#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:২৪
মিস্টার আজাদ সকালে ব্রেকফাস্ট করে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ফাইল দেখছিলো।তখন হানিফ আহমেদ ওখানে আসলো।হানিফ আহমেদ এসে পাশের সোফায় বসলো।মিস্টার আজাদ কিছু বললেন না চুপচাপ কাজ করতে লাগলেন।কিছুক্ষণ পর হানিফ আহমেদ গলা ঝাঁকিয়ে মিস্টার আজাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলো। মিস্টার আজাদ হানিফ আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“কিছু বলবে?”
“ইয়ে মানে স্যার একটা কথা ছিল”
“আমার সাথে কথা বলতে এতো আমতা আমতা করছো কেনো?কি বলবে বলে ফেলো”
“যদি কিছু মনে না করেন একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
মিস্টার আজাদ ফাইল থেকে চোখ সরিয়ে হানিফ আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললো, “হুম বল…”
“আপনি কি আয়ানকে মেয়ে জামাই হিসেবে মেনে নিয়েছেন?”
মিস্টার আজাদ আবার ফাইল দেখতে দেখতে বললো, “না মেনে নিয়ে ছাড়া তো আর কোন উপায় নেই”
“স্যার আপনি কি ভুলে গেছেন আয়ান মামনি কে কত কষ্ট দিয়েছে?তাছাড়া আয়ানের কারণে আমাদের বিজনেসে একের পরে এক লস হয়েছে।আয়ান এখনো আমাদের পিছনে পড়ে আছে।তারপরও আপনি আয়ানকে ফারিহার হাজবেন্ড হিসেবে মানতে রাজি?”
“না আমি আয়ানকে ফারিহার হাসবেন্ড হিসেবে মানতে রাজি না।কিন্তু এখন কি চাইলেও ফারিহাকে আয়ানের কাছ থেকে দূরে সরানো যাবে?এতদিন তো তাও ফারিহা আমার কথা শুনতো কিন্তু আয়ান আমার মেয়েটাকে কি যে করলো মেয়েটা এখন শুধু আয়ান আয়ান করে!”
“তাই বলে আপনি আয়ানকে কিছু করবেন না? আপনি শুধু একবার বলুন ওকে আমি শেষ করে দিবো।তারপর ফারিহা মামনি একদম মুক্ত”
মিস্টার বিস্ফোরিত চোখে হানিফ আহমেদের দিকে তাকালো।তারপর একটু রেগে বললো,
“আমি বাবা হয়ে আমার মেয়েকে বিধবা করবো?আয়ান যেমনই হোক ও এখন ফারিহার হাজবেন্ড। আর ঐদিন যে ওরা আসলো তুমি তো নিজের চোখে দেখলে ফারিহা এখন আয়ানকে কতো ভালবাসে।আমি আমার মেয়ের ভালোবাসা কি করে কেড়ে নেবো??”
হানিফ আহমেদ একটু রেগে বললো, “স্যার আপনি বুঝতে পারছেনা ফারিহা যাকে ভালোবাসে সে আপনার শত্রু”
“শত্রু?বিজনেস রাজনীতি এগুলোর সব পড়ে।আমার কাছে সবার আগে আমার মেয়ে।আমার মেয়ের শান্তি সবচেয়ে বড়”
হানিফ আহমেদ মনে মনে প্রচুর বিরক্ত হচ্ছে, রেগে যাচ্ছে।কিন্তু বাহিরে একটু হাসিমুখে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে আপনার যা ইচ্ছে”
মিস্টার আজাদ শক্ত চোখে হানিফ আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললো, “তুমি আয়ানকে কিছু করার চেষ্টা করবে না।যেভাবে চলছে চলতে দাও”
হানিফ আহমেদ কিছু না বলে হেসে মাথা নাড়ালো।আর মাথায় ফন্দি আঁটতে লাগলো কিভাবে কি করা যায়।
_________
ফারিহা সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে সবসময়ের মত ছাদে চলে গেলো।তারপর কিছুক্ষণ ছাদে সময় কাটিয়ে নিচে এসে কিচেনে গেল নাস্তা তৈরি করতে।ফারিহা রান্না করলেও সার্ভেন্টরা সব সময় ওকে হেল্প করে।নাস্তা তৈরি করা শেষে ফারিহা রুমে আসলো।
আয়ান সব সময় দেরি করে উঠে।ফারিহা ভেবেছিল আয়ান এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি কিন্তু রুমে এসে দেখল বিছানা ফাঁকা।ফারিহা ভাবলো আয়ান হয়তো ওয়াশরুমে তাই ফারিহা বিছানার চাদরটা ঠিক করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর ব্যালকনি থেকে কথার আওয়াজ আসছে শুনে ফারিহা সেদিকে গেল।গিয়ে দেখলো আয়ান কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে।আয়ান জিহাদ নাম বলাতে ফারিহা বুঝতে পারলে আয়ান ওই জিহাদ গুন্ডাটার সাথে কথা বলছে।যে কিনা মাফিয়া জগতে আয়ানে খুব কাছের।ফারিহা একে একদম দেখতে পারে না।ফারিহা ওদের কাজটাই অপছন্দ করে।আর তাছাড়া ভার্সিটিতে বডিগার্ড হিসেবে প্রায় সময় আয়ান জিহাদকে ফারিহা সাথে পাঠায়।এতে ফারিহা আরো বিরক্ত।কিন্তু জিহাদ সবসময় ফারিহাকে অনেক সম্মান করে।
এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কারোর কথা শুনাটা ঠিক না তাই ফারিহা চলে যেতে নিলো।কিন্তু নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়ালো।আয়ান ফোনে হেসে বলছে,
“আরে না,তুমি কি ভাবছো আমি প্রতিশোধের কথা ভুলে গিয়েছি?তুমি তো প্রথম প্রথম দেখলেই ফারিহাকে অত্যাচার করলে ও আরো দূরে চলে যায়।সব সময় বাপি বাপি করে।তাই এখন ওকে ভালোবেসে নিজের কাছে টেনে আনছি যেন মিস্টার আজাদ ওকে বললেও ও আমার সাথে থাকে”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহা অনেক অবাক হচ্ছে।ফারিহা কি ঠিক শুনছে?ফারিহা আরেকটু কাছে এগিয়ে আসলো।ওপাশ থেকে কিছু বলাতে আয়ান আনার জোরে হেসে বললো,
“ফারিহাকে আমি বুঝে গিয়েছি। ওকে অত্যাচার করে হাতের মুঠোয় রাখা যাবে না তাইতো ভালোবেসে কাছে টানছি।আর তাছাড়া ফারিহা হলো মিস্টার আজাদের প্রাণ ভোমরা।একবার ফারিহা আমার কাছে চলে আসলে মিস্টার আজাদ এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে।তার জন্য তো একটু নাটক করতেই হবে!হাহাহা…”
আয়নের কথা শুনে ফারিহার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে।ফারিহা নিজের উপর নিজে তাচ্ছিল্য হাসলো।ও এতটা বোকা??আয়ানকে এতদিন চিনতে পারল না?আয়ান ফোনে প্ল্যান করছে কিভাবে মিস্টার আজাদকে শেষ করা যায় ফারিহা এসব আর শুনতে না পেরে দৌড়ে নিচ চলে গেলো।তারপর একটা রুমে গিয়ে দরজা বাড়ি দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।আয়ান এরকম করবে ফারিহার বিশ্বাস হচ্ছিল না।ফারিহা কাঁদতে কাঁদতে নিজেকে নিজের বলছে,
“ফারিহা তুই এতো বোকা?তুই কি করে এসব আগে বুঝলি না?কি করে ঐ লোকটার মিথ্যে অভিনয় বুঝলি না?ওই লোকটার ফাঁদে পা দিলি!ওই লোকটা তোকে প্রথম প্রথম এতো অত্যাচার করত তারপর হঠাৎ ভালোবাসা শুরু করে দিয়েছে আর তুইও বোকার মত লোকটাকে ভালোবাসলি??ফারিহা তুই খুব বোকা,,খুববববব…”
ফারিহা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।ফারিহা নিজের চুল টানছে আর মুখ চেপে কান্না করছে যেন বাহিরে আওয়াজ না যায়।আজকে ফারিহার বুকটা ফেটে যাচ্ছে কারণ যতোই হোক ফারিহা আয়ানকে ভালোবাসে।আয়ান ফারিহার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা।আয়ান এরকম একটা রূপ ফারিহা মেনে নিতে পারছে না।ফারিহা নিজে নিজেই বললো,
“আমি্ আমি তো উনাকে এতো ভালোবাসলাম।আর উনি তার এই প্রতিদান দিলো? উনি এত দিন আমার সাথে নাটক করলো?প্রতিরাতে আমার শরীরটা নিয়ে…”
ফারিহা নিজের শরীরের চামড়া খামচে ছিড়ে ফেলতে চাইছে।ফারিহার নিজের শরীরের প্রতি ঘেন্না হচ্ছে।এই শরীরের প্রতিটি ভাঁজে আয়ানের ছোঁয়া আছে। ফারিহা একদম পাগলের মতো আচরণ করছে।কি করছে নিজেও বুঝতে পারছে না।
.
অনেক্ষণ কান্না করে ফারিহা আস্তে আস্তে একটু শান্ত হলো।তারপর নিজেই নিজেকে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“ফারিহা তুই না খুব বোকা!না হলে নিজের বাবার শত্রুকে কেউ ভালোবাসে? উনি কক্সবাজার তোর সাথে যা করলো তারপর তুই উনাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস?
উনাকে ক্ষমা করে দেওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে।এখন তার শাস্তি পাচ্ছি।হ্যাঁ এটা আমার শাস্তি!নিজের বাবার শত্রুকে আপন ভাবার শাস্তি।হাহাহা…”
এতক্ষণ কান্না করলেও এখন ফারিহা হাসছে।আসলে জীবনে এত বড় ধাক্কাটা ফারিহা মেনে নিতে পারছে না।
ফারিহার জীবনে বড় ধাক্কা গুলো হঠাৎ করেই আসে।ছোট থাকতে মা মারা গিয়েছিল সেদিন একটা বড় ধাক্কা খেলো।তারপর ফারিহার এসএসসি পরীক্ষার কিছু মাস আগে মিস্টার আজাদের একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল।তখন ফারিহা একদম ভেঙ্গে পড়েছিল খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়েছে।
তারপর আয়ানের সাথে বিয়ে!এটাতো ফারিহার কল্পনাতেও ছিল না।বিয়ের পর ফারিহা একদম ভেঙ্গে পড়েছিল কিন্তু শুধুমাত্র মিস্টার আজাদের কথা ভেবে নিজেকে শক্ত করে।আর আজকে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেলো ফারিহা নিজের ভালোবাসার কাছে ঠকে গেলো!
.
আয়ান রুমে এসে দেখল বিছানা একদম গোছানো।আয়ান ভ্রু কুঁচকে বিছানার দিকে তাকিয়ে ভাবলো ফারিহা রুমে এসেছে কিন্তু ওর সাথে কথা না বলে চলে গেল কেন?আয়ান আর আর কিছু না ভেবে নিচে গেল।কিচেনে গিয়ে দেখল সার্ভেন্টরা কাজ করেছে কিন্তু ফারিহা সেখানে নেই।আয়ান একটা সার্ভেন্ট কে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল,ফারিহা নাকি নাস্তা তৈরি করে উপরে চলে গিয়েছে।আয়ান ভ্রু কুঁচকে উপরের দিকে তাকালো।কিন্তু ফারিহা তো ওখানে নেই।আয়ান দুটো সার্ভেন্টকে ছাদে আর বাগানে পাঠালো ফারিহা আছে কিনা দেখতে।কিন্তু সার্ভেন্ট দুটো এসে বললো, ফারিহা কোথাও নেই।
বাইরে নিজের নাম নিয়ে কারো ডাকার আওয়াজ শুনে ফারিহা ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো।তারপর হাত মুঠো করে শক্ত করে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো।ফারিহার ভেতর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে।খুব কষ্টে নিজেকে সামলাতে চাইছে কিন্তু পারছেনা। ফারিহা ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো।তারপর নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে দরজা খুলে ড্রইং রুমে এসে দেখলো আয়ান সার্ভেন্টাদের ধমকাচ্ছে।ফারিহা কাছে গেলে আয়ান ফারিহাকে দেখে ফারিহার কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে বললো,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি?কখন থেকে খুঁজছি”
আয়ানের ছোঁয়া ফারিহার কাছে অসহ্য লাগছে।আয়ানের দিকে চোখ তুলে তাকাতেও ঘেন্না লাগছে।ফারিহা মাথা নিচু করেই বললো,
“একটু বাইরে গিয়েছিলাম।বাগানের দিকে”
আয়ান ভ্রু কুঁচকে বললো, “কিন্তু সার্ভেন্ট রা তো বললো তুমি বাগানে নেই”
“না না বাগানে ছিলাম।ঐ যে কোনার দিকটায় ছিলাম। ওরা হয়তো খেয়াল করেনি”
আয়ান ফারিহার থুতনি ধরে বললো, “মাথা নিচু করে আছে কেনো?আমার দিকে তাকাও”
ফারিহা না চাইতেও চোখ তুলে আয়ানের দিকে তাকালো।আয়ানের দিকে তাকাতেই ফারিহার বুকটা ধক করে উঠলো।ওর ভালবাসার মানুষ!যাকে কিনা বাপির পরে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আজ তার কাছে ঠকে গেলে!
চলবে…