#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩৮
ড্রইংরুমে বড় সোফাটায় ফারিহা শুয়ে আছে।আর ডাক্তার রহমান ওকে চেকাপ করছে।ডাক্তার রহমান ওদের ফ্যামিলি ডাক্তার।আর এদিকে মিস্টার আজাদ অস্থিরভাবে পায়চারী করছে। ফারিহা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়াতে মিস্টার আজাদ প্রচুর ঘাবড়ে যায়।এমনিতে মেয়েটাকে এতদিন আয়ান অত্যাচার করেছে।মিস্টার আজাদ ভেবেছিল ওনার কাছে ফারিহা ভালো থাকবে কিন্তু এখানে এসে তো আরও অসুস্থ হয়ে পরলো!হনুফা বেগম একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আর পাশে বাড়ির আরো অনেক সার্ভেন্ট দাঁড়িয়ে আছে।সবাই চিন্তিত!মিস্টার আজাদ অস্থির হয়ে ডক্টর রহমান কে বললো,
“ওর কি হইছে?হঠাৎ অজ্ঞান হলো কেন? আর এখনো জ্ঞান ফিরছে না কেনো?”
ডাক্তার রহমান হেসে বলল, “মিস্টার চৌধুরী চিন্তা করবেন না আপনার মেয়ে একদম ঠিক আছে”
“কি বলছেন? ঠিক আছে!ঠিক থাকলে অজ্ঞান হলো কেনো?”
মিস্টার আজাদের অস্থিরতা দেখে ডাক্তার রহমান হাসলো।তারপর বললো,
“চিন্তা করবেনা এই সময় এটা স্বাভাবিক। মিষ্টি খাওয়ান আপনি নানা হতে চলেছেন”
মিস্টার আজাদ অবাক হয়ে একটু পিছিয়ে গেল। তারপর ফারিহা দিকে তাকালো।ডাক্তার রহমান হেসে বললো,
“কি হলো অনেক বেশি অবাক হয়েছেন?আনন্দ হওয়ারই কথা,সবারই নাতি-নাতনির শখ থাকে আপনার আনন্দটা আমি বুঝতে পারছি।আর চিন্তা করবেন না আপনার মেয়ে একদম ঠিক আছে। ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরবে।আর এই কিছুদিনের মধ্যেই হসপিটালে গিয়ে একবার চেক করে নিবেন”
মিস্টার আজাদ একবার ফারিহার দিকল তাকিয়ে হেসে বললো, “আপনাকে আমি কি বলে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না।সত্যি আমার মেয়ে মা হতে চলেছে?”
ডাক্তার রহমান হেসে বললো, “হ্যাঁ সত্যি আর আমি কিন্তু খালি মুখে ধন্যবাদ নেবো না। মিষ্টি কই?আমার কিন্তু মিষ্টি চাই আর এখন আসছি”
“হ্যাঁ আমি আজকেই আপনার চেম্বারে মিষ্টি পাঠিয়ে দিবো। আসুন আপনাকে এগিয়ে দিচ্ছি”
ডাক্তার রহমান উনার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললো, “না না এগিয়ে দিতে হবে না।আপনি এখন ফারিহার কাছে থাকুন।ওর একটু খেয়াল রাখবেন”
মিস্টার আজাদ একটু হেঁসে মাথা নাড়ালো।তারপর ফারিহার কাছে গিয়ে বসলো। উনার এইটুকু মেয়ে আজকে মা হতে চলেছে!সেই কিছুদিন আগেও গুটিগুটি পায়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াতো তারপর বিয়ে হয়ে গেল। এখন মা হতে চলেছে!হঠাৎ মিস্টার আজাদের আয়ানের কথা মনে পড়লো।নানা হবার খবর শুনে মিস্টার আজাদ এত খুশি হয়েছিল যে ভুলেই গিয়েছে ফারিহার গর্ভের সন্তানের বাবা আয়ান।যেই আয়ানের কাছ থেকে পায় ফারিহাকে দূরে রাখতে চায় এখন ফারিহা সেই আয়ানের সন্তানের মা হতে চলেছে!মিস্টার আজাদ এবার চিন্তিত হয়ে পরলো।
.
প্রায় আধাঘণ্টা পর ফারিহার জ্ঞান ফিরলো। ফারিহা মাথায় হাত দিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসলো।ফারিহার জ্ঞান ফিরেছে দেখে মিস্টার আজাদ ফারিহাকে ধরে উঠিয়ে ফারিহার পেছনে বালিশে ঠেস দিয়ে বসলো।ফারিহা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে হনুফা বেগম হাসিমুখে ফারিহার দিকে তাকিয়ে আছে।বাসার সব সার্ভেন্ট,দারোয়ান আঙ্কেল, ড্রাইভার আঙ্কেল সবার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।আসলে এখানে কি হচ্ছে ফারিহা বুঝতে পারছে না।ফারিহা মিস্টার আজাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সবাই এখানে কেন?আর আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো?”
মিস্টার আজাদ হনুফা বেগমের দিকে তাকালে হনুফা বেগম হাসিমুখে বললো, “সেসব কথা পরে হবে।তুই এখন রুমে চল একটু বিশ্রাম কর।তারপর খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে”
“কেনো?আমার কি হয়েছে?আমি কি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম?ও মনি বলোনা কি হয়েছে??”
হনুফা বেগম আর কথা আটকে রাখতে পারলো না। হাসিমুখে বললো, “মামনি তুই মা হতে চলেছিস?”
হনুফা বেগমের কথা শুনে ফারিহার দুই ঠোঁট নিজের অজান্তে আলাদা হয়ে গেল।ফারিহা হা করে একবার হনুফা বেগমকে আর একবার মিস্টার আজাদকে দেখছে।মিস্টার আজাদ মাথা নেড়ে বললো যে হনুফা বেগমের কথা সত্যি।ফারিহার চোখে পানি চিকচিক করছে।ফারিহা একহাত ওর পেটের মধ্যে রাখলো!ও মা হতে চলেছে?মা হওয়ার অনুভূতি যে কতটা আনন্দের সেটা ফারিহা প্রকাশ করতে পারছে না।ছল ছল চোখে মিস্টার দিকে তাকাচ্ছে।মিস্টার আজাদ ফারিহার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,
“আমি আজকে খুব খুশি।এই বাড়িতে একটা ছোট্ট ফারিহা আসবে।আমাকে নানাভাই বলে ডাকবে।ফারিহা তোকে বলে বোঝাতে পারবোনা আমি আজকে কতটা খুশি”
ফারিহা মিস্টার আজাদ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।মিস্টার আজাদ হেসে ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“এই পাগলি মেয়ে কাঁদছিস কেনো?”
“আমি্ আমি সত্যি মা হতে চলেছি?”
“হ্যাঁ মা সত্যি।আর তুই একদম চিন্তা করিস না তুই একা নস আমি সব সময় তোর পাশে আছি।বাবা না থাকলে কি হয়েছে আমার নাতি/নাতনির জন্য এই নানা তো আছে।”
মিস্টার আজাদের কথা শুনে ফারিহার আয়ানের কথা মনে পড়লো।ও আয়ানের সন্তানের মা হতে চলেছে! এখন তো আরো বেশি করে আয়ানের সাথে জড়িয়ে গেল।যেখানে ফারিহা চাইছে আয়ানের থেকে দূরে থাকতে,আয়ানের সব সৃতি মুছে দিতে সেখানে ওর গর্ভে এখন আয়ানের সন্তান।ফারিহা যত আয়ানের থেকে দূরে যেতে চাচ্ছে ভাগ্য ততো আয়ানকে ওর সাথে বেঁধে দিচ্ছে।ফারিহাকে অন্যমনস্ক থেকে মিস্টার আজাদ বললো,
“আচ্ছা এসব কথা বাদ দে।এই আনন্দের মুহূর্তে আমি ওই ছেলেটার কথা মনে করে খুশি নষ্ট করতে চাই না।তুই অনেক দুর্বল রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর”
মিস্টার আজাদ হনুফা বেগমের দিকে তাকালে হনুফা বেগম মাথা নেড়ে ফারিহাকে ধরে বসা থেকে উঠালো।ফারিহা কিছু না বলে চুপচাপ হনুফা বেগমের সাথে উপরে নিজের রুমে গেল।আর মিস্টার আজাদ খুশিমনে অফিসে গেল। আজকে সবাইকে মিষ্টি খাওয়াবে।মিস্টার আজাদের আজকে অফিসে একটি ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে তাই শুধু এক ঘন্টার জন্য যাচ্ছে।আজকের সারাদিন মিস্টার আজাদ নিজের মেয়ের সাথে কাটাবে।
হনুফা বেগম রুমে নিয়ে গিয়ে ফারিহাকে বিছানায় বসালো।তারপর ফারিহা মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“এখানে চুপচাপ বস।আমি তোর জন্য ফলের জুস নিয়ে আসছি”
ফারিয়া কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়লো।ফারিহয়র আজকে আয়ানের কথা খুব মনে পড়ছে।আচ্ছা যদি জানতে পারে ও বাবা হতে চলেছে।তাহলে আয়ানের কেমন রিএকশন হবে?ফারিহার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে!
ফারিহা আবার ওর পেটে হাত রাখলো।ও মা হবে! ফারিহার এটা ভেবে আরো ভালো লাগছে যে মিস্টার আজাদ আয়ানকে ঘৃণা করলেও আয়ানের সন্তানকে দূরে সরিয়ে দেয়নি। মিস্টার আজাদ চাইলে বলতে পারতো এখন ফারিহাকে এবরশনের করে নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে।কিন্তু মিস্টার আজাদ সেটা করেনি।উল্টো ফারিহাকে বলেছে ওর সন্তানের জন্য বাবার দরকার নেই,নানা আছে।ফারিহা জানে ওর বাপী অনেক ভালো,আয়ান খারাপ হলেও আয়ানের সন্তানকে কখনো কোনো অবহেলা করবে না।এতদিন আয়ানকে ছেড়ে একা থাকতে ফারিহার মন খারাপ হতো,, কষ্ট হতো।কিন্তু এখন তো ওর সাথে ওর বাচ্চা আছে।ফারিহা মুচকি হাসলো।
.
আয়ান অফিসে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল তখন জিহাদ হন্তদন্ত করে আয়ানের কেবিনে ঢুকে।আয়ান চোখ তুলে জিহাদকে দেখে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“নক করে ঢুকতে পারলে না?সেই ম্যানার্স টুকু নেই তোমার?”
জিহাদ আয়ানের কথা শুনেও, না শোনার ভান করে অস্থির হয়ে বললো,
“স্যার ম্যাডামের ব্যাপারে খবর আছে”
জিহাদের কথা শুনে আয়ান চমকে ওঠে ফাইল থেকে চোখ তুলে জিহাদের দিকে তাকালো।তারপর বললো,
“ফারিহার?কি হয়েছে ওর?আমি বলেছিলাম তোমাদেরকে ওর খেয়াল রাখতে।ওর কিছু হলে তোমাদের একটা কেউ আমি আস্ত রাখবো না”
আয়ানের রাগ দেখে জিহাদ একটুও ভয় পেলোনা।উল্টো হেসে বলল, “স্যার আমার কথাটা তো একটু শুনুন”
“কি কথা তাড়াতাড়ি বলো।ফারিহার তো এখন ভার্সিটিতে থাকার ক…”
“স্যার আপনি বাবা হতে চলেছেন”
জিহাদের কথায় আয়ানের কথা থমকে গেল।আয়ান আসলে বুঝতে পারছেনা জিহাদ কি বলছে?আয়ান ভেবেছে ও হয়তো ভুল শুনেছে তাই আবার জিজ্ঞেস করলো,
“কি বললে?”
জিহাদ হেসে বললো, “স্যার আপনি বাবা হতে চলেছেন।আমাদের ম্যাম প্রেগনেন্ট”
আয়ান অবাক চোখে জিহাদের দিকে তাকালো। আয়ান আসলে কিভাবে ওর খুশি প্রকাশ করবে বুঝতে পারছে না।ও একদম থমকে গিয়েছে। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।জিহাদ আয়ানের রিয়েকশন দেখে হেসে বললো,
“স্যার ম্যামের বাড়ির একটা সার্ভেন্টের সাথে আমার কথা হতো ম্যামের খোঁজ খবর রাখার জন্য।ওই সার্ভেন্টটাই কিছুক্ষণ আগে আমাকে ফোন করে বলল।আমি শুনেই আপনার কাছে এসেছি খবরটা দেয়ার জন্য”
আয়ান টেবিলের উপর হাত রেখে দুই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল।আয়ান আজকে কত খুশি বলে বোঝাতে পারবে না।আয়ান বাবা হবে!আয়ানের এখনো কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না।জিহাদ হেসে বললো,
“স্যার কি হলো কিছু বলছেন না কেনো?আপনি বাবা হতে চলেছেন।আজকে কিন্তু আমাদের পার্টি চাই”
জিহাদের কথা শুনে আয়ান হাসলো।তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে হাত দিয়ে চুলগুলো পেছনে ঠেলে উঠে দাঁড়ালো।তারপর চেয়ার থেকে পর কোটটা নিলো।জিহাদ জিজ্ঞেস করলো,
“স্যার কোথায় যাচ্ছেন?”
আয়ান হাসিমুখে বললো, “কোথায় আবার!আমার বাচ্চাটার মায়ের কাছে”
চলবে…