স্রোতের টানে পর্ব-৩০

0
3486

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩০

আয়ান আস্তে আস্তে ফারিহার কাছে এগিয়ে গেলো।তারপর কাছে গিয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
“ফারিহা!”

আয়ানের ডাকে ফারিহা মিস্টার আজাদের বুক থেকে মুখ তুলে ভীতু চোখে আয়ানের দিকে তাকালো।আয়ান ফারিহাকে ধরতে আসলে ফারিহা একটু পিছিয়ে গেল। কারণ আয়ানের হাতে এখনো হানিফ আহমেদের রক্ত লেগে আছে।জিহাদ তাড়াতাড়ি করে পানি এনে আয়ানের হাতটা ধুয়ে দিল।
আয়ান আবার ফারিহার কাছে গেলে মিস্টার আজাদ ফারিহাকে ছেড়ে দিল।ফারিহা ভীতু চোখে আয়ানের দিকে তাকালে আয়ান আলতো করে ফারিহাকে জড়িয়ে ধরলো।ফারিহা ও এক মুহূর্তের জন্য আয়ানের করা সবকিছু ভুলে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।আয়ান শক্ত করে ফারিহার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরলো।
ফারিহা ফুঁপিয়ে কান্না করতে করতে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,

“আংকেল আংকেল আমার সাথে… ”

“চুপ!চুপ সোনা,কান্না করে না।দেখ সব ঠিক হয়ে গেছে।কিছু হয়নি”

ফারিহা হাত মুঠো করে আয়ানের শার্ট আঁকড়ে ধরলো।ফারিহার কান্না আয়ানের সহ্য হচ্ছে না তাই ফারিহাকে বুক থেকে তুলে ফারিহার দু গালে হাত রেখে চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,

“কান্না করে না সোনা।দেখো সব ঠিক হয়ে গিয়েছে।আমি এসে গেছি তো।প্লিজ ডোন্ট ক্রাই”

মিস্টার আজাদ দূরে দাঁড়িয়ে ফারিহা আর আয়ান কে দেখছে। যদিও মেয়ে আর জামাইকে এভাবে দেখা ঠিক না।তবু মিস্টার আজাদের বেহায়া চোখ আজকে শুধু আয়ানকে দেখছে।
ফারিহাকে যখন পাওয়া যাচ্ছিল না তখন মিস্টার আজাদ আয়ানের অস্থিরতা দেখেছে।তারপর কিছুক্ষণ আগে হানিফ আহমেদকে এভাবে মারতে দেখলো আর এখন ফারিহাকে শান্ত করতে দেখছে।মিস্টার আজাদ জানে আয়ান একটু ভুল বোঝাবুঝির কারণে ফারিহাকে এতদিন কষ্ট দিয়েছে কিন্তু এখন বুঝতে পারে যে আয়ান ফারিহাকে কতোটা ভালোবাসে।মিস্টার আজাদ মুচকি হাসলো!

আয়ানের বুকে কান্না করতে করতে ফারিহা এক সময় শান্ত হয়ে গেলো। তারপর আয়ানের অভিনয়ের কথা মনে পড়াতে হঠাৎ আয়ানের থেকে দূরে সরে গেল।ফারিহা এভাবে ঝট করে দূরে সরে যাওয়াতে আয়ান চমকে উঠলো।ফারিহা কিছু মনে পড়াতে বললো,

“আমি যে এখানে আছি আপনার কিভাবে জানলেন?’

ফারিহার কথা শুনে মিস্টার আজাদ বললো, “ওসব কথা পরে হবে আগে বাড়ি চল”

ফারিহাও এখন প্রচুর দুর্বল তাই আর প্রশ্ন না করে মিস্টার আজাদের সাথে যেতে লাগলো।ফারিহা চলে যেতে নিলে আয়ান অবাক হয়ে ঝট করে ফারিহার হাত ধরে ফেলল।তারপর বললো,

“কোথায় যাচ্ছো? তুমি আমার সাথে যাবে চলো..”

ফারিহা আয়ানের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বললো, “আপনার বাড়িতে কেনো যাবো? আশা করি আপনি এতক্ষণে সত্যিটা জানতে পেরেছেন।তাহলে এখন তো আমার আপনার সাথে থাকার কোন প্রশ্নই উঠে না”

আয়ান অবাক হয়ে ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো, “ফারিহা কি বলছো এসব?তুমি আমার স্ত্রী,আমার সাথে থাকবে না মানে?

ফারিহা আয়ানের চোখের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছেন আপনি আমাকে কেন বিয়ে করেছেন।শুধুমাত্র বাপির থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমাকে বিয়ে করেছিলেন!মনে আছে??তা এতক্ষণে তো আপনি সব সত্য জেনে গিয়েছেন তাহলে এবার আমাকে মুক্তি দিন প্লিজ”

ফারিহার কথায় আয়ান প্রচুর অবাক হচ্ছে।ফারিহা কি বলছে এসব?মুক্তি দিবে মানে!ফারিহা কি আয়ানকে ছেড়ে চলে যাবে?না না এটা হতে দেওয়া যাবেনা।আয়ান ফারিহাকে ছাড়া বাঁচবে না।
আয়ান ফারিহার হাত ছাড়ছে না দেখে মিস্টার আজাদ আয়ানকে বললো,

“আয়ান আমি চাইলে এখন তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতে পারতাম। তুমি বিনা দোষেই এতোদিন আমার মেয়েটাকে শাস্তি দিলে।তাছাড়া এটা ঠিক যে সব ছেলেরাই চাইবে নিজের বাবা,মায়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে, আমি জানি তুমি একটা ভুল বুঝাবুঝির মধ্যে ছিলে তাই কিছু বললাম না। কিন্তু এখন আমার মেয়েটাকে মুক্তি দাও”

আয়ান মিস্টার আজাদের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো, “না আঙ্কেল!ফারিহা আমার স্ত্রী।ও আমার সাথে থাকবে।আমি ওকে কোথাও যেতে দেবে না।আমি ফারিহাকে ছাড়া বাঁচবো না”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,।
“আপনি তো এতদিন সব প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নাটক করেছেন।তাহলে এখন আমাকে ছাড়া বাঁচবে না কেন?এটা আবার কোন নাটক?”

“আমি নাটক করছি?হ্যাঁ আমি মানছি আমি প্রতিশোধের জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি।এমনকি প্রথম প্রথম তোমার উপরে অনেক অত্যাচারও করেছি, তোমাকে ভালবাসতে পারিনি।কিন্তু…কিন্তু আজকে যখন তোমাকে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম ফারিহা।আমি তোমাকে ভালবাসি বুঝতে পারছনা কেনো?প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না”

আয়ানের কথায় ফারিহা প্রচুর অবাক হলো।আয়ান যে মিথ্যে বলছেন না সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।কিন্তু এখন আয়ানের সাথে যেতে ফারিহার মন মানছে না।ফারিহা আয়ানের ধরা হাতটা ছুটাতে মুচরামুচরি করতে করতে বললো,

“আমাকে যেতে দিন প্লিজ..”

আয়ান এবার প্রচুর রেগে গেলো।মেয়েটা এতো অবুঝ কেনো?বলছি ভালবাসি তবু কেন বুঝতে পারছে না।বারবার বলছে যেতে দিন!যেতে দিন।আয়ান রেগে বললো,

“আমি বলছি তুমি আমার কাছে থাকবে মানে আমার কাছেই থাকবে।তুমি আমার স্ত্রী তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে”

আয়ান ফারিহার উপর রাগ দেখাচ্ছে দেখে মিস্টার আজাদ রেগে গেলো।আয়ানের দিকে তেড়ে এসে বললো,
“খবরদার আমার মেয়েকে রাগ দেখাবিনা।আমার মেয়ে তোর প্রচুর অত্যাচার সহ্য করেছে।এতদিন আমি মুখ বুজে থাকলেও এবার আর নয়”

“মিস্ট্..আঙ্কেল আপনি বোধহয় ভুলে যাচ্ছে ফারিহা আমার স্ত্রী।আপনি আমার কাছ থেকে আমার স্ত্রীকে আলাদা করতে পারেন না”

“কিসের স্ত্রী? তুমি তো আজকে সব সত্যি জানলে। তবু কেন ফারিহাকে মুক্তি দিচ্ছল না।দেখো আমি ভালোই ভালোই বলছি ফারিহাকে ছাড়ো”

আয়ান রেগে যাচ্ছে দেখে জিহাদ পরিস্থিতি সামলানোর জন্য মিস্টার আকাদকে বললো,”আঙ্কেল দেখুন এটা ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার।আপ্…”

“তুমি মধ্যে কথা বলবে না।আর হ্যাঁ স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার তাই তো?কিন্তু ফারিহা তো আয়ানের সাথে থাকতে চায় না”

মিস্টার আজাদ আয়ানের ফারিহার ধরে রাখা হাতটা ছাড়িয়ে ফারিহাকে টানতে টানতে নিয়ে বেরিয়ে গেল।আয়ান অসহায় চোখে ফারিহার যাওয়ার দিকে তাকালো।ফারিহা দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছন ফিরে শেষবারের মতো আয়ানের মুখটা দেখেছিল।ফারিহার খুব কষ্ট হচ্ছে এই মানুষটাকে তো ফারিহা ভালোবেসেছিল।ফারিহার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা!কিন্তু ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে ধোকা ফারিহা সহ্য করতে পারলো না তাই এখন দূরে যাওয়াই শ্রেয়।

বড় হয়ে বুঝ হওয়ার পর এই প্রথম মনে হয় জিহাদ এতো বেশি অবাক হল।আয়ানের চোখে পানি! এটাতো অসম্ভব ব্যাপার।জিহাদ আগে কখনো আয়ানকে কাঁদতে দেখেনি।সবসময় চোখে গম্ভীরতা দেখেছে,রাগ দেখেছে।এত বড় গ্যাংস্টার হয়ে সামান্য একটা মেয়ের জন্য আজকে আয়ান অসহায়ের মত কাঁদছে।আয়ান ফারিহার যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।আয়ান নিজের কান্না অনুভব করে নিজেই অবাক হলো।বাবা,মা মারা যাওয়ার পর আয়ান কখনো কান্না করেনি।সব সময় নিজের কষ্টটাকে বুকের মধ্যে চেপে রাখতো কিন্তু চোখে পানি আস্তে দিতো না।আর আজকে??
জিহাদ অবাক হয়ে আয়ানের দিকে একটু এগিয়ে এসে বললো,

“স্যার আপনি চিন্তা করবেন না।ম্যাডামকে আমরা..”

আয়ান হাত দিয়ে জিহাদকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমাদের কিছু করতে হবে না”

তারপর হন হন করে বাইরে চলে গেলো। আয়ান বেরিয়ে এসে দেখলো মিস্টার আজাদের গাড়ি চলে গিয়েছে।আয়ান নিজের গাড়িতে উঠে ফুলস্পিডে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।
আর এইদিকে জিহাদ হানিফ আহমেদের লাশটা সরানোর ব্যবস্থা করছে।

.
গাড়িতে বসে ফারিহা মিস্টার আজাদের বুকের সাথে লেপ্টে আছে আর কিছুক্ষণ পরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মিস্টার আজাা ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

“কাঁদছিস কেন মামনি?”

ফারিহা কিছু বললো না শুধু চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।ফারিহার চোখের জলে মিস্টার আজাদের বুকের দিকে পান্জাবি ভিজে গিয়েছে। মিস্টার আজাদ ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

“যা হয়েছে ভুলে যা মা।তোকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে।আমি জানি এতদিন একসাথে থাকার পর তোর হয়তো আয়ানের প্রতি মায়া জন্মে গিয়েছে কিন্তু তোকে এই মায়া কাটাতে হবে।নাহলে স্বাভাবিক হতে পারবি না”

ফারিহাকে কান্না করতে করতে বললো, “আমি উনাকে ভালোবাসি বাপি।কিন্তু উনার আমার সাথে করা প্রতারণা আমি সহ্য করতে পারছি না”

মিস্টার আজাদ কিছুক্ষন চুপ থেকে শান্তকণ্ঠে বললো, “তুই কি আয়ানের কাছে ফিরে যেতে চাস?”

ফারিহা না সুচক মাথা নাড়ালো। আবার কিছুক্ষণ পরে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।আসলে ফারিহা কি করবে নিজেই বুঝতে পারছে না।মিস্টার আজাদ ফারিহাকে বুঝতে পেরে বললো,

“আমি জানি তুই আয়ানকে ভালোবাসিস।ওকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে কিন্তু আয়ান আসলে তোকে ভালোবাসে কিনা সেটা কিন্তু আমরা জানি না!আয়ান যদি আবার কখনো তোকে ধোঁকা দেয়
তুই সহ্য করতে পারবি না।তাই আমার কথাটা
শোন আয়ানের কাছে ফিরে গিয়ে কষ্ট না পেয়ে এখনি নিজেকে সামলা।দেখবি তোর জীবনটা
সুন্দর হবে”

“আমি কী করবো বাপি? আমার খুব কষ্ট হচ্ছে”

ফারিহা হু হু করে কেঁদে উঠলো।মিস্টার আজাদ ফারিহার মাথাটা শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরল।তারপর বললো,
“শান্ত হ প্লিজ,,তুই এমনিতেই অসুস্থ আর কান্নাকাটি করিস না,সব ঠিক হয়ে যাবে।ভার্সিটিতে রেস্টুরেন্টে গেলে দেখবি মন ভালো হয়ে যাবে।এখন কান্না বন্ধ কর মামনি”

ফারিহা আরো কিছুক্ষণ কান্না করে আস্তে আস্তে মিস্টার আজাদের বুকে শান্ত হয়ে গেলো।আয়ানকে ছেড়ে যেতে ফারিহার কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু ফারিহা আর আয়ানের কাছে ফিরে যাবে না।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here