#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:১৫
কেটে গেছে এক সপ্তাহ।ফারিহা এখনও আয়ানের সাথে স্বাভাবিক হতে পারেনি। যদিও ওই দিনের পর থেকে আয়ান ফারিহাকে আর জোর করেনি।তবুও ফারিহা আয়ানকে দেখলে ভয়ে সিটিয়ে থাকে। আয়ান ফারিহার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করার চেষ্টা করে।ফারিহা ভার্সিটির পড়াশোনা,রেস্টুরেন্টের কাজ এসব নিয়ে ভালোই দিন কাটছে।
ফারিহা মিস্টার আজাদের সাথে আর সরাসরি দেখা করেনি।কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিকই ফোনে কথা বলেছে।ফারিহা ভাবে আয়ান হয়তো জানেনা।কিন্তু ফারিহা জানে না যে,ফারিহা যে মিস্টার আজাদের সাথে লুকিয়ে কথা বলে সেই সব আয়ান জানে।কারণ আয়ান ফারিহার ফোন নিজের ফোনের সাথে কানেক্ট করে রেখেছে।ফারিহার ফোনে কে কল দে, ফারিহা কার সাথে কি কথা বলে,সব আয়ান শুনতে পায়।কিন্তু অদ্ভুত হলো এই যে,মিস্টার আজাদের সাথে কথা বলার পরেও আয়ান ফারিহাকে কিছু বলে না।আয়ানের মাথায় কি চলছে সেটা ওই জানে।
আয়ান অফিসে যাওয়ার জন্য রেডী হচ্ছে তখন ফারিহা রুমে আসলো। ফারিহাকে দেখে আয়ান হাতে ঘড়ি পরতে পরতে বললো,
“কোথায় ছিলে তুমি?ঘুম থেকে উঠে দেখিনি।তুমি সারাক্ষণ কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াও?”
আয়ানের কথায় ফারিহা একটু থতমত খেয়ে গেলো।তারপর বললো,
“কি্ কিচেনে ছিলাম”
আয়ান ভ্রু কুঁচকে বললো,”সকাল থেকে কিচেনে?”
“নাহ!ভোরে ছাঁদে গিয়েছিলাম”
“আচ্ছা তুমি ছাদে এতো কি করো বল তো?সকালে রাতে,বিকালে, যখন সুযোগ পাও তখনই ছাদে চলে যাও”
“তো গেলে কি হয়েছে?আপনার যা বাড়ি আশেপাশে তো কোনো বড় বাড়ি নেই। চিন্তা করবেন না ছাদ থেকে আমি কোনো ছেলেদের দেখিনা”
আয়ান ফারিহার দিকে এক নজর তাঁকিয়ে আবার রেডি হতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।তারপর বললো,
“সব সময় ত্যাড়া ত্যাড়া কথা না বললে হয় না,না? ভার্সিটি যাবেনা?”
“যাবো,, ইয়ে মানে আপনাকে একটা কথা বলার ছিলো”
“হুমম বল.. ”
ফারিহা দাঁড়িয়ে উসখুস করছে দেখে আয়ান চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বললো,
“বাই এনি চান্স,,তুমি কি তোমার বাপির সাথে দেখা করার কথা বলবে?”
“না না ওটা না।আসলে আজকে ভার্সিটি শেষে একটু অনাথ আশ্রমে যেতে চাই।অনেকদিন যাওয়া হয়না প্লিজ না করবেন না।আপনার বডিগার্ডরা সাথে থাকবে”
আয়ান ভ্রু কুঁচকে বললো,”অনাথ আশ্রম?”
“হ্যাঁ অনাথ আশ্রম।আমাদের রেস্টুরেন্টে থেকে যেতে আধা ঘন্টার মতো সময় লাগে।বাপি বছরের প্রায় সময়ই ওই অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের জামা কাপড় খাবার দিতো।আমিও বাপির সাথে যেতাম। ওদের সাথে সময় কাটাতে খুব ভালো লাগতো।তারপর আমার রেস্টুরেন্ট চালু করার পর নিজের টাকা দিয়ে ওদেরকে সাহায্য করেছিলাম।কিন্তু বিয়ের পর..”
ফারিহা মাথা নিচু করে ফেললো।আয়ান স্বাভাবিকভাবে বললো, “বিয়ের পর?”
“বিয়ের পর আর যাওয়া হয়নি। ওদেরকে অনেক মিস করছি। আপনি যদি রাগ করেন তাই এতদিন বলতে পারিনি। প্লিজ আজকে না করবেন না”
আয়ান অবাক হয়ে ফারিহাকে দেখছে।মেয়েটা ওকে কতো ভয় পায়।সামান্য একটা কথা বলার জন্য কতবার আটকে গিয়েছে। ভীতু ভীতু চেহারা, বারবার মাথা নিচু করছে।আয়ান কি ওর সাথে একটু বেশি রুড ব্যবহার করে! ফারিহার ভয় কাটিয়ে দিয়ে আয়ান হাসিমুখে বললো,
“তোমার ইচ্ছা হলে যেতে পারো।তবে হ্যাঁ আমার বডিগার্ডরা তোমার সাথে থাকবে”
“হুম হুম ওরা আমার সাথে থাকবে।থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ সো মাচ পার্মিশন দেওয়ার জন্য”
ফারিহা চলে যেতে নিলে আয়ান বললো,
“তোমার বোধহয় কারোর থেকে পারমিশন নেয়ার অভ্যাস নেই, তাই না?”
ফারিহা পেছনে ফিরে আয়ানের দিকে তাকালে আয়ান আবার বললো,
“না মানে, মনে হলো আরকি। এই যে সামান্য একটা পারমিশন এর জন্য আমার সাথে কিরকম ভয় পেয়ে কথা বললে। তাছাড়া আসলে কিভাবে কথাটা বলবে বুঝে উঠতে পারছিলে না।এম আই রাইট?”
“হুম।আসলে আমার গার্জিয়ান বলতে শুধু বাপি ছিলো।আর বাপি আমাকে কখনো কিছুতে বাঁধা দিতো না।আমি যেখানে যেতে চেয়েছিলাম নিজের ইচ্ছামতো যেতে পেরেছিলাম।বাপির পারমিশন লাগতো না, শুধু বাপিকে ফোন দিয়ে বলে দিলেই হতো।
ভার্সিটি শেষে স্কুটি করে আমি আর নওশীন অনেক ঘোরাঘুরি করতাম।মাঝে মাঝে অনাথ আশ্রমের যেতাম কিন্তু হ্যাঁ রাত হওয়ার আগে বাসায় ফিরতে হতো। না হলে বাপি টেনশনে অসুস্থ হয়ে পড়তো”
বলেই ফারিহা হেসে দিলো।ও মাঝে মাঝে লেট করে বাসায় ফিরে দেখতো সার্ভেন্টরা মিস্টার আজাদের মাথায় পানি ঢালছে।মিস্টার আজাদ কেমন অস্থির অস্থির করছে,কারণ ফারিহা এখনো বাসায় ফিরেনি। অন্য সময় বাপি অসুস্থ হলে ফারিহা নিজেও অস্থির হয়ে উঠতো।কিন্তু ওর বাপির এই কাণ্ড গুলা দেখে আরো হাসতো।
ফারিহার হাসিমুখ দেখে আয়ানের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো।তারপর বললো,
“তা তোমার আর কি কি সিক্রেট আছে? ”
ফারিহা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “সিক্রেট?আমার আবার কিসের সিক্রেট?”
“হ্যাঁ সিক্রেটই তো।এই যে নিজে রেস্টুরেন্ট চালাও, নিজে ইনকাম করে অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের সাহায্য করো।এরকম আর কি কি সিক্রেট আছে যা আমি জানিনা?”
ফারিহা হেসে বললো, “আর কিছু নেই।আর এগুলা তো সিক্রেট না।আমি তো ভেবেছিলাম আপনি হয়তো জানেন”
এটা বলে ফারিহা চুপ হয়ে গেলো। ফারিহার নিজের কথা শুনে নিজেরই হাসি পাচ্ছে।যেখানে আয়ান ওর নামটাই জানতো না,সেখানে কি করে এসব জানবে যে ওর নিজের রেস্টুরেন্ট আছে।ও অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের কে সাহায্য করে।আয়ানকে কিছু বলতে না দিয়ে ফারিহা আবার বললো,
“আচ্ছা আমি নিচে যাচ্ছি।আপনিও আসেন।নাস্তা রেডি”
“বাসায় আসবে কয়টায়?”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহা একটু উসখুস করে বললো, “আসলে অনেকদিন পর যাচ্ছি তো।আর ওদের কাছে গেলে আমার আসতে ইচ্ছে করে না, তার জন্য বাপির অনেক বকাও শুনেছি। কিন্তু আপনি চিন্তা করবেন না রাত হওয়ার আগে ফিরে আসবো।আর আপনার বডিগার্ডরা তো আছেই”
ফারিহার কথার ধরন দেখে হেসে দিলো।আয়ান জানে বডিগার্ডরা ফারিহার সাথে থাকে বলে ফারিহা অখুশি।সেটা ফারিহার আচরণ দেখেই বোঝা যায়। আয়ার মুচকি হেসে আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল ঠিক করতে থাকলো।ফারিহা নিচে চলে গেলো।
.
ভার্সিটি ক্লাস শেষে ফারিহা,নওশীন,শিহাব ক্যাম্পাস হাঁটছে। নওশীন বকবক করছে আর শিহাব কিছুক্ষণ পরপর নওশীনের মাথায় চাঁটি মারছে।নওশীন আবার শিহাবের পিঠে কিল ঘুষি দিচ্ছে।ওদের কান্ড দেখে ফারিহা হাসছে।ফারিহা হাসছে দেখে নওশিন বললো,
“এই তোর হাসি পাচ্ছে?দেখ শিহাব আমাকে মারছে। শিহাইব্বা আমার চুল ছাড়”
“ছাড়বোনা।তুই আমাকে মারলি কেনো?আমার পিঠটাকে কি নিজের সম্পত্তি মনে করিস,যে যখন তখন কিল,ঘুসি মারছিস”
“একশোবার মারবো”
“এই তোরা কি শুরু করলি বলতো?আমরা অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের কাছে যাচ্ছি।তোরাই এখন বাচ্চামি করছিস।তোদেরকে কে সামলাবে?”
শিহাব বললো, “আমি কিছু করিনি ফারিহা যা করার এই শাকচুন্নি করেছে”
“ফারিহা দেখলি তোর সামনে তোর বেস্টুকে শাকচুন্নি বলছে?”
“ফারিহা কি তোর একার বেষ্টু নাকি রে?ফারু আমারও বেস্টি”
“এই তোরা দুজন চুপ এবার।কিন্তু আমার রাগ উঠছে”
ফারিহার ধমক শুনে দুইজনই চুপ করে গেলো। তারপর তিনজন কথা বলতে বলতে ভার্সিটির গেট দিয়ে বের হলো।আয়ানকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফারিহা অবাক হয়ে সামনে দিকে তাকালো।
আয়ান গাড়ি সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভার্সিটির সুন্দর সুন্দর মেয়েরা সব আয়ানের আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।সব মেয়েরা একদম হাঁ করে আর কে দেখছে।ফারিহার দৃষ্টি অনুসরণ করে শিহাব আর নওশীনও সামনে দিকে তাকালো।আয়ান ফারিহাকে দেখে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে হাত দিয়ে ইশারা করে “হাই” দেখালো।তারপর ফারিহার কাছে এগিয়ে আসলো।ফারিহা অবাক হয়ে বললল,
“আপনি এখানে?”
“আমিও তোমার সাথে অনাথ আশ্রমের যাবো।আমিও দেখি আমার বউটা কি সমাজ সেবা করে”
শিহাব আর নওশীন এখনো হাঁ করে আয়ানকে দেখছে।আয়ান হাসিমুখে শিহাবের দিকে এক হাত বাড়িয়ে বললো,
“তুমি শিহাব রাইট?তোমাদের সাথে আগে কখনো দেখা হয়নি কিন্তু ফারিহা বাসায় প্রায় সময় তোমাদের কথা বলে।তাই চিনতে পেরেছি”
শিহাব অপ্রস্তুত ভাবে আয়ানের সাথে হাত মিলালো। নওশীন গালে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে আয়ানকে দেখছিলো। আগে টিভিতে পেপারে আয়ানকে দেখেছিলো কিন্তু কখনো সামনাসামনি দেখার সুযোগ হয়নি। তাই এখানে সামনাসামনি দেখে নিজেকে সামলাতে পারছে না।আয়ান নওশীনের গাল টেনে দিয়ে বললো,
“তুমি নওশীন রাইট?ইউ আর সো কিউট”
আয়ানের আচরণে নওশীন হতভম্ব হয়ে গেলো।তারপর একটু হেসে বললো,
“হুম আমি নওশীন। কেমন আছেন ভাইয়া?”
“হ্যাঁ ভালো আছি। তোমরাও অনাথ আশ্রমের যাবে? আচ্ছা আমার গাড়িতে চলো”
ফারিহা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললো, “আপনার বডিগার্ডরা কই?”
“ওদেরকে পাঠিয়ে দিয়েছি।এখন আমি আছি আমার বউকে আর কারোর নজরদারিতে রাখতে হবে না ”
আয়ানের এতো মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে শিহাব আর নওশীন অবাক হচ্ছে।ফারিহা শিহাব আর নওশীনের দিকে তাকিয়ে বললো, “চল”
তারপর আয়ান ড্রাইভিং সিটে বসলো।আর ফারিহা সামনের সিটের পাশে।নওশীন আর শিহাব পেছন বসেছে।
প্রায় আধাঘন্টা পর কথা বলতে বলতে ওরা অনাথ আশ্রমের পৌঁছে গেলো। এই আধা ঘন্টায় আয়ান নওশীন আর শিহাবের সাথে একদম ফ্রী হয়ে গিয়েছে। নওশীন আর শিহাব আয়ানের আচরণে অবাক হচ্ছে। কারণ ওরা ধারণা করেছিলো আয়ান খুব বাজে একটা লোক। আর করবে নাই বা কেনো, আয়ান ফারিহার সাথে যা করলো!কিন্তু এখন আয়ানের কথাবার্তায় তার বিপরীত মনে হচ্ছে..!
চলবে..