিউরিটি সফটওয়ার তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। বড় বড় অর্গানাইজেশান তাদের ডাটা সিকিউরড রাখতে আমাদের ফার্মকে হায়ার করা শুরু করে। দেখতে দেখতে ও টপে উঠে যায়। একসময় চাকরী ছেড়ে দিয়ে ফ্রি ল্যান্স কাজ শুরু করে। অ্যান্ড দেন… যাকে বলে লিটারালি টাকার পাহাড় গড়ে তোলে।
কথাগুলো সম্ভবতঃ বলছে আমাকে ইম্প্রেস করার জন্য। পার্ট অফ হিজ ডিল। তাই এই মুহুর্তে কোন কথাই বিশ্বাস করছি না। আর যেভাবে বাই ফোর্স আমাকে বিয়ে করার প্ল্যান ফেঁদেছে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ প্রমাণিত হলেও, এই ছেলেকে আমি কোনদিন অ্যাকসেপ্ট করব না। তবে গল্পটা ইন্টেরেস্টিং। বাকীটা শুনতে ইচ্ছে করছে। বললাম
— তারপর?
— তারপর আপনার ইশতিয়াকের আর কোন গল্প নেই। আমার গল্প শুরু।
‘আপনার ইশতিয়াক’ কথাটা ইচ্ছে করেই বলল মনে হল। আমাকে ইরিটেট করার জন্য। এই মুহূর্তে কাহিনী থেকে সরতে চাইছি না। পরে স্কোর সেটল করব। আপাততঃ তাই চুপচাপ রাগটা গিলে ফেললাম। মুখে একটা স্মাইল টেনে জানতে চাইলাম
— বেশ, আপনারটাই শুনি। কি হল এরপরে?
— ঠিক সেই সময়ে, আমার ক্যারিয়ার স্থবির হয়ে ছিল। ও চলে যাওয়ার পরে সফটওয়্যার ডিজাইনের চিফ আর্কিটেক্ট হই আমি। জিনিয়াস আমি নিজেও কম ছিলাম না। বাট… কেমন করে যেন ঠিক ব্যাটে বলে হচ্ছিল না। যেসব অ্যাসাইনমেন্ট পাচ্ছিলাম, কোন সফটওয়ারই রোবাস্ট হচ্ছিল না। হ্যাকার দিয়ে টেস্ট করতে গেলে দেখা যেত ওরা ক্র্যাক করে ফেলছে। একদিকে ইশতিয়াকের সাফল্য আর অন্যদিকে আমার ব্যার্থতা। একসময় ফিল করলাম সমস্ত ফ্রাস্ট্রেশান গিয়ে পড়ছে এই শালার ওপর। ঠিক করলাম, ওকে ডিস্ট্রয় করব। হ্যাকার হব। ওর তৈরী করা সফটওয়ার হ্যাক করব।
কখন যেন গল্পের ভেতরে ঢুকে গেলাম। বাকীটা জানতে মন চাইছে। গল্পটা গুছিয়ে নেয়ার জন্য আসিফের এই থেমে যাওয়াকে কিছুটা সময় দেয়া উচিৎ। অপেক্ষা করে আছি। বাট আসিফ সেই যে মাথা নীচু করেছে, আর উঠাবার নাম নেই। একেবারে চুপ। অস্থির লাগছে। বাকীটা কি বলবে না? গল্পটা জানতে চাইলে এই ব্যাটা আবার অন্য মিনিং বের করবে। কফিতে চুমুক দিলাম।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আসিফ চোখ তুলল। স্মাইল দিল, তবে এবার বেশ ম্লান। এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বলে ফেললাম
— বাকীটা?
ও আবার বলতে শুরু করল
— হ্যাক করতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, এই ফিল্ডে আমি রিয়েলি জিনিয়াস। ঠিক সেইসময় কিছু বাজে সঙ্গ জুটে গেল। ছোট খাট ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা শুরু করলাম। ভাল ইনকাম হচ্ছিল। অ্যান্ড দেন একদিন হ্যাক করতে গেলাম, আপনার ইশতিয়াকের তৈরি করা সিকিউরিটি কোড।
— ধরা পরে গেলেন?
সম্মতি জানাল। বলল্ল
— ইয়েস। জেল হল। যখন বেরিয়ে আসলাম, তখন বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কি করব। আমার টিমের সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে। জমানো টাকা দিয়ে চলছিলাম। একদিন আবিষ্কার করলাম পেছনে ফেউ লেগেছে।
— ইশতিয়াক লাগিয়েছে?
— না। এফবিআই। উইকিলিকসের পরে ওরা হ্যাকার দেখলেই পেছনে লাগে। ওদের ভয় আমি যদি আমেরিকার গোপন কোন নথি হ্যাক করি।
— তারপর?
— তারপর ওরা অফার দিল, প্রফেশান চেঞ্জ করতে। ট্রেনিং দিল। আন্ডারকাভার এজেন্টদের যেসব ট্রেনিং দেয় আর কি। জেমস বন্ড টাইপ। অ্যান্ড দেন, আমাকে ইমিউনিটি দিল। ছোটখাট ক্রাইম করতে পারি, ওরা ধরবে না। শর্ত শুধু একটাই…
— ওদের ওয়েবসাইট হ্যাক করবেন না।
আসিফ সম্মতি জানাল। আমি তখন উদগ্রীব, আমি কিভাবে আসলাম এই গল্পে, সেটা জানার জন্য। জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা।
— আমার কিডন্যাপিংয়ে কিভাবে ইনভল্ভ হলেন?
— এফবিআইয়ের অফার পেয়ে শুরু করলাম ছোটখাট ক্রাইম। দেখলাম সবচেয়ে লাভজনক হচ্ছে ছিনতাই আর কিডন্যাপিংয়ে। একে তো ধরা পড়ার ভয় নেই, অন্যদিকে একটা রিভলভার হলেই কাজ চলে যায়। হ্যাকিং তো জানিই, কাউকে টার্গেট করলে, ওর কম্পিটার হ্যাক করে সেই লোকের সেদিনের প্ল্যানিং জেনে নিতাম। দেখতে দেখতে বেশ দক্ষ কিডন্যাপার হয়ে উঠলাম। অ্যান্ড ওয়ান ডে, ইশতিয়াক কেম টু মি, উইথ ইয়োর পিকচার।
আবার আমার দিকে তাকাল। এবার আমার চোখে চোখ রেখে বলতে লাগল
— ইশতিয়াক যখন আপনার ছবি আমাকে দেখিয়ে বলল, একে কিডন্যাপ করতে হবে, আমি এক বাক্যে রাজী হয়ে গেলাম। যা শর্ত দিল সব মেনে নিলাম।
ব্যাপারটা ক্লিয়ার হল না। কি বোঝাতে চাইছে। আমার ছবি দেখে এই ডিলে রাজী হয়েছে মানে কি? কথাটা জানতে চাইলাম
— একটু এক্সপ্লেইন করবেন?
আসিফ এবার আমার দিকে তাকাল। বলল
— আপনার ছবি দেখে…
এরপরে আমার দিকে তাকাল। কেমন যেন একটা লাজুক টাইপ চাহনি। বলল
— লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট। প্রেমে পড়ে গেলাম আপনার। বাট এটাও জানি… আপনার সাথে ম্যাচ মেকিং কোনভাবেই সম্ভব না। তবে অফারটা নিলে একটা প্রাপ্তি আছে। আর তা হচ্ছে আপনার সাথে এই ছটা দিন একসঙ্গে কাটাতে পারব।
চলবে
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/groups/Anyaprokash/posts/1311506829364341