স্রোতের টানে পর্ব-৩৪

0
3531

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩৪

ফারিহা অস্থির হয়ে আছে কখন সব সত্যি শুনবে।গতকাল থেকেই ফারিহা চিন্তা করছে আয়ান কিভাবে পর খোঁজ পেলো?মিস্টার আজাদ চুপ করে আছে দেখে ফারিহা বললো,

“বাপি বলোনা কি করে তোমরা আমার খোঁজ পেলে?”

মিস্টার আজাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমি তো প্রথমে তোর কিডন্যাপ হওয়ার খবর জানতাম না আয়ান এ বাড়িতে এসেছিল তারপর জানতে পেরেছি।তারপর তোকে খোঁজার জন্য লোক লাগিয়েছিলাম কিন্তু কেউ তোর কোন খবর দিতে পারছিল না।পরে আয়ন কল করে বলল ও নাকি তোর খোঁজ পেয়েছে।এটা শুনে আমি ঠিকানায় গেলাম,ওখানে আয়ান ছিলো।তারপর আমরা একসাথে ওই বাড়িতে যাই।ওখানে গিয়ে আয়ানের বডিগার্ডরা হানিফের সব লোকদের মেরে ফেলেছিল।তারপর একটা লোককে জিজ্ঞেস করতে বলল যে তুই কোন রুমে আছিস।তারপর তোর কাছে গেলাম”

“কিন্তু বাপি আমি যে ওই বাড়িতে আছি সেটা আয়ান কিভাবে জানলো?”

“হ্যাঁ সেটা আমি আয়ানকে গাড়িতে জিজ্ঞেস করেছিলাম।আয়ান বলেছে,ও নাকি তোর সেফটির জন্য তোর ঘড়ির সাথে ট্রান্সমিটার লাগিয়ে রেখেছিল। আসলে আয়ান জানত যে ওর অনেক শত্রু তাই ওকে কাবু করার জন্য কেউ তোর ক্ষতি করার চেষ্টা করবে।তাই আয়ান বুদ্ধি করে আগে থেকেই তোর ঘড়ির সাথে ট্রান্সমিটার লাগিয়ে রেখেছিল যেনো তোর লোকেশন জানতে পারে। আর তুই তো সব সময় হাতে ঘড়ি পড়ে থাকিস। তুই কিডন্যাপ হওয়ার পর আয়ানের এই কথাটা মাথায় আসেনি পরে।হঠাৎ মনে পড়তে আমাকে ফোন দিয়ে বলল যে তোকে পাওয়া গিয়েছে”

ফারিহা ওর হাতের দিকে তাকালো।এখন ফারিহার হাতের ঘড়িটা নেই।ওই রুমে হানিফ আহমেদের সাথে জোড়াজোড়ি করার সময় ঘড়িটা কখন হাত থেকে খুলে পড়ে গিয়েছে ফারিহার খেয়াল নেই।ফারিহা অনেক টাইম মেনটেন করে চলতো, তাই সব সময় হাতে ঘড়ি পড়ে থাকত।কিন্তু ফারিহা জানতো না যে ওর ঘড়ির সাথে ট্রান্সমিটার লাগানো আছে। ফারিহা অবাক হলেও এটা ভেবে অবাক হয় যে আয়ান আগে থেকেই ওর সেফটির ব্যবস্থা করে রেখেছে।কিছুক্ষণ পর মিস্টার আজাদ বললো,

“যাই বলিস আয়ান কিন্তু এ কাজটা ভালো করেছে। না হলে কিন্তু তোকে খুজে পাওয়া যেত না।আর ওই হানিফ..”

হানিফ আহমেদের কথা শুনে ফারিহা ভয়ে গুটিয়ে গেল।তাই মিস্টার আজাদ কথা বন্ধ করে দিল।তারপর ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে কথা ঘুরিয়ে বললো,

“আয়ান তোর সাথে যোগাযোগ করার কোন চেষ্টা করেছে?”

ফারিহা সত্যিটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো।তারপর না সূচক মাথা নাড়ালো।মিস্টার আজাদ ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“আয়ান যদি তোকে ওর বাড়িতে ফিরিয়ে নিতে চায় তাহলে ও এমনি বসে থাকবে না।আমি সিওর ও তোর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে”

মিস্টার আজাদের কথা শুনে ফারিহা না সূচক মাথা নেড়ে বলল, “না উনার সাথে আমার আর কথা হয়নি।আর আমি উনার সাথে কথা বলতে যাব কোন দুঃখে! আমি আর ওই বাড়িতে ফিরবো না”

ফারিহার কথা শুনে মিস্টার আজাদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।ফারিহা মিস্টার আজাদ কে বলল না যে ফারিহার জিহাদের সাথে কথা হয়েছিল। কিছুক্ষণ পর মিস্টার আজাদ বললো,

“আজকে ভার্সিটিতে যেতে হবে না।সারাদিন রেস্ট কর।কাল থেকে ভার্সিটি,রেস্টুরেন্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে দেখবি আর কিছু মনে পরবে না।ঠিক আছে মামনি?”

ফারিহা কিছু না বলেই শুধু মাথা নাড়ালো।আরও কিছুক্ষণ পর হনুফা বেগম এসে ফারিহা আর মিস্টার আজাদকে ব্রেকফাস্ট করার জন্য বলল।ওরা দুজন একসাথে ব্রেকফাস্ট করতে গেল।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে ফারিহা আয়ানের কথা ভাবছে।আয়ান তো ওর হাতে কফি ছাড়া অন্য কফি খায় না।আজকে খেয়েছে তো?অন্যদিন তো ফারিহা ব্রেকফাস্ট তৈরি করতো,আয়ানের খাবারের সবদিক খেয়াল রাখতো।আজকে আয়ান ব্রেকফাস্ট করেছ তো?ফারিহয় আয়ানের কথা ভাবছে তখন মিস্টার আজাদ ফারিহাকে ভার্সিটির কথা বলাতে ফারিহার ধ্যান ভাঙলো।ফারিহা নিজেকে নিজে ধিক্কার দিলো, ও এখন আয়ানের কথা ভাবছে!

ব্রেকফাস্ট শেষে ফারিহা মাত্র টেবিল থেকে উঠেছে তখনই নওশীন দৌড়ে এসে ওকে জরিয়ে ধরল। নওশীনের পিছুপিছু শিহাব এসেছে। নওশীন ফারিহাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।তারপর বললো,

“ফারিহা তুই ঠিক আছিস?আমি কালকে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু আয়ান ভাইয়া আমাকে নেয়নি।সারারাত তোর জন্য চিন্তা করেছি”

নওশীনের কথা শুনে ফারিহা হেসে দিল।তারপর বললো, “এই বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেনো?আমি ঠিক আছে দেখ, এই চোখ তুলে তাকা”

নওশিন ফারিহা কে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো।ফারিহা নওশীনের চোখের পানি মুছে দিল।নওশীন ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো,

“জানিস কালকে রাত্রে আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এতো রাত হয়ে গিয়েছে বলে শিহাব নিয়ে আসেনি”

“একদম ঠিক করেছে শিহাব।তুই তো শুনেছিস আমি ঠিক আছে তাহলে এত অস্থির হচ্ছিস কেনো।কান্না বন্ধ কর হারামি”

ফারিহার কথায় নওশীন হেসে দিল।শিহাব ফারিহাকে বললো,
“তোকে দেখে তো এখন সুস্থ মনে হচ্ছে। কিন্তু আঙ্কেল যে বলল গতকাল নাকি তুই অনেক অসুস্থ ছিলি”

শিহাবের কথায় মিস্টার আজাদ বললো,
“হ্যাঁ গতকাল তো ভালো করে হাঁটতেও পারছিল না, অনেক দুর্বল ছিল।ওষুধ খেয়েছে তাই এখন ঠিক হয়েছে”

ফারিহা হেসে বললো, “আচ্ছা সেসব কথা পরে হবে এখন ব্রেকফাস্ট করবি আয়”

শিহাব কিছু বলতে যাবে কিন্তু ফারিহা বাধা দিয়ে বললো,
“তোরা যদি এখন বলিস যে ব্রেকফাস্ট করে এসেছিস তবুও আমি মানবোনা।ব্রেকফাস্ট করতেই হবে”

অজ্ঞতা উপায় না পেয়ে শিহাব আর নওশিন ফারিহা দের বাড়িতে ব্রেকফাস্ট করলো।তারপর ওরা ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে তিনজন গল্প করতে লাগল।আর মিস্টার আজাদ হনুফা বেগমকে ফারিহার খেয়াল রাখতে বলে পার্টি অফিসে যাওয়ার জন্য বের হলো।আজকে একটা ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে নাহলে ফারিহাকে একা ফেলে মিস্টার আজাদ যেতো না।
শিহাব আর নওশীন কখন থেকে উৎসুক চোখে ফারিহার দিকে তাকিয়ে আছে।ওরা সবকিছু জানতে চায়।ফারিহা ও আস্তে আস্তে ওদেরকে সব কিছু খুলে বললো।কেন হানিফ আহমেদ ফারিহাকে কিডন্যাপ করলো,আয়ান হানিফ আহমেদ কে কিভাবে মারলো, মিস্টার আজাদ আর আয়ান ফারিহাকে কিভাবে খুজে পেল।ফারিহা একে একে একে সব খুলে বলল।শিহাব আর নওশিন হা করে সব শুনছে সব শুনছে।নওশীন বললো,

“ওই হানিফ আংকেল এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করলো।তোদের খেয়ে পরে তোদের পিঠেই ছুরি মারলো।ওই লোকটার মৃত্যুই প্রাপ্য”

হনুফা বেগম পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নওশীনের কথা শুনে থমকে দাড়ালো।ফারিহা ওর হাত দিয়ে নওশীনের হাত চেপে ধরে ইশারায় চুপ করতে বললো। নওশীন ও বুঝেছে এখন এটা বলা ঠিক হয়নি তাই চুপ করে অন্য কথা বলতে লাগলো। হনুফা বেগম ও নিজেকে সামলে নিয়ে কিচেনে দিয়ে গেল।হানিফ আহমেদ যা করেছে তার জন্য যোগ্য শাস্তি পেয়েছে,কিন্তু উনি এত কষ্ট পাচ্ছে কেন!

কিছুক্ষণ পর শিহাব বললো, “ভাগ্যিস আয়ান ভাইয়া তোকে খুঁজে পেয়েছিল, না হলে যে কি হতো!”

ফারিহা নিচু কন্ঠে বলল, “হুম”

নওশীন সোফার উপর পা তুলে আসন ধরে বসে ফারিহার হাত ধরে বললো,

“ফারিহা তুই কি আয়ান ভাইয়ার কাছে আর ফিরে যাবি না?”

ফারিহা নীচু কন্ঠে বললো, “না”

“তুই যে আর ফিরে যাবি না সেটা নিয়ে আয়ান ভাইয়া তোকে কিছু বলেনি”

“হুম বলেছে তো। উনি বলেছে আমি উনার কাছে ফিরে যেতে উনি নাকি আমাকে ভালবাসে।কিন্তু তোদেরকে তো বলা হয়নি কিছুদিন আগে উনি জিহাদের সাথে ফোনে বলেছিল উনি নাকি এতদিন আমার সাথে সব নাটক করেছে।এখন বুঝতে পারছিনা ওনি সত্যি আমাকে ভালবাসে কিনা! আর বাপি ও আমাকে উনার কাছে যেতে দেবে না।তাই…”

ফারিহার কথার মাঝেই শিহাব বললো,
“একদম ঠিক করেছিস। তোরা উনার কাছে ফিরে যেতে হবে না।এই ক’টা মাস তোর চেহারা একদম পাল্টে গিয়েছে।সেই আগের হাসিমাখা চেহারাটা নেই।তোর কষ্ট দেখে আমারাও খুব কষ্ট পেতাম। এখন থেকে তুই একদম হ্যাপি থাকবি”

শিহাবের কথা শুনে ফারিহা হাসলো।ফারিহা এতদিন কষ্টে থাকলেও এখন যে সুখে থাকবে তার নয়।কারণ ফারিহা যে ওর ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে অনেক দূরে আছে।ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে দূরে থেকে কি ভালো থাকা যায়!

আয়ান আজকে অফিস যায়নি।আয়ানের আশেপাশে কিছু ভালো লাগছেনা।যে আয়াম সব সময় কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সেই আয়ানের আজকে কাজ করতে ইচ্ছা করছে না!তখন ফারিহার কথাগুলো শুনে আয়ানের মন খারাপ হয়ে গিয়েছে।আচ্ছা ফারিহা কি আর ওর কাছে আসবে না?ওর জীবন থেকে একেবারে চলে গেল!আয়ান যে ফারিহাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না।মেয়েটা বোঝেনা কেন?
আয়ান তো ফারিহাকে সরি বলেছে তবুও ফারিহা কেন এরকম করছে?আয়ান আর থাকতে না পেরে ফারিহার নাম্বারে কল দিলো।ফারিহার রুমে এসে দেখল ওর ফোন বাজছে।ফোন হাতে নিয়ে দেখে আয়ানের নাম্বার।ফারিহার খুব ইচ্ছা করছে আয়ানের সাথে কথা বলতে, আয়ানের কণ্ঠস্বর টা একটু শুনতে।কিন্তু ফারিহা নিজেকে সামলে কল কেটে দিল।
কল কাটে দেয়াতে আয়ানের প্রচুর রাগ হলো তবু আবার কল করলো।ফারিহা আবার কেটে দিলো। এভাবে আয়ান প্রায় 5/6 বারের মতো কল করলো।বারবার কল করছে দেখে ফারিহা বিরক্তি নিয়ে কল রিসিভ করে বললো,

“কি সমস্যা?দেখছেন না কল কেটে দিচ্ছি। তাহলে বারবার কেন কল দিচ্ছেন কেনো?”

ফারিহার বিরক্তি কণ্ঠস্বর শুনেও আয়ান শান্ত হলো। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে আয়ানের কাছে মনে হচ্ছে কয়েক বছর ফারিহার কণ্ঠস্বর শুনে না।আয়ান চুপ দেখে ফারিহা বলে উঠলো,

“কি হল? কিছু বলবেন নাকি শুধু শুধু জ্বালাতে কল করছেন?”

আয়ান শান্তকণ্ঠে বললো, “কেমন আছো?এখন শরীর ঠিক আছে তো?”

আয়ানের কথায় ফারিহা থতমত খেয়ে গেল।আয়ান ওর শরীর কেমন আছে সেটা জানার জন্য কল করেছে? ফারিহা এবার শান্ত কন্ঠে বললো,

“হুম আমি ভালো আছি”

আরো কিছুক্ষন দুজনেই নিশ্চুপ।আয়ান আর ফারিহা দুজনে একে-অপরের নিঃশ্বাস শুমছে। মনে মনে কত কথা বলছে কিন্তু মুখ ফুটে কেউ কিছু বলতে পারছেনা।এবার আয়ন বললো,

“আমার কাছে কবে ফিরে আসবে?”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর শক্ত কণ্ঠে বললো,

“আমি গতকালকেই বলে দিয়েছি আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরবো না”
ফারিহার কথা শুনে আয়ানের বুকটা মুচড় দিয়ে উঠলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here