স্রোতের টানে পর্ব-৩১

0
3469

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩১

বাড়ির গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকে থামল।মিস্টার আজাদ ফারিহাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে গাড়ি থেকে নামালো।ফারিহা এখন শান্ত হয়ে গিয়েছে কান্না করছে না।চুপচাপ হেঁটে মিস্টার আজাদের সাথে ভেতরে ঢুকলো।ফারিহা বাসার ভেতরে ঢুকার সাথে সাথে হনুফা বেগম চিৎকার করে ফারিহাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে লাগল আর বলতে লাগলো,

“মা তুই ঠিক আছিস?ওই অমানুষটা তোর সাথে কিছু করেনি তো?তুই বিশ্বাস কর আমি যদি আগে জানতাম তাহলে আগে থেকে তোদেরকে বলে দিতাম।আমি এমন একটা মানুষের সাথে সংসার করেছি যে কিনা….”

হনুফা বেগম কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না।ফারিহা একটু মুচকি হেসে বললো,
“মনি আমি ঠিক আছি আর তুমি নিজেকে কেন দোষারোপ করছো?যা করার ওই লোকটা করেছে তুমিতো নির্দোষ”

“তুই আর স্যার খুব ভালো রে মা।না হলে আমার স্বামী তোদের সাথে যা করলো তারপরেও তোরা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিস নি। আমাকে মেরে ফেলিস নি!”

“মনি কি বলছো এসব?তোমাকে মারতে যাবো কেন? তুমি তো কিছু করনি আর আমি জানতাম আমার মনি কখনো আমার সাথে এরকম করতে পারে না। এবার শান্ত হও প্লিজ”

এতক্ষণে সবাই আসল ঘটনাটা জেনে গিয়েছে।বাসার অন্য সার্ভেন্টদের কাছ থেকে হনুফা বেগম সব জানার পর প্রচন্ড অবাক হয়।উনি এতদিন এমন একটা লোকের সাথে সংসার করলো আর তাকে চিনতে পারল না!হানিফ আহমেদের মরার খবর শুনে হনুফা বেগম অনেক কষ্ট পায় শত হলেও স্বামী তো। এতদিন যার সাথে থাকলে সেই মানুষটা আজকে পৃথিবীতে নেই, একটু কষ্ট তো হবেই।তবে তার চেয়ে বেশি ঘৃণা হচ্ছে,ওই লোকটা কি করে নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের দিকে হাত বাড়াতে পারলো!ঐ লোকটার মৃত্যুই প্রাপ্য।হনুফা বেগমের কান্না দেখে মিস্টার আজাদ বিরক্ত হয়ে বললো,

“আহ কি করছো?মেয়েটা অসুস্থ দেখতে পাচ্ছো না? ওকে একটু রেস্ট নিতে দাও”

হনুফা বেগমের এবার ফারিহার দিকে খেয়াল হলো ফারিহার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে,কান্নার কারনে চোখ মুখ ফুলে আছে, চেহারার করুন অবস্থা। হনুফা বেগম তাড়াতাড়ি করে নিজের চোখের পানি মুছে ফারিহাকে ধরে বললো,

“মা তোকে দেখে তো অনেক দুর্বল মনে হচ্ছে।তুই রুমে চল”

মিস্টার আজাদ বললো, “আমি ওকে রুমে নিয়ে যাচ্ছি।তুমি ওর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করো”

হনুফা বেগম মাথা ছেড়ে চলে যেতে নিলে মিস্টার আজাদ পেছন থেকে ডাক দিল। হনুফা বেগম পেছন ফিরে বললো, “জ্বী আর কিছু লাগবে?”

মিস্টার আজাদ হনুফা বেগমের দিকে তাকালো।হনুফা বেগমের পরনে একটা সাদা শাড়ি।যেদিন ফারিহার মা উনাকে আর হানিফ আহমেদকে এই বাড়িতে এনেছিল তখন হনুফা বেগমের পরনে একটা লাল শাড়ি ছিল।তখন ছিল নতুন বউ আর আজকে!
মিস্টার আজাদ হনুফা বেগমকে সব সময় ছোট বোনের চোখে দেখে।হনুফা বেগমের কাছে মিস্টার আজাদ অনেক ঋণী। কারণ ফারিহার মা মারা যাওয়ার পর হনুফা বেগমই ফারিহাকে বড় করেছে। মিস্টার আজাদ হনুফা বেগমকে বললো,

“হানিফ যা করেছে তার জন্য শাস্তি পেয়েছে।তুমি এটার জন্য নিজেকে দোষারোপ করো না।তুমি এই বাড়িতে আগে যেভাবে থাকতে এখনো সেভাবেই থাকবে”

হনুফা বেগম একটু হেসে মাথা নাড়ালো। ফারিহা হনুফা বেগমের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলো।মিস্টার আজাদ ফারিহাকে নিয়ে উপরে রুমে আসলো।তারপর ফারিহার কাবার্ড থেকে একটা জামা বের করে ফারিহার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

“যা ফ্রেশ হয়ে আয়।তারপর খাবার খেতে হবে”

ফারিহা দুর্বল কন্ঠে বললো, “বাপ্পি আমি এখন একটু ঘুমাবো।এখন কিছু খাবো না”

“হ্যাঁ আমি জানি তোর ঘুমের প্রয়োজন কিন্তু আগে ফ্রেশ হয়ে খাবার খা।তারপর ইচ্ছামত ঘুমাবি।খাবার না খেয়ে ঘুমানো যাবে না।তাছাড়া খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে তো।তুই অনেক দুর্বল মামনি”

“বাপি…”

“আর কোন কথা নেই মা,যেটা বলছি সেটা কর”

ফারিহা একটু হেঁসে মাথা নেড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো।আর মিস্টার আজাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

.
আয়ান বারের একটা টেবিলে বসে একের পর এক বোতল শেষ করছে।আয়ান আমেরিকা থাকতেও ড্রিংক করতো এমন কি ফারিহাকে বিয়ের আগ পর্যন্ত ড্রিঙ্ক করেছে।কিন্তু ফারিহাকে বিয়ের করার পর আয়ান কোনো এক কারণে ড্রিঙ্ক করা বন্ধ করে দিলো।আয়ান জানে ফারিহা এসব পছন্দ করেনা তাই হয়তো আয়ান এসব খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো।শুধুমাত্র ফারিহার জন্য!
আর তাছাড়া আয়ান যখন খুব কষ্টে থাকে তখন বেশিদিন মদ খায় কিন্তু ফারিহাকে বিয়ে করার পর তো ফারিহাকে কষ্ট দিয়ে আয়ান নিজে ভালো থাকতো।তাই ড্রিঙ্ক করার প্রয়োজন পড়তো না।কিন্তু আজকে আবার আয়ানের সেই আগের রূপ ফিরে এসেছে।আয়ান একের পর এক বোতল খালি করছে।বারের একটা ছেলে ভয় ভয়ে আয়ানকে আর খেতে বারণ করেছিল কিন্তু আয়ানের ধমক শুনে ছেলেটা দৌড়ে পালিয়েছে।

আয়ান ড্রিংক করছে তখন একটা মেয়ে আসলো।মেয়েটার পরনে হাঁটুর অনেকটা ওপরে অব্দি একটা ড্রেস।বুকের ভাজ অনেকাংশে বুঝা যাচ্ছে।মেয়েটা আয়ানকে নিজের দিকে একটু আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।মেয়েটা ভেবেছে বড়লোকের মাতাল ছেলে নিশ্চয়ই ছোট ড্রেস পরা মেয়ে দেখলে পাগল হয়ে যাবে।কিন্তু আয়ান মাতাল হলেও নিজেকে কন্ট্রোল করতে জানে।মেয়েটা এসে আয়ানের কাছে ঘেসে বসলো।তারপর আয়ানের ঘাড়ে স্লাইড করতে করতে বললো,

“হেই হ্যান্ডসাম কারোর জন্য অপেক্ষা করছো নাকি?”

আয়ান ঘাড় থেকে মেয়েটার হাত সরিয়ে দিলো। মেয়েটা আবার আয়ানের কাছে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে বললো,

“কেউ না থাকলে আমি আজকে রাতে তোমাকে সময় দিতে পারি।অনেক মজা হবে বেবি”

“প্রয়োজন নেই, তুমি এখন যেতে পারো”

মেয়েটা আবার বেহায়ার মতো বললো, “অ্যাটিটিউড?আই লাইক ইট বাট ভেবে বলছো তো? আমার মতো মেয়েকে মিস করলে কিন্তু”

আয়ান শান্তকণ্ঠে বললো, “হুম ভেবে বলছি।তুমি এবার যেতে পারো।আমার তোমাকে প্রয়োজন নেই”

মেয়েটা তবু বেহায়ার মত বারবার আয়ানের কাছে আসার চেষ্টা করছে।জামাটার গলার দিকটা আরেকটু নামিয়ে আয়ানকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে।আয়ান একমুহূর্তের জন্য ভুল করেও সে দিকে তাকাচ্ছে না।মেয়েটা এবার আয়ানের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,

“বউ আছে? বউকে ভয় পাও নাকি?তাই আমার কাছে আসতে চাচ্ছো না!চিন্তা করো না তোমার বউ কিছু জানবে না”

আয়ান হেসে বললো, “বউকে ভয় পাই তার জন্য নয়।বউকে ভালবাসি তাই তোর মত মেয়ের কাছে যাচ্ছি না”

মেয়েটা এবার খুব অপমানিত হলো তবু বেহায়ার মত বললো, “বউকে ভালবাসে তাহলে এরকম জায়গায় আসো কেন?”

“আমি কোথায় যাবো,না না যাবো সেটা কি তোকে কৈফিয়ত দিতে হবে?”

আয়ান তুই করে বলছে বলে মেয়েটা খুব অপমানিত বোধ করছে।তবুও বেহায়ার মতো আইনের হাত ধরলো।এবার আয়ান রেগে মেয়েটার হাত ঝাপটা মেরে সরিয়ে মেয়েটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো।তারপর বললো,

“একবার বারণ করেছি আমাকে টাচ করবি না তবুও তুই টাচ করছিস কেন?আমাকে টাচ করা অধিকার একমাত্র ফারিহার।ফারিহা কে জানিস?আমার বউ, আমার ভালোবাসা,আমার প্রাণ,আমার সবকিছু! শুধু মাত্র ওই আমাকে ছুঁতে পারবে আর কেউ না।”

মেয়েটা অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকালো।আয়ানের রাগ মেয়েটা ভয়ে ঢুক গিলছে।আয়ান আনার বললো,
“আর তুই ভাবলি কি করে তোর মতো পতিতাদের সাথে আমি শুতে যাবো।আমি ড্রিঙ্ক করেছি বলে ভাববি না আমি হুসে নেই।প্রানের মায়া থাকতে এখান থেকে যা”

আয়ান মেয়েটাকে ওর কোমড়ের কাছে গুঁজে রাখা গানটা দেখালো।বন্দুক দেখে মেয়েটার গলা শুকিয়ে গেল।মেয়েটা বুঝে গেছে আয়ান কে পাওয়া যাবে না তাই নিজের প্রাণ বাঁচাতে ওঠে তাড়াতাড়ি করে হেঁটে চলে গেল।

.
ফারিহা গোসল করে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে দেখল মিস্টার আজাদ প্লেটে করে খাবার নিয়ে এসেছে।ফারিহাকে দেখে মিস্টার আজাদ ধমক দিয়ে বললো,

“চুলগুলো ভালো করে মুছে নিতে পারলি না?এমনিতে রাতের বেলায় গোসল করেছিস ঠান্ডা লেগে যাবে তো”

ফারিহা মুচকি হেসে টাওয়াল দিয়ে ভালো করে চুলগুলো মুছল।মিস্টার আজাদ ফারিহাকে খাটের উপর বসিয়ে তারপর নিজের হাতে ফারিহার মুখের সামনে ভাত তুলে ধরলো।ফারিহা কিছু বলতে
গেলে মিস্টার আজাদ চোখের ইশারায় ফারিহাকে খেতে বললো।ফারিহা ও কিছু না বলে চুপচাপ মিস্টার আজাদের হাতে খেতে লাগলো।খাবার খাইয়ে দিতে দিতে মিস্টার আজাদ বললো,

“এখন খাবার টা শেষ করে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বি ঠিক আছে?”

ফারিহা হ্যা সূচক মাথা নাড়লো।কিন্তু ফারিহার শরীর দুর্বল হলেও আজকে রাতে ফারিহার ঘুম আসবে না।এতদিন সব সময় আয়ানের সাথে ঘুমিয়েছে আজকে আয়ানকে ভীষণভাবে মিস করছে।মিস্টার আজাদ ফারিহার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,

“এসব নিয়ে আর ভাবিস না।গত কয়েকমাসের স্মৃতি তোর মাথা থেকে মুছে দে।আয়ান নামে কেউ যে তোর জীবনে ছিল সেটাই ভুলে যায়”

কিন্তু চাইলেই কি ভুলে যাওয়া যায়?ফারিহা কখনো আয়ানকে ভুলতে পারবে না।ফারিহা কিছু বলছে না দেখে মিস্টার আজাদ ফারিহার মুখে খাবার দিয়ে বললো,

“আমি জানি তোর কষ্ট হবে।কিন্তু তা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।আরেকটা উপায় আছে তুই যদি আয়ানের কাছে ফিরে যাস। তুই কি আয়ানের কাছে ফিরে যেতে চাস?”

ফারিহা মাথা নিচু করে না সূচক মাথা নাড়ালো।মিস্টার আজাদ হেসে বললো,

“তাহলে আয়ানকে ভুলে যা।আমি তোর পাশে আছি”

ফারিহা কিছু বললো না।চুপচাপ মিস্টার আজাদের হাতে খেতে লাগলো।মিস্টার আজাদ ফারিহাকে খাবার খাইয়ে তারপর ওষুধ খাইয়ে দিল।তারপর বললো,

“এবার চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়। সকালে উঠে দেখবি অনেক সুস্থ বোধ করছিস”

মিস্টার আজাদ একটা সার্ভেন্টকে ডেকে খাবারের প্লেট টা নিয়ে যেতে বলল।তারপর ফারিহাকে শুতে বললে ফারিহা কোন কথা না বলে চুপচাপ খাটে শুয়ে পড়লো।মিস্টার আজাদ ফারিহার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।মিস্টার আজাদ নিজের মেয়ের মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছে।উনি জানে আয়ানের জন্য ফারিহার মনের অনুভূতি কি।কিন্তু ফারিহাকে তো ঘুরে দাঁড়াতে হবে।মিস্টার আজাদ আয়ানের সাথে ফারিহার সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে।আয়ান যখন ফারিহাকে অত্যাচার করতো তখন মিস্টার আজাদ চেয়েও কিছু করতে পারতো না। দূর থেকে শুধু কষ্ট পেতো কিন্তু এখন ফারিহাকে কষ্টে থাকতে দেবেনা।
অনেকক্ষণ ধরে মিস্টার আজাদ ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।তারপর ফারিহার ভারী নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনে নিঃশব্দে ফারিহার পাশ থেকে উঠে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল।মিস্টার আজাদ চলে যাওয়ার পর ফারিহা চোখ মেলে তাকালো।আর ওর গাল বেয়ে দুফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here