স্রোতের টানে পর্ব:৪

0
4454

#স্রোতের_টানে
লেখিকা: #Tarin_Niti
পর্ব:৪

ফারিহা সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলেই প্রথমে আয়ানকে দেখতে পায়। আয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে ঘড়ি পড়ছে।তারপর চুল গুলো ঠিক করে বডি স্প্রে মেরে ফারিহার দিকে তাকায়। ফারিহাকে এভেবে আয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়ান বললো,
“কি দেখছো?”

আয়ানের কথায় ফারিহার ধ্যান ভাঙ্গে। ফারিহা তাড়াতাড়ি চোখ সরিয়ে নেয়।
তারপর কিছুক্ষণ উসখুস করে জিজ্ঞেস করে,
“কোথায় যাচ্ছেন?”

“কোথায় আবার! অফিসে”

ফারিহা বাচ্চাদের মতো বললো, “আমি বাপির কাছে যাবো!”

আয়ান শান্ত চোখে ফারিহার দিকে তাকায়।তারপর বললো,
“আজ থেকে তুমি এই বাড়িতেই থাকবে আর বাবাকে ভুলে যাও!”

এটা বলে আয়ান ফারিহাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে হন হন করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আর এইদিকে ফারিহা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।সোফায় ঘুমানোর কারণে ওর ঘাড় ব্যথা করছে। ফারিহা আগে কখনো এরকম ছোট জায়গায় ঘুমায়নি।সবসময় একলা বড় খাটে ঘুমিয়েছে।তাই আজকে সোফায় ঘুমানোর কারণে হাত পা ও ব্যথা করছে।

ফারিহার আজকে দেরিতে ঘুম ভাঙ্গে।এমনিতে ও ফজরের সময় উঠে পড়ে।কিন্তু কালকে রাত্রে একটুও ঘুমাতে পারেনি। একেতো নতুন জায়গা তার উপর কালকে ওর উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে গেছে।কি করে ঘুম আসবে!অনেক্ষণ এপাশ ওপাশ করার পর ভোরের দিকে ঘুম আসে।তাই আজকে দেরিতে ঘুম থেকে উঠে।
ফারিহা সোফা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিচে যায়। নিচে অনেক সার্ভেন্ট আছে।একজন একেক কাজ করছে। ফারিয়াকে দেখে একটা মহিলা সার্ভেন্ট বলে উঠে,
“ম্যাম বসুন আপনাকে ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি”

ফারিহা একটু হাসি মুখে বললো,
“আমাকে ম্যাম বলতে হবে না।আমার নাম ফারিহা”

“কিন্তু আমরা তো স্যার কে স্যার বলে ডাকি তাই আপনাকে…”

“উনাকে যা বলার বলুন কিন্তু আমাকে নাম ধরে ডাকলে খুশি হবো”

মহিলাটা হেসে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে।ফারিহা বলে ডাকবো। এখন বসো আমি ব্রেকফাস্টে দিচ্ছি”

ফারিহার একটুও খেতে ইচ্ছে করছিলোনা।
কিন্তু গতকাল সন্ধ্যাবেলায় আয়ান যে খাইয়ে দিয়েছিলো তারপর আর কিছু খায়নি।এখন
অনেক খিদে পেয়েছে।তাই খাবার জন্য বসে পড়ে।কিছুক্ষণ পর একটা সার্ভেন্ট এসে ফারিহাকে ব্রেকফাস্ট দে।

.
ব্রেকফাস্ট শেষ করে ফারিহা ঐ মহিলাটা কে বললো,
“আপনার কাছে ফোন আছে?”

মহিলাটা মুখ গোমরা করে বললো,
“সরি ফারিহা!স্যার বারণ করেছে তোমাকে ফোন দিতে।আমরা স্যারের অর্ডার অমান্য করতে পারবোনা”

ফারিহা বুঝতে পারে এখানে কেউ ওর কথা শুনবে না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে উপরে চলে আসে। ফারিহার কিছু ভালো লাগছেনা।বাপির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।আচ্ছা বাপি কি ওকে না পেয়ে অনেক টেনশন করছে?বাপি ঠিক আছে তো? কিভাবে যোগাযোগ করবো?

সারাদিন ফারিহার একলা কাটে!ফারিহা পুরো বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখেছে।এতগুলো সার্ভেন্ট থাকা সত্তেও ফারিহা কারোর থেকে একটা ফোন নিতে পারেনি। ফারিহা একবার বাড়ি থেকে পালানোর চেষ্টা করেছিলো!গেটের কাছে যেতেই বডিগার্ডরা ওর পথ আটকায়।ফারিয়া পালাতে চেয়েও পালাতে পারেনি।

বিকেলের দিকে ফারিহা ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তখন হঠাৎ বাপির কথা মনে করে ফুঁপিয়ে কেঁদে দে। ও কবে এই বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পাবে?

.
আয়ান রাত দশটার দিকে বাড়িতে আসে।রুমে ঢুকে দেখে রুম একদম অন্ধকার।আয়ান ভ্রু কুঁচকে লাইট অন করে দেখে ফারিহা গুটিসুটি মেরে সোফায় ঘুমিয়ে আছে।কাত হয়ে ঘুমানোর কারণে ফারিহার ওড়নাটা সরে গিয়ে বুকের ভাজ বুঝা যাচ্ছে। আয়ান দুই সেকেন্ড তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নেয়।তারপর তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে যায়।
ফারিহা কখনো এত তাড়াতাড়ি ঘুমায় না।আজকে অনেক কান্না করেছিলো।কান্না করতে করতে ডিনার না করেই সোফায় শুয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে টেরও পায়নি।
আয়ান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে একটা টি-শার্ট পরে কাবার্ড থেকে একটা চাদর নামিয়ে ফারিয়ার গায়ে জড়িয়ে দে।তারপর নিচে চলে যায়। নিচে গিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আয়ান ল্যাপটপ অন করে আজকের ইমেইল গুলো চেক করতে থাকে। তখন একজন সার্ভেন্ট এসে আয়ানকে কফি দিয়ে যায়। সকালে আর রাত্রে কফি খাওয়া আয়ানের অভ্যাস।

তারপর অনেকক্ষণ কাজ করে সাড়ে এগারোটার দিকে ডিনার করতে যায়।আয়ান একটা সার্ভেন্ট কে জিজ্ঞেস করে,
“ফারিহা খেয়েছে?”

“না স্যার। ম্যামকে তো বিকালের পর আর নিচে নামতে দেখিনি”

আয়ান একবার ভাবে ফারিহাকে ঘুম থেকে তোলে খাবার খাওয়াবে।তারপর আবার ভাবে না খেয়ে ঘুমিয়েছে, তো না খেয়ে থাক। এতো আদিখ্যেতার কি আছে!
ডিনার শেষ করে অনেক্ষণ পর আয়ান রুমে আসে।আয়ান এটা ভেবেই অবাক হয় যে আয়ান এসেছে, ওয়াশরুমে গিয়েছে,রুমের লাইট অন করেছে,রুমে আওয়াজ করেছে তবুও ফারিহার ঘুম ভাঙ্গেনি। এই মেয়েটা কি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমায় নাকি?
আয়ান অনেকবার ফারিহা দিকে তাকিয়ে লাইট অফ করে বেডে শুয়ে পড়ে।
আয়ান শুয়ে পড়লে ফারিহা চোখ খুলে।আসলে আয়ান রুমে আসার পরই ফারিহার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কিন্তু ফারিহার আয়নের সাথে কথা বলার একদম ইচ্ছে নেই তাই ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। ফারিহা আয়ানের দিকে তাকায়।যদিও অন্ধকারের কারণে আয়ানকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না! ফারিহা সোজা হয়ে শুয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।ওর চোখের কোনা দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে..

সকালে,,
আজকে ফারিহা আয়ানের আগে ঘুম থেকে উঠে পড়ে।তারপর ফ্রেশ হয়ে নামাজ পড়ে ছাদে চলে যায়।
আয়ান ঘুম থেকে উঠে সোফার দিকে তাকিয়ে ফারিহাকে না দেখে ভ্রু কুচকায়।তারপর আর কিছু না ভেবে ওয়াশরুমে চলে যায়।ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখে ফারিহার রুমে আসছে।আয়ান ফারিহাকে দেখে বললো,
“কোথায় গিয়েছিলে?”

ফারিহা আমতা আমতা করে বললো, ” ছা ছাদে..”

আয়ান শান্ত দৃষ্টিতে ফারিহার দিকে তাকালে ফারিহা একটু হেসে বললো,
“চিন্তা করবেন আপনারা এতো বডিগার্ডদের নজর পেরিয়ে আমি পালাতে পারবোনা”

ফারিহার কথা শুনে আয়ান বাঁকা হাসে।তারপর ফারিহাকে কয়েকটা শপিং ব্যাগ দেখিয়ে বললো,

“তোমার ড্রেস।রাতে এনেছিলাম কিন্তু এসে দেখি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো!”

ফারিহা একটু কৌতুকের সুরে বললো,
“আপনি আমার জন্য শপিং করেছেন?”

আয়ান ফারিহার কথা শুনে একটু জোরেই হাসে। তারপর বললো,
“তোমার জন্য শপিং করা বাদে আমার আরো অনেক কাজ আছে। এগুলো আমার অফিসের একটা ফিমেল স্টাফকে দিয়ে কিনিয়েছি”

“ওহ.. ”

.
আয়ান অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে।অনেকক্ষণ ধরে ফারিহা আয়ানের কাছে এসে উসখুস করছে।হাত কঁচলাচ্ছে দেখে আয়ান বললো,
” কিছু বলবে?”

” হ্যাঁ মানে..”

“যা বলার সোজাসুজি বলো”

“আমি ভার্সিটিতে যেতে চাই” ফারিহা এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললো।

আয়ান ফারিহার দিকে তাকালে ফারিহা ভয়ে ভয়ে বললো,
“দেখুন আমি পড়াশোনা করতে চাই। আপনি যা বলবেন আমি মেনে নেবো কিন্তু আমার পড়াশোনা টা বন্ধ করবেন না।প্লিজ..”

আয়ান হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বললো,
“কিসে পড়ো?”

এবার মনে হয় ফারিহার মাথায় বাজ পড়ছে। মানে যে মেয়েটাকে বিয়ে করলো সেই মেয়েটা কিসে পড়ে সেটাই জানে না!এমনকি নামটাও জানতো না!শুধু জানে ফারিহা এমপি আজাদের মেয়ে তাই ওকে বিয়ে করলো। লোকটা কি পাগল নাকি?
আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ফারিয়া বললো,
“অনার্স থার্ড ইয়ারে”

“ওয়েল!তুমি পড়াশোনা করতে চাইলে আমি কোনো বাধা দেব না।তুমি ভার্সিটি যেতে পারো”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহা একটা মিষ্টি হাসি দে।ও ভাবতে পারেনি আয়ান ওকে ভার্সিটি যেতে অনুমতি দেবে।আর আয়ান অবাক চোখে ফারিহার হাসি দেখে। মেয়েটাকে এই বাড়িতে আনার পর আয়ান একবারও হাসতে দেখে নি। এই প্রথম ফারিহাকে হাসতে দেখলো!হাসলে ফারিহার গালে টোল পড়ে। তখন অনেক কিউট লাগে। আয়ান ফারিহার থেকে চোখ সরিয়ে নে।ফারিহার সেদিকে খেয়াল
নেই। ও মন খারাপ করে বললো,
“কিন্তু আমার স্কুটি টা..”

“হেই তুমি কি ভেবেছো স্কুটি দিয়ে ভার্সিটিতে যাবে?নো নো,,আমার গার্ডসরা তোমাকে পৌঁছে দেবে।আবার ওরাই তোমাকে নিয়ে আসবে”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহার মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ ওর কখনো এসব গার্ড ফার্ড ভালো লাগেনা। এমপির মেয়ে হওয়ার কারণে মিস্টার আজাদ ফারিহার সেফটির জন্য ওর সাথে বডিগার্ড দিয়েছিলো।কিন্তু ফারিয়া জিদ করেছে যে ওর সাথে বডিগার্ড রাখবে না।এভাবে নাকি স্বাধীনভাবে বাঁচা যায় না।দুইদিন অভিমান করে খাবারও খায়নি। তারপর মিস্টার আজাদ বলেছে ঠিক আছে ও একা একা চলাফেরা করতে পারে।কিন্তু মিস্টার আজাদ বললেও ফারিহা জানে দূর থেকে ঠিকই ওর বাবার বডিগার্ডরা ওর উপর নজর রাখতো।কিন্তু ফারিহা সেসবের তোয়াক্কা না করে নিজে স্কুটি নিয়ে স্বাধীনভাবে চলতো।কিন্তু এখন আবার সেই গার্ডের নজরে থাকতে হবে!

ফারিহার ভাবনার মাঝে আয়ান বলে উঠলো,
“এত ভেবে লাভ নেই। ভার্সিটিতে যাচ্ছো বলে ভেবোনা পালিয়ে যেতে পারবে।তোমাকে সব সময় আমার নজরে রাখবো।সো পালানোর চেষ্টা করো না”

ফারিহা কিছু বললো না।এখন কিছু বললে যদি হিতে বিপরীত হয়ে যায়? যদি ওকে ভার্সিটিতে যেতে না দে! তাই ফারিহা আয়ানের কথা মেনে নিলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here