#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৪২
মিস্টার আজাদ ফারিহার হাতে এতগুলা ফল দিয়ে ওর সামনে বসে আছে।ফারিহা একদম নিজের খেয়াল রাখে না,একটুও খেতে চায় না।কিন্তু মিস্টার আজাদ চায় না উনার নাতি/নাতনির দুর্বল হোক তাই প্রতিদিন ধমকে ধমকে ফারিহাকে খাবার খাওয়ায়।আর ফারিহা অসহায় মত ধমক শুনতে শুনতে খায়।ফারিহার এখন নয় মাস চলছে।পেট অনেকটাই উচু হয়েছে।ওর যখন ছয় মাস ছিল তখন থার্ড ইয়ারের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে।তাই এখন ভার্সিটিতে ক্লাস বন্ধ। পরীক্ষার সময় আয়ান ফারিহার অনেক খেয়াল রাখতো।ফারিহা বসে বসে পড়তো আর আয়ান সারা রাত জেগে থাকতো।কিছুক্ষণ পরপর ফারিহার জন্য কফি,ফলমূল নিয়ে আসতো।আয়ান এখন যখন তখন এই বাড়িতে আসে।মিস্টার আজাদ বাধা দেয় না।কারণ আয়ান ফারিহার যথেষ্ট খেয়াল রাখে আর আয়ান আসলে ফারিহা একটু বেশিই হাসিখুশি থাকে।পরীক্ষা শেষে ফারিহার ভার্সিটি যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি।বেবি হওয়ার পর অনার্স ফাইনাল ইয়ারে ভর্তি হবে।আয়ান চায়না বেবির জন্য ফারিহার পড়াশোনা আটকে থাকুক।আয়ানের সিদ্ধান্তটা ফারিহার অনেক ভালো লেগেছে কারন ফারিহাও পড়াশোনা করতে চায়।
মিস্টার আজাদ ফারিহার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ফারিহা ইনোসেন্ট মুখ করে বললো,
“বাপি আর খাবো না।আমার বমি পাচ্ছে”
মিস্টার আজাদ একটু হেসে বললো, “ডাক্তার বলেছে এসময় একটু আধটু বমি হয় তাই বলে খাবার খাওয়া বন্ধ করা যাবে না।আচ্ছা ঠিক আছে সবটা খেতে হবে না অল্প কিছু খা।”
ফারিহা মুখ গোমরা করে আপেল একটুকরা তুলে নিলো।মিস্টার আজাদ কিছুক্ষন পর বললো,
“তুই একদম তোর মায়ের মত হয়েছিস। তুই যখন তোর মায়ের পেটে ছিলি তখন তো ও একদম কিছু খেতে পারতো না। কিছু খেলেই বমি করত আমি তো খুব চিন্তায় ছিলাম”
“আমি মাম্মাকে অনেক জ্বালিয়েছি তাই না?”
মিস্টার আজাদ একটু হেসে বললো, “মা হতে গেলে একটু জ্বালাতন সহ্য করতে হয়।আর তুই যেদিন তোর মায়ের কোলে আসলি ওইদিন তোর মা গত নয় মাসের কষ্ট ভুলে গিয়েছিল।তোকে বুকে চেপে ধরে কান্না করে দিয়েছিল”
ফারিহা খেতে খেতে বললো, “আচ্ছা বাপি মাম্মা আর আমার মধ্যে অনেক মিল তাইনা?”
“হ্যাঁ অনেক,,তোদের চেহারা তো মিল আছে তাছাড়া আচার-আচরণ।এখন প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তোর আর তোর মায়ের লক্ষণগুলো সব এক”
“তুমি মাম্মাকে অনেক কেয়ার করতে?একদম আয়ানের মতো?”
ফারিহা আয়ানের কথা বলে আবার নিজেই চুপ হয়ে গেল।মিস্টার আজাদ কিছু বললো না,একটু হাসলো। তারপর ওরা ডিনার করে হনুফা বেগম ফারিহাকে ওর রুমে দিয়ে আসলো।ফারিহার রুম এখন নিচে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় উপর নিচ আসা-যাওয়া করতে প্রবলেম হবে তাই মিস্টার আজাদ নিচেই ফারিহার রুম অনেক সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে।আর ফারিহার পাশেই হনুফা বেগমের রুম।রাতে ফারিহার
কোন সমস্যা হলে হনুফা বেগম যেনো বুঝতে পারে।
.
রাত একটা।ফারিহাদের বাসার কলিং বেল বাজচ্ছে। হনুফা বেগমের ঘুম খুব পাতলা কলিংবেলের আওয়াজ শুনে উঠে পড়ে।তারপর অবাক হয়েছে এই ভেবে যে এতো রাতে কে এলো!আর তাছাড়া বাড়িতে বডিগার্ড আছে এত রাতে কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিলো?হনুফা বেগম রুম থেকে বেরিয়ে সদর দরজা খুলে দেখে আয়ান হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।উনি অবাল হয়।কলিংবেলের আওয়াজ শুনে ফারিহার ঘুম ভেঙ্গে গেল।ইদানিং রাতে ফারিহা খুব কম ঘুমায়।বাচ্চাটা ওকে প্রচুর জ্বালা।ফারিহা দরজা খুলে দেখল হনুফা বেগম অবাক হয়ে আয়ানকে বলছে,
“তুমি এত রাতে এখানে?”
আয়ান হেসে বললো, “ফারিহার কাছে আসলাম। আসলে আজকে একটু বেশি বিজি ছিলাম তাই আমার বউটার সাথে দেখা করতে পারিনি।ও ঘুমিয়ে পড়েছে তাইনা?চিন্তা করবেন না আমি ওকে ডিস্টার্ব করবো না”
হনুফা বেগম পেছন ফিরে দেখে ফারিহা দাঁড়িয়ে আছে।উনি অবাক হয়ে বললো, “কিরে তুই এখনো ঘুমাস নি?”
ফারিহা একটু হেসে বললো, “ঘুম আসছিল না তাই এতো রাতে কে এলো দেখতে আসলাম।আপনি এখন এই বাড়িতে কেনো?”
আয়ান দুই হাত উপরে তুলে বললো, “এই দেখো তোমার জন্য কি নিয়ে এসেছি।”
ফারিহা আয়ানের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে এক হাতে ফুচকা আরেক হাতে চকলেট!ফারিহা ফিক করে হেসে দিল।তারপর বললো,
“আপনি এত রাতে আমার জন্য এগুলো এনেছেন? আমি কি বলেছি নাকি এসব আনতে?”
ফারিহার কথা শুনে আয়ান ইনোসেন্ট মুখ করে বললো, “কিন্তু প্রেগন্যান্ট অবস্থায় তো মেয়েরা টক পছন্দ করে।তাইতো ফুচকা আনলাম আর আমি জানি তোমার চকলেট খেতে অনেক ভালো লাগে”
আয়ানের পাগলামি দেখে ফারিহা হাসছে। তারপর বললো, “তাই বলে আপনি এত রাতে এগুলো নিয়ে আসবেন?”
“হ্যাঁ আমার মেয়ে বলেছে।বাবাই আমার জন্য চিপ্স চকলেট নিয়ে আসো।তাইতো আনলাম!”
ফারিহা অবাক হয়ে বললো, “আপনার মেয়ে?”
“হ্যাঁ ওই তো বললো!”
“আপনি জানেন আপনার মেয়ে হবে না ছেলে?আর ও কিভাবে আপনাকে বলল যে চকলেট আনতে?”
আয়য়ান একটু ভাব নিয়ে বললো, “সেটা তুমি বুঝবে না।আমাদের বাবা মেয়ের মনের কানেকশন আছে”
আয়য়ানের কথা শুনে হনুফা বেগম কিছুক্ষণ হাসল তারপর আয়ান আর ফারিহাকে একা কথা বলতে দিয়ে উনি চলে গেলেন।
কলিংবেলের আওয়াজ শুনে মিস্টার আজাদের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল উনি এতক্ষণ ওপরে দাঁড়িয়ে আয়ান ফয়রিহার কথা শুনেছে। তারপর আয়ানের পাগলামি দেখে হেসে নিজের রুমে চলে গেলেন।ফারিহা হেসে উঠে বললো, “রুমে আসুন।”
আয়নার ফারিহার পিছনে পিছনে ওর বাড়ি রুমে গেল।সত্যি বলতে ফারিহার আজকে ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছিল।আয়ান ওর জন্য ফুচকা নিয়ে এসেছে দেখে ফারিহা অবাক হলো।আয়ান নিজের হাতে ফারিহাকে ফুচকা খাইয়ে দিল।তারপর ফারিহাকে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে নিজে ফারিহার সামনে বসলো।কিছুক্ষণ ফারিহার হাত ধরে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে মুখটা ফারিহার পেটের কাছে নিয়ে বললো, “মামনি পেট ভরেছে?আর খাবে?”
ফারিহা আয়ানের কথা হেসে বললো,
“আপনি এমন ভাবে বলছেন যেন মনে হচ্ছে আপনার মেয়ে হবে!”
আয়ান হেসে বললো, “হ্যাঁ দেখো আমার মেয়ে হবে।আমাদের ঘরে একটা ছোট্ট প্রিন্সেস আসবে।একটা ছোট্ট ফারিহা”
ফারিহা আয়ানের কথা শুনে হাসছে।ইদানিং আয়ানের পাগলামি টা একটু বেড়েছে।ফারিহা এসবে অভ্যস্ত।আয়ন হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে বললো, “এই দেখো দেখো বেবি কিক মারছে।”
ফারিহা ওর পেটের দিকে তাকালো।ওর বাচ্চা মাঝে মাঝেই ওকে কিক মারে।আয়ান উৎসুক চোখে ফারিহার পেটের দিকে তাকিয়ে আছে।তারপর আস্তে করে ফারিহার পেটে দু’তিনটে চুমু খেলো।
.
সকালে ব্রেকফাস্ট করে আয়ান এখান থেকেই অফিসে চলে যায়।ফারিহা ব্রেকফাস্ট করে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে ম্যাগাজিন পড়ছিল। মিস্টার আজাদ অফিস যাওয়ার আগে প্রতিদিন মেয়ের সাথে দেখা করে যায়।।আজকেও তৈরি হয়ে ফারিহার কাছে আসলো।ফারিহা বাপিকে দেখে একটু হাসল।মিস্টার আজাদ ফারিহা শরীর কেমন আছে যেনে ফ্পর কপালে চুমু দিয়ে চলে যেতে নিয়ে আবার পেছনে ফিরে বললো,
“তুই কালকে রাত্রে প্রশ্ন করেছিলি না যে,তুই তোর মায়ের পেটে থাকতে আমি পাগলামি করতাম কিনা?”
ফারিহা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল।মিস্টার আজাদ হেসে বলল, “হ্যাঁ আমিও পাগলামি করতাম তবে আয়ানের মতো এতটাও না।”
ফারিহা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল।ফারিয়া বুঝতে পারে কালকে আয়ান যে এত রাত্রে এসেছে সেটা মিস্টার আজাদ দেখেছে।আয়ানটা যে কি করে!
.
আয়ান অফিসে বসে কাজ করছিল।এখন দুপুর, সকালে ফারিহাকে দেখেছে কিন্তু তবুও এখন আবার খুব মিস করছে।ইচ্ছে করছে সারাক্ষণ ফারিহার পাশে বসে থাকতে।আয়ান নিজের ইচ্ছে কথা ভেবে নিজেই হাসলো।আর থাকতে না পেরে ফারিহার নাম্বারে কল দিলো ফারিহা দুপুরে খেয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করার জন্য।কিন্তু ফারিহা কল রিসিভ করছে না।আয়ান একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল তারপর ভাবলো হয়তো ফারিহা রুমে নেই।আয়ানের খুব চিন্তা হচ্ছে তাই হনুফা বেগমের নাম্বারে কল দিল হনুফা বেগম ও কল রিসিভ করছে না!সকালেই তো সব ঠিক ছিলো এখন কি হলো যে কেউ কল ধরছে না!আয়া আরো কয়েকবার কল দিলো।তারপর ওপাশ থেকে হনুফা বেগমের বিচলিত কন্ঠ শুনতে পেল,
“আয়ান আমরা ফারিহাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি। তুমি তাড়াতাড়ি চলে এসো”
আয়ান তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, “হোয়াট!কেনো?ওর কী হয়েছে?”
“জানিনা কি হয়েছে! কিছুক্ষণ আগে বলল পেট ব্যথা করছে তারপর আস্তে আস্তে ব্যথা বাড়লো।এখন শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে।স্যার এম্বুলেন্স নিয়ে এসেছে আমি এখন এম্বুলেন্সে আছি।ফারিহার খুব কষ্ট হচ্ছে তুমি তাড়াতাড়ি এসো”
হনুফা বেগমের কথা শুনে আয়ানের হাত কাঁপছে।ফারিহার শ্বাস নিতে সমস্যা হচ্ছে!আয়ানের মনে হচ্ছে ওর নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।হনুফা বেগমের কাছ থেকে হসপিটালের নাম যেনে তাড়াতাড়ি করে অফিস থেকে বের হলো হসপিটালে যাওয়ার জন্য।আয়ানের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সকালে ফারিহাকে ভালো দেখে এলো এখন কি হয়ে গেল ওর জানটার!ফারিহার কিছু হলে যে আয়ান বাঁচবে না।
চলবে….