#স্রোতের_টানে
লেখিকা: #Tarin_Niti
পর্ব:৩
ফারিহা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়িটা দেখছে।দেখে তো মনে হচ্ছে এটা আয়ানের বাড়ি।তারমানে ও এতক্ষণ আয়ানের বাড়িতে বন্দি ছিলো!ফারিহা ভেবেছিলো ওকে হয়তো কোনো গোডাউনে বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু না, ও আয়ানের বাড়ির স্টোররুমে বন্দি ছিলো।
বাড়িটা অনেক বড়।দেশি-বিদেশি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো।ফারিহাদের বাড়িটাও অনেক সুন্দর তবে আয়ানের বাড়িটা আরো বড়।মেয়েদুটো ফারিহাকে দুদিক থেকে ধরে নিচে নামায়। আর ফারিহা শাড়ির কুচিগুলো ধরে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচে নামছে।
আয়ান একবার ফারিহার দিকে তাকায়।তারপর সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়।ফারিহা নিচে গিয়ে আয়ানকে দেখে।আয়ান ব্লু কালারের কোট প্যান্ট পড়ে আছে। হাতে দামি ঘড়ি, চুলগুলো স্টাইল করা। পায়ে দামি শু।ফারিহা আয়ানের থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দরজার দিকে তাকায়।
ফারিয়াকে দরজার দিকে তাকাতে দেখে আয়ান বাঁকা হেসে বললো,
“পালানোর চেষ্টা করছো নাকি?”
আয়ানের কথায় ফারিহার কোনো ভাবান্তর হয় না। সেই ভাবে দরজার দিকল তাকিয়ে থাকে।ফারিয়া ওর বাপির অপেক্ষায় আছে। আচ্ছা ওর বাপি কি জানে যে ও এখন আয়ানের বাড়িতে আছে?ফারিহার ভাবনার মাঝেই আয়ান ফারিহার হাত ধরে সোফায় নিয়ে বসায়। ফারিহা চারদিকে তাকিয়ে দেখে এখানে কয়েকজন গার্ড,বাসার সার্ভেন্টরা। পাঞ্জাবি টুপি পরা একটা লোক আর কালো কোট পরা একজন লোক বসে আছে।হাতে কিছু কাগজপত্র।
ফারিহা চারদিকে তাকিয়ে আয়ানের আপনজন হবে এরকম কাউকে দেখতে পায় না। ফারিহা সবাইকে দেখছে তখন আয়ান ফারিহার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দে। ফারিহা দেখেছে কালো কোট পরা লোকটা আয়ানকে কাগজটা দেয়াতে আয়ান সাই। করে তারপর ফারিহাকে দে।ফারিহা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আয়নের দিকে তাকালে আয়ান বললো,
“আমাদের ম্যারেজ রেজিস্ট্রি পেপার। সাইন করো”
ফারিহা শক্ত হয়ে বসে থাকে। বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে।ওর বাপি কি আসবে না ওকে বাঁচাতে? ফারিহাকে দরজার দিকে তাকাতে দেখে আয়ান আবার হাসে।তারপর বললো,
“তোমার বাপি আসবে না। সাইন করো”
“না আমি সাইন করবো না।আমি আপনাকে বিয়ে করবো না”
আয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ” সাইন করো বলছি”
ফারিহা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“আমি সাইন করবো না, করবো না”
ফারিহার কথা শেষ হওয়ার আগেই আয়ান সবার সামনে ফারিহাকে ঠাস করে একটা চড় মেরে দে। তারপর ফারিহার গাল চেপে ধরে বলেলো,
“যদি বাবার ভাল চাও তাহলে সাইন করে দাও”
ফারিহা ভীত চোখে আয়ানের দিকে তাকায়।তারপর এখানে উপস্থিত সবার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায়।আয়ান আবার বললো,
“আমি চাইলে এক্ষুনি তোমার বাবাকে মেরে ফেলতে পারি”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহার বুকটা ধক করে ওঠে। এ পৃথিবীতে তো বাবাই আছে ওর আপনজন। ও বাবাকে হারাতে পারবে না!ফারিহা কান্না করে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
” প্লিজ কেউ আমাকে বাঁচান”
ফারিহার কথা শুনে আয়ান জোরে হেসে দেয়। তারপর হাসতে হাসতে বললো,
“তোমার কি মনে হয় ওরা তোমার কথা শুনবে? ওরা আমার লোক”
ফারিহা ফুঁপিয়ে কান্না করে দে।আইয়ান ফারিহার কাঁধে হাত রেখে বললো,
“আর যদি চড় খেতে না চাও আর বাবাকে বাঁচাতে চাও তাহলে চুপচাপ সাইন করো”
ফারিহা আবার দরজার দিকে তাকায়।নাহ!ওর বাবা আসবে না।ওর বাবা হয়তো জানেই না যে ও এখানে আছে। ফারিহা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে আয়ান আবার বললো,
” তুমি সাইন করবে নাকি তোমার বাবাকে..”
“না না করছি”
“গুড গার্ল.. ”
ফারিহা পাথরের মত সোফায় বসে।ওর কোনো অনুভূতি হচ্ছে না। একদম রোবট হয়ে গিয়েছে!ফারিহা কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি ওর বিয়ে এভাবে হবে!আয়ান ফারিহার হাতে কলম হাতে দে।ফারিহা শেষবারের মতো দরজার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে কান্না করে দে।তারপর আর কোনো উপায় না পেয় পেপারে সাইন করে দে!
ফারিহা সাইন করা শেষ হলে কালো কোট পরা লোকটা হেসে বললো,
“আপনার আজ থেকে আইনগত ভাবে স্বামী স্ত্রী ”
ফারিহার কোনো কথা কানে যাচ্ছে না,ও একদম মূর্তি মতো বসে আছে।তারপর পাঞ্জাবি টুপি পরা লোকটা ধর্মীয় মতে ওদের বিয়ে পড়ায়।
ফারিহাকে যখন কবুল বলতে বলে ও কিছু না ভেবে কবুল বলে দেয়।আসলে ফারিহার কোন অনুভূতিই হচ্ছে না,ওকে যেটা করতে বলা হচ্ছে সেটাই করছে। আজকে ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে!টুপি পরা লোকটা বলেলো,
“আলহামদুল্লিলাহ বিয়ে সম্পন্ন হলো”
তারপর আয়ানের সাথে কথা বলে লোক গুলো চলে যায়। ওরা কি কথা বলে ফারিয়া শুনতে পায়না,ওর আশেপাশে কোনো দিকে খেয়াল নেই।
আয়না এসে হঠাৎ ফারিহাকে কোলে তুলে নেয়! এবার যেন ফারিহার হুঁশ আসে।ফারিহা এক দৃষ্টিতে ছলছল চোখে আয়ানের দিকে তাকায়।আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ওকে নিয়ে উপরের রুমে যায়।উপরে এসে আয়ান ফারিহা কে একটা রুমে নিয়ে আসে।
এখন রাত দশটা টা।আয়ান ফারিহাকে রুমে এনে নিচে নামিয়ে দে। তারপর ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“এটা আজ থেকে আমাদের রুম।আজকে প্রথম দিন তাই তোমাকে কোনো কষ্ট দিবো না।তবে কাল থেকে প্রস্তুত থেকো তোমার বাবার শাস্তি তোমাকে ভোগ করতে হবে!”
ফারিহা প্রাণহীন চোখে আয়ানের দিকে তাকায়।আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায়।
ফারিহার রুমটা দেখতে থাকে।রুমের সব কিছু কালো!বেড কভার কালো,পর্দাও কালো।এমনকি দেয়ালের রঙও কালো। কাভার্ডটা সাদা! কালো সাদার সুন্দরই।
ফারিহা ভাবছে ওকে না পেয়ে ওর বাপী অনেক টেনশন করছে হয়তো।আচ্ছা বাপি অসুস্থ হয়ে যাবে না তো?ফারিহার বুকটা কেঁপে ওঠে। ফারিহা ব্যালকনিতে যায়। ব্যালকনি টা অনেক বড়। ফারিহা অবাক হয়ে দেখে যে ব্যালকুনিতে কোনো ফুল গাছ নেই, সব ক্যাকটাস গাছ! ক্যাকটাস গাছ ও কারোর এত পছন্দ? কিন্তু ফারিহার রুমের ব্যালকুনিতে পুরো ফুল গাছে ভরা। এত্ত এত্ত ফুল গাছ।ফুল গাছ ফারিহার অনেক পছন্দ আর এখানে ফুলই নেই।
ফারিহা ব্যালকনি থেকে বাইরের দিকে তাকায়
সামনের বাগানে রং বেরঙ্গের লাইট জ্বলছে।গেটের দুপাশে বড় দুটো লাইট। রাত হওয়ার কারণে লাইটের আলোয় যতটুকু যায় ফারিহা ততটুকুই দেখে। বাড়ির সামনে অনেক বডিগার্ড রয়েছে।গেইটেও দুজন বডিগার্ড পায়চারি করছে।ফারিহার চারদিক দেখছে তখন পেছন থেকে আয়ান ফারিয়ার কাছে এসে বললো,
“ডিনার করবে চলো তার আগে ফ্রেশ হয়ে নাও”
ফারিহা আয়ানের দিকে তাকায়।আয়ান কোট প্যান্ট খুলে একটা নরমাল টি শার্ট আর একটা টাউজার পড়েছে।চুলগুলল হালকা ভেজা।আয়ানকো অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে।ফারিহাকে এভানো তাকাতে দেখে আয়ান ভ্রু নাঁচায়।ফারিহা তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“আমি খাবো না”
“কেনো? দেখো আমি নাটক করা একদম পছন্দ করি না। চলো..”
ফারিহা আমতা আমতা করে বললো,
“সন্ধ্যাবেলায় আপনি খাইয়ে দিয়েছিলেন তাই এখন খিদে নেই। এখন আর খাবো না”
“ওকে,এস ইওর উইশ”
এটা বলে আয়ান একবার ফারিহার দিকে তাকিয়ে চলে যায়। ফারিহার খিদে থাকলেও আজকে ওর গলা দিয়ে খাবার নামবে না।
ফারিহা আজকে সকালেও ভাবতে পারেনি ওর সাথে এরকম কিছু হবে।সবকিছু কেমন ঝড় এর বেগে হয়ে গেল!ওর জীবনটা এক ঝটকায় পাল্টে গেল।আজ থেকে ফারিহা বিবাহিত!আয়ান ওর স্বামী! যে কিনা ওর বাবার শত্রু। তাও কেমন শত্রু সেটা ফারিহার জানা নেই।কেনো আয়ান ওর বাপির উপর রাগ সেটা ও জানে না।
ফারিহার নিজেকে কেমন যেন পুতুল পুতুল মনে হচ্ছে।ঠিকই তো ওতো পুতুলই।তাইতো আয়ান ওকে নিয়ে কিছুদিন খেলে তারপর ছুড়ে ফেলে দেবে। ফারিহা তাচ্ছিল্য হেসে ব্যলকনির দেয়াল ঘেঁষে নিচে বসে পড়ে।
প্রায় ঘন্টাখানেক পড় আয়ান রুমে আসে।রুমে এসে ফারিহাকে দেখতে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকায়।তারপর ব্যালকনিতে গিয়ে দেখে ফারিহা নিচে বসে এক ধ্যানে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান ভাবছে যাওয়ার সময় মেয়েটাকে বেলকনিতে দেখে গেলাম, এখনো এখানে বসে আছে!
আয়ান রুম থেকে একটা প্যাকেট এনে ফারিহার দিকে প্যাকেটটা ছুড়ে মেরে বললো,
“চেঞ্জ করে নাও”
এভাবে হঠাৎ প্যাকেট টা ছুঁড়ে মারায় ফারিহা ভয় পেয়ে যায়।তারপর প্রশ্নসূচক চোখে আয়নের দিকে তাকালে আয়ান বললো,
“শাড়ি পরে ঘুমোতে পারবে না।চেঞ্জ করে নাও। আজকে এই একটাই জোগাড় করতে পেরেছি
কালকে তোমার জন্য শপিং করে আনবো”
আয়ান ফারিহাকে কিছু বলতে না দিয়ে রুমে চলে যায়। ফারিহা কিছুক্ষণ ব্যালকনিতে বসে থেকে রুমে যায়।গিয়ে দেখে আয়ান ল্যাপটপে কাজ করছে। ফারিহা ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে একে একে গয়না গুলো খুলতে থাকে।আয়ান একনজর ফারিহার দিকে তাকিয়ে আবার কাজে মন দিলো।ফারিহা গয়না গুলো খুলে প্যাকেটটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।এভাবে শাড়ি পড়ে থাকতে ফারিহাও বিরক্ত লাগছিলো।ফারিহা প্যাকেটটা খুলে দেখে একটা হালকা গোলাপি রঙের একটা থ্রি পিস। ফারিহা শাড়ি খুলে থ্রি পিস টা পড়ে নিলো।
তারপর চোখে মুখে পানি দিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে ওর বাবার দেওয়া দুল গুলো পড়ে নিলো। ওই মেয়েটার থেকে দুলগুলো নিয়ে ফারিহা ওর হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েছিলো। দুলগুলো পরে কেনো জানি অনেক শান্তি লাগছে।
ফারিহা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে আয়ান শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ফারিহাকে বেরুতে দেখে আয়ান বললো,
“ভেবেছিলাম তোমাকে ব্যালকনিতে থাকতে দিবো। কিন্তু তুমি রুমে এসে কোনো চিল্লাচিল্লি করো নি
একদম গুড গার্ল হয়ে থেকেছো। তাই এখন শুতে পারো।গুড নাইট”
আয়ান ফারিহাকে কিছু বলতে না দিয়ে রুমের লাইট অফ করে দিলো।ফারিহা ও একবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে সোফায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।
চলবে…