হাতটা রেখো বাড়িয়ে পর্ব -২

0
1987

#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

অগ্রহায়ণ মাসের শেষের দিক। সকালটা আষ্টেপৃষ্ঠে কুয়াশার চাদরে মোড়া। রাস্তাঘাট শুনশান। থেমে থেমে ডেকে উঠছে পাখিরা। এমনই এক দিনে ধারা যাচ্ছিল কোচিংয়ে। গ্রাম থেকে বেড়িয়ে শহরে প্রবেশমুখে স্টেডিয়ামের পরেই তার কোচিং সেন্টার। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। তাই সকালের হিমবাহুকে ঠেলে সাতটার আগেই বেড়িয়ে পড়তে হয় রাস্তায়। চারিপাশে বিরাজ করছে নিরবতা। মাঝেমধ্যে আবছা ধোঁয়াশার মধ্যে থেকে টুংটাং করে বেজে উঠছে একটা দু’টা সাইকেলের ঘন্টা। কুয়াশার মধ্যে তাকালেও চোখে পড়ে অস্পষ্ট দৃশ্য। ধারার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের থ্রি পিছ। তার উপরে পেঁচিয়ে নিয়েছে নীল রঙের শাল চাদর। কাঁধে ব্যাগ। মোড়ের মাথাতেই অটোরিকশা ছেড়ে দিয়েছে সে। মোড় থেকে কোচিং সেন্টারের দূরত্ব হাঁটা পথে চার মিনিট। কিন্তু এই চার মিনিটের দূরত্ব গাড়িতে গেলেই হয়ে যায় এক্সট্রা পাঁচ টাকা। গাড়ি চালকদের যতসব টাকা কামানোর ধান্দা। এতটুকু রাস্তার জন্য আবার বারতি পাঁচ টাকা দিতে হবে কেন? অনর্থক খরচ। তাই ধারা প্রতিদিন মোড়ের মাথাতেই নেমে পড়ে। পায়ে হেঁটে চলে যায় বাকি পথ। হাঁটতে হাঁটতে ধারা লক্ষ করলো অন্য দিনগুলোর চাইতে আজ যেন কুয়াশার আধিক্য একটু বেশিই। তার সাথে পাল্লা দিয়ে নিস্তব্ধতাও। পাঁচ হাত দূরত্বের কোন দৃশ্যও স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্তও কোন লোকজনের আলাই বালাই নেই। পিচ ঢালা রাস্তায় পাতা থেকে ঝরে পড়া শিশির বিন্দুর শব্দও যেন কান পাতলে শ্রবণেন্দ্রিয় হয়। ধারার মনে একটু অস্বস্তিপূর্ণ অনুভুতি নাড়া দিল। হাঁটার গতি আরেকটু বাড়িয়ে দিল সে। হঠাৎ নিস্তব্ধতা ছাপিয়ে কানে এলো কতগুলো কুকুরের শব্দ। তাদের বিকট ভয়ংকর চিৎকারে মুহুর্তের মধ্যেই যেন খান খান হয়ে ভেঙে গেলো নিরবতা। দল সমেত পায়ের খুড়ের শব্দ জানান দিল এদিকেই দৌড়ে আসছে তারা। শিরদাঁড়া বেঁয়ে একধরণের শীতল শিহরণ নেমে গেল ধারার। কুকুর প্রচন্ড ভয় পায় সে। আতঙ্কিত হয়ে হঠাৎ কি করবে বুঝতে না পেরে সে ফাঁকা প্রশস্ত রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথায় দৌড়ে গেলো। গিয়েই বুঝলো কত বড় ভুলটাই না করে ফেলেছে। ঠিক তখনই কুয়াশা ভেদ করে চার পাঁচ টা কুকুরের হৃষ্ট পুষ্ট শরীর দৃশ্যমান হয়। ধারার দিকেই দুর্নিবার গতিতে ধেয়ে আসছে কুকুরগুলো। আতঙ্কে ধারার শরীর জমে যায়। কোন দিকে সরে যাবার জন্য শক্তিও যেন পায় না সে। কাঁধের ব্যাগ আর চাদর খুলে পড়ে গেছে অনেক আগেই। তবুও এত শীতে ঘাম ছুটে যায় তার। ঘেউ ঘেউ শব্দ করে কুকুরগুলো যখন ধারার অনেক কাছে চলে আসে তখন চোখ বন্ধ করে কানে দু হাত নিয়ে একটা জোরে চিৎকার দিয়েই শরীরের ভারসাম্য হারিয়ে অবশ হয়ে পড়ে ধারা। ঠিক তখনই একটা বলিষ্ঠ হাত এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ধারার হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে। ধারা তখন জ্ঞান শুন্য। কুকুরগুলোও তাকে অতিক্রম করে চলে গেছে অনেক আগেই। শুধু নির্জন রাস্তায় একজন জ্ঞান হারা সুন্দর তরুণীকে নিয়ে বিপাকে পড়ে যায় ছেলেটা। হাতের উপর ভর দিয়ে ধরে রাখা মেয়েটির সুন্দর চেহারা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটা একবার আশেপাশে ঘুরে তাকালো। সাহায্যের জন্য ডাকার মতো কেউ নেই। এদিকে মেয়েটাকে ছাড়তেও পারছে না। অচেনা একটা মেয়েকে আবার নিশ্চয়ই কোলেও উঠানো যায় না। এখন উপায়? পানি-ই বা কোথায় পাবে? মেয়েটার জ্ঞান যে ফেরাতে হবে। ছেলেটা ধারাকে ধরে রাখা ডান হাত মৃদু ঝাঁকিয়ে এক দুবার ডাকলোও তাকে৷ কাজ হলো না। হঠাৎ ছেলেটার চোখ পড়ল তাদের মাথার উপরের শিউলি গাছটার দিকে। ডালে ডালে শিশির ভেজা অজস্র ফুলের সমারোহ নিয়ে কি সুন্দর নিজেকে সজ্জিত করে রেখেছে গাছটা! কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে থেকে ডান হাতেই ধারাকে রেখে বাম হাতটা দিয়ে গাছের একটা ডাল চেঁপে ধরলো সে। হাতের বলপ্রয়োগে মুহুর্তেই আন্দোলন সৃষ্টি করলো পুষ্পশাখায়। একটা মৃদু স্নিগ্ধ ঝঙ্কার তুলে যত্নে জমানো শিশির বিন্দু নিয়ে ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো শুভ্র মাতাল শিউলি ফুলের দল। এ যেন স্নিগ্ধ প্রভাতে মুগ্ধ ছন্দে ঘুমন্ত রাজকন্যার উপর চলছে বিরতিহীন অনিন্দ্য ফুল বর্ষণ। নিজের কোমল মসৃণ ত্বকে বিন্দু বিন্দু জল আর ফুলের শীতল স্পর্শ পেতেই খানিকবাদে কেঁপে উঠে ধারার ঘন চোখের পল্লব। পিটপিট করে চোখের পাতা খুলতেই দেখতে পায় তার মুখের সামনেই কালো জ্যাকেট পরিধেয় করা একটা ছেলের বিরক্তি মাখা মুখ তাকে বলছে,
‘এই যে মিস, এবার তো উঠুন। সিনারি টা সিনেমাটিক হলেও সিচুয়েশানটা কিন্তু একদমই সিনেমাটিক না। আমার হাত খুলে পড়ে যাচ্ছে। ট্রাস্ট মি।’

ঝট করে ধারা চোখ মেলে তাকালো। গায়ে তার একটা পাতলা কাঁথা। ঘামে ভিজে শরীরের অবস্থা হয়ে উঠেছে জবজবে। মাথাটা ভীষণ ভার লাগছে। হঠাৎ মাথায় কয়েক মাস আগের একটা স্মৃতি আসলো কেন তার? একটা মুখ কোথাও দেখেছি দেখেছি বলে মনে হচ্ছিল বলে, এই কারণেই কি? ধারা পাশ ঘুরে সোজা হয়ে শুয়ে নিলো। হঠাৎ ঠাওর করতে পারলো না সে আসলে আছে টা কোথায়! বিচলিত দৃষ্টি এদিক ওদিক ঘুরতেই হঠাৎ তার নজর একটা ছবির দিকে গিয়ে আটকে গেলো। বিছানা ছেড়ে আস্তে ধীরে নেমে আসলো সে। ধীর পায়ে টিনের বেড়ার গায়ে ঝুলানো ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা ছেলের ছবি। কালো কোট আর ক্যাপ মাথায় দিয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার মুহুর্তের। ছবির নিচে টাইপিং করে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা মাহতাব ইসলাম শুদ্ধ। এই ছেলেটাকেই তো কোথায় দেখেছে দেখেছে বলে মনে হচ্ছে ধারার। হঠাৎ তার মনে পড়লো এটাই সেই শীত সকালে স্টেডিয়ামের কাছে শিউলি গাছের নিচের সেই বিরক্তি মুখো ছেলেটা। এবং ইনি-ই কাল রাতের সেই ব্যক্তি। যার সাথে কিনা ধারার বিয়ে হয়েছে। বিয়ের কথা মনে পড়তেই ব্যথিত মনে পাশের আয়নায় চোখ পড়তেই ধারা চমকে উঠে। কাল রাতে জ্ঞান হারাবার আগ পর্যন্তও তো তার গায়ে লাল বেনারসি শাড়ি ছিল। সাথে অনেক প্রসাধনীও। কিন্তু এখন তো দেখছি গায়ে শুধু একটা পাতলা সুতি শাড়ি। ধারার শাড়ি পাল্টে দিয়েছে কে? ঐ লোকটাই?

তখনই রুমে গটগটিয়ে প্রবেশ করে শুদ্ধ। ধারার কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুখ দেখেই বুঝে যায় কি ভাবছে সে। তাই এসেই বলতে থাকে,
‘এতো অবাক হবার কি আছে? আপনার স্বামী তো আপনাকে ছুঁতেই পারে তাই না! নাকি এটাও ভাবেননি। বাবা বলেছে আর ওমনিই বিয়ে করে নিয়েছেন।’

শুদ্ধ রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ধারা হতবিহ্বল।
__________________________________________

খোদেজা আজ মহাখুশি। তার একমাত্র ছেলের বিয়ে যে সে এমন ভালো ঘরে দিতে পারবে তা হয়তো কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি তিনি।
ছেলের জন্মের আগেই তার স্বামী মারা যায়। স্বামী ছাড়া একা হাতে ছেলেকে মানুষ করা সহজ ছিল না। কিন্তু এই কঠিন কাজটাই তিনি সম্ভব করেছিলেন। বরং ভালো মতোই করেছেন। যুবতী বয়সেই বিধবা হওয়ায় সবাই যখন তাকে দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তাব দেন তখন তিনি এর পরিবর্তে প্রথম স্বামীর স্মৃতি নিয়েই বাকি জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। তা যতই কঠিন হোক না কেন। এ কারণেই গ্রামের মানুষও তাকে একপ্রকার সমীহ করে। ছেলেকে মানুষ করেছেন এখন একটা ভালো সম্বন্ধ দেখে বিয়েও দিতে পেরেছেন। তিনি এখন দুশ্চিন্তামুক্ত। তার উপর এতো বড় ঘরের মেয়ে! মেয়েটাকে একদিন রাস্তায় অটোর মধ্যে দেখেছিল খোদেজা। দেখেই তিনি মেয়েটাকে পছন্দ করে বসেন তার একমাত্র ছেলের জন্য। মেয়ে তো দেখতে মাশাআল্লাহ! এর পরপরই এই মেয়ের ঠিকানা বের করে ফেলে একটা ঘটকের সাহায্যে প্রস্তাব পাঠিয়ে দেন খোদেজা। তখনও তিনি জানতেন না মেয়েদের অবস্থা এতো ভালো। যখন জানলেন তখন একপ্রকার চমকেই গিয়েছিলেন। আরো বেশি চমকান যখন জানতে পারেন মেয়ের বাবা রাজী হয়ে গেছেন। নয়তো আশা তো একপ্রকার ছেড়েই দিয়েছিল খোদেজা। তাই আর দেরি না করে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন তিনি। গ্রামের কম বেশি সব মহিলারাই আজ তার ছেলের বৌকে দেখতে এসেছে। বৌ দেখে সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। খোদেজার বুক গর্বে উঁচু হয়। তখন পাশের বাসার হাসুর মা এসে খোদেজাকে মনে করায় নতুন বৌকে দিয়ে কিছু নিয়ম কানুন পালন করা বাকি আছে। খোদেজার পছন্দ হয় না। এত নিয়ম কানুনের ভারে পাছে তার ছেলের বৌটার কষ্ট না হয়। কিন্তু উপায় নেই। গ্রামের মহিলাদের সামনে একটা কথা বললে দশটা কথা বানাবে। মনের বিরক্তি মনেই রেখে খোদেজা অন্যদের ব্যবস্থা করতে বলে নিজেও ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

গ্রামের মহিলাগুলো যখন নিয়ম পালনের যোগাড় যন্ত্রে ব্যস্ত তখন এক কোণে একটু হাফ ছেড়ে দাঁড়ায় ধারা। এতক্ষণ একটানা বসে থাকতে থাকতে তার কোমর ধরে এসেছে। পরনে তার একটা সিল্কের কমলা রঙের শাড়ি। মাথার ঘোমটা টা আরো একটু টেনে নিয়ে যখনই একটু সোজা হয়ে দাঁড়ায় তখন হঠাৎ সেখানে এসে দাঁড়ায় শুদ্ধ। কোন হেঁয়ালি না করেই বলে,

‘কিছু ভেবেছেন?’

শুদ্ধ’র এমন আকস্মিক আগমনে ধারা চমকে উঠে। এতটুকু সময়ের অভিজ্ঞতাতেই এই লোকটাকে কিছুটা ভয়ই পায় ধারা। আবারও না কিছু বলে বসে তাই দ্রুতই মৃদু স্বরে উত্তর দেয়,

‘কি?’

‘কি বলবেন?’

ধারা অবাক হয়ে বলে, ‘কি বলবো?’

শুদ্ধ ঠান্ডা ভাবেই বলে, ‘আপনি তো বিয়েতে রাজি না। তাই আমাদের একসাথে থাকারও কোন মানে হয় না। আজকে তো নিয়ম অনুসারে আপনার সাথে আমার আপনাদের বাড়ি যাবার কথা। আমি ঠিক করেছি আমি এখন কিছু একটা বাহানা দিয়ে যাবো না। আপনি একাই যাবেন। আপনাকে আনতে যেতেও আমি যাবো না। ততক্ষণে নিশ্চয়ই আত্মীয় স্বজনরাও সব কমে যাবে। বিয়ের আগে কিছু বলতে পারেননি, এখন বলবেন। বলবেন, আপনার এই বিয়েতে মত ছিল না। আমার সাথে থাকা আপনার পক্ষে সম্ভব না।’

ধারা স্তব্ধীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। শুদ্ধ বলতে লাগলো, ‘মনে রাখবেন প্লিজ, আমি কিন্তু আপনাদের বাড়িতে যাবো না। আপনি আপনার বাবাকে আপনার সমস্যাটা খুলে বলবেন।’

মূর্তির মতো অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে ধারা বলার মতো কিছুই খুঁজে পায় না। যতটা সহজ ভাবে লোকটা বলল পারতপক্ষেই কি ধারার জন্য সবটা এতোটাই সহজ?

চলবে,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here