#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩৯
আয়ান ফারিহাদের বাড়িতে এসে দেখে বসার ঘরে কেউ নেই।কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে হনুফা বেগম কিচেন থেকে হাতে জুসের গ্লাস নিয়ে এদিকে আসছে।হনুফা বেগম আয়ানকে দেখে অবাক হয়ে বললো,
“তুমি এখানে?”
আয়ান হাসিমুখে বললো, “হুম ফারিহা কোথায়? উপরে আছে তাইতো?আমি দেখছি।”
এটা বলে আয়ান হনুফা বেগমের কথার অপেক্ষা না করে উপরের দিকে চলে যেতে গেলো।হনুফা বেগম তড়িঘড়ি করে বললো, “এই আয়ান, শোনো।এই..”
কিন্তু কে শুনে কার কথা!আয়ান তো আজকে কারোর কথা শোনার পাত্র নয়।আজকে ফারিহার কাছে যাবেই।আয়ান উপরে ফারিহার রুমের সামনে এসে তারপর দরজা ধাক্কা দিল।ফারিহা ভেবেছিল হনুফা বেগম এসেছে তাই দরজার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখন আয়ানকে দেখে চুপ করে গেল।ফারিহা অবাক হয়ে আয়ান কে দেখছে।আজকে প্রায় এক সপ্তাহ পর আয়ানকে দেখছে। এক সপ্তাহ আগেও বিষন্ন মুখে আয়ানকে দেখেছিলো।কিন্তু আজকে আয়ানের মুখ থেকে হাসি সরছেই না।ফারিহা অবাক হয়ে ভাবলো আয়ান কি সব জেনে গেল নাকি!
ফারিহাকে আরও অবাক করে দিয়ে আয়ান রুমে এসে বিছানা থেকে ফারিহাকে কোলে তুলে নিল।তারপর ঘুরতে ঘুরতে হেসে বললো,
“ফারিহা ফারিহা ফারিহা আমি কি আজকে সব সত্যি শুনলাম?আমি বাবা হতে চলেছি?তুমি জানো না আমি আজকে কত্তো খুশিইই”
আয়ানকে এভাবে ঘুরতে দেখে ফারিহা ভয় পেয়ে আয়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো।তারপর ভীতু কন্ঠে বললো,
“আরে আরে কি করছেন?পড়ে যাবো তো,,নামান আমাকে”
আয়ান ঘুরা থামিয়ে ফারিগ্হাকে কোলে নিয়েই ফারিহার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
“পরবে না।আমি আছি তো”
ফারিহা এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললো, “আমাকে নামান প্লিজ।আমার ভয় লাগছে”
আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে হাসে তারপর ফারিহাকে কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় বসালো। তারপর নিজের বিছানায় বসে ফারিহার হাত ধরে উৎসুক চোখে তাকিয়ে বললো,
“ফারিহা জানো,কিছুক্ষণ আগে যখন জিহাদ আমাকে বলল আমি বাবা হতে চলেছি।তখন আমি প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারিনি।আচ্ছা ফারিহা তোমারও অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে তাইনা?”
ফারিহার চুপ করে আয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে।আয়ানকে কখনো ফারিহা এতো হাসিমুখে দেখেনি।আয়ান সব সময় রাগী আর গম্ভীর মুখে থাকতো। এই প্রথম আয়ানকে এত হাসিখুশি দেখছে।ফারিহা কিছু বলছে না দেখে আয়ান ফারিহার হাত নেড়ে আবার বললো,
“এই ফারিহা তুমি শুনছো?আমরা বাবা মা হতে চলেছি।আমাদের একটা ছোট্ট বাবু হবে। ওর ছোট ছোট হাত পা দিয়ে খেলবে। সারাবাড়ি হেঁটে বেড়াবে। আমি না আমাদের বাবুর রুমটা অনেক সুন্দর করে সাজাবো”
আয়ানের হাসি মুখে জল ঢেলে দিয়ে ফারিহা বললো,
“এতোটা আশা করা ঠিক না।ও আমার বাচ্চা আমার সাথেই থাকবে”
ফারিহার কথা শুনে আয়ানের মুখে বিষন্নতার ছায়া নেমে এলো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“তোমার সাথে থাকবে মানে?”
“আমার সাথে থাকবে মানে আমার সাথে থাকবে। আমরা দুজন তো সারা জীবনের জন্য আলাদা হয়ে যাবো।কিন্তু আমার বাচ্চা আমার কাছেই থাকবে”
আয়ান অবাক হয়ে বললো, “ফারিহা!এখনো তুমি আমাদের আলাদা হওয়ার কথা ভাবছো?আমাদের বেবি আসতে চলেছে এখন তো আমরা একসাথে থাকতে পারি।আমরা একসাথে ওকে বড় করবো”
আয়ানের বিষন্ন মাখা মুখটা ফারিহার ভালো লাগছে না।তবুও শক্ত কন্ঠে বললো,
“আমার বাচ্চাকে বড় করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। আপনার প্রয়োজন লাগবেনা আর আমার পাশে আমার বাপি আছে”
আয়ান উৎসুক চোখে ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ফারিহা তুমি তো তোমার বাবাকে অনেক ভালোবাসো তাই না?তুমি জানো একটা সন্তানের জন্য তার বাবার ভালোবাসাটা কতটা জরুরি।তাহলে আমার সন্তানের কাছ থেকে কেনো তার বাবা কে আলাদা করেছো??”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহা চুপ করে গেল।আয়ানের প্রশ্নের উত্তর ফারিহার কাছে নেই।আয়ান তো ঠিকই বলেছে,একটা বাচ্চার জন্য তার বাবার আদর ভালোবাসা কতটা জরুরী সেটা ফারিহা জানে।তাহলে কেন জন্মের আগে ওর বাচ্চাকে তার বাবার কাছ থেকে দূরে করছে?ফারিহা কিছু বলছে না দেখে আয়ান ফারিহার হাত ধরে বললো,
“ফারিহা আমাদের বেবির বাবা মা দুজনেরই ভালোবাসা পাবে।তুমি কি চাও জন্মের পর ওর বাবাকে নিয়ে কেউ কোনো কথা শোনাক?আর আমি থাকতে সেটা হতে দিবো না”
ফারিহা চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান কিছুক্ষণ ফারিহার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মাথা নিচু করে ফারিহার পেটে চুমু খেলো।আয়ানের কাজে ফারিহা কেঁপে উঠলো।আয়ান ফারিহার পেটে মুখ গুঁজেই বললো,
“আবার বাচ্চা বাবা-মা দুজনকে একসাথে পাবে।বাবা-মা আলাদা থাকলে সেটা বাচ্চাদের উপর খারাপ প্রভাব ফেলে যেটা আমি আমার বাচ্চার সাথে হতে দেবো না।আমার বেবি! তাড়াতাড়ি চলে এসো ঠিক আছে?”
আয়ান এমনভাবে বলছে মনে হয় যেন বাচ্চাটা ওর সামনে আছে।আয়ানের পাগলামি দেখে ফারিহা হাসলো। ফারিহার হাসিমুখ দেখে আয়ান কিছুটা শান্ত হয়।ফারিহা যখন বলেছিল যে ও বাচ্চাকে আয়ানের থেকে দূরে রাখবে তখন আয়ানের ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়।এখন কিছুটা শান্ত লাগছে।
হঠাৎ দরজায় নক তোরা দুজনের ধ্যান ভাঙলো। ওপাশ থেকে হনুফা বেগম ফারিহাকে ডাকছে,
“ফারিহা ফারিহা..”
হনুফা বেগম ডাক শুনে ফারিহা আয়ানের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বললো, “মনি আসো”
হনুফা বেগম জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।ভেতরে এসে দেখে আয়ান ফারিহার কাছে বিছানায় বসে আছে।হনুফা বেগম একবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে তারপর ফারিহার কাছে গিয়ে জুসের গ্লাসটা ফারিহার হাতে দিয়ে বললো,
“একটা খেয়ে নে।ডাক্তার বলেছে তোর শরীর অনেক দুর্বল।এখন থেকে বেশি বেশি খেতে হবে”
হনুফা বেগমের কথা শুনে আয়ান বললো, “হুম ফারিহা মনি কিন্তু ঠিকই বলেছে।এখন কিন্তু তুমি একা না তোমার সাথে আমার বাচ্চাও আছে। তোমাকে সুস্থ থাকতে হবে,,তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও”
ফারিহা একটু হেসে কিছু না বলে জুসের গ্লাসে চুমুক দিল।ফারিহা সবটা জুস খেয়ে হনুফা বেগমের হাতে গ্লাসটা দিতে যাবে তখন মিস্টার আজাদ হন্ততদন্ত করে ফারিহার রুমে ঢুকলো।তারপর আয়ানকে দেখেই বললো,
“তুমি আবার চলে এসেছো?”
আয়ানের আজকে একটুও রাগ হচ্ছে না।উল্টো দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
“তো আসবো না?আমি বাবা হচ্ছি তাই আপনাকে মিষ্টি খাওয়াতে আসলাম”
আয়ানের কথা শুনে মিস্টার আজাদের হাসি পাচ্ছে। তবুও গম্ভীর স্বরে বললো,
“তোমার আমাকে মিষ্টি খাওয়াতে হবেনা। আমি অলরেডি আমার অফিসের সবাইকে মিষ্টি খায়িয়ে এসেছি”
আয়ান হেসে বললো, “বাব বাহ,,আমার শশুর মশাই তো দেখি আমার থেকেও ফাস্ট”
মিস্টার আজাদ আয়ানের কথার উত্তরে কিছু বলল না শুধু হাসলো।তারপর কিছুক্ষন পর বললো,
“তুমি ভেবোনা এখন ফারিহাকে তোমার বাড়িতে নিয়ে যাবে।ফারিহা কিন্তু আমার কাছেই থাকবে”
“হুম ফারিহার যদি ইচ্ছে হয় এই বাড়িতে থাকতে তাহলে থাকুক।কিন্তু একবারে আমার থেকে দূরে সরে যেতে পারবেনা।আর ফারিহা চাইলেও আমি সেটা হতে দেবো না”
আয়ানের কথার প্রতি উত্তরে মিস্টার আজাদ কিছু বললো না।কারণ আজকে মিস্টার আজাদের এখন আয়ানের উপর রাগ দেখাতে ইচ্ছে করছে না।
মিস্টার আজাদ আয়ানকে বকাবকি করে এই বাড়িতে আসার জন্য আর আয়ান উল্টো এখানে ফারিহার হাত ধরে বসে আছে!মিস্টার আজাদ জানল এখন আয়ানকে কিছু বললেও লাভ হবে তাই কিছু বলেনি।আর আয়ান তো আজকে কত খুশি সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।
.
ভার্সিটি শেষে দুপুরের দিকে নওশিন আর শিহাব আসে।আজকে ফারিহা ভার্সিটিতে যায়নি বলে শিহাব মিস্টার আজাদকে কল করেছিল।তখন জানতে পারে যে ফারিহা মা হতে চলেছে। নওশীন তো তখন থেকেই লাফালাফি শুরু করেছে ফারিহার কাছে আসার জন্য।নওশিন ফারিহা রুমে ঢুকে দৌড়ে গিয়ে ফারিহাকে জরিয়ে ধরে খুশি হয়ে বললো,
“ফারিহা আমি কী ঠিক শুনেছি?আমি খালামণি হতে চলেছি! উফ আমার যে কত খুশি লাগছে।তোর একটা ছোট্ট বাবু হবে”
নওশীনের কথা শুনে ফারিহা হাসছে তখন শিহাব বললো, “আমাদের এইটুকু মেয়ে ফারিহা নাকি মা হবে ভাবা যায়!”
শিহাবের কথা শুনে ফারিহা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। নওশিন শিহাবের কথার উত্তরে বললো,
“আহারে এভাবে বলেছি না। মেয়ে টা লজ্জা পাচ্ছে”
নওশীনের কথা শুনে শিহাব জোরে হেসে দিলো। হাসতে হাসতে আয়ানের দিকে চোখ পড়তেই শিহাব একটু অবাক হল।তারপর হাসিমুখে বললো, “কংগ্রাচুলেশন”
আয়ান হেসে বললো, “থ্যাংকস”
শিহাব ফারিহার পাশে বসতে বসতে বললো, “শুনেছিলাম তুই নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিস?এখন শরীরের কী অবস্থা?”
শিহাবের কথার উত্তর হনুফা বেগম বললো, “হ্যাঁ এখন ভালো আছে। ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছে”
নওশীন বললো, “ফারিহা এখন কিন্তু উত্তর নিজের খেয়াল রাখতে হবে।এতদিন শরীরে অবহেলা করেছিস ঠিক আছে।কিন্তু এখন তোর মধ্যে তোর বাচ্চা বেড়ে উঠছে”
নওশীনের কথা শুনে ফারিহা বললো, “হুম”
আজকে সবাই খুশি।আয়ান শুধু ফারিহাকে দেখছে, মা হওয়ার খবরটা শোনার পর থেকে যেন ফারিহার চেহারার উজ্জ্বলতা বেড়েছে।কিছুক্ষণ পরপর লজ্জা পাচ্ছে আবার খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠছে।ফারিহাকে আজকে সত্যি অন্যরকম লাগছে।আয়ান চোখ ফেরাতে পারছে না।
চলবে…