#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:২২
কেটে গেল আরও কিছুদিন।আয়ান আর ফারিহার সম্পর্ক এখন স্বাভাবিক ভাবেই চলছে।বলতে গেলে ফারিহা আয়ানের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে।আয়ান ফারিহাকে অনেক যত্ন করে।সবসময় ফারিহার সাথে ভালো করে কথা বল।আর ফারিহার উপর অত্যাচার করে না।ফারিহা ভাবে আয়ান হয়তো ওকে ভালবেসে ফেলেছে!কিন্তু আসলে আয়ান এসব ফারিহাকে নিজের হাতে মুঠো করার জন্য করছে।আয়ান ফারিয়ার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লেও এখনো ভালবাসতে পারেনি।আর ফারিহা বোকার মতো আস্তে আস্তে আয়ানকে ভালোবাসতে শুরু করেছে।
ফারিহা, নওশীন আর শিহাব এখন রেস্টুরেন্টে। নওশীনের একটু শরীর খারাপ।মেয়েটার দুই দিন জ্বর ছিল তারপরও আজকে ভার্সিটি ক্লাস শেষে জোর করে রেস্টুরেন্ট এসেছে।ফারিহা বারণ করা সত্ত্বেও শুনেনি।আর শিহাব তো কখন থেকেই নওশিন কে ধমকে যাচ্ছে।
নওশীন চুপচাপ একটা টেবিলে বসে ছিল তখন শিহাব একটা প্লেটে করে খাবার নিয়ে আসলো। তারপর নওশীনের সামনে প্লেটটা এগিয়ে দিলো নওশীন ভ্রু কুঁচকে শিহাবের দিকে তাকালো।তা দেখে শিহাব বললো,
“এইভাবে তাকাচ্ছিস কেনো?খাবারটা কমপ্লিট কর”
“আমি কিছু খাবো না ”
“খাবি না মানে? তুই এখনো লাঞ্চ করিসনি।লাঞ্চ করে ওষুধ খেতে হবে তো ”
“প্লিজ জোড় করিস না।ভাল লাগছে না সবকিছুতে তেতো তেতো লাগছে”
“দেখি” বলেই শিহাব ওর হাতটা নওশীনের কপালে রাখলো। তারপর একটু চমকে উঠে বললো,
“তোর তো এখনো জ্বর আছে। তোকে বারণ করেছিলাম ভার্সিটিতে আসতে তবু নেচে নেচে আসলে”
“তো কি করবো?আমার বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না”
“আচ্ছা ভার্সিটিতে আসলি ভালো কথা রেস্টুরেন্ট আসার কি দরকার ছিল?এই শরীর নিয়ে তুই কাজ করবি??”
নওশীন শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, “কাজ করছি না তো।বসে রয়েছি”
“আচ্ছা এখন খাবারটা খা প্লিজ”
নওশীন অসহায় চোখে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমার সত্যি খেতে ইচ্ছে করছে না”
“বুঝেছি তোকে কিভাবে খাওয়াতে হবে”
এটা বললেই শিহাব পাশে থাকা চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো।তারপর নিজ হাতে ভাত তুলে নওশীনের মুখের সামনে ধরলো।
নওশীন শিহাবের আচরণে অবাক হচ্ছে।কারণ শিহাব সবসময় ওর সাথে ঝগড়া করে,পিছনে লাগে।
আজকে এত যত্ন করছে!নওশীন শিহাবের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার আজকে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিস?”
“কেনো?তোকে খাইয়ে দিতে পারি না?বেশি কথা না বলে খা”
নওশীন খাবার মুখে তুলে চিবোতে চিবোতে বললো,
“তা পারিস কিন্তু তুই তো সব সময় আমার সাথে ঝগড়া করিস।আজকে হঠাৎ এত আদর করে খাইয়ে দিচ্ছিস!ব্যাপার কি?”
শিহাব নওশীনকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো, “ব্যাপার কিছুই না।তুই অসুস্থ তাই খাইয়ে দিচ্ছি। সুস্থ হও আবার ঝগড়া করবো”
“কুত্তা তুই তো পারিস শুধু আমার সাথে ঝগড়া করতে পারে।একটু ভালবাসতে পারিস না?”
শিহাব চমকে নওশীনের দিকে তাকালো।নওশীন বুঝতে পারলো ও কি বলে ফেলেছে।নওশিন জিভে কামড় দিলো।শিহাব সন্দেহ চোখে নওশীনের দিকে তাকিয়ে বললো, “ভালবাসতে বলছিস?”
নওশিন আমতা আমতা করে বললো, “আমি কি এটা বলেছি নাকি?বেশি শুনিস! কানের ডাক্তার দেখা”
“কিন্তু আমি তো শুনলাম..”
নওশীন কিছু বলতে যাবে তখন ওখানে ফারিহা আসলো।ফারিহা এসেই অবাক হয়ে গেলো শিহাব নওশীনকে খাইয়ে দিচ্ছে দেখে।ফারিহার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।কারণ এই দুটো সব সময় টম এন্ড জেরির মত ঝগড়া করে কিন্তু ফারিহা জানে ওরা উপরে ঝগড়া করলেও ভেতরে ভেতরে দুজন দুজনকে ভালোবাসে।ফারিহা একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো তারপর গালে হাত দিয়ে নওশীনের শিহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘বাব্ বাহ,, আজকে কোন দিক দিয়ে সূর্য উঠেছে?দুই টম এন্ড জেরির ঝগড়া বাঁধ দিয়ে গল্প করছে?একজন আবার আরেকজনকে খাইয়ে দিচ্ছে!”
নওশীন বিরক্তি মুখে বললো, “এই ফারিহা পিঞ্চ মেরে কথা বলবি না তো।আমি খেতে চাইনি ওই তো জোর করলো”
ফারিহা দুষ্টু হয়েছে শিহাবের দিকে তাকালে শিহাব বললো, “ও অসুস্থ, তাই তো খাইয়ে দিচ্ছে।এটা নিয়ে এতো কথা বলার কি আছে?”
ফারিহা হাসিমুখে বললো, “তাদের ভালোবাসা দেখলে না আমার খুব হিংসে হয়”
শিহাব আর নওশীন এক সাথেই বললো, “ভালোবাসা! ”
ফারিহা গালে হাত দিয়ে বললো, “হুম”
শিহাব চোখমুখ কুঁচকে বললো, “পাগল হয়ে গেছিস?আমি এই শাকচুন্নি কে ভালবাসবো?”
নওশীন বিরক্তি মুখে বললো, “ফারিহা আর কোনো কথা পেলি না?আমি এই কুত্তাটাকে তাকে ভালোবাসবো?দুনিয়াতে কি আর ছেলে নেই নাকি?”
“ঠিকই তো!দুনিয়াতে কি আর মেয়ে নেই নাকি যে আমি এই শাকচুন্নিকে ভালোবাসতে যাবো”
ওরা দুজন দুজনকে কুত্তা,শাকচুন্নি বলছে কিন্তু কথার মধ্যে দিয়ে শিহাব নওশীনকে খাইয়ে দিচ্ছে। আর নওশীনকে খাচ্ছে।যেটা ওদের দুজনের কারোর খেয়াল নেই।ফারিহা খেয়াল করে মিটিমিটি হাসছে। ওদের থামাতে ফারিহা হেসে বললো,
“আচ্ছা ঠিক আছে আর ঝগড়া করতে হবে না।শুধু নওশীন অসুস্থ বলে ওকে খাইয়ে দিবি? আমাকে খাইয়ে দিবি না?”
শিহাব ফারিহার দিকে তাকিয়ে ফারিহার পেছনে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ পথের দিকে তাকালো।তারপর বললো, “এই দেখ।তোকে খাইয়ে দেয়ার লোক চলে এসেছে”
ফারিহা উল্টো দিকে ঘুরে বসেছিল।শিহাবের কথায় পেছন ফিরে দেখল মিস্টার আজাদ রেস্টুরেন্টে ডুকছে।মিস্টার আজাদকে দেখে ফারিহা হেসে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো।
মিস্টার আজাদ চৌধুরী এখন প্রায় সময় রেস্টুরেন্টে ফারিহার সাথে দেখা করতে আসে।আয়ান কিছু বলে না তাই ফারিহা এখন আয়ানের উপর অনেক খুশি।
ফারিহা একটু অভিমানী মুখে মিস্টার আজাদের দিকে তাকিয়ে বললো, “বাপি তুমি এতদিন পর আসলে?আমাকে ভুলে গিয়েছো? আমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করেনা??”
“কে বলেছে ইচ্ছে করেনা?একটু কাজ ছিলো মামনি। সরি..”
“আচ্ছা ঠিক আছে আর সরি বলতে হবে না।চলো..”
শিহাব আর নওশীন একটা টেবিলে বসে লাঞ্চ করছে।ফারিহা মিস্টার আজাদকে নিয়ে পাশের টেবিলে বসলো।তারপর রেস্টুরেন্টের একটা ওয়েটারকে খাবার দিতে বলল।মিস্টার আজাদ প্রায় সময় রেস্টুরেন্টে এসে ফারিহার সাথে গল্প করে,,সময় কাটায়।
খাবার দিয়ে গেলে মিস্টার আজাদ খাচ্ছে আবার ফারিহাকে ও খাইয়ে দিচ্ছে।খাবার খেতে খেতে মিস্টার আজাদ বললো,
“আয়ান এখন তোর সাথে ভালো আচরণ করে তো? তুই ভালো আছিস তো মা?”
ফারিহা হেসে বললো, “আমি একদম ঠিক আছি।বাপি জানো উনি আমার কতো কেয়ার করে”
ফারিহার উজ্জ্বল মুখ দেখে মিস্টার আজাদ অবাক হচ্ছে।ফারিহার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে যে ফারিহা সত্যি বলছে।তার মানে ফারিহা এখন ভালোই আছে। কিন্তু মিস্টার আজাদ বুঝতে পারছেনা যে আয়ান ফারিহাকে সুখে রাখছে কেনো!
যাইহোক মেয়েকে ভালো দেখে মিস্টার আজাদ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।তারপর বললো, “তোর পড়াশোনা কেমন চলছে?”
“খুব ভালো বাপি।জানো আমার পড়াশোনায় কোথায় আটকে গেলে উনি আমাকে অনেক হেল্প করে।আবার কখনও টিচারের মতো শাসন করে। হিহিহিহি..”
মিস্টার আজাদ তৃপ্তি নিয়ে ফারিহার হাসি মাখা মুখ দেখছে।ওনার আজকে সত্যিই খুব শান্তি লাগছে। কিছুক্ষণ পর মিস্টার আজাদ খেতে খেতে বললো,
“এখন অনাথ আশ্রমের যাস না?”
“না বাপি।কিছুদিন আগে উনার সাথে গিয়েছিলাম। আর রিমঝিমের সাথে প্রতিদিন ফোনে কথা হয়”
“আমিও ভাবছিলাম যাবো। কিন্তু এই রাজনীতির কাজে এত ব্যস্ত থাকি যে যেতে পারি না”
“আমি তোমাকে বারণ করেছি না এত কাজ করবেনা।তোমার শরীরের দিকে একটু নজর দাও”
“আমি একদম ফিট আছি।দেখছিস তো”
“হ্যাঁ হ্যাঁ দেখছি” ফারিহা মিস্টার আজাদ হাতে খেতে খেতে বললো।
কিছুক্ষণ পরে কেউ ওর পাশে চেয়ার টেনে বসলো। ফারিহা পাশে তাকিয়ে দেখে আয়ান।ফারিহা একটু বেশিই অবাক হল।মিস্টার আজাদ আয়ানকে দেখে কিছু বলতে যাবে তখন আয়ান বললো,
“এখানে তো বাবা মেয়ের ভালোবাসা উতলে পড়ছে”
মিস্টার আজাদ শক্ত চোখে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “ঠিকভাবে কথা বলো”
আয়ান ইনোসেন্ট মুখ করে বললো, “আমি আবার কী বললাম?আচ্ছা যাই হোক আমি আপনাদের সাথে লাঞ্চ করতে এলাম।আপনার আমাকে ওয়েলকাম করবেন না?”
“কিসের ওয়েলকাম?তুমি এখানে কেন এসেছো?’
“কেন আবার!লাঞ্চ করতে”
“তুমি অন্য কোন রেস্টুরেন্টে যাও”
“কি যে বলেন না শ্বশুরমশাই। বউয়ের রেস্টুরেন্ট থাকতে অন্য রেস্টুরেন্টে যাবে কেনো?”
আয়ান ওয়েটারকে ডেকে নিজের জন্য খাবার অর্ডার দিল।আয়ান ফারিহা আর মিস্টার আজাদের মধ্যে এসেছে দেখে মিষ্টি আজাদ একটু বেশি বিরক্ত। ফারিহা অবাক হয়ে বললো, “আপনি এখন এখানে?আপনার কাজ নেই?’
“আছে তো।কিন্তু আজকে তোমাদের সাথে লাঞ্চ করতে ইচ্ছে হলো তাই চলে এলাম”
নওশীন আর শিহাব অবাক হয়ে আয়ানকে দেখছে
মিস্টার আজাদ ফারিহাকে খাইয়ে দিচ্ছে দেখে আয়াত বললো, “শুধু মেয়েকে খাইয়ে দেবেন?মেয়ের জামাইকে খাইয়ে দেবেন না?”
আয়ানের কথায় মিস্টার আজাদ অবাক হলো।আয়ান উনার হাতে খেতে চাচ্ছে সেটা যেন বিশ্বাস হচ্ছে না।তবে যাই হোক মিস্টার আজাদ তো কখনো আয়ানকে খাইয়ে দেবে না কারণ ফারিহা ভুলে গেলও মিস্টার আজাদ ভুলেনি যে আয়ান ফারিহার সাথে কি করতো।মিস্টার আজাদ ফারিহাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো, “সেটা কখনো আশা করোনা”
আয়ান মিস্টার আজাদের দিকে তাকিয়ে বললো, “ওকে আপনি না বললে তো আর জোর করা যায়না। আর নিজের শত্রুকে কেই বা খাইয়ে দিতে চায়।হাহাহা…”
মিস্টার আজাদ আয়ানের কথার বিপরীতে কিছু বললো না।তারপর ওরা তিনজনে একসাথে লাঞ্চ করলো।মিস্টার আজাদ না চাইলেও ফারিহার কথা আয়ানকে এলাও করে।মিস্টার আজাদের কাছে আয়ানকে জাস্ট বিরক্ত লাগছে। কিন্তু মেয়ে জামাই বলে কিছু বলতে পারছেনা।
তবে মিস্টার আজাদ আয়ানের হঠাৎ পরিবর্তনে ও অবাক হয়।কারন বিয়ের পর আয়ান যে রকম আচরণ করেছিল,যেভাবে ফারিহার উপর অত্যাচার করতো মিস্টার আজাদ তো ভেবেই নিয়েছিল ফারিহার জীবনটা শেষ হয়ে যাবে।কিন্তু এখন ফারিহাকে অনেক সুখি দেখায়।সব সময় হাসিখুশি থাকে।আর আয়ান ফারিহাকে মিস্টার আজাদের সাথে কথা বলতে দেয়।সেটা নিয়ে মিস্টার আজাদ একটু বেশিই চিন্তিত।আয়ান কি করতে চাইছে?
চলবে…