স্রোতের টানে পর্ব-২১

0
3730

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:২১

দুপুরে যোহর নামাজের পরে কয়েকজন হুজুর আসলো।তারপর ফারিহার মায়ের জন্য দোয়া করলো।সব কাজ শেষে আয়ান শিহাব আর নওশীনকে খাবার খেতে বসিয়ে দিয়ে ফারিহার জন্য একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে এলো।এসে দেখলো ফারিহা একটা মহিলার সাথে কি যেন কথা বলছে। মায়ের জন্য দোয়া করতে গিয়ে ফারিহা আজকে অনেক কান্না করেছে।বরাবরের মতো আজকেও ফারিহার কান্না দেখে আয়ানের খুব কষ্ট হয়।তারপর কোনরকমে ফারিহার কে সামলে কান্না বন্ধ করেছে। আয়ান আজকে মিস্টার আজাদ কে দেখে অবাক হয়।শত্রু হিসেবে আয়ান মিস্টার আজাদকে চিনে।মিস্টার আজাদের মতো এত শক্ত মনোবলের একটা লোককে আয়ান আজকে ভেঙে পড়তে দেখলো।আয়ান দেখেছে মিস্টার আজাদ নিজের স্ত্রীকে কতটা ভালোবাসে।আয়ান যেন আজকে ওর প্রতিশোধের কথা ভুলে গিয়েছিলে।
আয়ান খাবার নিয়ে ফারিহার কাছে এসে বললো,
“ফারিহা দুপুর তিনটা বাজে।তুমি এখনো খাওনি কিছু খাওনি।এসো খাবে এসো..”

ফারিহা আয়ানকে দেখে বললে, “আমি খাবো না। ভাল লাগছে না”

আয়ান ফারিহা দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে তাকিয়ে বললো, “তোমাকে আসতে বলেছি”

ফারিহা মহিলাটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বিদায় জানিয়ে আয়ানের কাছে আসলো।আয়ান ফারিহার হাত ধরে পাশে থাকা সোফায় বসালো।তারপর নিজের হাতে ভাত মেখে ফারিহার মুখের সামনে ধরলো।ফারিহা অবাক হয়ে আয়ানকে দেখছে। তারপর বললো, “আপনাকে খায়িয়ে দিতে হবেনা। আমি খেতে পারবো”

“কিভাবে খাবে?তোমার তো হাত কেটে রেখেছো”

“এটাতো সামান্য।কোন সমস্যা নেই”

“সামান্য হোক আর বেশি হোক কাটা হাত দিয়ে তুমি খেতে পারবে না।কেনো?আমি খাইয়ে দিলে কোন সমস্যা?”

“না মানে..”
ফারিহা এদিক ওদিক তাকাচ্ছে দেখে আয়ান বললো, “লোকজনের দিকে তাকাচ্ছ কেনো?আমরা স্বামী-স্ত্রী,,কে কি বলবে?তাছাড়া তুমি কি লোকজনের জন্য খেতে চাচ্ছো না নাকি আমার হাতে খাবে না তাই?”

ফারিহা আমতা আমতা করে বললো, “না তেমন কিছু না”

“তাহলে খাও”

ফারিহা একটু ইতস্ত করে আয়ানের হাত থেকে খাবার মুখে নিলো।আয়ান মুচকি হেসে ফারিহাকে খাইয়ে দিতে লাগলো।
মিস্টার আজাদ এসেছিল ফারিহাকে খেয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু এসে দেখলো আয়ান ফারিহাকে যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে।মিস্টার আজাদ বুঝতে পারেনা এই ছেলেটা কি চায়!একে তো ফারিহাকে কষ্ট দেয় প্রতিশোধের জন্য, এখন আবার এতো আদর করে খাইয়ে দিচ্ছে।
যাইহোক আয়ান ফারিহাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর ফারিহাও চুপচাপ খাচ্ছে দেখে মিস্টার আজাদ আর কিছু না বলে চলে গেলো।

ফারিহা খেতে খেতে বললো, “আপনি খেয়েছেন?”

“তোমাকে খাইয়ে দিয়ে তারপর খাবো”

“কেনো?”

ফারিহার কথায় আয়ান দুষ্টু হেসে বললো,তো কি এখান থেকে খেতে বলছো?এক প্লেটে??”

আয়ানের কথা ফারিহা লজ্জায় নিচের দিকে তাকালো।আশেপাশের অনেকেই ফারিহা আর আয়ানকে লক্ষ্য করছে।অনেকে ভাবছে মিস্টার আজাদের মেয়েটা কত লাকি!কত ভালো একটা হাজবেন্ড পেয়েছে।এটা সেটা আরো কত প্রশংসা
করছে।ফারিহা এসব শুনে তাচ্ছিল্য হাসলো কারণ ফারিহা জানে আয়ান কতটা জঘন্য।
যদিও আয়ানের এতো কেয়ার ফারিহার ভালো লাগছে ও সায় দিচ্ছে কিন্তু ফারিহা জানে আয়ান এসব লোক দেখানোর জন্য করছে।না হলে ওকে আদর করার মতো ছেলে আয়ান নয়।
আয়ান লোক দেখানোর জন্য করুক আর এমনিতেই করুক আয়ানের হাতে খেতে ফারিহার অনেক ভালো লাগছে।তাই চুপচাপ খাচ্ছে।
আয়ান ফারিহাকে খাইয়ে প্লেট নিয়ে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পর নওশীন আর শিহাব আসলো।ফারিহা ওদেরকে দেখে বললো, “তোরা খেয়েছিস?”

“হুম এইমাত্র খেয়ে এলাম।তুই কই ছিলি?”

“আমিও খাচ্ছিলাম।আচ্ছা তোরা আজকে আমাদের বাড়িতে থাক”

নওশীন বলল, “নারে ফারিহা সম্ভব না।বাসায় বলে আসিনি”

“তাতে কি হয়েছে?ফোন করে বলে দে”

“না যেতে হবে।ভার্সিটির অনেকগুলো পড়া জমে আছে।আরেকদিন থাকবো, প্লিজ রাগ করিস না”

ফারিহা শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, “আচ্ছা তাহলে শিহাব তুই থাক”

শিহাব মুখ গোমড়া করে বললো “আমার বাসায় একটু কাজ আছে আজকে সম্ভব না রে”

ফারিহা মন খারাপ করে বললো, “তোরা কেউ থাকবি না?”

শিহাব বললো, “প্লিজ মন খারাপ করিস না।আমরা তো কত এই বাড়িতে থেকেছি।পরে আবার আসলে থাকবো।কিন্তু আজকে সত্যিই যেতে হবে”

ফারিহা হেসে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমি মন খারাপ করছি না”

শিহাব আর নওশীন হেসে ফারিহা আর আয়ানের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে মিস্টার আজাদের থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
শিহাব আর নওশীন!ওদের সম্পর্কটা আসলে কেমন ওরা নিজেরাই জানেনা।যদিও ওরা উপরে অনেক ঝগড়া করে কিন্তু আসলে ওরা দুজনেই কেউ কারোর অনুভূতি টা বুঝতে পারে না।শিহাব নওশীনকে অনেক কেয়ার করে,আর নওশীনও শিহাব যদি কোন মেয়ের সাথে কথা বলে তাহলে রেগে যায়।ওদের অজান্তেই ওরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছে।ওরা বুঝতে পারলেও ফারিহা ঠিকই বুঝতে পারে।তাইতো ফারিহা মাঝেমাঝে শিহাব আর নওশীনের সাথে দুষ্টুমি করে।আর নওশীন রেগে যায়।

“কি হলো তুমি এখনো যাওনি?”

বাসার সব মেহমান চলে গিয়েছে বাহিরে বাগানে লোকেরা সবকিছু গুছানোর কাজ করছে।মিস্টার আজাদ সবদিক দেখে বাসায় এসে দেখলো আয়ান সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে।তারপর ওই কথাটা বললো।
মিস্টার আজাদের কথা শুনে আয়ান ফোন থেকে চোখ তুলে মিস্টার আজাদ এর দিকে তাকালো।তারপর হেসে বললো, “তাড়িয়ে দিচ্ছেন?”

মিস্টার আজাদ শক্ত কন্ঠে বললো, “তোমাকে যে এতক্ষণ সহ্য করেছি সেটাই অনেক বেশি।এবার তুমি আসতে পারো”

“ওকেহ!কিন্তু আমি গেলে ফারিহাকে সাথে নিয়ে যাবো”

“না ফারিহা এখানে কিছুদিন থাকবে”

আয়ান নির্লজ্জের মতো বললো, “তাহলে আমিও থাকবো”

“না তুমি আমার বাড়িতে থাকতে পারবে না।এক্ষুনি চলে যাও”

আয়ান উঠে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ফারিহাকে ডাকতে লাগলোফারিহা আসলে আয়ান ফারিহাকে বললো, “ফারিহার রেডি হয়ে নাও আমরা এখন বাসায় যাবো”

ফারিহা অবাক হয়ে বললো, “কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন আমি কিছুদিন থাকতে পারবো”

“বলেছিলাম কিন্তু তোমার বাবা তো আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।সো তুমিও চলো আমার সাথে”

ফারিহা অসহায় চোখে মিস্টার আজাদের দিকে তাকালো।মিস্টার আজাদ শক্ত চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “ও যাবে না।তুমি চলে যাও”

আয়ান ফারিহার হাত ধরে বললো, “চলো বউ!”

মিস্টার আজাদ আয়ানের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বললো, “বললাম তো ফারিহা যাবে না।ও এখানে থাক।এই আয়ান তোমার কি শত্রুর বাড়িতে থাকতে ভয় লাগছে না?তোমাকে যদি খাবারের সাথে কিছু মিশিয়ে খাইয়ে দি?”

আয়ান হেসে বললো, “মেয়েকে বিধবা করতে চাচ্ছেন?”

আয়ানের কথায় ফারিহা কেঁপে উঠলো। তারপর মিস্টার আজাদ এর দিকে তাকালো!আর মিস্টার আজাদ আয়ানের কথা শুনে দমে গেলো।কোন বাবা চাইবে না তার মেয়ে বিধবা হোক।মিস্টার আজাদ আয়ানের দিকে তাকিয়ে রাগি কন্ঠে বললো,

“এসব কথা বলে তোমাকে এক্ষুনি বাড়ী থেকে বের করে দেবো,,ইডিয়েট।আর ফারিহা ওকে বল আমার বাড়িতে যতদিন ইচ্ছা থাকুক কিন্তু আমার সামনে যেন না আসে।ওকে আমার সহ্য হয় না”

তারপরও মিস্টার আজাদ হনহন করে হেঁটে চলে গেল।আয়ান মিস্টার আজাদের কথা শুনে জোরে হেসে দিলো। ফারিহা আয়ানের হাসি দেখে অবাক কন্ঠে বললো,
“আপনি হাসছেন?”

“তো কি করবো?আমার শ্বশুরমশাই রাগ দেখেছো?হাহাহা…”

.
রাতে আয়ান ফারিহার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ান ফারিহার ব্যালকনিতে গিয়ে অবাক হয়ে যায় এতো এতো ফুল গাছ!আয়ান আগে বুঝতে পেরেছে ফারিহার ফুলগাছ পছন্দ কিন্তু এত পছন্দ সেটা বুঝতে পারেনি।আয়ান অবাক হয়েছে ওর ব্যালকনিতে এতো ফুল গাছ নেই তাহলে ফারিহা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কি করতো।ফারিহার নিশ্চয়ই ভালো লাগত না।
ফারিহার রুমে এসে দেখে আয়ান রুমে নেই।
তারপর ব্যালকনিতে গিয়ে দেখলো আয়ান ওখানে দাঁড়িয়ে ফুলগাছ দেখছে।আয়ান ফারিহাকে দেখে বললো, “এখানে তো ফুলের দোকান দেখছি”

ফারিহা একটু হেসে বললো, “হ্যাঁ ফুল আমার অনেক ভালো লাগে”

তারপর ফারিহা একে একে সবগুলো ফুলের কথা বলতে লাগলো।কোনটা কোথা থেকে কিনেছে, কার সাথে গিয়ে কিনেছে।এতো এতো ফুল গাছ কারণে মিস্টার আজাদ ফারিহা সাথে রাগারাগি করতো ফারিহা সব বলতে লাগলো।আয়ান ব্যালকনিতে রাখা দোলনায় বসে বসে ফারিহা বকবক শুনছ আর হাসছে।
এ বাড়িতে আসার পর ফারিহাকে যেন প্রানবন্ত লাগছে। আয়ানের বাড়িতে ফারিহা সবসময় চুপচাপ থাকতো।আয়াত যা বলতো তা করতো,বেশি কথা বলতো না। কিন্তু এখানে আসার পর ওর বাবার সাথে হনুফা বেগমের সাথে কথা জুরি খুলে বসে।আয়ান যেন নতুন করে ফারিহাকে চিনছেন।

কিছুক্ষণ পর আয়ান আর ফারিহা রুমে আসলো। আয়ান ফারিহার বেডের পাশে টেবিলে রাখা একটা ফটো ফ্রেম হাতে নিল। ওখানে মিস্টার আজাদ ফারিহা আরেকটা মহিলার ছবি আছে।ফারিহাকে ফটোটা দেখে বললো, “এটা আমার মাম্মা”

আয়ান ফটোফ্রেমটার দিকে তাকিয়ে বলল, “হুম তোমার সাথে চেহারা মিল আছে।বাই দা ওয়ে আমার শাশুড়ি মা তো অনেক সুন্দর ছিল”

“হ্যাঁ মাম্মা অনেক সুন্দর ছিলো।আমিতো তার তুলনায় কিছুই না”

“তুমি অসুন্দর না”

“সুন্দর বলছেন??”

ফারিহার কথা আয়ান কিছু বলবো না শুধু মুচকি হাসলো।ফারিহা বিছানার চাদর টা ঠিক করতে করতে বললো, “আমার খাট কিন্তু ছোট।আপনার জায়গা হবে তো?”

নিজের কথায় ফারিহা নিজেই হেসে দিলো।আয়ানও হাসলো তারপী বললো, “দুজনের না হলে সমস্যা নেই। আমি ঘুমাবো”

ফারিহা অবাক হয়ে বললো, “তাহলে আমি কোথায় ঘুমাবো?”

“কেনো?আমার বুকে”

আয়ানের কথায় ফারিহা আটকে গেল। ফারিহার রিয়াকশন দেখে আয়ান জোরে হেসে দিল।
কিছুক্ষণ পর ওরা দুজন শুয়ে পড়লো।ফারিহার রুমের লাইট অফ করে দিলো।ফারিহা অন্য দিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে।আর আয়ান ফারিহার দিকে কাত হয়ে শুয়ে ফারিহার পিঠের দিকে তাকিয়েছে। কিছুক্ষণ পর আয়ান শান্তকণ্ঠে বললো, “ফারিহা?”

ফারিহা আয়ানের দিকে ফিরে বললে, “জ্বী বলুন”

“আজকে তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে”

আয়ানের কথায় ফারিহা কেঁপে উঠলো।চারদিক নিস্তব্ধ হালকা আলোর মধ্যে আয়ান ফারিহা কাছাকাছি।ফারিহা চুপ দেখে আয়ান আবার বললো, “তোমাকে আমি জোর করবো না।তোমার ইচ্ছে না হলে থাক।কিন্তু..”

আয়ানকে থেমে যেতে দেখে ফারিহা বললো,
“কিন্তু কি?”

“কিন্তু আজকে তোমাকে সত্যিই অনেক বেশি আদর করতে ইচ্ছে করছে।আমি কি তোমাকে একটু আদর করতে পারি?”

আয়ানের কথায় ফারিহা একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো।আয়ান আগে কখনো এরকম আবেগময় কথা বলেনি।কখনো ফারিহার কাছে এরকম আবদার করে নি।আজকে আইনের কথায় ফারিহা বারবার কেঁপে উঠছে।ফারিহার দিকে তাকিয়ে আয়ান ফারিয়াকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো
ফারিহা কিছু বলছে না আসলে আয়ানের এতো আবেগময় আবদার ফেলতে পারছে না।ফারিহা এতদিনে আয়ানের দেওয়া সব কষ্ট ভুলিয়ে গিয়ে আয়ানের কাছে নিজেকে তুলে দিলো। নিজের অজান্তে ফারিহা আরেকটা ভুল করে বসলো।আয়ান পারিহার সম্মতি পেয়ে বাঁকা হাসলো।ফারিহাকে ও আস্তে আস্তে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারছে।আয়ান আর এক মূহুর্ত দেরি না করে ফারিহাকে কাছে টেনে নিলো..

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here