স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_১৫
Writer -Afnan Lara
.
নীল চলে যাচ্ছে অফিসে
অথচ মুন এখনও দাঁড়িয়ে নীলের যাওয়া দেখছে
.
এরপর নাস্তাটা সেরে কোমড়ে আঁচল গুজে নীলের রুমকে মানুষ করলো সে,,
সব পরিষ্কার করে ফেললো ধীরে ধীরে,,
.
হুম এখন ঠিকঠাক লাগছে রুমটা,
.
মুন খোঁপা ছেড়ে নীলের রুমের আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো
গায়ে তার খয়েরি রঙের সুতোর শাড়ী,,গলায় সোনার একটা হালকা পাতলা চেন,নীলের মা পরিয়ে দিয়েছিলো সেটা,,ঠোঁটে কোনো লিপ্সটিক নেই,কারণ মুন বেশি সাজগোজ পছন্দ করে না
চোখে কাজল ও দেয় না,চুলটা ঠিক করে মুন এক প্রকার জোর করেই হাসলো
এবার নিজেই নিজের সাথে কথা শুরু করলো সে
.
মুন এখন তুমি কারোর বাড়ির বউ,কোনো একজনের স্ত্রী ,যার নাম নীল চৌধুরী,,একজন পুলিশ অফিসার,,তুমি তাকে চেনো না,,সেও তোমাকে চিনে না,নামে মাত্র হাসবেন্ড ওয়াইফ তোমরা,,এ্যারেঞ্জড ম্যারেজেও একে অপরের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানা থাকে,আর তুমি মুনতাহা রহমান,তুমি শুধু এটাই জানো নীলের অতীত আছে যেটা তোমাদের মাঝে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে আজীবন,বুঝছো,আর সেই দেয়ালের নাম হলো “স্মৃতির দেয়াল,,,এই দেয়াল ভাঙ্গবে না কারণ নীল আজ পর্যন্ত একটিবার মুখ তুলে তাকিয়ে দেখেওনি তোমাকে
দেয়াল ভাঙ্গবে না বরং সে দেয়ালে বিভিন্নরকম রঙ করা হবে প্রতিবছর
.
-হুম এবার উনার আলমারিটা দেখব,এসব চিন্তা বাদ,আমাকে এটা মানতে হবে যে লোকটা আমার বিপদে আমার সাহায্য করেছে,কত বড় ভাগ্য হলে এমনটা হয়??
.
আলমারি কি দেখবো?নাহ,থাক,কাউকে না বলে তার পার্সোনাল জিনিস দেখা ঠিক না,আমি বরং উনাকে জিজ্ঞেস করে দেখবো,তারপর পরিষ্কার করে নিবো,কিন্তু আজ তো এই শাড়ী পরলাম,কাল কি পরবো,আমার তো পরার কোনো শাড়ী নেই,বাসায় গেলে সব জামা কাপড় নিয়ে আসতে পারতাম
এখন তো ভুলেও আমার বাসায় যাওয়া যাবে না,মা চিবিয়ে খাবে আমাকে আর তুষার তো আছেই,এদিকে উনার ভাইয়া ভাবীরা আসবে,আমি কি পরবো?এটাই পরা থাকুক,আর কি করবো,উনার মা তো বাবাকে নিয়ে বাজারে গেছেন,নিপা আপু দরজা বন্ধ করে তার হবুর সাথে ফোনে কথা বলছে,বলতে গেলে বাসা ফাঁকা
.
মুন গালে হাত দিয়ো বারান্দায় এসে এক দৃষ্টিতে লিচু গাছটার দিকে চেয়ে থাকলো
ইস যদি একটু উঠতে পারতাম,কি সুন্দর ঢাল আর ঢাল
বসে পা দুলানো অনেক ইজি হবে,হাতে যদি থাকে তেঁতুল আর লবণ মরিচ,আহা আহা বিষয়টা জমে ক্ষীর হয়ে যাবে
আচ্ছা এখন তো কেউ নাই,আমি বরং আমার ইচ্ছা পূরন করে ফেলি,মনটাও ভালো হয়ে যাবে
.
এসব ভেবে মুন এক দৌড়ে রান্না ঘরে আসলো,নাহার নেই,সে গেছে তার বাসায় কি যেন কাজে,মা বলেছে বিকালে আসতে,বিকালে ভাইয়াদের জন্য রান্না হবে সেটা করবে মা নিজেই,নাহার তখন যেন হেল্প করতে আসে এটা বলেছেন ওকে
আর আজকে দুপুরের জন্য রান্নার দায়িত্ব নিপা আপুর ছিল,উনি চুলায় ভাত আর ডাল বসিয়ে গেছেন
মুন ফ্রিজ থেকে একটা বক্স বের করলো,ভিতরে খোসা ছাড়ানো তেঁতুল,এগুলো মায়ের,মা তেতুলের পোকা,সবসময় তেঁতুল তার লাগবেই লাগবে
মুনের একটা সুবিধা হলো,মায়ের সাথে সাথে সেও রোজ খেতে পারবে
দাঁত কেলিয়ে চার পিস নিয়ে নিলো সে
বক্সটা ফ্রিজে রেখে দিয়ে লবণ এক চামচ আর মরিচ এক চামচ মিক্স করে একটা কাগজে নিয়ে ছুটলো গাছের দিকে
এসে গাছটাকে যতটা সহজসরল মনে হয়েছিলো সেটা একদমই ভুল,এটা দেখি এত লম্বাচওড়া গাছ,এখন গাছে উঠতে আমার দুই হাতের প্রয়োজন হবে,তাহলে তেঁতুল আর লবণ মরিচ কোথায় নেবো?
ভাব মুন!!ভাব
ও হ্যাঁ,শাড়ীর আঁচলে গিট্টু দিয়েও তো নিতে পারি কিন্তু লবণ মরিচ তো সব ফালাছড়া হয়ে যাবে,কাগজটা এত ছোট যে মোড়াতেও পারছি না কি ঝামেলা
.
মুন তেঁতুল শাড়ীর আঁচলে গিট্টু দিয়ে লবণ মরিচ হাতের মুঠোতে নিয়ে গাছে ওঠা শুরু করে দিলো
নীল আজ জলদি জলদি বের হতে গিয়ে অফিসের দরকারি ফাইলটা রুম থেকে নিতে ভুলে গিয়েছিলো,বেশিদূর আসেনি বলে গাড়ী ঘুরিয়ে আবারও বাড়ি ফিরছে সে,এরই মাঝে মা ফোন করে অর্ডার করলো মুনকে সাথে নিয়ে শপিং করিয়ে আনতে,ওর ভালো শাড়ী জামা নাই তাই
নীল তাই একটু জলদি করেই ফিরছে, তাড়াতাড়ি সব কাজ সেরে অফিসে যেতে হবে
মুন তখন সবে একটা ঢালে উঠেছে অনেক কষ্টে
নীল গাড়ী নিয়ে বাসায় ফিরতেই সবার আগে ওর চোখ গেলো ওরই বারান্দার সাথের লিচু গাছটার দিকে
মুন সেখানে বাদুড়ের মতন ঝুলে আছে,শাড়ী পরে কোন পাগলে গাছে উঠে তা মুনকে দেখলে প্রমাণ হয় সে একটা পাগল,আবার এক ঢালে উঠেও গেছে
নীলের চোখ কপালে,মুন এখনও ওকে দেখেনি,সে তার মতন ঝুলে হাত পা ছড়িয়ে আরেকটা ঢালে ওঠার মোক্ষম চেষ্টা চালাচ্ছে এখন
.
নীল হনহনিয়ে সেদিকে গিয়ে এক ধমক দিতেই ভয়ের চোটে মুন গাছ থেকে নিচে
নীল ঠিক সময়ে ধরে ফেললো ওকে
কথা সেটা না,কথা হলো এভাবে ধরে ফেলায় মুন তার হাতের লবণ মরিচ শূন্যের উপর ছুঁড়ে দিয়েছিলো
এখন আপাতত সব নীলের মুখে আর চুলে
.
নীল হাঁচি দিতে দিতে মুনকে নিচে নামিয়ে দিয়ে রুমাল বের করে নাক মুখ মুছতে মুছতে বললো”কি হলো এটা,কি করলে!!
.
সরি সরি
.
মুন কিছুটা ব্যস্ত হয়ে শাড়ীর আঁচল দিয়ে নীলের মুখ মুছতে যেতেই নীল হাত দিয়ে মানা করে বললো”লাগবে না”
.
চলে গেলো সে
.
মুন মুখ বাঁকিয়ে ভাবছে আরেকটা মেয়ের আঁচল দিয়ে মুখ মুছলে কি হিয়া রাগ করবে??ঐ মেয়ের সাথে একবার কথা বলতে হবে,তার তো জানা উচিত তার পাগল প্রেমিক বউয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না
.
এসব ভাবতে ভাবতে মুন বাসার দিকে যেতে নিতেই গেট খোলার আওয়াজ পেয়ে সেদিকে তাকালো,একটা নীল রঙের কার ঢুকছে ভেতরে
কেূলো করেছে,,ভাইয়া ভাবীরা এসে পড়েননি তো?
.
মুন এক দৌড়ে পালালো,এমন জোরে দৌড় দিলো রুমে যাওয়ার জন্য সে ঘটে গেলো বিপত্তি
নীল তখন সবেমাত্র গায়ের পোশাক খুলেছে কারণ ওর জামার ভেতরেও মরিচের গুড়া ঢুকেছিলো
মুন গিয়ে ওর উদম গায়ে দুম করে পড়লো
নীল নিজেকে সামলে মুনকেও ধরে ফেললো নাহলে দুজনে এতক্ষণে বিছানায় পড়তো
.
আজব!!!
.
এত বড় ধমক শুনে মুন দূরের কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো ভয়ে
.
একদম আমার এত কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবা না,তোমাকে ছুঁতে চাই না আমি তাও বারবার এমন সিচুয়েশন কেন ক্রিয়েট করো যেটাতে তোমাকে ছোঁয়ার দরকার পড়ে যায়
.
মুন মুখটা ছোট করে চেয়ে আছে এখনও,তারপর হঠাৎ গাল ফুলিয়ে বললো”আমাকে বাঁচানোর জন্য ছুঁলেও যদি আপনার হিয়া রাগ করে তো আর ছুঁবেন না আমাকে,মরলে মরবো তাও আপনার আর আপনার হিয়ার খোঁটা শুনতে পারবো না
মুন মুখ বাঁকিয়ে রুম থেকে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো
নীলের ও রাগ হলো,তার ও একটা ডায়ালগ মারা উচিত ছিলো এখন
তাকে যা বলার বলুক কিন্তু হিয়াকে কেন বলবে?তাই সেও পিছু নিয়েছে মুনের
মুন সোফার রুমে আসতেই থেমে গেলো
সেখানে দুজন মানুষ,একটা মেয়ে আর একটা ছেলে,কাউকেই মুন চিনলো না
তারপর ভাবলো নীলের ভাইয়া ভাবী না তো??আন্দাজেই সালাম দিলো সে,নীলের ভাইদের ছবি সব ওয়ালে টাঙানো ছিল,মুন দেখেনি সেগুলো
উনারা সালাম নিলেন,,লোকটা বললেন”নীল বাসায় আছে?”
.
মেয়েটা মুখ টা ফুলিয়ে রেখেছিল এতক্ষণ তারপর হঠাৎ মিথ্যা হাসির অভিনয় করে জিজ্ঞেস করলো মুন কি হয় এই বাড়ির
মুন শাড়ীর আঁচল থেকে লবন মরিচ বালু পাতা সব ঝাড়তে ঝাড়তে আঁচল টেনে মাথায় দিয়ে বললো”আমি হলাম…”
.
ওপাশ থেকে নীল এসে বললো”ও আমার স্ত্রী,এই বাড়ির নতুন বউ,এবং ছোট বউ”
.
মুন পিছন ফিরে নীলের দিকে তাকালো,নীল শক্ত হয়ে সেই দুটো মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে
মেয়েটা সোফায় বসলো চুপচাপ,কপালের ঘাম মুছলো গায়ে থাকা জর্জেটের ওড়না দিয়ে,জর্জেট দিয়ে তো আর ঘাম মুছা হয় না
নীল দূর থেকে বললো”বসেন,আমি দু মিনিটে আসছি”
.
মুন সিউর হলো এটা ভাইয়া ভাবী না,কারন উনারা হলে নীল কথা শুরু করতো,তাহলে এরা কারা??
.
মুন রান্নাঘরের দিকে গেলো নাস্তা আনতে,আর ভাবতে থাকলো এরা কারা হতে পারে
.
নীল একটা টিশার্ট পরে আসলো,,ওদের সামনে বরাবর সোফায় বসলো সে
মেয়েটি হালকা হেসে বললো”বিয়েটা তাহলো করেই ফেললে”
.
নীল ও হাসলো তারপর হাসি মূহুর্তেই থামিয়ে বললো”কি আর করবো,সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না,আর কেউ কারোর জন্য থেমে থাকে না,তাই না হিয়া???
তা সাকিব??কি খবর?’
.
ভালো,আমিও খুব খুশি হলাম এটা জেনে যে তুমি তোমার লাইফটা গুছিয়ে নিয়েছো
.
হিয়া কোনো কথা বলছে না,চুপ করে সামনে থাকা সেন্টার টেবিলটার দিকে তাকিয়ে আছে সে
সেখানে নীলের প্রতিচ্ছবি,ভালোবাসার মানুষটা আজ অন্য কারোর,অবশ্য আমিও তো অন্য কারোর হয়ে গেলাম
.
চা এসে গেছে,নিন,আগে নাস্তা করুন তারপর চা
.
নীল মুনের দিকে এক নজর তাকালো,গাছে ওঠার শাস্তি আর লবণ মরিচ গায়ে ঢালার শাস্তিস্বরুপ ধরে পিটাইতে ইচ্ছে করছে ওকে কিন্তু নাহ আপাতত হিয়ার সামনে ঠিকঠাক চলতে হবে তা নাহলে হিয়া এটা নিয়ে হাসবে কারণ ওর নীল একটা আগোছালো,চঞ্চল মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে
নীলের ভাবনায় ছেদ ঘটালো হিয়ার উক্তি
হিয়া মুনপর দিকে তাকিয়ে বললো”তা নীল!!!এত বাচ্চা একটা মেয়েকে বিয়ে করলে??সামলাতে পারছো তো?”
.
নিজের নামের উপর বাচ্চা নামটা এওয়ার্ড হিসেবে পেয়ে মুনের রাগ হলো
কিসের বাচ্চা সে?এরকম বয়সী মেয়েরা বাচ্চা হয়??
আরে আমি অনার্সে পড়ুয়া মেয়ে,কোথা থেকে আসছে এই ফকিন্নি,নিজে মনে হয় কত ম্যাচিউর!,দেখে তো শুকনা কাঠি মনে হয়
.
নীল মিষ্টির বাটি একটু ঠেলে দিলো সাকিবের দিকে তারপর বললো”মুন??শুনলে তো হিয়া কি বললো?”
.
হিয়া নাম শুনে মুনের পায়ের তলার মাটি মনে হয় জায়গা ছেড়ে পালিয়েছে
মুন ইয়া বড় হা করে তাকালো তারপর মনে মনে ভাবলো সূবর্ন সুযোগ হাতের কাছে পেলাম,আজ এরে বাসা ছাড়তে দিব না,আগে দেখবো ওর আর আমার কি তফাৎ
.
মুন???বসো আমার পাশে,এভাবে দাঁড়িয়ে থেকো না
.
মুন চুপচাপ নীলের পাশে বসে নিজের হাতের রঙ আর হিয়ার হাতের রঙ মেলাচ্ছে,যতদূর মেলালো সেটা হলো মুন নিজে একটু ফর্সা কম,আর হিয়া একটু বেশি ফর্সা
মুখটা ফুলিয়ে মুন নীলের দিকে তাকালো
তার ধারনা হিয়া বেশি সাদা বলে নীল ওর প্রেমে পাগল
হিয়া চায়ে চুমুক দিয়ে বললো”তোমার ওয়াইফ মনে হয় তোমার উপর রেগে আছে?বারবার গাল ফুলিয়ে তাকাচ্ছে”
.
নীল মুনের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে বললো”বাচ্চা মেয়ে তো!!চকলেট,আচার এসবের জন্য বায়না ধরে,সব তো পূরন করা যায় না,দাঁতে পোকা নাহলে জলদি হবে,তাই ধমক দিয়েছিলাম,বুঝোই তো বড় সাইজের বাচ্চাদের ধমক দিলে কাজে লাগে
.
ভালোই কেয়ার করছো তাহলে
.
কেয়ার তো করতেই হবে,কেয়ারের খাতিরেই তো আজ সে আমার স্ত্রী
.
হিয়া বারবার সোফা চেপে ধরছে,আজ সে টের পাচ্ছে সেই কষ্ট যেটা নীল কয়েকবছর আগে পেয়েছিলো তাকে আরেকজনের স্ত্রী হতে দেখে,তবে ওদের মাঝের এমন বসার দূরত্ব আর কথা বার্তার দূরত্ব দেখে হিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো
মুচকি হেসে বললো”সাকিব তুমি একটু নীলের সাথে কথা বলো,আমি মুনের সাথে একটু কথা বলি,,মেয়ে মানুষ তো,সব কথা তো আর সবার সামনে বলা যায় না”
.
সাকিব ও বলদের মতন ঠিক আছে বলে দিলো
নীল মুনের দিকে তাকিয়ে ব্রু দুটো একটার পর একটা কুঁচকালো
.
মুন ও ব্রু কুঁচকালো
.
দুজনে ব্রু দিয়ে কথা বলে যাচ্ছে ক্রমাগত
চলবে♥