#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:১৯
ফারিহা ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়লো
তারপর অনেকক্ষণ ওর মায়ের জন্য মুনাজাতে দোয়া করলো।ফারিহা প্রচুর কান্নাও করলো।
১৬ বছর আগে এই দিনে ফারিহার মা ফারিহাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো।ফারিহা তখন মাত্র সাত বছরের বাচ্চা।তখন তো এটাও বুঝতো না যে ওর মা সারা জীবনের জন্য ওদের ছেড়ে চলে যাচ্ছে।কিন্তু ফারিহা বড় হওয়ার সাথে সাথে বুঝতে পারে যে ওর মা আর ফিরে আসবেনা।
অনেকক্ষণ পর ফারিহা নিচে আসলো।নিচে অনেক লোক কাজ করছে। সবার হুড়োহুড়ি,কথার আওয়াজে বাড়িটা মুখরিত হয়ে উঠেছে। ফারিহাকে দেখেই হনুফা বেগম টেনে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসালো।
“আরে আরে কি করছো মনি?”
“কি করছি মানে? তুই এখনো নাস্তা করিসনি।তাড়াতাড়ি এগুলো খা”
“আমি খাচ্ছি তো মনি।দেখো এমনিতে তুমি কত কাজ করছো আমার দিকে এতো খেয়াল রাখতে হবে না।আমি এখন বড় হয়েছি”
“দেখছি কি বড় হয়েছিস।আমি জানতাম তুই আজকে খাবি না,নিশ্চয়ই সকালে উঠে কান্নাকাটি করেছিস তাই না?”
“মনি..”
হনুফা বেগম ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“আমি তোর চোখ মুখ দেখেই বুঝতে পেরেছি।দেখ মা বাবা তো সারা জীবন বেঁচে থাকে না।এই সত্যিটা তো তাকে মেনে নিতে হবে, তাইনা?”
ফারিহা নীচু কন্ঠে বললো, “হুম”
“আচ্ছা ঠিক আছে এখন এসব কথা মনে করে মন খারাপ করিস না। নাস্তা কর”
“তুমি খাইয়ে দাও না”
হনুফা বেগম মায়াবী দৃষ্টিতে ফারিহার দিকে তাকালো।উনি জানে মেয়েটা ওনাকে কত ভালবাসে। আগে ও মাঝে মাঝে এসে বায়না ধরতে হানুফা বেগমের হাতে খাওয়ার জন্য। হনুফা বেগম মিষ্টি হেসে পাশে একটা চেয়ারে বসে ফারিহাকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
খাওয়া শেষে ফারিহা বললো,
“মনি একটা প্লেটে খাবার দাও তো”
হনুফা বেগম জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফয়রিহার দিকে তাকালে ফারিহা বললো, “আমি জানি বাপিও হয়তো এখনো কিছু খায়নি। তুমি খাবার দাও আমি বাপিকে খাইয়ে আসছি”
হনুফা বেগম একটু হেসে মিস্টার আজাদের জন্য খাবার বেড়ে দিলো।ফারিহা প্লেট হাতে নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো মিস্টার আজাদ দরজার সামনে দুইটা লোককে কি যেন বলছে।ফারিহা গিয়ে মিস্টার আজাদের হাত ধরে টানতে টানতে বললো,
“বাপি তুমি এত কি কাজ করছো বলোতো? চলো খাবে চলো..”
“আরে আরে ফারিহা কি করছিস?ঐদিকের কাজটা একটু বুঝিয়ে দিতে হবে তো”
“তোমার কিচ্ছু করতে হবেনা।হানিফ আঙ্কেল সব করবে।তুমি এখন নাস্তা করবে আসো”
ফারিহা একহাতে প্লেট আর একহাতে মিস্টার আজাদকে ধরে টানতে টানতে সোফায় এনে বসালো।তারপর মিস্টার আজাদের মুখের সামনে খাবার তুলে দিয়ে বললো,
“তোমাকে বারণ করেছি না?এতো কাজ করলে তোমার শরীর খারাপ করবে তো”
মিস্টার আজাদ হেসে বললো, ” আমি কাজ করছি না তো।একটু দেখিয়ে দিচ্ছি”
“একটু পরে দেখি দেওয়া যায়না? আগে খাবারটা খেয়ে নিলে কি হয়?তোমাকে বকা না দিলে কোন কথা শুনো না”
“তোর বকা শুনতে ভালো লাগে। তাই তো আগে খাই না”
“উফ বাপি তুমিও না”
ফারিহা মিস্টার আজাদ কে খাইয়ে দিচ্ছে আর মিস্টার আজাদ একদৃষ্টিতে ফারিহার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর ফারিহা বললো, “কি দেখছো?”
“তোর চেহারাটা একদম তোর মায়ের মতো”
ফারিহা একটু মন খারাপ করে বললো, ” আজকে মাম্মার কথা খুব মনে পড়ছে তাই না বাপি?”
“হ্যাঁ রে মা,,আজকের দিনেই তো আমি ওকে হারালাম”
“থাক বাপি মন খারাপ করো না। তুমি মন খারাপ করলে তো মাম্মার আরো কষ্ট হবে তাই না?প্লিজ মন খারাপ করো না”
মিস্টার আজাদ হেসে বললো, “আমার মেয়েটা অনেক বড় হয় গিয়েছে।আমাকে কি সুন্দর করে বুঝাচ্ছে”
ফারিহা একটু ভাব দেখিয়ে বললো, ” হ্যাঁ আমি তো বড় হয়ে গিয়েছি।শুধু তুমি আমাকে বাচ্চা মনে কর”
মিস্টার আজাদ ফারিহার কথা শুনে জোরে হেসে দিলো।আরো অনেকক্ষণ গল্প করতে করতে ফারিহা মিস্টার আজাদকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
__________
দুপুরে গোসল করে ফারিহা একটা সাদা থ্রি পিস পড়লো।সাথে সাদা সালোয়ার ওড়না। তারপর চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে মুছে ব্যালকনিতে গেলো। ব্যালকনি থেকে পাশের বাগানের দিকটা দেখা যাচ্ছে।সেখানে অনেক মানুষ।
মিস্টার আজাদের অনেক বন্ধুরাও এসেছে।ওরা বসার ঘরে সোফায় বসে আছে।ফারিহা একবার ব্যালকনি থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে তারপর রুম থেকে বেরিয়ে নিচে আসলো।
ফারিহার বাবার বন্ধুর বউ মিসেস রহমান ফারিহাকে দেখে বললো,
“আরে এটা মিস্টার চৌধুরীর মেয়ে না?তোমার নাম কি যেনো?”
ফারিহা একটু মিষ্টি হেসে বললো, “ফারিহা”
মিসেস রহমান ফারিহার গালে হাত রেখে বললো, “বাহ খুব মিষ্টি নাম। তুমি দেখতেও অনেক মিষ্টি।কতো বড় হয়ে গিয়েছো।তোমাকে সেই ছোটবেলায় দেখেছিলাম।শুনলাম তোমার নাকি বিয়ে হয়ে গিয়েছে!”
মিসেস রহমানের কথা শুনে ফারিহা চুপ হয়ে গেলো।আসলে ফারিহা কি বলবে বুঝতে পারছে না। তখন মিস্টার রহমান বললো,
” হ্যাঁ আমিও শুনেছি। বাংলাদেশের টপ বিজনেসম্যান আয়ান খানের সাথে নাকি বিয়ে হয়েছে।ছেলেটার কিন্তু অনেক পাওয়ার”
মিসেস রহমান অবাক হয়ে বললো, “এমপির মেয়ের সাথে এতো বড় বিজনেসম্যান ছেলের বিয়ে হলো আর আমরা কিছু জানি না!”
মিস্টার রহমান হেসে বললো, “হ্যাঁ আমরা তো প্রথমে কেউ কিছু জানতাম না,পরে শুনেছি।আসলে আমি শুনেছি আয়ান নাকি তোমাদের বিয়েটা পাবলিক করতে চায়নি,তাইনা ফারিহা?”
ফারিহা কি বলবে বুঝতে পারছে না।শুধু মাথা নাড়ালো।মিসেস রহমান কিছু বলতে যাবে তখন সেখানে মিস্টার আজাদ উপস্থিত হলো।মিস্টার আজাদকে থেকে মিসেস রহমান বললো,
“আপনার মেয়েটা খুব মিষ্টি দেখতে,অনেক লক্ষী”
মিস্টার আজাদ ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “হুম এটা আমার ঘরের লক্ষী”
মিস্টার আজাদের কথায় ফারিয়া হাসলো।মিস্টার রহমান মিস্টার আজাদের সাথে অন্য কথা বলতে থাকলো।বিয়ের কথা উঠাতে ফারিহা অনেক অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলো।এখন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
অনেকক্ষণ পর ফারিহা মনির সাথে কিচেনে গল্প করে তারপর বাহিরে আসলো।ফারিহা বাহিরে এসে বাগানের দিকে যেতে নিলে সেদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো।ফারিহা কি ঠিক দেখছে? গেট দিয়ে আয়ানের গাড়ি ঢুকেছে! এটা কি সত্যি আয়ানের।গাড়ি নাকি ফারিহা কি ভুল দেখছে?ব্ল্যাক কারটা পার্কিং লটে গিয়ে থামলো। ফারিহা একপ্রকার দৌড়ে সেদিকে গিয়ে একটু দূরে দাঁড়ালো।
আয়ান গাড়ির দরজা খুলে চুলগুলো হাতে ঠিক করতে করতে বেরোয়।পরনে সাদা পাঞ্জাবি, হাতে দামি ঘড়ি,চুলগুলো সবসময়ের মতো স্টাইল করা। ফারিহা আজকে প্রথম আয়ানকে পাঞ্জাবিতে দেখল তাও আবার সাদা পাঞ্জাবি।আয়ানকে অনেক সুন্দর লাগছে।
ফারিহা হঅবাক হয়ে আয়ানকে দেখছে তখন আয়ান এসে ফারিহার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
“হেই কি দেখছো?”
ফারিহা আমতা আমতা করে বললো, “আপ্ আপনি এখানে?”
“কেনো?আসতে পারি না?”
“না মানে…”
“ওহ কামন ফারিহা। আমার শাশুড়িমায়ের মৃত্যু বার্ষিক আর আমি আসবো না?”
ফারিহা একটু হেসে বললো, “এসেছেন ভালো করেছেন।ভিতরে চলুন”
আয়ান ফারিহাকে দেখছে।সাদা থ্রি পিসে ফারিহাকে আরো মিষ্টি লাগছে।সামনে ভেজা চুলগুলো গালেট সাথে লেপ্টে আছে। মায়াবী মুখটা চোখ ছোট ছোট করে ওকে দেখছে।আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো।তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ভেতরে গেলো।আয়ান আজকে প্রথম মিস্টার আজাদের বাড়ি আসলো।ওর শ্বশুর বাড়িটা কেমন দেখতে হবে তো।
ফারিহা ভিতরে গিয়ে দেখে একটু দূরে মিস্টার আজাদ কার সাথে যেন কথা বলছে।ফারিহা আয়ানকে নিয়েছে সেদিকে গেল।
কাছে গিয়ে ফারিহা মিস্টার আজাদ কে বললো,
“বাপি উনি এসেছে”
ফারিহার কথায় মিস্টার আজাদ হাসি মুখে পেছন ফিরে তাকালো।তারপর আয়ানকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো।আয়ান হেসে মিস্টার আজাদকে লম্বা একটা সালাম দিলো এতে মিস্টার আজাদ হকচকিয়ে যায়।তারপর বললো, “তুমি এখানে?”
আয়ান দাঁত কেলিয়ে বললো, “হ্যাঁ শ্বশুরমশাই চলে আসলাম।আপনি বা আপনার মেয়ে আমাকে দাওয়াত দেন নি।তাই নির্লজ্জের মতো বিনা দাওয়াতে চলে এসেছি”
“তোমাকে তো আসতে বলিনি তাহলে এসেছো কেনো?”
“ওই যে বললাম আমি নির্লজ্জ!তাই বিনা দাওয়াতে চলে এসেছি।ঠিক করেছি না?”
মিস্টার আজাদ বিরক্তি নিয়ে বললো, “না,,একদম ঠিক করনি।তুমি আমার বাড়িতে কেনো এসেছো?”
আয়ান ইনোসেন্ট মুখ করে বললো, “আমি কি আমার শ্বশুর বাড়িতে আসতে পারিনা?”
“না পারো না।তোমার সাহস কি করে হয় আমার বাড়িতে পা রাখার”
মিস্টার আজাদ রেগে যাচ্ছে দেখে ফারিহা বললো,
“বাপি প্লীজ শান্ত হও।রাগারাগি করো না”
“রাগারাগি করবো না মানে?ও তোর সাথে কি রকম আচরন করে আমি জানি আর তুই কি চাইছিস ওকে এখন আমি জামাই আদর করি?”
ফারিহা কাঁদো কাঁদো চোখে মিস্টার আজাদের দিকে তাকিয়ে বললো, “বাপি প্লিজ..আমার জন্য?”
ফারিহার কথা শুনে মিস্টার আজাদ চুপ করা গেলো।ফারিহার কথা উনি ফেলতে পারবে না।আর এমনিতেই আজকে ফারিহার মায়ের মৃত্যু বার্ষিক মিস্টার আজাদের মন খারাপ তাই আর কিছু বললো না।আয়ানকে বসতে বলে অন্যদিকে চলে গেলো।আর ফারিহা মিস্টার আজাদ কে থামিয়ে দিয়েছে কারণ ফারিহা জানে যদি আয়ান এখন এখানে অপমানিত হয় তাহলে মিস্টার আজাদের ক্ষতি করতে ও দুবার ভাব্বে না।যেটা ফারিহা চায় না। মিস্টার আজাদের রাগারাগি করলেও আয়ানের কোনো ভাবান্তর হয়না।কারণ আয়ান জানতো এরকম কিছু একটা হবে।
আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“তোমাদের বাড়ীটা আমাকে ঘুরিয়ে দেখাবে না?”
ফারিহা আয়নার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো,”হুম আসুন”
চলবে…