স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৫
Writer -Afnan Lara
.
নীল ওদিকে চেয়ে ভাবলো মেয়েটা কি সারাদিন কাঁদে???নিশ্চয় আবার কিছু না কিছু চুরি করেছিলো,হায়রে এর স্বভাব বদলানোর মতন না যা দেখলাম
.
মুন এলোমেলো ভাবে হাঁটছে পথের কিনারা ধরে,পথ তাকে বলছে এখান থেকে ফিরে যেতে
কিন্তু কোথায় যাব?কার কাছে যাব??আমার যে দুনিয়ায় কেউ নেই
বাসায় গিয়েই বা কি হবে,সেটা তো জাহান্নাম হয়ে আছে
মনে হয় কপালে বিয়েই লিখা আছে,শেষ কেনো উপায় মাথায় আসছে না আমার
.
মুন বাসায় ফিরে নিজের রুমে এসে বসলো,,রুশাকে বললো পানি এনে দিতে,বিয়ে বাড়িতে পানি ও পাওয়া যায়না অনেক সময়
রুশা কাজের চাপে পানির কথা ভুলে গেছে
মুনের ও মনে নেই যে তার তৃষ্ণা পেয়েছিলো,খালি পেটেই সে ঘুমিয়ে পড়লো বিছানার এক কোণায়
নীল থানা অফিসার মিনাল হোসেনের সাথে ফোনে কথা বলছে,,রাঙামাটিতে একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে হুট করেই
এখন তিনি আসিফকে নতুবা নীলকে সেখানে পাঠানোর কথা ভাবছেন
নীল হেসে দিয়ে বললো”আসিফ বেস্ট হবে এই কাজের জন্য”
মিনাল হোসেন তাচ্ছিল্য করে হেসে বললেন”মজা করছো??এই কাজে কে বেস্ট এটা তুমি নিজেও জানো,তুমি ছাড়া এই কাজ কেউ পারবে না,আসিফ সিচুয়েশন না বুঝেই গুলি মারামারি শুরু করে ফেলে বাট তুমি সিচুয়েশনকে বুঝার চেষ্টা করো সবসময়,আই থিং তোমার যাওয়াটা ভালো হবে,এন্ড আই এম সিউর তুমিই সমস্যাটার সমাধান করে তার পরেই ফিরবে
নীল ফোনটা একটু হোল্ডে রেখে ভাবলো ঢাকায় এসে তার লস হয়েছে,একের পর এক বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে মা প্রতিদিন হাজির হচ্ছেন তার চেয়ে বরং আমি এটাতেই রাজি হয়ে যাই,অন্তত বিয়ে করা থেকে বেঁচে যাব
.
আচ্ছা স্যার,আই এম রেডি
.
অল দ্যা বেস্ট বয়,,কিপ ইট আপ!
♣
মুনকে জোর করে সাজানো হয়েছে
আজ ওর গায়ে হলুদ,,পরশু বিয়ে
এমন কেউ বাকি নেই যার পা মুন ধরেনি,কিন্তু মায়ের সিধান্তই বড় সিধান্ত,,
কাঁদতে কাঁদতে চোখের নিচে কালি দাগ পড়ে গেছে তার,,
মুন কাঁদে বিয়ে তার অমতে হচ্ছে তাই
আর নীল কাঁদে শুধুই হিয়ার জন্য
.
মুনের চোখের নিচে কনসিলার লাগিয়ে দিয়েছে রুশা যাতে কালো দাগটা না দেখা যায়
নীল নিজের চোখের নিচে কালো দাগ দেখে হাসতে হাসতে হালকা বরফ লাগিয়ে চোখে সানগ্লাস পরে বাসা থেকে বের হয় সবসময়
দুজনেই কষ্ট লুকায় বাকিদের থেকে,,
.
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হতে আর কটা ঘন্টা বাকি,মুন চুপিসারে ছাদে আসলো হাতে ব্লেড নিয়ে
ঐ ব্লেডটা নিয়ে অনেকক্ষন ভাবলো,,তারপর আবার রেখে দিলো,,
মরবে কি মরবে এই ডিসিশানটা নেওয়া অনেক টাফ ব্যাপার
♣
হ্যালো,,ওকে,আমি আজ রাতের বাস ধরে আসতেছি আপনারা ফোর্স রেডি রাখেন,ওকে বাই
.
মা শুনো!!
কি হলো?কথা বলবে না আমার সাথে?ওকে বলিও না,আমাকে এখনই রাঙামাটিতে যেতে হবে আবার,,ওখানে নাকি ডাকাতি বেড়েছে জঙ্গল এরিয়াতে,,যাই মা???
–
আমাকে বলস কেন,তোর যা মন চায় কর,আমার কোনো কথায় যখন শুনস না এসব বলে কি লাভ?
–
ওমা,দোয়া করে দিবা না,যদি জঙ্গলে ডাকাতের গুলিতে মারা যাই??
অবশ্য মারা গেলেই সব দায় চুকে যাবে
.
মা দৌড়ে কাছে এসে নীলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন
.
একটা মেয়ের জন্য এত কষ্ট নিজেকে কেন দেস নীল ,তোর কষ্ট যে আমি প্রতিদিন দেখি,,তুই এই সানগ্লাস দিলে আমি তোর চোখের নিচের কালো দাগ দেখবো না ভেবেছিস??
–
মা এসব বাদ দাও এখন ওকে?? আর আমার ব্যাগ গুছিয়ে দাও,রাতেই রওনা হতে হবে
♦
মুন এবার মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেই দিলো সে এই বিয়ে করবে না
.
তুমি আমার সৎ মা বলে এমন করতেছো তাই না??আমার নিজের মা হলে আমার সাথে এমনটা করত না কিছুতেই
–
ব্যাস!!
মা সেদিন মুনকে এত মারলো যে মুন এখন বিছানা থেকেও নামতে পারছে না,,
মুনের বাবা কিছুই করতে পারেনি তখন,কিভাবে করবে??যেদিন থেকে মুনের মা মারা গেছে সেদিন থেকে উনি জ্যান্ত লাশ হয়ে গেছেন,,মুনের এখনকার মায়ের সাথে কোনো কথায় তিনি পেরে উঠেন না
খুব হালকা ধুমধামেই আজকে গায়ে হলুদটাও হয়ে গেলো
ব্যাথার জায়গায় হলুদ লাগতেই মুন কেঁপে কেঁপে উঠতো বারবার
চোখ দিয়ে পানি পড়ছে আর রুশা এসে বারবার মুছিয়ে দিচ্ছে,,
রাতে মুন ছাদে গিয়ে বসে থাকলো আবারও,বাসায় বসে থেকে নিজের চোখে নিজের কোরবানি হওয়ার এরেঞ্জমেন্টের দৃশ্য দেখার চেয়ে এখানে বসে থাকা আরও ভালো
জীবনটা আমার এখানেই শেষ হয়ে যাবে?এমন জীবনসঙ্গী তো আমি চাইনি,,কখনও কারো কোনো ক্ষতিও করিনি আমি,তাহলে কেন আমাকে এত শাস্তি দিচ্ছে আল্লাহ,,কি দোষ আমার,,?
হাত পা হলুদের জন্য জ্বলতেছে,,মুন সেটার জন্য চোখের পানি ফেলছে না,,মনের কষ্টে কাঁদছে,,এমন মার খাওয়ার অভ্যাস ওর আছে,,ছোট থেকেই মা এমন করেই মারে,এটা নতুন কিছু না
চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুন বসে রইলো সেখানেই,,মুন খেলো কি খেলো না কেউ খবর নিলো না,,
সারাটা রাত ঘুম আসলো না মুনের,,শুধু ভাবলো কি করবে সে,,সুইসাইড নাকি পালাবে,,কোনটা ভালো হবে তার জন্য?
.
নীল পরেরদিন সকাল সকাল রাঙামাটি এসে পৌছালো
এখন সে ডিউটিতে এসে দাঁড়িয়ে আছে জিপের সামনে,,
কাল রাতের ঘুমটা গেলো জলে
সামনের মাটির মেঠো পথটা দিয়ে একটা বাউল গান গাইতে গাইতে যাচ্ছেন
পরনে শীর্ণ হলুদ রঙের ফতুয়া আর লুঙ্গি,গলায় লাল গামছা আর হাতে একটা বাঁশ,সেটার উপর ভর দিয়ে দিয়ে পাহাড়ের উঁচু নিচু পথ পাড়ি দিচ্ছেন তিনি
হঠাৎ নীলকে দেখে থেমে গেলেন তিনি,,
তারপর বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলেন নীলের দিকে,,নীলের গায়ে পুলিশি পোশাক,হাত দুটো দুই পকেটে ঢুকিয়ে জিপের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে
লোকটা ওকে ভালোমতন দেখে তারপর বললেন
“তোমার জীবনসঙ্গী অনেক দূরে তোমার থেকে তাই না বাছা??
কিন্তু তুমি কি জানো সে খুব শীঘ্রই তোমার সামনে এসে হাজির হবে??দুহাত চারহাত হয়ে যাবে শীঘ্রই
আর শুনো বাবা মনে রেখো একটা কথা,,তোমাদের যে আল্লাহ একই জোড়ায় পাঠিয়েছেন,,”
.
কথাগুলো বলা শেষে বাউল আবার ও গান ধরে চলে গেলেন
–
এসব কি বললেন লোকটা?যার আসার সে আর কখনও ফিরবে না
.
নীল হাসলো কিছুক্ষন তারপর আবার কাজে মন দিলো,,আজ পুরোটা সময় এই জঙলে নজর রাখতে হবে,,
কোনো ব্রেক দেওয়া যাবে না
♣
বিয়ের সব রেডি, স্টেজ সাজানো ও হয়ে গেছে,,
হঠাৎ করে রুশা হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বললো মুন আপুকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না
এবার সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লো মুনকে খুঁজার জন্য
মুন ঠিক সেসময়ে বাসে বসে আছে,,
হাতে ফোন,,সাথে কোনো ব্যাগ নেই,,ব্যাগ আনতে গেলে সবাই সন্দেহ করতো,তাই খালি হাতেই বেরিয়ে গেছে মুন
গন্তব্য স্থান হলো রাঙামাটি,,ছোটবেলার বান্ধুবী সামিয়ার বাসা সেখানে,,তারই কথায় মুন বাসা থেকে পালিয়েছে,,
সে বলেছে মুন কিছুদিন তার বাসায় থাকতে পারবে,এক মাসের মতন,তার কথার ভরসাতেই মুন এত বড় পদক্ষেপটা নিলো
রাঙামাটি আসতে আসতে রাত শেষে ভোর হয়ে গেলো,
৪:৪০টা বাজে তখন,,
মুন বাস থেকে নেমে একা রোডে দাঁড়িয়ে আছে,একটা মানুষ ও নেই কোথাও,,বাসের সবাই যে যার গন্তব্যে চলেও গেছে,তাই মুন এখন একা আপাতত
ফোনটা হাতে নিয়ে সামিয়াকে কল দিলো সে,,৩/৪বার দেওয়ার পর সামিয়া রিসিভ করলো,,
–
সামিয়ার গলা বেশ লজ্জাজড়িত মনে হলো মুনের কাছে,বুকে ভয় করতে লাগলো তার
সামিয়া নিচুস্বরে বললো”দোস্ত আমাকে মাফ করে দিস আমি না জেনে তোকে এখানে আসতে বলেছিলাম,তোকে আমার বাসায় আমার শশুর শাশুড়ি এলাউ করবে না,প্লিস তুই ফিরে যা,,আমার অবস্থাটা বুঝার চেষ্টা করিস,আমি নিজেই আরেকজনের বাসায়,এটা আমার বাসা হলে এক কথা ছিল,আর এই বাসায় আমার শশুর যা বলে তাই হয়
–
মুনের মাথায় যেন বাজ পড়লো,,সে এখন কি করবে, কোথায় যাবে,আর বাড়ি ফিরলে তো মা নির্ঘাত ওকে মেরে ফেলবে,এসব ভাবতে ভাবতে মুন পাশে থাকা পাহাড়টার সাথে লেগে গেলো,এতক্ষন পাহাড়ের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল সে
মাথা কাজ করছে না কিছুতেই
ফোনে তাকিয়ে দেখলো ৫%চার্জ আছে,,ভোর ৫টা বেজে গেছে,,সামিয়া কল কেটে দিয়েছে মুনের সাড়া না পেয়ে
.
এটাকে বেইমানি বলবো??নাকি আমার ভাগ্যের দোষ দেবো?
.
চোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে নিচে পড়তেই মুন ফোনটা হাতে মুঠো করে ধরে সামনে তাকালো,,সে দেখলো ৫/৬টা ছেলে ওর সামনে,,
পকেটে হাত ঢুকিয়ে মুনের দিকে হিংস্র প্রানীর মত চেয়ে আছে সবাই,এতক্ষন মুন ভাবনায় ডুবে ছিল বলে কখন ছেলেগুলো এসেছে তা বুঝতেই পারেনি মুন
–
কি?বিয়ের পিড়ি থেকে পালিয়েছো বুঝি??
–
ভাই এই দেখি রেডি জিনিস,লাল বেনারসি আবার গয়না গাটি,,সাজানো গুছানো,সব ব্যবহার করা যাবে
–
মুনের গলা শুকিয়ে গেছে,আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে সে আর চারপাশে তাকাচ্ছে,,কেউ নেই,একটা পশুপাখিও নেই,,কেউ নেই যে তাকে এখন বাঁচাবে,নিজেই নিজেকে বাঁচানের সব চেষ্টা করতে হবে এখন
.
এটা ভেবে এক সময় দৌড় দিলো মুন
ছেলেগুলা ওর পিছন গিয়ে ওকে ধরতে গেলো
.
ভারী লাল বেনারসিটাতে পা লেগে এবং পথে থাকা ইটের একটা কণার সাথে হোচট খেয়ে মুন নিচে পড়ে গেছে,আর দৌড়ানো হলো না
.
পা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে সেদিকে মুনের খেয়াল একদমই নেই
এই মূহুর্তে ছেলেগুলোর হাসি দেখে মুনের খুব ভয় হচ্ছে,,পায়ের জন্য উঠতেও পারছে না মুন
জীবনে এরকম অসহায় নিজেকে আর কখনও মনে হয়নি
এই দৃশ্য দেখার আগে মৃত্যু হলে ভালো হতো
ছেলেগুলো হাসতে হাসতে এগিয়ে আসছে
একেকটাকে হিংস্র মনে হয়,এরকম করে হাসছে কেন ওরা!
আমাকে কি আজ বাঁচতে দেবে না?আমার ইজ্জত নষ্ট করে দেবে???
.
এবার কই পালাবি মাইয়া??
.
মুন পায়ে ব্যাথা নিয়ে ওদের সবার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে,,পায়ে যে ব্যাথা সেটার অনুভব শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে
তার মাথায় শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে কি করে সে রেহায় পাবে,নাকি পাবে না
জীবন কি এইখানেই শেষ আমার???
আমার ভাগ্য এতই খারাপ??
.
কি হয়েছে?কে তোমরা?
.
এই কথাটা শুনে মুন সাথে সাথে পিছনে ফিরে তাকালো,ভুল শুনলো না তো?ভুল দেখছে না তো সে??
.
ওর ঠিক পিছনে নীল দাঁড়িয়ে আছে,
ছেলেগুলো নীলকে দেখে আর ১মিনিট ও দাঁড়ালো না,কারন নীল এখানে ১বছর যাবত ডিউটি করেছে ওকে সবাই চেনে, ছেলেগুলো ও চিনে তাই পালিয়ে গেলো মূহুর্তেই
.
নীল সামনে এসে মুনের দিকে তাকালো,মুনের চোখ থেকে পানি টপটপ করে নিচে পড়ছে,মুখে বুলি নেই কোনো
সে এখনও ঘোরের মাঝে আছে আদৌ এটা সত্যি কিনা তা ভাবতে গিয়ে
–
কি হয়েছে?তোমার এই অবস্থা কেন?
.
মুন কাঁদার জন্য কথাও বলতে পারছে না,,শুধু কেঁপে কেঁপে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে
–
ঠিক আছে বলতে হবে না,,উঠো এখন
.
নীল মুনের হাত ধরে ওকে উঠালো
.
তোমার তো পা অনেকটা কাটা গেছে,,ঐ ছেলেগুলো করেছে এমন??
–
মুন খুব কষ্টে কান্না থামিয়ে “না” বললো
–
ঠিকমত হাঁটতেও পারতেছো না তুমি
.
নীল একটু দূরে একটা চায়ের দোকান একটার সামনে থাকা বেঞ্চে মুনকে এনে বসালো,,
দোকানটা বন্ধ,শুধু কাঠের দুটো বেঞ্চ বাহিরে রাখা
.
এবার বলো তুমি এখানে কেন??কি করে এসেছো??আর এই বেশ কেন তোমার?তোমার সাথে আর কেউ নেই?
.
মুন চোখ মুছতেছে, মুছার সাথে সাথেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে বারবার
চলবে♥