স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_৭
Writer -Afnan Lara
.
বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই নীলের কি যেন মনে পড়ে গেলো,তাই সে আবারও বাসায় ফিরে এসে নিজের পুলিশি পোশাক পাল্টে একটা ব্লু টিশার্ট আর তার উপরে অফ হোয়াইট জ্যাকেট পরে নিলো
আমাকে আগে দেখতে হবে ঐ বাসার সিচুয়েশন কেমন,পুলিশ দেখলে বা আসতেছে শুনলে কুকুরের লেজ ও সোজা হয়ে যায় তাই চেঞ্জ করে যাওয়াটাই বেটার হবে,মুন ঠিক কেমন আছে তা জানতে হবে
.
নীলদের বাসা থেকে মুনদের বাসা বেশি দূরে না,,মিনিট দশেকের মতন লাগে হেঁটে যেতে
নীল সেই দেরিটাও করতে চাইলো না,,তাই গাড়ী নিয়ে নিলো তার
গাড়ীতে বসে ড্রাইভ করে মুনদের বাসার সামনে এসে গাড়ী থামালো সে
এসে দেখলো এলাহি কান্ড,মনে হয় বিয়ে বাড়ি,রাতের এসময়টাতে বিয়ের সকল অনুষ্ঠান শেষ হয় জানতাম কিন্তু এখন দেখি সব শুরু হলো মনে হয়
মুনদের বাসার সামনে আর ভেতরে এত মানুষ কেন??মুন কি আবার পালালো নাকি??বিষয়টা তো দেখতে হয়
.
নীল বাড়ির ভিতরে গেলো দেখার জন্য,ভেতরে সোফায় বরের পোশাক পরে একটা ছেলে বসে আছে,,তারই পাশে হুজুর বই খাতা নিয়ে কিসব লিখছেন,তাদের দুজনেরই আশেপাশে মানুষ জড়ো হয়ে আছে
নীল এমন ভাবে দাঁড়ালো যাতে ওকে কেউ না দেখে,,
নীল তখন ড্রেস চেঞ্জ করছিলো তাই কারোরই ধারনা নেই তাদের পাশে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে
নীল বাম পাশে তাকাতেই ওর নজর গেলো মুনের দিকে,,রুশা আর ওর মা মুনকে ধরে নিয়ে আসছে ভেতরের রুম থেকে
মুন হাঁটতেও পারছে না ঠিকমতন,গায়ে সেই বিয়ের বেনারসি,,মাথায় ইয়া বড় ঘোমটা, চোখ মুখ দেখে মনে হয় হুস ও নেই,কোনোরকম হাঁটিয়ে আনতেসে ওকে
.
এই রাত বারোটার সময় বিয়ে????
.
মুনকে একটু দূরে বসালেন সেলিনা
মুনের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে,হুস এসেছে সবেমাত্র,সে চেয়েও এখন কিছুই করতে পারবে না,করার শক্তি তার নেই
আর একটু টু শব্দ করলে আবারও মারতে দ্বিদাবোধ করবেন না সেলিনা
হুজুর পাত্র পাত্রীকে দেখে নিয়ে বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন
–
এক মিনিট!!
.
নীলের মুখে কড়া ভাবে “এক মিনিট “শুনে সবাই নীলের দিকে তাকালো পিছন ফিরে
.
সেলিনা তো নীলকে দেখে ভয় পেয়ে গেলেন
–
কি হচ্ছে এটা??আমার কথায় দেখি আপনারা কেউ কোনো গুরুত্বই দিলেন না,,এত করে বলে গেলাম,এখন দেখি যেই লাউ সেই কদু!!
এমন জোর করে বিয়ে দেওয়ার জন্য আপনাদের আমি জেলে নিতে পারি জানেন আপনারা??
–
সেলিনা মুখের ভাবগতি পাল্টে বললেন”কে বলেছে জোর করতেছি, মুনের মত আছে এই বিয়েতে”
–
নীল মুনের মুখের দিকে তাকালো ও যেনো এখনই নিচে পড়ে যাবে এই অবস্থা ওর
–
ওকে জিজ্ঞেস করতেছেন কেন,ওকে কি কিছু বলার অবস্থায় রেখেছেন আদৌ?
–
নীল ফোন বের করে তার অফিসের একজন কন্সটেবলকে কল করলো
.
হ্যালো কনক?? একটা ফোর্স পাঠাও এ.কে রোডের থেকে সোজা গিয়ে বামের মোড়,একসাথে অনেকগুলোকে জেলে পুরতে হবে,,
.
কথাটা নীল মুনের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো
.
কথা শেষ করে নীল ফোন রাখতেই মুনের মা এক দৌড়ে এগিয়ে এসে হাত জোড় করে নীলের সামনে ফ্লোরে বসে গেলেন
–
দয়া করে এমন করবেন না,,ঠিক আছে বিয়ে দিব না,,তাও এমন করবেন না,আমাদের একটা রেপুটেশন আছে এলাকায়
–
রেপুটেশন?? রেপুটেশন কাদের দেওয়া হয় জানেন??অন্তত আপনাদের মতন লোকদের দেওয়া হয়না যারা মেয়েদের অমতে তাদের মেরেপিটে বিয়েতে বসায় জোর করে
আপনাদের আমি বিন্দু মাত্র বিশ্বাস ও করি না,আপনাদের সকলের চরিত্রের সাথে ভালোভাবে পরিচিত হয়ে গেছি আমি,ব্যস আর না
আর একটা মূহুর্ত ও এই মেয়েটা আপনাদের কাছে সেফ না
অত্যন্ত দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে আজকালকার মেয়েরা তাদের পরিবারের লোকদের কাছেও সেফ না যেই পরিবারে আপনার মতন লোক থাকে
.
কথা শেষ দিয়ে মুনের মাকে সরিয়ে নীল এগিয়ে এসে মুনের হাত ধরে নিয়ে গেলো
মুন হাঁটতেও পারছে না ঠিকমতো,সবার সামনে দিয়ে নীল ওকে নিয়ে গেলো বাহিরে
–
তুষার এতক্ষণ সোফায় বসে সবটা দেখছিলো,কিন্তু যখন নীল মুনকে ধরলো তখনই তার গায়ে জ্বালা ধরলো,এবং সে উঠে দাঁড়ালো প্রতিবাদ করতে
.
কে এই ছেলে?? আর আপনারা ওকে এত ভয় পান কেন,মুনকে ও নিয়ে গেলো,আজব,আপনারা আটকাচ্ছেন না কেন??
–
উনি পুলিশ,উনিই মুনকে আমাদের কাছে এনে দিয়েছেন তখন
–
মুনের মায়ের কথা শুনে তুষার তার কথা মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়েছে
পুলিশকে সে অনেক ভয় পায়
.
নীল কি করবে বুঝতেছে না
এদিকে মুন হাঁটতেও পারছে না,নীলের মাথা কাজ করছে না
থানায় নিয়ে গেলে উনারা বলবে বাসায় ফেরত দিতে আর নয়ত অন্য ব্যবস্থা
মুনের এই অবস্থাতে ওকে একটা চেয়ারেও বসিয়ে রাখা অসম্ভব ব্যপার হয়ে যাবে
নীল আর সাত পাঁচ না ভেবে মুনকে ওর বাসাতেই নিয়ে আসবে ভেবে নিলো
.
কার ড্রাইভ করতে করতে সে মুনের দিকে চেয়ে বললো”তুমি টেনসন করিও না,আমি দেখি কি করতে পারি”
.
নীল বাসায় এসে গাড়ী থেকে নেমে দেখলো মুন অজ্ঞান হয়ে সিটে শুয়ে আছে মাথা এলিয়ে দিয়ে, নীল কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলো ওর মুখের দিকে
.
হিয়া আমাকে মাফ করে দিও,কিন্তু আমার কাছে আজ কেনো পথ নেই ,,তোমার অধিকার আরেকজনকে দিতে যাচ্ছি,জাস্ট কোলে নেওয়া শুনে তো তুমি রাগ করবে না তাই না?
অবশ্য তুমি জানবেও বা কি করে!!তাও আমার মনকে করা ওয়াদা আজ ভঙ্গ করতে যাচ্ছি,তোমার কাছে তো কোলে নেওয়া অনেক বিরাট বড় বিষয়,আমার কাছেও!! তাই তো রাঙামাটিতে ওর পায়ে এত চোট থাকার পরেও ওকে আমি কোলে নিই নাই
কিন্তু আজ তো মনে হয় আমাকেই নিতে হবে
.
নীল বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে মুনকে কোলে তুলে বাসার দিকে চললো
মা টিভি দেখছিলেন,আর নীলের অপেক্ষা করছিলেন,নীল কে নিয়ে একসাথে ডিনার করবেন এরপর নীলের চুলে তেল লাগিয়ে দিয়ে ওকে ঘুম পাড়াবেন,নীলের মন খারাপ থাকলে মা এমনটা করেন,তাই এসব ভেবে রেখে তিনি নিজেও ডিনার করেননি, বাকি সবাই ডিনার করে যে যার রুমে চলে গেছে
.
কলিংবেল বাজতেই নাহার এসে দরজা খুলে দিলো
মা এক নজর দরজার দিকে চেয়ে হঠাৎ নীলের কোলে একটা মেয়েকে দেখে রীতিমত অবাক হয়ে গেলেন,বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি
তার উপর মুনের গায়ে বিয়ের বেনারসি,,তার এক মূহুর্তের জন্য মনে হলো এ মেয়েটা বুঝি নীলের বিয়ে করা বউ
পরেই মাথায় আসলো নীল তো হিয়াকে ছাড়া কোনো মেয়ের কথা ভাবতেই চায় না,আবার বিয়ে??এটা হতেই পারে না
.
নীল মায়ের অঙ্গভঙ্গিমাকে তোয়াক্কা না করেই মুনকে সোফায় এনে শোয়ালো সবার আগে
–
নীল??এই মেয়েটা কে?গায়ে বিয়ের শাড়ী কেন?আর ওর জ্ঞান নেই কেন??কোথা থেকে এনেছিস??কি হয়েছে মেয়েটার?
–
মা এত প্রশ্ন একসাথে করলে কিভাবে জবাব দিব,??
–
আগে বল ও কে?
–
নাম তো মনে হয় মুন,তোমাকে সব বলতেছি,নিপাকে ডাকো,নিপা এই নিপা”!!
–
নিপা তার হবু বর সামিরের সাথে কথা বলছিলো,এ সময়ে নীলের হাঁকডাক শুনে ফোন রেখে ছুটলো ড্রয়িং রুমের দিকে,সচরাচর নীল ওকে ডাকে না তাই নিশ্চয় জরুরি কিছু হবে হয়ত
.
হুম ভাইয়া বলো,,,একি!!এই মেয়ে কে?কখন আসছে?
এভাবে অচেতন হয়ে গেছে কেন?
–
তুই ওর শাড়ী চেঞ্জ করে দিয়ে তোর একটা জামা পরিয়ে দে,,আর দেখ জ্ঞান ফেরাতে পারস কিনা
.
মা আর নিপা একসাথে বললো”কিন্তু ও কে আগে সেটা তো বলো”
.
সব বলবো,আগে ওর জ্ঞান ফিরানো জরুরি
.
নীল আবারও মুনকে সোফা থেকে তুলে নিপার রুমে দিয়ে আসলো
–
মুনকে বিছানায় রাখতেই মা নীলের হাতের কুনুই ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে এলেন
তারপর বললেন”এবার তুই আমাকে বল মেয়েটা কে?আমাদের বাসায় কেন?”
–
মা এই মেয়েটার অনেক প্রব্লেম, ওকে ওর পরিবার জোরপূর্বক বিয়ে দিচ্ছিলো,আমি ওয়ার্নিং দিয়ে আসলাম তারপরেও রাতের এসময়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিলো ওকে,আর তাই আমি বাধ্য হয়ে ওকে এখানে নিয়ে আসলাম,জানো তো পুলিশ স্টেশন নিয়ে গেলো কত কাঠখড় পোড়াতে হবে
.
মেয়েটা সেন্সলেস কেন?
.
ওকে অনেক টর্চার করে ওরা
.
আহারে,বিয়ের জন্য বুঝি মানুষ এমনটা করে যে একেবারে জ্ঞানই হারিয়ে ফেললো,
কিন্তু এখন কি করবি তাহলে?
–
সেটাই তো ভাবছি
–
ভাইয়ায়ায়ায়ায়া
–
কি হয়েছে?
নিপা মুখে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো এরপর চোখদুটো নিচু করে বললো”ভাইয়া মেয়েটাকে তো খুব করে টর্চার করা হয়েছে”
–
কই দেখি
–
নীল তুই বাহিরে থাক আমি দেখে আসতেছি
.
মা ভিতরে গিয়ে দেখলেন মুনের সারা পিঠে গরম খুন্তির ছ্যাকার দাগ,মা এটা দেখে এক চিৎকার দিলেন
নীল মায়ের চিৎকার শুনে ভিতরে চলে আসলো,মুনের পিঠের এমন অবস্থা দেখে নীল নিজেও চমকে উঠেছে
নিপা মুনের পিঠটা একটা কমলা রঙের ওড়না দিয়ে ঢেকে দিলো সাথে সাথে
.
নীল দেয়ালে একটা ঘুষ দিয়ে বললো”আমি ওকে রেখে আসার পর ওরা আবারও ওর গায়ে হাত তুলেছে,ছাড়বো না কাউকে!”
.
নীল রেগেমেগে ফোন নিয়ে কল করতে করতে চলে গেলো রুমের বাহিরে
.
নিপা আর মা মিলে মুনের শাড়ী বদলিয়ে জামা পরিয়ে দিলো,,
নীল ততক্ষণে মুনের মাকে জেলেও নিয়ে এসেছে
.
রাত তখন সাড়ে বারোটা বাজে
.
নীল পকেটে হাত ঢুকিয়ে চোখ মুখ শক্ত করে বললো”মুনের যদি কিছু হয় ফাঁসিতে ঝুলবেন সেটা জানেন?”
.
মুনের মা চুপ হয়ে আছেন,তার কিছু বলার মুখ নেই তার
.
এমনিতেও যা করেছেন তাতে আপনি কি করে জেল থেকে বের হোন সেটাও দেখে নেবো আমি
.
নীল আর কিছু না বলে পুলিশ স্টেশন থেকে বাসায় ফিরে গেলো,সাথে করে ডাক্তার একজনকে নিয়ে গেলো
উনি মুনের অবস্থা চেক করে একটা ইনজেকশান দিয়ে চলে গেলেন,,
–
এরকম অত্যাচার করেছে কেন মেয়েটার উপর,কি ফুলের মত মেয়ে,কারা এমন করেছে?
–
ওর নিজের মা
–
না ভাইয়া নিজের মা এমনটা করতে পারবে না,নির্ঘাত সৎ মা হবে
–
হুম নিপা ঠিক বলেছিস,তো নীল এবার কি করবি ভেবেছিস?
–
আমার মাথায় কিছুই আসছে না,,
.
আধ ঘন্টা পরই মুনের জ্ঞান ফিরলো,চোখ মেলতেই বিছানার এক কেণায় একটা মেয়েকে দেখতে পেলো মুন
সে নিপা,মুনের জ্ঞান ফিরার অপেক্ষা করছিল সে,
সে মুনের জ্ঞান ফিরেছে দেখে এক দৌড়ে চলে গেলো চিল্লাইতে চিল্লাইতে
মুন মাথা ধরে উঠে বসলো,দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো একজন ভদ্র মহিলা মুচকি হেসে আসতেসে সাথে সেই মেয়েটা,সবার শেষে নীল ও আসলো
নীলকে দেখে মুনের কেন যেন স্বস্তি অনুভূত হলো
–
এখন কেমন লাগছে তোমার?
–
ভালো
–
খিধা পেয়েছে??খাবার রেডি চলো খাবা
–
নাহ খিধে নেই
.
নীলের মায়ের কথার জবাব দিতে দিতে মুন বারবার নীলের দিকে তাকাচ্ছে, বুঝে উঠতে পারছে না কি বলবে,সে এখানে কি করে,আর তার বিয়ের কি হয়েছিলো,সেসব মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে শুধু
–
ডোন্ট ওয়ারি,তোমার বিয়ে হয়নি,আমি আটকে দিছি,,আর তুমি এখন আমার বাসায় আছো,উনি আমার মা,,আর এ হলো আমার বোন নিপা,আর আমি হলাম নীল
–
সে কিরে তোর নাম এখনও জানে না??
–
নাহহহ,বললে তো জানবে,আজ বললাম,আর আমিও তো ওর পুরো নাম জানি না
–
আমার নাম মুনতাহা রহমান
চলবে♥