#স্মৃতিতে_তোমার_বন্দনা
#পর্ব_৩৫
#Saji_Afroz
.
.
কাল রাতে তুষার অনেক রাত অবধি জেগেছিল । কিছুতেই তার চোখে ঘুম আসছিল না । ছোঁয়াকে দেখার পর থেকে আগের সব কথা মনে পড়ে গেল তার । রাগ হচ্ছে নিজের উপরে । কেন সে গেল কাল শপিংমলে!
এসব ভাবতে ভাবতে অনেক চেষ্টার পর কেবল একটু তন্দ্রাভাব এল । তখনি তার ফোনটা বিকট শব্দে ভাইব্রেট করে উঠল । সে বিরক্তিভাব নিয়ে ফোনটা রিসিভ করে ঘুমে জড়ানো কণ্ঠে বলল-
হ্যালো ।
.
ওপাশ থেকে মেয়েলী কণ্ঠে শুনতে পেল সে-
কেমন আছো?
.
এই কণ্ঠ তার অচেনা নয়! কত রাত জেগে কথা বলেছে সে এই কণ্ঠের সাথে । হ্যাঁ মেয়েটি ছোঁয়া । কিভাবে সে ভুলে থাকবে ছোঁয়ার কণ্ঠ!
.
উঠে বসলো তুষার । নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল-
হঠাৎ তুমি?
.
ছোঁয়া বুঝতে পারলো, তাকে চিনতে পেরেছে তুষার ।
এতদিন পরেও তার কণ্ঠ শুনেই তাকে তুষার চিনেছে, এই খুশিতেই চোখের কোণে পানি চলে এল ছোঁয়ার ।
.
সে বলল-
তখন যেটা জানাতে পারিনি আজ জানাতে ফোন দিয়েছি । আমি তোমাকে বলব না, ফিরিয়ে নাও আমাকে তোমার জীবনে । এতটুকু বলব, আমায় ক্ষমা করে দিও । আমি নিরুপায় ছিলাম তুষার ।
-এতদিন পর কি জানাতে চাও তুমি?
-আমি তোমাকে বলেছিলাম, তোমাকে আমি ভালোবাসিনা । রাফসানকে বিয়ে করব । কারণ উনিই আমায় সুখে রাখতে পারবে । এটা আমার মনের কথা ছিল না তুষার ।
-তবে?
.
সবটা তুষারকে জানালো ছোঁয়া । এসব বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে ।
তুষার তাকে শান্তনা দিয়ে বলল-
শান্ত হও তুমি । এমন করলে আমার কষ্ট হবে ।
.
শেষের কথাটি শুনে ছোঁয়ার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তুষার কি এখনো ভালোবাসে ছোঁয়াকে?
কিন্তু কিছু বলতে পারছেনা সে ।
তুষার বলল-
এসব জেনেও তুমি কি রাফসান কে বিয়ে করতে চাও?
-নাহ ।
.
কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করার পর তুষারই বলল-
আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি ছোঁয়া ।
.
এই একটি কথাতেই ছোঁয়ার হৃদয়টা জুড়িয়ে গেল । মনেহচ্ছে হাজার বছর ধরে এই কথাটি শোনার অপেক্ষা করছিল সে, মনেহচ্ছে আজ তার দেহে প্রাণ ফিরে এসেছে!
চোখ জোড়া বন্ধ করে ছোঁয়া বলল-
সত্যি?
-হ্যাঁ ছোঁয়া । তোমাকে ছাড়া একটা দিনও ভালো কাটেনি আমার, প্রতিটা মুহুর্তে কষ্ট পেয়েছি । দিন শুরু করেছি এই আশায়, তুমি ফিরে আসবে আজ! সেই আজ, আজকের দিনটা হবে আমি ভাবতে পারিনি ছোঁয়া । আজ আমি অনেক খুশি, অনেক । আমার ভালোবাসা সত্যি ছিল বলে ফিরে এসেছ তুমি । এবার সারাজীবনের জন্য চলে এসো আমার কাছে ।
.
ছোঁয়ার কান্না থামছেই না! এই যেন খুশির কান্না!
.
.
একটা কফি শপে রাফসানের সামনে বসে আছে পরশ । রাফসান আজই ফিরেছে । সেই খবরটা পেয়ে, নয়নতারার থেকে ফোন নাম্বার নিয়ে দেখা করতে এল পরশ ।
রাফসান বলল-
এভাবে বাইরে দেখা করার মানে বুঝলাম না?
-আসলে ছোঁয়া সবটা জেনে গিয়েছে ।
.
কপালের ভাজ তুলে রাফসান বলল-
কি বিষয়ে?
-আপনার বিষয়ে ।
-মানে?
.
পরশ সব বলল তাকে । সবটা শুনে রাফসান কি বলবে বা করবে বুঝে উঠতে পারছেনা ।
ছোঁয়া এখন কি করবে? এটায় তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে ।
পরশ বলল-
ছোঁয়া ফিরে গিয়েছে তুষারের কাছে । তুষারও তাকে ভালোবাসে এখনো ।
.
রাফসান হতাশ হয়ে বলল-
জোর করে ভালোবাসা পাওয়া যায়না, কথাটি সত্য আরো একবার প্রমাণ হলো আমার মাধ্যমে ।
-আপনি কি বিষয়টি সহজে মেনে নিচ্ছেন?
-না নেয়ার মতো কিছু নেই । এত কিছু করেও ওর মন আমি জয় করতে পারিনি । ঠিকই সে ফিরে গেল তুষারের কাছে । এখন আমার আর কি করার আছে! খুনাখুনি করার মতো সাহস আমার নেই ।
.
মৃদু হেসে পরশ বলল-
বেশ!
.
সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রাফসান বলল-
আপনি ছোঁয়ার জন্য এত কিছু করলেন কেন? আমি কি আমার ধারণা সঠিক ভেবে নিব?
.
পরশ হাসলো আবারো ।
রাফসান বলল-
আমার কোনো আফসোস নেই । আমি তো চেষ্টা করেছি নিজের ভালোবাসাকে কাছে পাওয়ার ।
-আপনার লজ্জিত হওয়া উচিত । আপনার পথ ছিল ভুল ।
.
লজ্জা পেলো রাফসান । সে বলল-
আমি ক্ষমা চাইব ছোঁয়ার কাছে ।
-আপনার নয়নতারার কাছেও ক্ষমা চাওয়া উচিত । আপনাকে ভালোবাসে বলেই সে এসব করেছে । তার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে এসব করেছেন আপনি । আমার যা মনেহয়, আপনি জানতেন নয়নতারা আপনাকে ভালোবাসে ।
.
কথাটি শুনে অবাক হলোনা রাফসান ।
সে হেসে বলল-
সাইকিয়াট্রিস্ট এর সামনে বসে আছি । মিথ্যে বলে লাভ নেই! আমি দুজনের কাছেই ক্ষমা চাইবো ।
-বেশ! তবে চলুন যাওয়া যাক ।
.
.
ছোঁয়ার কাছে ক্ষমা চায়লে তাকে কোনো কথা বলল না ছোঁয়া । নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো সে । পরশ বলল-
কিছু তো বলো?
-যে সময়টা আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছে, সেই সময় টা কি উনি ফিরিয়ে দিতে পারবেন?
.
উত্তরে রাফসান কিছু বলতে পারলো না ।
ছোঁয়া বলল-
আমি আপনাকে ক্ষমা করব, যদি আপু করে! কারণ অন্যায় টা আপনি তার সাথেই বেশি করেছেন ।
-কোথায় সে?
.
নিজের রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে নয়নতারা । রাফসান এতক্ষণ যা বলেছে, আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনেছিল সে ।
রাফসান জানতো, নয়নতারা তাকে ভালোবাসে! নয়নতারার ডায়েরিতে তাকে নিয়ে লেখা কবিতাটি রাফসান পড়েছিল । কিন্তু কখনো প্রকাশ করেনি তা । বরং সত্যিটা জেনে তার দূর্বলতা বুঝে ব্যবহার করেছে তাকে! আর সে কিনা বোকার মতো, নিজের বোনের কথা না ভেবে তার কথা ভেবেছে! কথায় আছেনা…
ভালোবাসা মানুষকে অন্ধ করে দেয় ।
-তুমি এখানে!
.
রাফসানকে দেখে চোখের পানি মুছে ফেললো নয়নতারা ।
রাফসান এসে বলল-
আমি যা করেছি, সব কিছুর জন্য লজ্জিত নয়নতারা!
.
সে কিছু বলল না ।
রাফসান বলল-
ভাইয়া কাল দেশে আসবে । আমি জানি ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করেনা । বাবার কথায় কিছু বলেনি বিদেশ যাওয়ার আগে । কিন্তু কিছুদিন আগেই বলেছে, সে তোমাকে বিয়ে করতে চায়না । কোনো স্মার্ট মেয়েকে নিজের জীবনসঙ্গী করতে চায় । এসব আমি জানাইনি । ছোঁয়া জানলে যদি বিয়েটা ভেঙে দেয়! কিভাবে কি ম্যানেজ করব অনেক চিন্তায় ছিলাম । ভালোই হলো, সব সত্যিটা সামনে চলে এসেছে । এখন আর কোনো মিথ্যে বলতে হবেনা আমায় ।
.
এবারো নয়নতারা কিছু বলল না ।
আচমকা রাফসান তার হাত ধরে বলল-
না হোক ভাইয়া আর তোমার বিয়ে, না হোক না ছোঁয়া আর আমার । আমাদের বিয়েটা তো হতে পারে?
.
রাফসানের মুখে এমন একটি কথা শোনার অপেক্ষায় দিন পার করছিল যে নয়নতারা, আজ সে নয়নতারার কথাটি শুনে মনে কোনো আনন্দের সৃষ্টি হচ্ছেনা । হাত সরিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল সে-
যে ছেলে বন্ধুত্বের মূল্য দিতে জানেনা, সে কখনো ভালো জীবনসঙ্গী হতে পারেনা । আমাকে তুমি সবটা জেনে ব্যবহার করেছিলে রাফসান । আজ কিভাবে আশা করছো? আমি তোমাকে বিয়ে করব?
.
রাফসান কিছু বলল না । নয়নতারা বলল-
তুমি এখান থেকে চলে গেলেই আমি খুশি হব । কোনো একদিন তোমার ঋণ আমি শোধ করব রাফসান । আল্লাহ যেন ততদিন আমায় বাঁচিয়ে রাখেন ।
.
এই প্রথম রাফসানের মনে খারাপ লাগা কাজ করছে । তার ভুলের জন্য, নয়নতারার মতো একজন ভালো বন্ধুও হারালো সে ।
.
.
ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে পরশ । আকাশভর্তি তারার মেলা । ছাদটাও আলোকিত হয়ে আছে ।
এমন সময় ছোঁয়া এসে বলল-
তারাদের মেলা দেখছেন?
-হ্যাঁ ।
-আমিও দেখতে এলাম । সাথে আপনার দেখাও পাবো, ভাবিনি ।
-আমিও ।
-ধন্যবাদ দিয়ে আর ছোট করতে চাইনা আপনাকে । আপনি আমার জন্য যা করেছেন, কেউ করবেনা ৷ বলুন না, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?
-তোমার বিয়ের শাড়িটা আমার পছন্দে পরবে ছোঁয়া? আবদার বলতে পারো এটা ।
.
পরশের মুখে কথাটি শুনে ছোঁয়া একটু অবাক হলো । এমন একটা আবদার কেনো করে বসলো পরশ?
ছোঁয়া বলল-
বিয়ের সাজ, শাড়ি নিয়ে আমার কোনো প্লান নেই । আপনি পছন্দ করে দিতেই পারেন ।
-যদি তোমার হবু বর চায়?
.
কি বলবে ভাবতে লাগলো ছোঁয়া । পরশ বলল-
তবে থাক । আর না চায়লে আমি করবো ।
-হুম ।
-কোন অধিকারে এটা চাইছি জানতে চাও?
.
হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়লো ছোঁয়া । পরশ বলল-
আমার মায়ের ইচ্ছে এটা । তার কোনো মেয়ে নেই তো । তোমাকে নিজের মনের মতো করে সাজাতে চান তিনি । আর তার পছন্দ কেমন আমি জানি বলেই কথাটি বলেছি ।
.
ছোঁয়ার মুখে হাসি ফুটলো কথাটি শুনে ।
পরশ বলল-
তু্ষার কি কাল পরিবার নিয়ে আসবে?
-হ্যাঁ । মায়ের সাথে কথা বলবে কাল ।
-তুমি খুশি তো ছোঁয়া?
-অনেক । কিন্তু মা…
-তিনিও ঠিক হয়ে যাবেন ।
-আপুকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে । আমার জন্য তার বিয়েটা..
-তোমার জন্য নয় । রাদিব তাকে এমনিতেই করতো না বিয়ে ।
-হুম ।
-আমার এক ফ্রেন্ড এখানে এসেছিল, মনে আছে তোমার? নাম আশফাক ।
-হ্যাঁ থাকবেনা আবার! অনেক মজার মানুষ তিনি ।
-সে নয়নতারাকে পছন্দ করেছিল প্রথম দেখাতেই । কিন্তু বিয়ে ঠিক আছে বলে আমি তোমাদের কিছু জানাইনি । আশফাক বিয়ের জন্য পাত্রি দেখছে । তুমি কি নয়নতারাকে বলবে ওর কথা? সে যদি চায়, আশফাক কে তার পরিবার নিয়ে আসতে বলব আমি ।
-আমি এখুনি মা আর আপুকে কথাটি জানাচ্ছি ৷ আমার তো তাকে বেশ পছন্দ হয়েছে দুলাভাই হিসেবে । আপুরও নিশ্চয় হবে ।
-আচ্ছা যাও ।
.
ছোঁয়া চলে যেতেই আগমন ঘটলো শফিউল আহম্মেদের । পরশের কাধে হাত রেখে তিনি বললেন-
সবার খুশির খেয়াল রাখিস তুই । তোর মুখ থেকে হাসিটা চলে যাচ্ছে, আমাদের কি হবে ভেবে দেখেছিস? তোকে এভাবে দেখতে আমাদের ভালো লাগেনা পরশ, ভালো লাগেনা ।
.
চলবে