#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (৩)
শিক্ষা জীবনের শেষ বর্ষে পড়ছে আবৃত্তি। এ বছরটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ওর জন্য। মাস্টার্সটা শেষ হলেই বেঁচে যাবে যেন। তবে গত কয়েক দিনের ঝামেলায় সব উলোট পালোট। আবৃত্তির সকল কাগজ পত্র ঘাটছে লেখা। পুরো বেড জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কলি চা হাতে এসে বলল,”ভাবি মনি, এইডা কি দেহি আমি। এমন কইরা সব ছড়াইয়া ছিটাইয়া লইসেন ক্যান। আপ্নে তো এমন মানুষ না।”
চা হাতে নিতে নিতে লেখা বলল,”কাজ থাকলে এত খেয়াল থাকে না রে কলি। তুই কি ব্যস্ত?”
“আর ব্যস্ত। আপনাগো বাড়ির কাম যত দিন ধইরা করতাছি মনে অয় কেউ আমারে তাল পাতার পাংখা দিয়া বাতাস করতেছে। ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বইয়া বইয়া টুক টাক কাম।”
গাল ভর্তি হাসল লেখা। “প্রথম যখন এ বাড়ির বউ হয়ে আসি। সেদিন তোর মতো আমারো একি কথা মনে হয়েছে। সবাই খুব গোছালো প্রকৃতির। কাজের পরিমাণ ও টুকটাক। ভালো লাগত খুব। নতুবা কাজের চোটে একটু বসার উপক্রম ও থাকত না।”
লেখার মুখটা মলিন হয়ে যাওয়াতে কলি বলল,” ভাবি মনি আপনের দিলে অনেক ব্যথা তাই না? জানেন তো ভালা মানুষ গো আল্লাহ খুব পছন্দ করে। তাই তাগো আগে আগে লইয়া যায়।”
“তাই? এর মানে আমাকে তিনি খুব পছন্দ করেছেন তাই না রে কলি।”
“হ মনে অয়। তবে আমি চাই আপনার কিছু যেন না অয়। ভাই জানের মুখটা দেখছেন। চিন্তায় চিন্তায় শুকায় গেছে। তার উপর আপনে আবার আবৃত্তি আপা মনি রে এই বাড়ির বউ কইরা আনলেন। এটা কোনো কাম হইল কন তো? এমন না করলেও পারতেন। অন্তত আপনি যতদিন আছেন…”
কলিকে থামিয়ে দিয়ে লেখা বলল,”ধুর বোকা। তুই ও সবার মতো ভাবছিস!”
“সত্যিই তো কইলাম। কেউ যে চেয়ে সতীন ঘরে আনবার চায়? আপনে সতীন তো আনলেন হেয় আবার আপনের খালাতো বোন!”
লেখা কাগজ পত্র গোছাতে গোছাতে বলল, “বোস তুই। তোকে একটা বিষয় বলি।”
মন খারাপ নিয়েই বসল কলি। লেখা সব কিছু সাইট করে নিয়ে শুধাল,”আবৃত্তি সুন্দর নাকি আমি সুন্দর?”
“এই ডা কোনো প্রশ্ন করলেন আপনে?”
“চুপ কর তো। তুই বল কে বেশি সুন্দর। দেখ সত্যিটা বলবি। এখানে কোনো মন কালাকালির বিষয় হচ্ছে না যে মন রক্ষা করবি।”
কলি দীর্ঘনিশ্বাস নামিয়ে বলল,”আবৃত্তি আপা মনি বেশি সুন্দর। তয় কি হইছে আপনি তো বেশি ভালা।”
“শোন তাহলে। আবৃত্তি আমার বোন। ওকে নিয়ে আমি কখনোই হিংসে করি না। তবে অন্য কাউ কে নিয়ে আমার ভীষণ হিংসে হবে। আমি ম রে গেলেও তোর ভাইজানের পাশে অন্য কাউকে আমার সহ্য হবে না। যতই বলুক তোর ভাইয়া, একটা মানুষ জীবনের এত গুলো বছর একা কাঁটাবে কি করে বল তো? শারীরিক মানসিক অনেক বিষয় কাজ করে এখানে। তাছাড়া সব কিছু না হয় বাদই দিলাম। একটা সময় আসবে তোর ভাইয়া বুড়ো হবে, সেই বয়সে কাউ কে তো লাগবেই বল। আবৃত্তি কখনো আমার উন্মেষ এর অযত্ন করবে না। অন্য কারো হাতে ওকে ছাড়ি কি করে বল তো। এখন আমি পুরো নিশ্চিন্তে চোখ বুজতে পারব।”
ফুপিয়ে কান্নার শব্দে লেখা থেমে গেল। কলি কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে। লেখা তড়িঘড়ি করে বলল,”একি রে তুই কান্না করছিস কেন?”
“ভাই জান রে আপনে এত ভালোবাসেন ভাবি মনি। আল্লাহ কেন আপনার অসুখ দিল। কেন আপনার থেকে ভাই জান রে আলাদা করল। ভালা মানুষ রাই সব সময় কষ্ট পাইব ক্যান কন তো?”
“কান্না থামা কলি। আর কে বলেছে তোর ভাই জান এর থেকে আমি আলাদা হয়ে গেছি। বরং আমাদের ভালোবাসা আরো গভীর হতে শুরু করেছে। যত দিন আছি তোর ভাইয়া এত ভালোবাসা দিবে যে একটা সময় ম রতে ও চাইব না দেখিস। সবার মতো আমি ও যে ভালোবাসার কাঙাল।”
কলি কান্না থামাল। দু হাতে চোখ মুছে বলল, “একবার আপনারে জড়াইয়া ধরি? না হইলে আমার কলিজা ঠান্ডা হইব না। মানা কইরেন না।”
হেসে উঠল লেখা। কলি জড়িয়ে ধরতেই লেখার দু চোখ দিয়ে পানি নেমে গেল। এই মেয়েটা ওকে ইমোশনাল করে দিল। যার কাছে যায় সেই ইমোশনাল করে দেয় ওকে। ও তো চায় না কাঁদতে তবু সবাই ওকে কাঁদিয়ে দেয়। সত্যিই তো ক্যান্সার নামক রোগটা ওর জীবনে না এলে পুরো জীবনটাই সুন্দর হতো।
কলি নামের মেয়েটি অষ্টাদশী। তবে জ্ঞান এর পরিধি বিশাল। মেয়েটির অনুভূতি ও বেশ তাজা। সেই যে ঘন্টা খানেক কেঁদে বুক ভাসালো এর পর থেকেই কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। লেখাকে দেখলেই করুণ চোখে তাকায়। আর লেখা পড়ে চরম অস্বস্তিতে। মনে হয় মেয়েটি ওকে অনেক কিছু বলতে চায়। কেমন যেন একটা অনুভূতি আসে। ভাবনার কারণে পড়ে যাচ্ছিল লেখা। চট করেই দু হাতে জড়িয়ে নিল আবৃত্তি। ড্রয়িং রুমে বসে থাকা প্রায় সকলেই ব্যগ্র হয়ে তাকাল। উন্মেষ উঠে এসে লেখাকে আগলে ধরল। হাত পা টেনে দেখে নিল ঠিক আছে কি না। লেখার কপালের মধ্য ভাগে কেমন ভাঁজ। মানুষটা এত পাগল কেন?
“সবাই দেখছে।”
খেয়াল করল না উন্মেষ। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আবৃত্তি। সোজা তাকানো তার দৃষ্টি। লেখা আবার বলল, “সবাই তাকিয়ে আছে উন্মেষ। তুমি কেমন পাগলামি শুরু করলে বলো তো।”
“কি বললে শুনতে পাই নি?”
“সবাই দেখছে বলেছি।”
সচকিত হলো উন্মেষ। কিছুটা দূরে সরে এসে আবার অগ্রসর হলো লেখার দিকে। লেখা ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটে। পেছনে আসে উন্মেষ। আবৃত্তি ধীরে ধীরে পা ফেলল। ড্রয়িং রুমে এসে সবাই নিস্তব্ধ। কথা নেই কারো মুখে।
“সবাই চুপ কেন? আমাদের বাড়িতে সন্ধ্যায় প্রায় দিন ই আড্ডা হয়। তোমরা সবাই কি ভুলে গেলে!”
উষা সোফায় শুয়ে ফোন চালনায় মগ্ন। আচমকা বই তুলে নিয়ে বলল,”সামনের সপ্তাহে আমার মান্থলী টেস্ট ভাবি। একদম ই ভুলে গিয়েছি। আমি পড়তে বসব। টা টা ভাবি।”
হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে উষা। আবৃত্তি এক পলক তাকাতে না তাকাতেই দিতিয়া ও উঠে গেলেন। আলমাস সাহেব আগে থেকেই কাজ করছিলেন। উন্মেষ লেখার পাশে এসে বসল। “সবাই রেগে আছে আমার উপর?”
“ভুল ভাবছ তুমি। সময়টা খারাপ। সব ঠিক হয়ে যাবে। আসো আমার সাথে।”
“হুম।”
কতদূর চলে গিয়ে লেখা আবার বলল, “আবৃত্তি একা থেকে কি করবে। ও বরং আমাদের সাথে আসুক।”
“থাক না লেখা। কলি আছে তো ওখানে। ওর সাথে গল্প গুজব করবে না হয়।”
সজাগ থাকলে আবৃত্তির কান বেশ খাড়া হয়ে থাকে। উন্মেষ আর লেখার কথা গুলো শুনতে পেয়ে তড়িঘড়ি করে কলির নিকটে এল। কলি টিভি দেখছিল। হা হয়ে তাকানো। প্রিয় সিরিয়াল চলছে। অন্যসময় হলে বিরক্ত করত না আবৃত্তি। তবে এখন উপায় নেই। হালকা কাশল সে। অথচ গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকা কলির কর্ণ দ্বয় পাত্তাই দিল না।
“তুমি কি আমার সাথে ছাদে যাবে একটু?”
“ছাদে ক্যান আপা মনি?”
“আসো না একটু। ভালো লাগছে না চার দেয়ালে ভেতর বসে থাকতে। একটু খোলা আকাশের নিচে ঘুরে আসি।”
“তয় কি করার আর। আসেন যাই।”
টিভি বন্ধ করে আবৃত্তিকে সঙ্গ দিল কলি। লেখা আর উন্মেষ অনেক আগেই চলে গেছে। ছাদে এসে দু দন্ড দাঁড়ানোর জো নেই। বাতাসের বেগ বাড়তে লাগল বিদ্যুৎ এর গতিতে। কলি বলল,”হায় হায় বৃষ্টি আইতেছে। আমি যাই আপা মনি। বড়ো বারান্দা ভরা কাপড় রাইখা আইছি। খালাম্মা খুব রাগ দেখাইব।”
আবৃত্তির উত্তরের আশা করে নি কলি। ছোট ছোট কদমে চলে গেল মুহূর্তেই। আবৃত্তির ইচ্ছে হয় না যাওয়ার। দু এক ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে শরীরে। ভালো লাগছে। বেশ আরাম লাগে। বুকটা শীতল ও হয় কিছুটা। দুই নেত্র বুজে আসে আলগোছে। আকাশ চমকায়। বাতাস এলোমেলো করে দেয় শাড়ি। আঁচল খানা বহু পূর্বেই ছাদ ছুঁই ছুঁই। হাল্কা বৃষ্টি থেকে এবার বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু।
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
**প্লটটা সাধারণ দৃষ্টিতে মানতে কষ্ট হবে। কোনো স্ত্রী তার স্বামীর সাথে অন্য মেয়েকে দেখতে পারে না পারবেও না। আর সতীন ঘরে আনাও অসম্ভব। তবে লেখা কেন এনেছে এর পেছনে নিশ্চয়ই কারণ রয়েছে। সব ক্লিয়ার হবে পনের পার্টে। অনেকের খারাপ লাগবে,তাদের বলছি গল্পটা আপাতত ইগনোর করুন।**