স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৬
Writer -Afnan Lara
.
ঠিক সেসময়ে চায়ের দোকানটার দোকানদার এসে দোকান খুলতে লাগলেন
সকাল সকাল একটা দুটো কাস্টমার হলেও লাভ,আর এখানকার মানুষেরা ভোর হতে না হতেই যে যার কাজে বেরিয়ে পড়ে
তাই এসময়ে দোকানদারের দোকান খোলাটা স্বাভাবিক ব্যাপার
.
মুনের এভাবে থমকে থাকা দেখে নীল শান্ত গলায় বললো” মামা ২কাপ গরম চা দেন তো”
.
এরপর সে নিজের পকেট থেকে তার সাদা রুমালটা বের করে নিচে বসলো মুনের পায়ের কাছে
এরপর রুমালটা গুচ্ছ করে মুনের পায়ে হাত দিতেই ও পা সরিয়ে ফেললো সাথে সাথে
নীল আবারও পা টা টেনে ধরলো
মুনের চোখের পানি ২ফোঁটা গিয়ে নীলের হাতের উপর পড়েছে
নীল পানির ফোটা দেখে একবার মুনের দিকে তাকালো তারপর চুপচাপ রুমালটা দিয়ে ওর পা বেঁধে দিচ্ছে এখন
.
আপাতত আমার কাছে ব্যান্ডেজ নেই তাই এটা দিয়েই কাজ চালালাম,পা কি বেশি ব্যাথা করছে তোমার?
.
মুন মাথা নাড়িয়ে “না” জানালো
.
চা ও এসে গেসে নাও খাও,ভালো লাগবে
.
মুন চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে আছে নীলের দিকে
–
পৃথিবীর কেউ কখনও ভোরবেলা চা পেলে তাকে রিজেক্ট করবে না
করবে তখন যখন তার পেটে খিধা থাকে আর নয়ত শরীর খারাপ থাকে,আর এই মেয়েটার মনে হয় দুটোয় আছে
–
আচ্ছা মামা এক কাজ করেন পাউরুটি আর কলা দেন আগে
.
নীল পাউরুটি আর কলা এনে মুনের হাত থেকে চায়ের কাপটা সরিয়ে ওকে ওগুলো ধরিয়ে দিলো
মুন ২দিন ধরে কিছুই খায়নি,,তাই খাবার হাতে পেতেই পুরোটা খেয়ে নিলো
–
নাও এবার চা খাও ভালো লাগবে
.
মুন চায়ে চুমুক দিয়ে নীলের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে ফেললো,এবার দ্বিতীয় বার আর পানি আসেনি চোখে
–
এখন বলো কি হয়েছে?
–
আমার কাল বিয়ে ছিলো,আমি রাজি ছিলাম না তাই পালিয়ে এসেছি
–
তো পালিয়ে এসেছো ভালো কথা,এমন জায়গায় কেন এসেছো??দুনিয়াতে জায়গার অভাব পড়ছিলো??
–
নাহ আসলে আমার ছোটবেলার বান্ধুবীর বাসা এখানে,এসে জানলাম ওর পরিবারে সমস্যা তাই…………!
–
তো এতই সমস্যা হলে তোমাকে আসতে বলেছিল কেন??
–
মুন আবার কেঁদে দিলো,ভাগ্যের কাছে আজ হেরে গেছে সে
–
আচ্ছা আর কাঁদতে হবে না,থাক বলতে হবে না,বুঝছি
.
নীল দোকানদারকে টাকা দিয়ে হাঁটা ধরলো,,
কিছুদূর যেতেই দেখলো মুন এখনও বেঞ্চে বসে চোখ মুছতেছে
–
কি হলো?যাবা না?নাকি আবারও ঐ ছেলেগুলোর দৌড়ানি খেতে মন চাচ্ছে তোমার??
.
মুন নীলের কথা শুনে বেঞ্চ থেকে নেমে হাঁটার জন্য পা বাড়াতেই নিচে পড়ে গেলো দুম করে,পায়ে যে ব্যাথা হলে হাঁটাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে
–
নীল হাত বাড়ালো ওকে উঠানোর জন্য
মুন কাঁপা কাঁপা হাতে নীলের হাতটা ধরে উঠলো,,
নীল গম্ভীর গলায় বললো”আমি তোমাকে কোলে নিতে পারবো না”
.
মুনের মনে হলো সে বুঝি এতই ভারী?
.
তার এমন চুপচাপ ভাব দেখে নীল জিপের দরজা খুলতে খুলতে বললো”কাউকে সত্যিকারের ভালোবাসলে,সে ভালবাসার ভাগ হয় না,আমি সেই স্থান কাউকে দিতে পারবো না,কোলে নেওয়াতে আমার মনে হয় সেই ভালোবাসার ভাগ হয়ে যেতে পারে
আর তুমিই ভাবো! অন্য কারোর ভবিষ্যত স্ত্রীকে আমি কেন কোলে নেবো??”
.
মুন হতভম্ব হয়ে নীলের মুখের দিকে চেয়ে আছে,কোলে নিলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে তা ও ভাবলো কিছুক্ষণ তারপর ভাবলো ভালো ম্যানার,অন্য কোনো ছেলে হলে কোলে তুলতে চাইতো,যাক বাবা আমি ওতো মোটা না তাহলে
আর আমাকে কোলে তুললে কিসের ভালোবাসার ভাগ হবে?সব যেনো মাথার উপর দিয়ে গেলো
.
নীল চুপচাপ তার জিপে এনে মুনকে বসালো,,
.
তারপর সিটবেল্ট লাগাতে লাগাতে বললো”শুনো আমি এখানে কাজে এসেছি,,তুমি ঠিক কই যাবা আমাকে বলো আমি তোমাকে দিয়ে আসবো,,বাপের বাড়ি নাকি বিএফের বাড়ি?”
–
নীল গাড়ী স্টার্ট দিয়ে চালাচ্ছে এখন,তার করা প্রশ্নের জবাব পায়নি এখনও
মুন মন খারাপ করে বললো ওকে এখানেই নামিয়ে দিতে
–
নীল গাড়ী থামিয়ে মুনের দিকে একনজর তাকিয়ে আবারও গাড়ী স্টার্ট দিয়ে চালাচ্ছে,
ও যে হোটেলে উঠেছে সেটাতেই আনলো মুনকে,,
–
আপাতত এখানে থাকো,,আমি দেখতেছি কি করা যায়
.
মুন বিছানা থেকে কাঁথাটা টেনে গায়ে জড়িয়ে বসলো,গায়ে জ্বর খুব,,
কাল সারা রাত ছাদে ঘুমিয়েছিলাম তাই এসেছে মনে হয়
.
নীল ফোনে কথা বলে এসে দেখলো মুন খাটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে ততক্ষণে
নীল আর জাগালো না মুনকে,,কিন্তু ওর তো এখন ডিউটিতে যেতে হবে,তখন সেসময়ে চা খেতে বেরিয়েছিল সে
নীল তাই একটা চিঠি লিখে খাটের উপর রেখে দরজা লক করে চলে গেলো
এরপর সে ফিরলো ঠিক দুপুরবেলা, প্রায়ই ২টার দিকে ফিরলো হোটেলে
এসে দেখলো মুন এখনও ঘুমায়
.
এখনও জাগেনি??
.
নীল কাছে এসে দাঁড়ালো,,কি করবে বুঝতেছে না ঠিক
.
-এই মেয়ে শুনো,,এই শুনো?? হ্যালো?
.
নীল হাত দিয়ে মুনের হাত টান দিলো
হালকা জোরেই টান দিলো
সাথে সাথে মুন জেগে উঠে তড়িগড়ি করে বসলো এতে করে মাথার ঘোমটা পড়ে গেলো ওর মাথা থেকে,আর ওর হাতে থাকা বেতের বাড়ির দাগ স্পষ্ট হয়ে উঠলো নিমিষেই
নীল অবাক হয়ে দাগগুলো দেখছে
মুন নীলের তাকানো দেখে ঘোমটা টেনে লুকিয়ে ফেললো হাত দুটো
–
এমন করে কে মেরেছে তোমাকে?
–
নাহ কই,,এগুলা এলার্জির দাগ,বেগুন খেয়েছিলাম তো তাই
–
নীল ভ্রু কুঁচকে মুনের হাত টিপে ধরতেই মুন ব্যাথায় কুকড়ে উঠে একটা চিৎকার দিলো
–
হুম বুঝলাম,এলার্জির দাগ হলে তো এরকম চিৎকার করতে না,,তা কে মেরেছে সেটা বলতে এত সংশয় কেন??
–
মুন চুপ করে রইলো,আর কিছু বললো না সে
–
আমি খাবার এনেছি, খেয়ে নাও,আর fresh হয়ে নাও,,
আমি আজকে রাতে ফিরবো ঢাকায়,আমার সাথে তোমাকেও ফিরতে হবে,আমি নিজে তোমাকে তোমার বাসায় দিয়ে আসবো,কেউ কিছু বলবে না দেখো
–
নাহ প্লিস,আপনি আমাকে ঢাকার রোডে ছেড়ে দিয়েন তাও বাসায় ছাড়িয়েন না,,আপনার পায়ে ধরি
–
শুনো একজন পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব হলো যেকোনো সাধারন জনগনকে যথাযথ নিরাপত্তায় তার বাসায় পৌঁছে দেওয়া,আমিও তাই করবো,এখন খাবার গুলা খেয়ে নাও
♣
মুন চুপচাপ খাবার খেয়ে বসে আছে,বাসায় ফিরলে যে মা মেরে ভূত বানায় দিবে তা খুব ভালো করে জানে মুন,,
আর নীল ও যে তার কথায় অটল তাও বুঝা হয়ে গেছে তার
নীল মুনকে নিয়ে বিকালেই রওনা দিলো ঢাকার জন্য,,পথে দুজনের একজনেও কোনো কথা বলেনি,বলবেই বা কেন,তারা তো পরিচিত না,দুজনেই অপরিচিত দুজন মানুষ
আসতে আসতে রাত ১১টা বেজে গেছে,,
–
গাড়ী থামিয়ে নীল বললো”চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি,এড্রেস বলো”
.
মুন হঠাৎ নীলের হাতটা ধরলো শক্ত করে
নীল কপালটা হালকা কুঁচকে হাতের দিকে তাকাতেই মুন হাতটা ছেড়ে দিলো সাথে সাথে তারপর আস্তে করে বললো”সরি”
–
প্লিস আমাকে বাসায় দিয়ে আসিয়েন না,আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন
–
শুনো এটা হয় না,আমার দায়িত্ব তোমাকে তোমার পরিবারের কাছে দিয়ে আসা,তোমাকে এখানে ছাড়লে তোমারই বিপদ হবে
.
নীল মুনের কোনো কথায় শুনলো না,সোজা মুনকে নিয়ে ওদের বাসায় চলে আসলো সে,,
সবাই উঠানে বসে আছে,বিয়ে ভাঙ্গার পর বিয়ে বাড়ির যে অবস্থা হয় ঠিক তেমনটায় হয়ে আছে এখন,বাবা নিচে বসে আছেন আর মা বাসার সামনের সিঁড়িতে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন,পাশে দাঁড়িয়ে রুশা বাতাস করছে দাদিকে
–
আসসালামু আলাইকুম
.
নীলের সালামে সবাই মুখ তুলে ওর দিকেই তাকালো,
এবার নীলের থেকে চোখ সরিয়ে সবার চোখ গেলো পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মুনের দিকে,মুন মুখ নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে
বাসার বাহিরের লাল বাতিটার আলোতে মুনকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে
মা সিঁড়ি থেকে উঠে হনহনিয়ে এগিয়ে এসে মুনের দিকে তাকিয়ে আছেন এখন
নীলের গায়ে পুলিশের পোশাক তাই কেউ কিছুই বললো না ওকে,, সবাই চুপ করে আছে এখনও
অবশেষে নীলই কথা বলা শুরু করলো
–
আপনাদের মেয়েকে ওর বান্ধুবী জায়গা দিবে বলে চলে আসতে বলেছিল আর তাই সে গিয়েছিল,,কিন্তু পরে ও না করে দেওয়ায় সে বিপদে পড়ে আমি তাই ওকে এখন এখানে নিয়ে আসলাম,,কেউ ওর কোনো ক্ষতি করতে পারেনি
আর একটা কথা ও তো নাবালিকা না,তাহলে অনার্সে পড়ুয়া মেয়েকে আপনারা তার অমতে বিয়ে দিতে গিয়েছেন??
এমন ভুল আর করবেন না,,তার উপর ওর গায়ে হাত ও তুলেছেন
আর কেউ যাতে এমন কাজ দ্বিতীয় বার না করে,,ওয়ার্নিং দিয়ে দিলাম,,ওকে বাই,,
আর ওকে পড়াতে টাকার কমতি হলে আমায় বলবেন আমি নিজে ওর খরচ চালাবো
.
কথা শেষ করে নীল মুনের দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলো,,
মুনের গলা শুকিয়ে গেছে, কেউ এতক্ষন একটাও কথা বললো না,নিরবতা তুফানের পূর্বাবাস,তাই ভেবে মুনের খুব ভয় হচ্ছে
–
সেলিনা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন”তোর এত বড় সাহস হয়েছে??একে তো পালিয়ে গেিছস আবার পুলিশের কাছে বলস আমি তোকে মেরেছি??”
–
মুন মুখ তুলে বললো”না মা আমি বলিনি”
–
বলস নি তো জানে কেমনে??
.
মা এগিয়ে এসে মুনের চুলের মুঠি ধরে এক টান দিলো
.
রুশা খুন্তি গরম করতে দে,ওর বিয়ের পিড়ি থেকে পালানোর শখ মিটাবো আজ আমি,,
আর বিয়ে??
তুষার বলেছে তোকে খুঁজে পেলেই বিয়ে করবে,,কত ভালোবাসে দেখ,আর তুই কিনা পালিয়ে চুনকালি মেখে এসেছিস
রুশার বাবা আপনি তুষারকে খবর দিন সময় থাকতে
.
রুশা কাঁপা কাঁপা হাতে খুন্তি নিয়ে এসেছে
–
মুন কেঁদে কেঁদে হাত জোর করে বলতেছে ওকে মাফ করে দিতে,,
বাবা কিছু বলতেছেন না,শুধু একবার বললেন “থামো সেলিনা”
মা মারা গেলে বাবারা এমন হয়ে যায় কেন??একটা সময় তাদের একটা সংসার ছিল এটা ভুলে যায় কেন??সেই সংসারের যে নারী থাকতে তার অবর্তমানে তারই সন্তানকে পালন করা কি এ লোকটার দায়িত্ব নয়??তিনি কি ওর বাবা নয়??
আগের সংসারের সন্তানেরা এতই ফেলনা?
.
বাবার মতে তার এমনিতেও কম অসম্মান হয়নি মুন পালিয়ে যাওয়ায়,যতজনে যা পেরেছে বলেছে তাদের
মা গরম খুন্তি দিয়ে মুনের সারা পিঠে দাগ করে ফেলেছে.
.
মুনের চিৎকার সবাই শুনলো এমনকি আশেপাশে যত মানুষ থাকে তারা সবাই ও শুনেছে,কেউ এগিয়ে আসলো না ওকে বাঁচাতে
কেউ কেউ বললো আপন মা না থাকলে এমনই হয়
আবার কেউ বললো ঠিক হয়েছে,,বিয়ের পিড়ি থেকে পালানো??আমি হলে খুনই করে ফেলতাম
মার রাগ কমায় মা খুন্তি রেখে চলে গেলেন বাসার ভিতর
দাদি হাঁটতে পারেন না
কেঁদে কেঁদে শুধু বলেছেন থামতে কিন্তু সেলিনা বেগম তো থামার মতন মহিলা না
রুশা দাঁড়িয়ে শুধু কেঁদেছে,,ও বাধা দিতে গেলে ওকেও গরম খুন্তি লাগিয়ে দিবে,এর আগেও এমন হয়েছে তাই সে ভয়ে কদম ফেলেনি সামনে
মুন অচেতন হয়ে খাটের পাশে মাথা হেলান দিয়ে বসে আছে
রুশা পানি নিয়ে এসে অনেক ডাকলো,ওর সাড়া না পেয়ে দৌড়ে গেলো মায়ের কাছে
–
মা মা মুন আপু তো অজ্ঞান হয়ে গেছে
–
ভালো হয়েছে,অজ্ঞানই থাকুক,ওর জ্ঞান থাকলে বিয়ের পিড়ি পর্যন্ত নেওয়া যাবে না,,আর তুষারেরা চলে এসেছে শরবত বানা তাড়াতাড়ি
♣
–
নীল বাসায় এসে মাকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে নিজের রুমে চলে আসলো,,
যাক বাবা আজ এসেই কোনো পাত্রীর মুখ দেখতে হয়নি
এই ভেবে ব্যাগ থেকে জামা কাপড় বের করছে নীল,মনে শান্তি বিরাজ করছে এখন
হঠাৎ মনে হলো আরে মেয়েটার নামই তো জানা হলো না,আর এখন কি অবস্থায় আছে সেটাও তো জানতে হবে,,,
–
মা আমি একটু আসতেছি
–
সেকি এত রাতে কই যাস তুই,??১১:৩৫ বাজে,ডিনার করবি কখন,এত রাতে যাওয়ার মানে কি নীল?কই যাবি সেটা তো বলে যা
–
একটু কাজ আছে, ১০মিনিটেই চলে আসবো
চলবে♥