#হাওয়ায়_ভাসা_উড়ো_চিঠি (৭)
উষা বলল,”ছোট ভাবি শপিং করতে যাবে প্লিজ?”
“শপিং এ যাবে? আমি তো সবে মাত্র বাসায় এলাম উষা।”
“প্লিজ, আসো না।”
উষার চোখ দুটো ফোলা। যেন খুব সময় নিয়ে কেঁদেছে। আবৃত্তি সেটা বুঝতে পেরে বলল,”ঠিক আছে। তুমি তৈরি হও আমি বরং ফ্রেস হয়ে আসি।”
“থ্যাংকস।”
রিক্সায় চড়তে ভালো লাগে আবৃত্তির। তাই ওরা রিক্সা নিয়েই রওনা হলো। মলিন হয়ে এসেছে উষার মুখশ্রী। বাচ্চা একটা মেয়ে। সবে ক্লাস টেনে পড়ে। সব সময় হাসি খুশি থাকবে। প্রাণোচ্ছল হবে মুখ। তা না করে কেমন গুমোট! এমন কি কেঁদে লাল করে ফেলেছে মুখ। আবৃত্তি একবার প্রশ্ন করতে চাইল তবে ভেতর থেকে সায় আসছে না। উষার ইচ্ছে হলে উষাই বলবে না হয়। শপিংমলে ঢুকে খুব একটা শপিং করল না উষা। দেখা গেল এই দোকান সেই দোকান ঘুরছে শুধু। আবৃত্তি পুরো টাই লক্ষ্য করেছে তবে নিশ্চুপ রইল। উষা ঈষৎ হাসার চেষ্টা করে বলল,”কিছু খেয়ে নেই আমরা?”
“এখনি?”
“হ্যাঁ। পরে আবার শপিং করব না হয়।”
“আসো।”
ফুড সেকশনে এসে খাবার অর্ডার করল ঠিক ই তবে উষার মনোযোগ অন্য দিকে। আবৃত্তি লক্ষ্য করল নাক বরাবর একটা ছেলে বসে। ইশারায় দুজন কথা বলছে কিছু। মগজটা এবার কিছু বুঝল বোধহয়। আবৃত্তি খপ করে ধরল হাত। উষা হতচকিয়ে উঠে।
“কিছু বলতে চাইছ উষা?”
“না মানে ছোট ভাবি।”
“কেঁদেছ খুব। কি হয়েছে তোমার?”
উষা বোধহয় ভরসা করতে পারছে না। এই বয়সটা অতিবাহিত করেছে আবৃত্তি। বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব সিরিয়াস ইস্যু। আস্বস্ত করার লক্ষ্যে বাহুতে হাত রাখল।
“আমাকে ভরসা করতে পারো উষা। আর মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ভরসা করেই এখানে এনেছ।”
দ্বিধা, হতাশা, সব কিছুকে গিলে নিয়ে উষা বলল,”আমি প্রেগনেন্ট ছোট ভাবি।”
মাথাটা ঘুরিয়ে এল আবৃত্তির। উষার হাতটা ধরেছিল এত সময়। এখন সেটা আলগা হয়ে এল। উষা প্রায় ডুকরে কেঁদে উঠল। আবৃত্তি সামলে নিল নিজেকে। উষার হাত ধরে বেরিয়ে আসার সময় ছেলেটিকে বলল,”আমাদের সাথে আসো।”
উষা কাঁদছে খুব। লেকের ধারটা খুব নির্জন। আবৃত্তি চায় নি রেস্টুরেন্টে অতো মানুষের সামনে কোনো ঝামেলা হোক। আবৃত্তি সময় নিয়ে ছেলেটাকে শুধাল,”তোমার নাম?”
“ইয়াস মুক্তাদির।”
“ইয়াস, পড়াশোনা করো তো?”
“জী।”
“কোন ক্লাস?”
“মেডিকেল থ্রার্ড ইয়ার।”
আবৃত্তি প্রায় রেগে গেল এবার, “ও না হয় ছোট মানুষ। তুমি তো প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে। তাছাড়া মেডিকেল স্টুডেন্ট। স্বাস্থ্য সচেতন সম্পর্কে আমার থেকে তোমরা ধারণা বেশি। তাছাড়া ও মানলাম আবেগে করেছ এমনটা। তাই বলে বেবি আসতে পারে এটা মাথায় রাখবে না?”
কথা গুলো বলে অস্থির হয়ে এল আবৃত্তি। মাথায় কিছু আসছে না। এটা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। উষা কাঁদছে খুব। ইয়াসের মুখটা একে বারেই নেতিয়ে গেল। আবৃত্তি শান্ত হলো। পরিস্থিতি যেমন ই হোক সবটা মুষ্টিবদ্ধ করতে হবে। কিছুটা শঙ্কা নিয়ে বলল,”ইয়াস তুমি নিশ্চয়ই এই বাচ্চা কে অস্বীকার করছ না?”
“ছি ছি ভাবি,এমনটা আমি কখনোই ভাবতে পারি না। বিশ্বাস করুণ আমি উষাকে ভীষণ ভালোবাসি। কিছু ভুলের কারণে আজ এই দশা। তবে আমি চাই আমাদের সন্তান আসুক পৃথিবীতে।”
ভরসা পেল আবৃত্তি। উষার মাথায় হাত রেখে বলল,”কেঁদো না আমি দেখি কি করতে পারি। আর সবথেকে বড়ো কথা সন্তান আসার খবর টা জানানো যাবে না কাউ কে। যত দ্রুত সম্ভব তোমাদের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তোমরা যা করেছ এটা ধর্ম সমাজ কোনো দিক থেকেই ঠিক নয়।”
এত সময় পর কান্না থামাল উষা। আবৃত্তির হাতটা ধরে বলল, “আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে ছোট ভাবি। ভুল করলেও অতোটাও পাপী নই আমরা।”
প্রথমে শকড হলে ও কোথাও একটা শান্তি লাগে আবৃত্তির। অন্তত বাচ্চাটা কে অ বৈ ধ নামক শব্দটা বয়ে বেড়ানো লাগবে না।
দুদিন ধরেই উন্মেষের সাথে কথা বলার চেষ্টা করছে আবৃত্তি। তবে হচ্ছে না কোনো ক্রমেই। আজ সন্ধ্যায় বাড়ির মেইন ফটকে অপেক্ষা করল। উন্মেষের গাড়িটা গেট দিয়ে ঢুকতেই একটি ম্যাসেজ পাঠাল,”আমার সাথে একটু দেখা করবেন প্লিজ? খুব আর্জেন্ট প্রয়োজন। আমি বাড়ির পেছনের রাস্তায় অপেক্ষা করছি।”
উন্মেষ বেশ আতঙ্কিত হলো। পাছে মেয়েটির বিপদ হলো নাকি এই ভয়ে দ্রুত গাড়ি পার্ক করে বের হলো। আবৃত্তি পায়চারি করছে এদিক সেদিক। বিচলিত দেখায় খুব। উন্মেষ উদ্বিগ্ন গলায় শুধায়,”কিছু হয়েছে তোমার? কোনো সমস্যা?’
“সামনে যাই আমরা? এখানে কথাটা বলা ঠিক হবে না।”
নীরবে এগোল উন্মেষ। বক্ষের মাঝে অচিরেই জেগে উঠল তীব্র ব্যথা। ভয় আর আতঙ্ক গুলো শরীরে সুচ হয়ে বিঁধে। এক সময় নির্জনে উপস্থিত হয় দুজনে। তখনি আবৃত্তি বলে, “একটা বিষয় খুব বেশিই জটিল হয়ে আছে। আমার মাথা কাজ করছে না। সেই জন্যেই আপনাকে ডাকলাম। এমন কি আপু কে ও বলতে পারছি না সেসব। অসুস্থ শরীর নিয়ে কি করবে।”
“কি কথা? যা লেখা কে বলতে পারছ না!”
“আসলে……!”
“হ্যাঁ বলো। তুমি ঘেমে যাচ্ছ আবৃত্তি।”
“উষা প্রেগনেন্ট।”
শুনতে পেল না উন্মেষ। ওর কান দুটো বোধহয় তালাবদ্ধ। হাত কচলাতে লাগল আবৃত্তি। ভীষণ চিন্তা ফুটেছে চোখে মুখে। উন্মেষ এর কপালে ভাঁজ। “আপনি রাগ করবেন না প্লিজ। পুরো বিষয়টা বোঝার ট্রাই করেন।”
“উষা কোথায়?”
“আগে আপনি আমার কথা শুনেন।”
“ওকে ডাকো। আমি জানি আশে পাশেই আছে।”
ভারী হয়ে আসে আবৃত্তির কণ্ঠ। উন্মেষের মুখের অভিব্যক্তি অনেকটাই গম্ভীর। বিগত কিছু বছর ধরে এমনিতেই পাংশুটে হয়ে উঠেছে মুখ। আগের মতো প্রাণোচ্ছল দেখা যায় না। সেই ছেলেটা এখন একটু রাগ দেখালেই কেমন যেন হয়ে উঠে মুখের গড়ন। আড়াল থেকে কাছে এল উষা। হাত পা কাঁপছে বেশ। মেয়েটির পাতলা গড়নে পেটটা নিচু হয়েই আছে। বোঝা যায় খুব বেশি দিন হয় নি ঘটনার। উন্মেষ বলার পূর্বেই আবৃত্তি বলল, “আসলে হয়েছি কি….।”
“আমি কথা বলি?”
মিইয়ে যায় আবৃত্তি। উন্মেষ ভালো করে বোন কে দেখে। তারপর সজোরে চ ড় টা বসায় মসৃণ গালে। আবৃত্তি ছুটে এসে আগলে নেয়। উন্মেষের কপালের রগ জেগে উঠেছে। ভয়ে কান্না করে দেয় উষা। আবৃত্তি প্রায় চেঁচিয়ে বলে”পাগল হলেন? বাচ্চা মেয়েটাকে এভাবে মারলেন।”
“বাচ্চা, কে বাচ্চা! বাচ্চা হলে নিশ্চয়ই আজ এভাবে আসতে পারত না।”
“ভুল হয়ে গেছে। আপনি সমাধান করবেন কি, তা না করে…।”
“চুপ থাকো তুমি। আমি ওর সাথে কথা বলছি। একদম সাফাই দিবে না।”
শেষোক্ত বাক্যে আবৃত্তি যেন একদম ই থমকে গেল। উষা এবার ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কাঁদছে। খিচে ধরেছে আবৃত্তির বাহু। মেয়েটির মানসিক অবস্থা চিন্তা করে আবৃত্তি সামলে নেয়ে নিজেকে। বলে,”আর আ ঘা ত করবেন না ওকে। এই বয়সটাই ভুলের।”
“প্রশ্রয় দিও না আর। ভুলের বয়সে ভুল করতে হবে এমন কোনো শব্দ নেই। প্রেম করেছে বেশ ভালো, তাই বলে ছিই ঘৃণায় আমার শরীর গুলিয়ে আসছে।”
আসলেই ঘৃনা হলো উন্মেষের। উষা ভীষণ কষ্ট পেল। আবৃত্তি এবার উষার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”কাঁদে না বোন। আমি কথা বলছি।”
হিচকি তুলতে তুলতে সরে যায় উষা। আবৃত্তি উন্মেষের মুখোমুখি হয়। উন্মেষ লক্ষ্য করে মেয়েটির চুল ছাড়া আজ। বাতাসে উড়ে হয়েছে সব এলোমেলো। ভীষণ অগোছালো হয়ে আছে তবু কোথাও একটা গোছানো। চোখ সরায় উন্মেষ। আবৃত্তি বলে,”এই বয়সের ভুলটা খুব কি অস্বাভাবিক?”
“কি বলতে চাইছ?”
“উষা বাচ্চা। বয়সটা খুব ই কম। মানুষ তো প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ও ভুল করে বসে। কত শত ভুলের মাঝে ও বেঁচে থাকে। তাহলে বাচ্চা মেয়েটির ভুল কে…।”
“পরিস্থিতি কেমন তা জানো না তুমি?”
“সেই জন্যেই বলছি। আর তাছাড়া ওরা অলরেডি ম্যারিড।”
ভ্রু কুচকাল উন্মেষ। আবৃত্তি শুধু বলল,”আর যাই হোক, ওদের মাঝে সর্বোচ্চ পাপ তো হলো না।”
অন্য দিক ফিরিয়ে নিল চোখ। উন্মেষ কিছুই ভাবছে না এখন। কোথাও একটা হারিয়ে গেছে বোধকরি। আবৃত্তিই বলল,”পারিবারিক ভাবে ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আর উষার প্রেগনেন্সির কথাটা একদম ই জানানো যাবে না কাউকে। ইয়াসের সাথে কথা হয়েছে আমার। ছেলে খারাপ নয়। মেডিকেল স্টুডেন্ট, শুধু ভুলটা করে বসল। সে যাই হোক, আপনি বাসায় ম্যানেজ করুন কোনো ভাবে।”
“সব সময় আমাকেই কেন ম্যানেজ করতে হবে বলতে পারো? ”
আবৃত্তি তাকাল। উন্মেষের দৃষ্টি অন্য দিকে। ছেলেটির চুল গুলো বাতাসে নড়ে। গালের খোচা খোচা দাড়িতে কোথাও একটা ব্যথা অনুভব করায়। মনে হয় এই তো কিছু সময়, কিছু মুহূর্ত এরপর ই আসবে বুক ভরা তীব্র প্রশান্তি।
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি