স্মৃতির দেয়াল🍁 পর্ব-৪

0
937

স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৪
Writer -Afnan Lara
.
মুন কাঁদতে কাঁদতে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে গেছে,,
তাদের বাসা থেকে একটু দূরে একটা লেকের কিনারা দিয়ে নিচে নেমে বসে পানির দিকে চেয়ে রইলো সে
.
নীল সেসময়ে লেকটার বিপরীত পাশে বসে ছিল,তখন বিকালবেলা,,এই সময়টায় নীল একটু হাঁটতে বের হয়,,বিকাল নীলের প্রিয় বেলা
এই বিকালেই সে হিয়াকে নিয়ে ঢাকার কত চত্বর ঘুরেছে তার হিসেব নেই আর আজ সব ভুলে মনটা চায় তাকে নিয়ে আবারও ঘুরি যেটা আর কোনোদিন সম্ভব নাহ
লেকের পথ দিয়েই কিছু বয়স্ক কাপলরা ব্যায়াম করছেন,কেউ কেউ আড্ডা জমিয়েছে,কেউ বা আমারই মতন আনমনে বসে আছে, কি অদ্ভুত!
একা থাকলে মানুষের মনে কত কথাই না জাগে
আমার তো একা থাকলেই হিয়ার ছবি,হিয়ার কথাবার্তা মনে পড়ে যায়
কতটা ভালোবাসলে একটা মানুষকে ভোলা ওঠিন হয়ে যেতে পারে তা হয়ত আমি খুব ভালো করে জেনে গেছি
কিন্তু আমি তো ভুলতে চাই না,আমি চাই সে আমার মনে বসবাস করুক,আমি তাকে মনে রেখেই ভালোবেসে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো
তবে খারাপ লাগে এই ভেবে যে আজ আমার পাশে আমার হিয়া নেই,চেয়েও তাকে একটিবার দেখতে পারি না,এখনও হালকা বাতাস গায়ে লাগলেই মনে হয় হিয়া বুঝি আমার কাঁদে হাত রাখলো
কিন্তু নাহ!সে আসবে না আর
জীবনটা বড়ই গোলমেলে,কারোর সাথে সবসময় খারাপটাই হয়,আর কারোর সাথে সবটা ভালো হয়
কপাল থাকা লাগে বৈকি
সব ঠিক ছিল কিন্তু ভাগ্যটাই সেদিন আমার সাথে ছিলো না
আজ আমি প্রতিষ্ঠিত কিন্তু যার জন্য এত কিছু সে….
.
এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নীল মুনকে দেখলো,সে পানির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে চোখ মুছতেসে,,
আবার কি যেন মনে করে লেকের পানিতে ওর প্রতিচ্ছবিকে হাত দিয়ে নেড়ে দিলো,তারপর আবার ও কাঁদতে থাকলো,,
নীল এতক্ষন শান্তি করে বাতাস খাচ্ছিলো আর হিয়াকে নিয়ে ভাবছিল,কিন্তু মুনের এমন কান্না দেখে নীলের শান্তি উড়ে গেলো আসমানের দিকে
কি এমন হলো যে এত কাঁদতেছে,,অবশ্য সব মানুষ তো সুখে থাকতে পারে না,সবারই কিছু না কিছু কষ্ট থাকে,,যেমন আমার আছে,,ওর ও হয়ত কষ্ট,,
.
নীল আবারও তাকালো মুনের দিকে
.
প্রায় ৩০মিনিট হলো নীল মুনকে লক্ষ করছে,
হিয়া কাঁদার সময় ৫মিনিট কাঁদতো,এর বেশি ওকে কখনও নীল কাঁদতে দেখেনি,,কারণ ততক্ষণে চকলেট আইসক্রিম এনে নীল হিয়ার চারপাশ ভর্তি করে ফেলতো
আর এই মেয়েটা কিনা ৩০মিনিট ধরে কেঁদেই যাচ্ছে,কোনো বিরতি নাই,,ও কি চকলেট পেলে থেমে যাবে?? কি জানি,সবাই তো আর হিয়ার মতন না
.
নীলের ফোন আসতেই উঠে চলে গেলো সে একটু দূরে
কথা বলে এসেই দেখলো মুন নেই,হয়ত এবার কান্না থামিয়েছে আর চলেও গেছে বাসায়
নীল তাই বাসায় ফিরে আসলো
.
বাসায় এসেই দেখলাম সোফার রুম ভর্তি মানুষ,,
কি ব্যাপার এত মানুষ কেন?কাউকেই তো চেনা যাচ্ছে না

নীল সালাম করো,,তোমার জাকির আঙ্কেল ও রিসা আন্টি,,চিনছো তো??

আসসালামু আলাইকুম,,

ওয়ালাইকুম আসসালাম,আসো নীল বসো এখানে
আরে আপা কি যে বলেন,নীল আমাদের চিনবে কি করে,ওকে সেই ছোটবেলায় আমরা দেখেছিলাম
এরপর বিদেশ চলে গেছি আমরা গোটা পরিবার,ফিরেছি কয়েকমাস হলো,,আমাদেরকে চিনার তো কথাই আসেনা
তবে নীলকে দেখে চিনতে পেরেছি আমি,ছোটবেলার চেহারা আর এখনকার চেহারার অনেক
মিল আছে

নীল আস্তে করে বললো”মা এসব কি??”

চুপ করে বস এখানে,,
.
নীল চুপচাপ গিয়ে বাবার পাশে বসলো,,
.
নীলকে তো আমরা সেই কবে থেকেই পছন্দ করি আর বলার কি আছে,এখন সে মৌকে পছন্দ করে কিনা তা বললেই সব পাকা করে ফেলবো
.
জাকির আঙ্কেলের মুখে বিয়ের কথা শুনে”নীল উঠে দাঁড়িয়ে গেলো,তারপর মায়ের দিকে এক নজর চেয়ে হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে আসলো”

মা পিছু পিছু এসে বললেন” নীল তুই সবার সামনে থেকে এভাবে চলে আসলি কেন??আর কত বার এমন করে কাটাবি,একদিন না একদিন তো কাউকে না কাউকে বিয়ে করতেই হবে”

মা প্লিস আমাকে একা থাকতে দাও আর হ্যাঁ আমার আর হিয়ার মাঝে কাউকে আনবা না,নো থার্ড পারসন!
কেউ আসবে না আমাদের মাঝে

মা রাগ করে চলে গেলেন
.
নীল হিয়ার ছবিটা নিয়ে খাটের মাঝখানে গিয়ে বসলো

আসবো নীল??
.
ছবিটার থেকে চোখ উঠিয়ে নীল দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো মৌ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে,দরজাটা একটু ফাঁক করে,মুখে হাসি রেখে
এই মৌ মেয়েটা ঐ যে বাবার বন্ধুর মেয়ে ঐ টাইপের

নাহ আসবা না,চলে যাও এখান থেকে,আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি,, তোমাকে ভালোবাসা তো দূরে থাক পছন্দও করি না,Now get lost!
.
কথা শেষ করে নীল আরেকদিকে মুখ করে তাকালো
.
মৌ রেগেমেগে ঠাস করে দরজা টেনে চলে গেলো তার বাবা মার কাছে
নীল হিয়ার ছবিতে হাত বুলাচ্ছে
.
***শুনো নীল!! যদি কখনও তোমাকে দেখতে আসে কোনো মেয়ের ফ্যামিলি তখন তুমি বলবা তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো,আর যে এসেছে বিয়ের জন্য তাকে তুমি পছন্দ ও করো না,,যদি একথা শুনে সে রাগ দেখিয়ে চলে যায় ভেবে নিবা সে কমন মেয়েদের মতন
আর যদি মুচকি হেসে তোমার পাশেই বসে থাকে ভাববে সি ইজ এক্সট্রাঅর্ডিনারি,তাকেই আজীবন ভালোবাসবে তুমি

প্লিস হিয়া,তোমার আর কাজ নেই??সবসময় আমাকে অন্য কারোর বানানোর চেষ্টায় থাকো কেন তুমি?বলতে পারবা??আমি বিয়ে করলে তোমাকেই করবো নয়তো চির কুমার থাকবো

হাহাহা,,নীল শুনো,পরিস্থিতি কখন বদলে যায় বলা যায় না
.
নীল আর কোনো কথা না শুনেই হিয়াকে বুকে টেনে নিলো
.
হিয়া??কেন বদলাবে পরিস্থিতি??, তুমি তো আমার বলো?আমিও তোমার তাহলে কেন বারবার তুমি সবসময় আমাকে অন্য কারোর কথা বলো??

ফাইন!এসব বাদ দাও,ঠিক আছে আমাকেই বিয়ে করিয়েন,আমাকেই বলিয়েন আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি,তখন আমি মুচকি হেসে পাশে থাকবো
.
কথাটা বলেই হিয়া মুখে হাত দিয়ে হাসা শুরু করে দিলো
নীল ও হেসে দিলো****
.
স্মৃতি গুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতেই নীল হেসে উঠলো হঠাৎ তারপরেই বাস্তবটা মনে পড়তেই ছবিটা খাটের উপর রেখে দিলো সে,চোখ মুছে উঠে গিটার নিয়ে বসলো আবার
ঘড়ির কাঁটায় ৬:০১বাজে তখন
সোফার রুম থেকে মেহমানদের কথা বার্তা কানে আসছে,কেউ যায়নি এখনও মনে হয়
তাতে আমার কি,যতবার এমন প্রোপোজাল আসবে ততবার ঠেকাবো
এই সময়টা আমার গানের,আমার হিয়ার,আমার মনের,আমার সবকিছুর
হিয়ার ছবিটা পাশে রেখে নীল গিটারে হাত দিতেই মুনের উদাসীন মুখটা হঠাৎ করে ভেসে উঠলো ওর চোখের সামনে,গিটারে টোন বাজতে গিয়েও বাজলো না,সব আটকে গেলো,এলোমেলো হয়ে গেলো
মুনের কষ্টমাখা মুখটার কথা মনে পড়তেই নীলের বুক কেঁপে উঠেছে
.
এই অসময়ে সেই মেয়েটার কথা কেন মনে পড়ছে?,,
আজ আর গান আসবে না,ধুর!
.
নীল গিটারটা রেখে বারান্দার দিকে চলে গেছে,,গান করার সময় এমন উদ্ভট চিন্তা আমার কখনওই আসে না,অথচ আজ এমনটা হলো,আসলে ঐ মেয়েটাকে নিয়ে অভারথিংকিং এর ফল এগুলা

মুন খাটের এক কোণায় বসে হাতে থাকা সোনার চুড়িটাকে মোছড়াচ্ছে
কিছুক্ষণ আগেই ওর ছোট চাচি মানে তুষারের মা এসে ওর হাতে চুড়িটা পরিয়ে দিয়েছেন,চুড়িটা ৫বার ছুঁড়ে মেরেছিল মুন
৬বারের সময় মা ওর দুগালে দুইটা চড় বসিয়ে দিয়ে জোর করে ওর হাতে চুড়িটা পরিয়ে দিয়ে চলে গেছেন,এতই জোর করে যে হাত ছড়ে রক্ত ফোটা ফোটা আটকে আছে,বের হচ্ছে না
বের হলে হয়তবা সে খুশি হতো
পরশু ওর গায়ে হলুদ,তার পরেরদিন বিয়ে
ওর বিয়ের সব কথা ফাইনাল অথচ তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি ওর মা,অনুমতি নেওয়া তো দূরের কথা
বিষ খেয়ে মরে গেলে ভালো হবে না?নাকি গলায় ফাঁস দেবো,কোনটা?
বেশির ভাগ মেয়েদেরই কেন বিয়েটা জোর করে দেওয়া হয়??
তাদের কি কোনো মত থাকতে পারে না??আমি কি দোষ করেছিলাম??আমি তো কারোর সাথে প্রেমের সম্পর্ক ও করিনি তাহলে তারা কেন এখনই আমাকে বিয়ে দিতে চায়
নিজের মা না থাকলে বুঝি এমনটা হয়??সৎ মা কেন কখনও ভালো হয় না??তাহলে তাদের সৎ মা নাম দিলো কেন
তাদের নাম দেওয়া উচিত ছিল নকল মা
যারা মা হওয়ার নাটক করে
তুষার একটা খোলা বইয়ের মতন,ওর চরিত্রের কথা এলাকার সব অবিবাহিত মেয়েরা জানে,এর পরেও মা জেনেশুনে আমাকে একটা পশুর হাতে তুলে দিচ্ছে
আমারর দাম তার কাছে ঐ হারের চেয়েও কম??ছোট থেকে বড় করলে নাকি সে আসল মা হয়,আর আমাকে তো উনি আমার এক মাস বয়স থেকে বড় করেছেন তাহলে কেন এমনটা হলো এখন??
হাতে রইলো বাবা,যার কাছে কোনো মূল্যই পেলাম না
.
পরেরদিন সকাল সকাল নীল গায়ের টিশার্টটা খুলে অফিসের ড্রেসটা পরছে জলদি করে,আজ লেট হয়ে গেছে এমনিতেও,রাতে ঘুম আসে না আর সকালে ঘুম ভাঙ্গে না,কি আজব!!
জামাটা খুলে পুলিশি পোশাকটা হাতে নিতেই নীলের চোখ গেলো ফ্রেমে বাঁধানো হিয়ার ছবিটার দিকে
হিয়া যেন দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে নীলের খালি দেহটার দিকে
নীল মুচকি হেসে ছবিটার উপর রুমাল টাঙিয়ে দিলো,আর নিজের অজান্তেই হেসে ফেললো অনেক
.
মুন বাবার পা ধরে কাঁদছে সকাল শুরু হতে না হতেই,বাবা চুপচাপ ওকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন মাথায় হাত রেখে
তার হাতে কিছুই নেই,তার কথার মূল্য রাইমা কখনওই দেয়না
মুন কাল থেকে না খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে,তার মুখে পানি তুলে দেওয়ার লোক নেই কোথাও
সবাই ব্যস্ত বিয়ের ডেকোরেশন নিয়ে,রাইমা হইচই করে সব কাজ করছেন,আপদ বিদায় দিয়ে শান্তিতে এবার তিনি থাকবেন
যতই ছোট থেকে পালুক না কেন,মুন তো তার পেটের মেয়ে না,একটা আলগা ভাব থেকেই যায়,তাই যখন হাতে এত বড় সুবর্ণ সুযোগ আসলো তা হাত ছাড়া করা যাবে না কিছুতেই
মুন চোখের পানি মুছে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে,গায়ে ছাই রঙের জামাটা,চেঞ্জ ও করেনি সে,বাসার জামাটা পরেই পুলিশ স্টেশন চলে আসলো
আসিফ ফোনে কথা বলছে তার ওয়াইফের সাথে
মুন চুপচাপ চেয়ার টেনে বসলো,তারপর কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আসিফ ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে উঠে চলে গেলো আরেক দিকে,মানে সে এখন কথা বলতে চায় না মুনের সাথে,কিছু শুনতেও চায় না
মুনের আরও কান্না পাচ্ছে
চোখ মুছে দশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করলো সে,তাও আসিফ আসলো না
মুন মন খারাপ করে ওড়নার কিনারায় দিয়ে চোখ মুছে বের হলো অফিস থেকে,সামনেই নীল তার জিপ থেকে নেমেছে সবেমাত্র
আসিফকে বাহিরে কথা বলতে দেখে সে এগিয়ে গেলো অফিসের দিকে
.
পথেই মুনকে দেখলো চোখ মুছতে মুছতে আস্তে হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে সে
নীল ব্রু কুঁচকে বললো”আরে আরে আপনি যে!!তা আবার কি চুরি করলেন?”
.
মুন নীলের কথার জবাব না দিয়েই চলে গেলো তার বাসার দিকে,অনেক সাহস করে সে এখানে এসেছিলো,মায়ের আর তুষারের নামে কেস করবে বলে কিন্তু আসিফের এমন ইগনর করা দেখে তার সাহস গায়েব
চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here