স্রোতের টানে পর্ব-১৬

0
4105

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:১৬

ফারিহা গাড়ি থেকে নেমে অনাথ আশ্রমের গেট দিয়ে ঢুকতে না ঢুকতেই এক ঝাঁক বাচ্চা এসে ওর উপর হামলে পড়লো।ফারিহা হাঁটুগেড়ে বসে সবাইকে জড়িয়ে ধরলো।বাচ্চারা একজনের উপর আরেকজন এসে কে আগে ফারিহাকে জড়িয়ে ধরবে তার জন্য হুরোহুরি লেগে যায়।ফারিহা হেসে সবাইকে শান্ত হতে বললো।
আয়ান অবাক হয়ে বাচ্চাদের দেখছে।প্রথমে বাচ্চারা এভাবে ফারিহার দিকে দৌড়ে আসায় আয়ান হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল।নওশীন আর শিহাব পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে কারণ ওরা এই ঘটনার সাথে পরিচিত।
একে একে বাচ্চারা ফারিহাকে বলতে শুরু করলো,
– “পিপি তুমি এতদিন পর আসলে কেন?”
– “হুম আমরা তোমার উপর রাগ করেছি”
– “তুমি কি আমাদের ভুলে গিয়েছো?
– “তুমি আমাদের একদম মিস করো না,তাই না?কিন্তু আমরা তোমাকে অনেক মিস করেছি”

ফারিহা একটু হেসে বললো, “ওলে বাবালে,,আমার বাচ্চারা দেখি সবাই আমার উপর অভিমান করে আছে।তাহলে আমি চকলেটগুলো কাকে দেবো হুম?”

ফারিহার কথা শুনে বাচ্চারা সবাই লাফাতে লাফাতে বললো, “আমাকে আমাকে..”

“ওকে ওকে।তোরা সবাই শান্ত হ।তোদের সবার জন্য চকলেট এনেছি”

ফারিহা অনাথ আশ্রমে কাজ করে দুটো ছেলেকে গাড়ি থেকে চকলেট নামাতে বললো।
ফারিহা সকালে আয়ানের বডিগার্ডের দিয়ে চকলেট কিনেছিল। তারপর ওই গাড়িতে চকলেটগুলো ছিলো।কিন্তু আয়ান এসে বডিগার্ডের দিয়ে ওর গাড়িতে চকলেট গুলো নিয়েছিল।ছেলে দুটো চকলেট নামাতে গেলো আর ফারিহা আয়ানকে ইশারা করে বাচ্চাদের নিয়ে ভেতরে দিকে এগোয়।আয়ান এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে।বাচ্চাদের আচরনেই বুঝা গেছে ওরা ফারিহাকে কতো ভালবাসে।ফারিহা কিছুদিন এসেছে না বলে কত রাগ অভিমান।ফারিহা সত্যিই অসাধারন একটা মেয়ে।

ফারিহাকে ভেতরে আসতে দেখে ঝুমা আন্টি এগিয়ে এসে বললো,
“ফারিহা তুমি এতদিনে আসলে? বাচ্চারা তো আমাকে জ্বালিয়ে মারছে,পিপি কবে আসবে?পিপি কবে আসবে বলে বলে”

ফারিহা একটু হেসে বললো, “আসলে একটু ঝামেলায় ছিলাম আন্টি”

“হ্যাঁ আমি শুনেছি।তুমি এতদিন আসছিলে না দেখে আমি তোমার বাবাকে কল করেছিলাম। তখন তোমার বাবা বললো। তোমার জন্য খুব খারাপ লাগছে”

ফারিহা জোরপূর্বক হেসে বললো, “না না আন্টি কষ্ট পাচ্ছেন কেন?আমি অনেক ভালো আছি আর আন্টি পরিচিত হন আমার হাজবেন্ড আয়ান খান”

আয়ান অবাক চোখে ফারিহার দিকে তাকালো। ফারিহা কখনো আয়ানকে এভাবে কারো সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়নি।ফারিহা যখন বলেছে “আমার হাজব্যান্ড আয়ান খান” তখন অজান্তেই আয়ানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ঝুমা আন্টি একটু বাঁকা চোখে আয়ানের দিকে তাকালো।তারপর একটু হেসে আয়ানকে বসতে বললো।
ওই দুটো ছেলে চকলেট নিয়ে আসলে ফারিহা, নওশীন আর শিহাব সব বাচ্চাদের চকলেট দিলো।ফারিহা এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝুমা আন্টিকে ডেকে বললো,
“আন্টি আমার প্রিন্সেস কই?”

“আর বলোনা তোমার প্রিন্সেস!উনি তো তোমার উপর প্রচুর অভিমান করে আছে।কথা বলে কিনা দেখো”

তখন নওশীন উৎফুল্ল হয়ে বললো, “দাঁড়া আমি রিমঝিমকে আনছি।গুলুমুলু টা কই গেলো?”

নওশিন দৌড়ে ভেতরে চলে গেলল। ফারিহা সব বাচ্চাদের সাথে কথা বলছে একটু পর নওশীন কোলে করে একটা চার বছরের বাচ্চা মেয়ে নিয়ে আসলো।পরনে একটা নরমাল লাল সুতি ফ্রক।গাল ফুলিয়ে নওশীনকে বলছে,আমি যাবো না আমি যাবো না।ফারিহা গিয়ে রিমঝিমের সামনে দাঁড়িয়ে কান ধরে বললো,
“আই এম সরি,,মাই প্রিন্সেস।রাগ করে না।এতগুলো সরি।পিপির সাথে কথা বলবে না?”

রিমঝিম মুখ ঘুরিয়ে নিলো।নওশীন জোরে হেসে বললো,
“বাব্বাহ,, এইটুকু মেয়ের রাগ দেখো!”

রিমঝিম হচ্ছে অনাথ আশ্রমের সবচেয়ে ছোট বাচ্চা। ওর যখন দুইদিন বয়স তখন ঝুমা আন্টি ওকে রাস্তায় কুড়িয়ে পায়।ভাগ্যক্রমে সেইদিন ফারিহা ওর বাপির সাথে অনাথ আশ্রম এসেছিলো।রিমঝিমকে দেখে ফারিহা কান্না করে দে।কেউ কি করে একটা বাচ্চাকে এভাবে রাস্তায় ফেলে যেতে পারে!তারপর থেকে রিমিঝিমি অনাথ আশ্রমের থাকতে শুরু করলো।রিমঝিম আসার পর থেকে ফারিহা প্রায় প্রতিদিনই অনাথ আশ্রম আসতো। রিমঝিম নামটাও ফারিহার দেওয়া।সব বাচ্চাদের থেকে ফারিহা রিমঝিমের প্রতি বেশী দুর্বল।ফারিহা রিমঝিমের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট উল্টে ফেললো। রিমঝিম আড়চোখে ফারিহার দিকে তাকিয়ে আধো আধো কন্ঠে বললো,
“এই পিপি তুমি কি এখন কান্না করবে নাকি?আমি রাগ করিনি,,কোলে নাও ”

ফারিহা মিষ্টি হেসে রিমঝিম কে কোলে নিলো। তারপর রিমঝিম এর জন্য স্পেশাল চকলেট টা ওর হাতে দিলো।শিহাব এসে রিমঝিমের সাথে হাই পাইভ করে।রিমঝিম আয়ানের দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললো,
“পিপি এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা কে গো?”

“কেনো প্রিন্সেস?ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে বুঝি? ”

“হ্যাঁ কত সুন্দর দেখতে। একদম সিনেমার হিরোদের মতো।এই তুমি কে?”

রিমঝিমের কথায় আয়ান থতমত খেয়ে গেলো।দ্য গ্রেট মাফিয়া কিং আয়ান খান সামান্য একটা বাচ্চা মেয়ে কোথায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।নওশীন রিমঝিমের গাল টেনে দিয়ে বললো,
“এই হ্যান্ডসাম ছেলেটা তোর পিপির বর”

রিমঝিম গালে হাত দিয়ে বললো, “পিপির বর?”
তারপর আয়ানের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে বললো,
“এই হ্যান্ডসাম ছেলে,আমাকে কোলে নাও”

আয়ান অবাক চোখে একবার রিমঝিমের দিকে আর একবার ফারিহার দিকে তাকালো। ফারিহা চোখের ইশারায় রিমঝিমকে কোলে নিতে বললো। আয়ান কখনো বাচ্চাদের কোলে নে নি। এমনকি ও বাচ্চাদের খুব একটা পছন্দ করে না। অপ্রস্তুত হয়ে রিমঝিম কে কোলে নিলো।রিমঝিম আয়ানের চুলে হাত দিয়ে বললো,
“ওমা তুমি কত সুন্দর! পিপি তুমিতো সুন্দর ছেলেটাকে বিয়ে করে ফেললে।আমার জন্যও এরকম একটা বয়ফ্রেন্ড খুজবে”

রিমঝিমের কথায় উপস্থিত সকালে হেসে দিলো।ঝুমা আন্টি বললো,
“হয়েছে আর পাকনা পাকনা কথা বলতে হবেনা। সকাল থেকে তো তোর মন খারাপ।যেই পিপি এসেছে সেই দুষ্টুমি শুরু”

“হুম সকালে পিপির জন্য মন খারাপ ছিলো।এখন তো পিপির চলে এসেছে।সাথে আবার এই হ্যান্ডসাম ছেলেটাকেও এনেছে”
বলেই রিমঝিম আয়ানের গালে একটা চুমু খেলো।আয়ান মায়াবী চোখে রিমঝিমের দিকে তাকালো।বাচ্চাটা খুব কিউট।এরকম মিষ্টি একটা মেয়ে এই পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই।

.
এখন বিকেল বেলা,,
ফারিহা বাচ্চাদের সাথে খেলছে।আর আয়ান দূরে দাঁড়িয়ে ফারিহাকে দেখছে।বাচ্চাদের সাথে মিশে ফারিহা একদম বাচ্চা হয়েছে।ওরা কানামাছি খেলছে,ফারিহা চোখ বাঁধা। ফারিহা খিলখিল করে হাসছে আর বাচ্চাদের তাড়া করছে।বাচ্চা রাও দৌড়াচ্ছে।ফারিহার মধ্যে যে এরকম একটা বাচ্চা লুকিয়ে ছিলো সেটা আয়ানের জানা ছিল না। আজকে আয়ান সত্যিই অবাকের উপর অবাক হচ্ছে।আয়ানের এক দৃষ্টিতে ফারিহাকে দেখছে তখন ঝুমা আন্টি আয়ানের পাশে এসে দাঁড়ালো।আয়ান ঝুমা আন্টির উপস্থিতি টের পেলো না।ঝুমা আন্টি আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ফারিহাকে দেখছো?”

ঝুমা আন্টির কথা শুনে আয়ান নড়েচড়ে দাঁড়ালো। তারপর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“না না বাচ্চাদের দেখছিলাম”

“মিথ্যা বলো না। আমি তোমার বড় আমি তোমাদের বুঝতে পারি”

“না মানে… ”

“ফারিহা খুব ভালো একটা মেয়ে।এই অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের অনেক আদর করে।ফারিহা টাকা না দিলে হয়তো বাচ্চারা এত সুখী থাকতে পারতো না।মেয়েটার মনটা ভালো কিন্তু ভাগ্যটা অনেক খারাপ”

আয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝুমা আন্টির কথা শুনছিলো।কিছুক্ষণ পর ঝুমা আন্টি আবার বলতে শুরু লাগলো,

“আসলে ফারিহার ও ছোট থাকতে ওর মা মারা গিয়েছিল।তাই হতো বাবা মা হীন বাচ্চাদের কষ্টগুলো বুঝে।ওর কিডন্যাপ হওয়ার খবরটা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম।তোমার সাথে কথা বলছি বলে ভেবোনা আমি তোমাকে পছন্দ করেছি। তুমি ফারিহার সাথে যা করেছ ঠিক করনি।তবে হ্যাঁ দয়া করে এই মেয়েটাকে কষ্ট দিও না।মেয়েটা অনেক ভালো।এমন যেন না হয় কষ্ট পেতে পেতে তোমার উপর থেকে ওর মায়া উঠে যায়।তখন তুমি চাইলে ওকে ফিরে পাবে না।”

ঝুমা আন্টি আর কিছু না বলে আয়ানকে এক সাগর ভাবনার মধ্যে ফেলে চুপচাপ চলে গেলো।আয়ান আবার ফারিহার দিকে তাকালো।ফারিহা আর বাচ্চারা খেলছে, নওশীন শিহাব পাশে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে।
_______________

“আপনি এখানে এসে বোর হচ্ছেন তাইনা? আপনার আসার কি দরকার ছিলো?’

ফারিহার কথা শুনে আয়ান পেছনে ফিরলো।আয়ান চুপচাপ একা একা হেঁটে অনাথ আশ্রম টা দেখছিলো।ফারিহা খেলতে খেলতে আয়ানের দিকে চোখ যায়। তারপর নওশীন আর শিহাবকে বাচ্চাদের সাথে খেলতে দিয়ে আয়ানের কাছে আসলো।আয়ান হেসে বললো,
“না না বোর হচ্ছি না।অনাথ আশ্রমটা দেখছিলাম। অনেক সুন্দর বাচ্চাদের জন্য একদম পারফেক্ট”

“হ্যাঁ সুন্দর না? তাই তো আমি প্রায় সময় এখানে চলে আসি।এখানে আসলে মনটা একদম ফ্রেশ হয়ে যায়”

“হুম জায়গাটাও সুন্দর আর বাচ্চাগুলোও মাশাল্লাহ”

“জানেন ওদের দেখলে না মাঝে মাঝে অনেক মন খারাপ লাগে। এতো ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর বাবা-মা নেই”

আয়ানের ওর বাবা-মায়ের কথা মনে পড়লো। আয়ান ছোট থাকতে ওর বাবা-মা মারা যায়।বাবা-মা মারা যাবার পর আমেরিকা মামার কাছে চলে যায়।তাই আয়ান সেরকমভাবে বাবা-মা এর আদর পায়নি।
ফারিহা হেঁটে হেঁটে আয়ানকে পুরো অনাথ আশ্রম টা দেখলো।সন্ধ্যা হয়ে আসছে তাই নওশীন ফারিহা কে বললো,
“ফারিহা সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। বেশি রাত হলে ফিরতে পারবো না”

ফারিহা এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,
“ওহ তোকে তো আবার একা ফিরতে হবে।আচ্ছা তুই আজকে শিহাবের সাথে চলে যা”

“না আমি ঐ বান্দরটা সাথে যাবো না।পরে দেখা যাবে আমাকে মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে চলে যাবে”

শিহাব মুখ ভেংচি দিয়ে বললো, “তোকে কে নিবে?তুই তোর পথে যা ভাগ”

“ফারিহা দেখলি আমার সাথে কিভাবে কথা বললো?”

ফারিয়া রাগি চোখে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, “শিহাবকে সবসময় নওশীনের সাথে এরকম করিস কেনো?দেখ সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে।কিছুক্ষণ পর রাত নামবে।এখনো নওশীনের একা যাওয়াটা ঠিক হবে না।তুই ওকে নিয়ে যা”

শিহাব কিছু বলতে যাবে কিন্তু ফারিহা ওকে থামিয়ে দিলো।শিহাব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “ওকে।শুধু তুই বলছিস বলে।না হলে ওকে আমার সাথে নিতে বয়েই গেছে”

নওশীন মুখ ভেঙ্গালো।শিহাব আর নওশীন সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
ফারিহা আর আয়ান কিছুক্ষণ বাচ্চাদের সাথে থেকে সবাইকে আদর করে,ঝুমার আন্টির সাথে কথা বলে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।ফারিহা আসার সময় রিমঝিমকে আদর করতে ভুলোনা।আর আয়ান তো আজকে ফারিহাকে নতুন করে জানলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here