স্রোতের টানে পর্ব-৩৫

0
3322

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩৫

ফারিহার কথা শুনে আয়ানের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

“আমাকে কি আর একটা সুযোগ দেওয়া যায় না? আমি মানছি আমি ভুল করেছি,কিন্তু ভুল শোধরানোর সুযোগ তো দাও”

ফারিহা শক্ত কন্ঠে বললো, “আপনি ভুল করেছেন তার জন্য ক্ষমা চেয়েছেন।আর আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছ। কিন্তু এখন তো আমাদের একসাথে থাকার কোন মানে হয়না।তাইনা??”

“কেনো?আমরা একসাথে থাকতে পারি না কেন?”

আয়ানের প্রশ্নে ফারিহা কি উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। তবুও মনে মনে কথা গুলো সাজিয়ে নিয়ে বললো,

“কারণ আপনি আমাকে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য বিয়ে করেছেন।কিন্তু এখন তো সত্যিটা জেনে গিয়েছেন তাহলে আমরা একসাথে থাকবো কেনো?”

“কারন আমি তোমাকে ভালোবাসি ফারিহা”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহার বুকটা ধ্বক করে উঠলো।আয়ান করুণভাবে বলছে যে ও ফারিহাকে ভালোবাসে।আয়ানের কথা শুনে ফারিহার মন নরম হচ্ছে যাচ্ছে কিন্তু এখন নরম হলে চলবে না।তাই ফারিহা তাচ্ছিল্য হেসে বললো,

“আমাকে ভালোবাসেন?আজকে আপনাকে একটা সত্যি কথা বলছি, আপনি ঐদিন জিহাদ ভাইয়ার সাথে সকালে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলেছিলেন।আমি সবকিছু শুনেছিলাম,এরপরেও বলবেন না যে আপনি আমাকে ভালোবাসে”

“ফারিহার কথা শুনে আয়ান মনে করার চেষ্টা করেছে যে ও জিহাদকে ফোনে কি বলেছে!সবকিছু মনে পড়লে আয়ান হাত মুঠ করে দেয়ালের জোরে ঘুষি দিল।ফারিহা ফোনের ওপাশ থেকে ঘুসির আওয়াজ শুনি কেঁপে উঠলো। আয়ান ফারিহাকে বোঝানোর জন্য অস্থির হয়ে বললো,

“ফারিহা আমি অস্বীকার করবো না।আমি জানি তুমি যা শুনেছো সব ঠিক শুনেছ কিন্তু তখন আমি প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ ছিলাম।আমি আর অন্য কিছু ভাবতাম না, শুধু আমার বাবা-মায়ের খুনের প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলাম যে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা টাও দেখতে পাইনি।কিন্তু্ কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না ফারিহা।প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।ফারিহা বুঝতে পারছে না আয়ান সত্যি বলছে নাকি মিথ্যা।ফারিহা জানে এখন যদি ও আয়ানের কাছে ফিরতে চায় তাহলে মিস্টার আজাদ ওকে যেতে দিবে না। আর ফারিহা মিস্টার আজাদকে আর কষ্ট দিতে চায় না।ফারিহা ভেবে নিয়েছিল ও ঘুরে দাঁড়াবে,আয়ান কে ভুলে নতুন করে জীবনটা শুরু করবে।তাহলে আয়ান কেন এখন ফোন করে ফারিহার মনটা দুর্বল করে দিচ্ছে। ফারিহা কান্না করছে সেটা আয়ানকে বুঝতে না দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো,

“আমার মনে হয় আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই ভালো।আমি ডি্ ডিভোর্স পেপারে সাইন করে পাঠিয়ে দিবো।আপনিও সাইন করে দিবেন”

ফারিহার কথা শুনে আয়ানের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল।আয়ান গর্জে উঠে বললো,
“ডিভোর্স? তুমি এসব কি বলছ ফারিহা??তুমি..”

আয়ানকে থামিয়ে দিয়ে ফারিহা বললো,
“হ্যাঁ আমি ঠিকই বলেছি। যেহেতু আমরা একসাথে থাকব না তাহলে ডিভোর্স হয়ে যাওয়া টাই ভালো”

কথাগুলো বলতে ফারিহার খুব কষ্ট হচ্ছে ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু ফারিহা নিজেকে শক্ত করে আজকে নরম হলে চলবে না।আয়ান রেগে বললো,

“তুমি চাইলেই কি আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে নাকি?আমি তোমাকে কখনো ডিভোর্স দেবো না। আজকে বলেছ ঠিক আছে,কিন্তু আর কখনো ডিভোর্সের কথা মুখেও আনবে না তাহলে খুব খারাপ হবে কিন্তু”

আয়ান আর এক মুহূর্ত দেরি না করে কল কেটে দিল।আয়ান কল কাটার পর ফারিহা শব্দ করে ডুকরে উঠলো।তারপর মোবাইলটা বুকের সাথে চেপে ধরে আস্তে আস্তে খাটের সাথে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসলো।ফারিহা জানেন না আজকে হঠাৎ আয়ানকে ডিভোর্সের কথা বললো কেন!কিন্তু এটাতো হওয়ারই ছিল।এভাবে তো চলতে পারে না,একদিন না একদিন ওদের সব সম্পর্ক শেষ করতেই হবে।সেটা যত তাড়াতাড়ি হবে ততোই ভালো।

.
এদিকে আয়ান কল কাটার সাথে সাথে ফোনটা জোরে আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলে।তারপর সোফায় বসে হাটুর উপর দুই হাত রেখে চুল টেনে ধরলো। আয়ানের প্রচুর রাগ লাগছে।ইচ্ছে করছে সবকিছু ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতে।ফারিহা ওর থেকে দূর গিয়েছে ঠিক আছে কিন্তু এখন পার্মানেন্টলি দূরে যাওয়ার চিন্তা করছে?ডিভোর্সের কথা শুনে আয়ানের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে।আয়ান কখনো ফারিহাকে ডিভোর্স দিতে পারবেনা।এটা অসম্ভব!
আয়ান এখানে ফারিহাকে ফিরিয়ে আনার কথা ভাবছে আর ওইদিকে ফারিহা ওকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা ভাবছে?আয়ান জানে ও অনেক বড় ভুল করেছে কিন্তু ভুল শোধরানোর একটা সুযোগ তো দিবে!
আয়ান সোফা থেকে উঠে বেডের পাশে টেবিলের ড্রয়ার থেকে গাড়ির চাবিটা নিয়ে হন হন করে বেরিয়ে পড়লো।জিহাদ আয়ানকে এভাবে নিচে নামতে দেখে অস্থির হয়ে বললো,

“স্যার কিছু হয়েছে?আপনাকে এরকম লাগছে কেন? কোথায় যাচ্ছেন স্যার?কোথাও কোনো গন্ডগোল হয়েছে?”

“আমি ফারিহাদের বাড়িতে যাচ্ছি”

আয়ান আর কিছু না বলে হন হন করে বেরিয়ে গেল। জিহাদ ভাবছে ওর কি এখন আয়ানের সাথে যাওয়া ঠিক হবে?কিন্তু আয়ানকে দেখে তো মনে হলো রেগে আছে।তাছাড়া আয়ান তো যেতে বলেনি।তাহলে আগবাড়িয়ে যাওয়াটা ঠিক হবেনা।তাই জিহাদ ফিরে এসে সোফায় বসে আবার নিজের কাছে মন দিল কিন্তু আয়ানের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে হঠাৎ এভাবে রেগে গেল কেনো!

.
নওশীন আর শিহাব অনেকক্ষণ ফারিহার সাথে গল্প করে তারপর ভার্সিটির ক্লাসের টাইম হলে ওরা চলে যায়।ফারিহাও চেয়েছিল আজকে থেকে ভার্সিটিতে যাতে কিন্তু মিস্টার আজাদ বারণ করেছে।বলেছে, আরো কিছুদিন রেস্ট নিতে।মিস্টার আজাদ জানে আজকে ভার্সিটিতে যেতে দিলে ফারিহা রেস্টুরেন্টও যাবে।আর মিস্টার আজাা চায়না ফারিহা এখন কোন কাজ করুক।
মিস্টার আজাা ঠিকই ভেবেছিল, ফারিহা অনেকদিন রেস্টুরেন্টে যায় না তাই ভেবেছিলো আজকে ভার্সিটিত শেষে রেস্টুরেন্টে যাবে। কিন্তু মিটার আজাদ যেতে দিল না।অফিসে যাওয়ার আগে মিস্টার আজাদ হনুফা বেগম কে বারবার করে বলে গিয়েছে আজকে যেন ফারিহা কোথাও না যায়,
সারাদিন যেন রেস্ট নে।

ফারিহার একা একা ভালো লাগছে না তাই নিচে আসে।হনুফা বেগম কিচেনে রান্না করছিল ওখানে বসে অনেকক্ষণ হনুফা বেগমের সাথে গল্প করে। এই কয়দিন ফারিহার উপর দিয়ে যেমন ঝড় গিয়েছে তেমনি হনুফা বেগম উপর দিয়েও কম কিছু যায়নি।ফারিহা জানে হনুফা বেগম হানিফ আহমেদকে অনেক ভালোবাসতেন।আর নিজের ভালোবাসার মানুষ এরকম মৃত্যু কেউ মেনে নিতে পারে না। কিন্তু তারপরও হনুফা বেগম অনেক স্ট্রং রয়েছেন।সবসময় কেমন হাসিমুখে কাজ করছে,ফারিহার সাথে হাসিমুখে কথা বলছে।ফারিহা হনুফা বেগম কে যত দেখছে তত অবাক হচ্ছে।এবাড়িতে আর হানিফ আহমেদের কথা ওঠেনি।ফারিহা ওইসব তিক্ত স্মৃতি মনে করতে চায় না আর হনুফা বেগমও নিজের স্বামীর কুকীর্তির কথা মনে করতে চায় না।সবাই সবকিছু ভুলে যেতে চায়।ফারিহা আর হনুফা বেগম অন্য বিষয়ে গল্প করছে।

হনুফা বেগম ফারিহার ছোটবেলার কথা বলছে আর ফারিহা খিলখিল করে হাসছে। ছোটবেলা ফারিহা অনেক দুষ্টু ছিলো। সব সময় হনুফা বেগমকে ফারিহার পেছনে দৌড়াতে হতো।সব শুনে ফারিহা জোরপ জোরে হাসছে। হনুফা বেগম ফারিহার হাসিমুখ দেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।ফারিহা এভাবে আগুনের কাছে বসে আছে দেখে কিছুক্ষণ গল্প করে হনুফা বেগম ফারিহাকে বললো,

“অনেক গল্প হয়েছে।এবার রুমে গিয়ে রেস্ট কর”

“না মনি আমার এখানেই ভালো লাগছে”

“এভাবে আগুনের কাছে থাকলে তুই আরো অসুস্থ হয়ে পরবি তারপর স্যার আমাকে বকাবকি করবে।আমি রান্না শেষে তোর রুমে গিয়ে গল্প করবো এখন রুমে যা”

“ওকে” ফারিহা উপরে চলে আসে।
রুমে এসে ফারিহা এদিক ওদিক ঘুরছে। ওর কিছু ভালো লাগছেনা।তারপর ফারিহা ওর স্টাডি টেবিলের কাছে যায়।তারপর অনেকক্ষণ বই-খাতা গুলো নাড়াচাড়া করে টেবিলের নিচে ড্রয়ার খুলে।ড্রয়ার খুলেই ফারিহার মুখে হাসি ফুটে উঠে ওর আর্ট খাতা!এই খাতাটা মিস্টার আজাদ ফারিহাকে কিনে দিয়েছিল,ফারিহা অনেক ভালো আর্ট করতে পারে। তবে ও সবসময় আর্ট করে না।বিশেষ কিছু সময় আর যখনই মন খারাপ হয় তখনই রং পেন্সিল নিয়ে বসে।ফারিহা খাতাটা হাতে নিয়ে দেখে খাতার পাশে রংপেন্সিল সহ সব আছে,,ফারিহা ওগুলো বের করে আনে।অনেকদিন না ধরার ফলে ধুলোবালি জমে আছে।ফারিহা খাতাগুলো ঝেড়ে সব রং পেন্সিল নিয়ে রুমের মাঝখানে ফ্লোরে আসন পেতে বসলো। তারপর খাতাটা খুলে একে একে ওর আগের করা আর্ট গুলো দেখছে আর মুখে মুচকি হাঁসি লেগেই আছে।তারপর ফারিহা একটা খালি পৃষ্ঠা বের করে রং তুলি হাতে তুলে নে।

আয়ান আধাঘন্টার মধ্যেই চলে ড্রাইভ করে ফারিহার দের বাড়ির সামনে এসে থামলো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে হনহন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো।আয়ানকে দেখে বডিগার্ডরা বাধা দিতে সাহস করলো না।আয়ান ভেতরে ঢুকিয়ে ড্রইংরুমে কাউকে দেখতে পেল না। কিছু দূরে একটা সার্ভেন্ট কাজ করছিল। আয়ান সার্ভেন্ট তাকে ধমক দিয়ে বললো,

“ফারিহা কোথায়?”

এভাবে হঠাৎ কারোর ধমকে সার্ভেন্ট টা কেঁপে উঠলো।সার্ভেন্টটা কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আয়ান সার্ভেন্টটার কথা শোনার অপেক্ষা না করে হনহন করে উপরে চলে গেল।সার্ভেন্ট বোকার মত আয়ানের যাওয়ার দিকে তাকালো।হঠাৎ এভাবে এসে ওকে ধমক দিল কেনো?

আয়ান উপর এসে ফারিহার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে রাগ কমানোর চেষ্টা করলো।তারপর নিজেকে সামলে দরজায় নক করলো।দরজা ভেতর থেকে লাগানো ছিল না তাই আর নক করতেই একটু ফাঁক হয়ে গেলো।আয়ান দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখে ফারিহা আয়ানের বিপরীত দিকে উপুড় হয়ে ফ্লোরে বসে কি যেন করছে।আয়ান আস্তে আস্তে হেঁটে ফারিহার কাছে গেল।তারপর পিছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখে ফারিহা আর্ট করছে। আয়ানের এবার প্রচুর রাগ উঠছে ওকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে এখন এখানে বসে বসে আর্ট করা হচ্ছে?এদিকে আয়ানের চিন্তায় পাগল পাগল অবস্থা আর ওইদিকে এই মেয়ে দেখো!
আয়ান একহাতে ফারিহাকে ধরে টান দিয়ে ফ্লোর থেকে উঠিয়ে পাশে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে রক্তিম চোখে ফারিহার দিকে তাকালো।হঠাৎ এভাবে আক্রমণে ফারিহা হকচকিয়ে গেল। ভীতু চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো আয়ান।আয়ানকে দেখে ফারিহা চোখ বড় বড় করে তাকালো।এভাবে হঠাৎ এসে কেউ টেনে তোলায় ফারিহা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল এখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।তবুও ফারিহা আয়ানের রাগী চোখ দেখে ভয় পাচ্ছে।ঢোক গিলে আমতা আমতা করে বললো,

“আপ্ আপনি এখানে?”

আয়ান ফারিহাকে দেয়ালের সাথে লাগিয়ে দুই হাত দেয়ালের সাথে আটকে ফারিহার মুখের সামনে মুখ নিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।ফারিহা যখন ডির্ভোসের কথা বলছে তখন থেকেই আয়ানের প্রচুর রাগ হচ্ছে।এখন নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।আয়ান হঠাৎ ফারিহার গলা মুখ গুঁজলো।এদিকে আয়ান ফারিহার গলায় মুখ গুঁজে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ওদিকে ফারিহা একদম বরফের মত সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here