#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-২৫
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
পেছন থেকে দাদীর গলা শুনে ধারার চেহারায় আতঙ্ক ফুটে উঠলো। দাদীকে ধারা খুব ভালো মতোই চিনে। না যেন এখনই চেচাঁমেচি করে সবাইকে জানিয়ে দেয়! ধারা একটা ঢোক গিলে আস্তে আস্তে পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। জমিরন বিবির মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু এর পরেই ধারাকে অবাক করে দিয়ে হঠাৎ করে জমিরন বিবি হেসে উঠে বললেন, ‘কিরে ছেড়ি! সোয়ামীর লগেই তো দেহা করোছ কোন নাগরের লগে তো আর না! এতো ডরানির কি আছে?’
দাদীর হাসি শুনে ধারা ঝট করে মাথা তুলে তাকালো। তার দাদী হাসছে! সত্যি?
জমিরন বিবি হাসি থামিয়ে বললেন, ‘হোন ছেমড়ি, সাবধানে থাকিস। তোর বাপ চাচায় যা শুরু করছে! দেইখা ফেললে কিন্তু মেলা ঝামেলা করবো। একটা কথা মনে রাখবি, বিয়ার পর কিন্তু মাইয়া গো স্বামীই সব। স্বামী ভালা হোক খারাপ হোক হের লগেই থাকতে হইবো। ঐ বাড়িই এহন তোর বাড়ি। এইয়া সব পর। আমার পোলাগুলার মাথার তার ছিড়া গেছে। বেশি পইড়া বেশি বুঝা শিখখা গেছে। ওগো লইয়া ভাববি না। স্বামী যা কইবো তাই করবি। বুঝছোস?’
ধারা খুশির সাথে ছলছল চোখে মাথা দুলিয়ে দৌঁড়ে গিয়ে দাদীকে জড়িয়ে ধরলো। দাদী তার পক্ষে থাকবে এটা ধারা কখনো আশা করেনি। জমিরন বিবিরও প্রথম থেকেই তার দুই ছেলের সিদ্ধান্ত পছন্দ হয়নি। তিনি আগেকার দিনের মানুষ। তালাক শব্দের সাথে ততোটা অভ্যস্ত নন। তার নাতনী স্বামী বাড়ি ছেড়ে আসবে তারপর তাদের তালাক হবে ভাবতেই রুহু কেঁপে উঠে জমিরনের। তিনি বিশ্বাস করেন বিয়ের পর মেয়েদের স্বামী বাড়িই সব। যাই হয়ে যাক তাদের সেখানেই থাকা উচিত। তাই নিজের নাতনীর সংসার বাঁচাতে মনে প্রাণে চান ধারা আবার শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাক। আবার সব ঠিক হোক। তাই বলেই তো মাঝ রাতে ঘুম ভেঙে ধারা শুদ্ধ’র গোপন সাক্ষাৎ সম্পর্কে অবগত হয়েও তিনি কাউকে কিছু বলেননি।
ধারা দাদীকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ পর জমিরন বিবি বললেন, ‘ছাড় ছেমড়ি, এতো জোরে ধরছোস কে? মাইরা লাইবি নাকি! এতো কান্দন লাগবো না এহন। ঘুমায় থাক। নইলে তোর ভাতারে আইলে তার লগে পিরিতি আলাপ করবি কেমনে?’
ধারা চোখের পানি মুছে দাদীকে ছেড়ে হেসে ফেললো। জমিরন বিবি বললেন,
‘তোমরা কি মনে করছো? বুড়া মানুষ দেইখা
রাইতের আন্ধারে কি হয় আমি কিছু টের পাই না। এই চুল কি পাকছে বাতাসে?’
ধারা লজ্জা পেলো। জমিরন বিবি বললেন,
‘হইছে আর শরম পাইতে হইবো না। এমন দিন আমাগোও গেছে।’
এরপর তিনি মাথায় ঘোমটা টেনে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করার আগে বললেন,
‘আর একটা কথা, তোর সোয়ামী রাতের বেলা খালি হাতেই হউরবাড়ি আইয়া পড়ে কেন? জানে না হের একটা দাদী হাউড়িও আছে। হেরে কবি আমার লেইগা মিডা পান নিয়া আইতে। জমিরন বিবিরে খালি হাতে পডানি যাইবো না।’
এই বলে দাদী চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। খুশির সাথে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ধারা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলো।
__________________________________________
সকাল বেলা তালুকদার বাড়ির সবাই একসাথেই টেবিলে খেতে বসলো। ধারার মন ভীষণ চঞ্চল হয়ে আছে। আজ শাহেদ বাড়িতে থাকবে না। তার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবে। এদিকে আজিজ সাহেবও কি একটা কাজে সারাদিন বাড়ির বাইরে থাকবেন। এই সুযোগে ধারা আজ শুদ্ধ’র সাথে দেখা করবে। ঘুরতে যাবে তারা দুজন। হাতে তো সারাটা দিন আছেই৷ আসমাকে ধারা বলে রেখেছে। জমিরন বিবিও জানেন। অতএব তেমন কোন সমস্যা হবে না। এখন শুধু সময় যাওয়ার অপেক্ষা। কখন সবাই ঘর থেকে বেড়োবে! শাহেদ আর আজিজ খাওয়া বাদ দিয়ে জমিয়ে আলোচনায় নেমেছে। সামনের নির্বাচনই মূল প্রসঙ্গ। হঠাৎ তারা কথায় কথায় ধারার বিয়ের প্রসঙ্গে চলে এলো। তারপর তাদেরকে আলাদা করা নিয়ে। ধারার ভেতরে যেই খুশিটা ছিল তা নিমেষেই মিলিয়ে গেলো। শাহেদ শুদ্ধ’র ব্যাপারে যা না তা বলতে লাগলো। ধারার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইলো না। ইচ্ছা করলো সব বাদ দিয়ে এক ছুট কাঁদতে। এতো ভালো মানুষটা! তবুও তাকে নিয়ে রোজ কতো খারাপ কথা শুনতে হয় ধারাকে। ধারার ভীষণ কষ্ট লাগে। ওদেরকে আলাদা করা নিয়ে খোলামেলা এমন কঠিন কঠিন কথা হতে লাগলো যা ধারার পক্ষে শোনা খুবই কষ্টকর। তার চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে লাগলো। আজিজ সাহেব তা দেখে বললেন,
‘এসব কান্নাকাটি করে লাভ নেই। তুমি তাই করবে যা আমি বলবো।’
ধারা কিছু বলতে চাইলো কিন্তু তার আগেই আসমা টেবিলের নিচ দিয়ে ধারার হাত ধরে থামিয়ে দিলো। আজিজ সাহেব আর শাহেদ চলে গেলে ধারা খাওয়া বাদ দিয়ে উঠতে গিয়েও উঠলো না। কান্না সমেত খেতে লাগলো। শুদ্ধ বলেছে ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করতে। শুদ্ধ’র কথা সে ফেলবে না।
__________________________________________
দিনটা সুন্দর। মেঘলাটে ভাব। আকাশ পরিষ্কার হলেও রোদের তেজ নেই। মৃদুমন্দ বাতাস মন ফুরফুরে করে রাখে। শুদ্ধ অনেকক্ষণ ধরে স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তাটিতে বাইক নিয়ে ধারার জন্য অপেক্ষা করছে৷ তার গায়ে হাতা ফোল্ড করে পড়া ব্রাউন কালারের একটা চেক শার্ট। এবং হোয়াইট জিন্স। হাতে একটা সাধারণ কালো বেল্টের ঘড়ি। বাইকটা তার নয়। আজকের সারা দিনের জন্য এক বন্ধুর থেকে ম্যানেজ করেছে। রাস্তাটা নির্জন। তেমন কারো চলাফেরা নেই। মাঝে মধ্যে এক দুটো যান বাহন চলাচল করছে৷ খানিক পর ধারা এলো। ধারাকে দেখে শুদ্ধ হাসিমুখে কিছু বলার আগেই হঠাৎ তাকে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে কেঁদে উঠলো ধারা। শুদ্ধ অবাক হলো৷ ধারার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে ধারা? আপনি কাঁদছেন কেন?’
ধারা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরে যেতে চাই না শুদ্ধ। আমাকে তোমার সাথেই নিয়ে চলো। যতো সময়ই যাক না কেন? কিচ্ছু ঠিক হবার না। আমি আমার বাড়ির লোকদের চিনি। আমার আর ভালো লাগছে না।’
শুদ্ধ ধারার মাথা তুলে কপালের সামনে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে বলল, ‘ধারা, এভাবে ভেঙে পড়বেন না। আমি একবার বলেছি না সব ঠিক হয়ে যাবে যদি আমরা ঠিক থাকি। হার মেনে নিলে কি করে হবে?’
‘কিন্তু শুদ্ধ, আমরা তো স্বামী স্ত্রীই না? আমরা যদি একসাথে থাকতে চাই তাহলে আমার পরিবারের নিষেধ আমাদের মানতে হবে কেন?’
‘সেটাই তো ধারা। আমরা স্বামী স্ত্রী। এখন যদি আপনার ও বাড়ি থেকে চলে আসতে হয় তাহলে আসতে হবে লুকিয়ে৷ আমাদের একটা হালাল সম্পর্ক। আমরা কেন লুকিয়ে পালিয়ে আসবো? সমস্যা থেকে ভাগলে সেটা কখনোই ঠিক হবে না। সারাজীবন এর বোঝা টেনে যেতে হবে। তাই না ভেগে সমস্যার সামনাসামনি হয়ে তার সমাধান করতে হবে। আর আমরা যদি এখন এমন একটা স্টেপ নেইও তাহলে আপনার পরিবার হয়তো আপনার সাথে কোনদিন আর যোগাযোগও রাখবে না। আমার মূল ভয়টা এদিকেই।’
ধারা কেঁদে বলল, ‘না রাখলে না রাখুক। আমার দরকার নেই।’
শুদ্ধ ব্যগ্র দিয়ে বলল, ‘এটা কেমন কথা ধারা! আপনাকে আমি পরিবারের সামনে নিজের মতটা প্রকাশ করতে বলেছি। তাদের বিরোধিতা করতে তো বলেনি। বাবা মা আমাদের জন্য অনেক ইম্পর্টেন্ট। তাদের মনে কখনো কষ্ট দিবেন না। যাই হোক না কেন, সেটা আপনার পরিবার। আপনি এই পর্যন্ত বড় হয়েছেন তাদের জন্যই। একটা পূর্ণাঙ্গ পরিবার পাওয়াও অনেক ভাগ্যের ব্যাপার ধারা। এভাবে তাকে হেলাফেলা করবেন না। তাদেরকে আপনার পয়েন্ট অফ ভিউটা বোঝান। একবার ব্যর্থ হলে আরেকবার বোঝান। বারবার বোঝান। তবুও তাদেরকে রাজী করিয়ে তারপর আসুন। আমি চাই না আমার কারণে আপনার পরিবারের সাথে আপনার সম্পর্ক খারাপ হোক৷ আপনি পারবেন না ধারা?’
ধারা অপলক শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। তার বাড়ির লোক শুদ্ধকে শত অপছন্দ করলেও শুদ্ধ কতোটা শ্রদ্ধার সাথে তাদের নিয়ে কথা বলছে। তাদেরকে সমর্থন করছে। শুদ্ধ তো শুদ্ধই। ধারা তো বুঝে। না জানি তার পরিবার কবে বুঝবে! কবে শুদ্ধ’র জন্ম পরিচয়ের চাইতে তার ব্যক্তিত্বটা তাদের কাছে বড় হবে! ধারা আলতো করে মাথা দুলিয়ে বলল সে পারবে। শুদ্ধ মৃদু হেসে বলল,
‘আপনি অযথাই এতো ভয় পাচ্ছেন। আপনি যদি না চান তাহলে আপনাকে কিভাবে আমার থেকে আলাদা করবে? আইনের নিয়মকানুন বলেও তো একটা কথা আছে৷ নাকি আপনি আবার ততোদিনে আমাকে না চাইবেন।’
শেষের কথাটা শুদ্ধ মজা করে বলেছিল৷ ধারা চোখের পানি মুছতে মুছতে কপট রাগ নিয়ে শুদ্ধ’র গায়ে মৃদু বারি দিয়ে বলল,
‘তোমার মনে হয় আমি এমনটা করবো!’
শুদ্ধ ঠোঁট চেঁপে হেসে বলল, ‘মনে তো অনেক কিছুই হয়৷ কিন্তু সব তো আর বলতে পারি না। বাই দা ওয়ে, আপনি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? আজকে আপনি আসার পর থেকে আমাকে তুমি তুমি করে বলছেন।’
ধারা লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে ঘুরে বলল,
‘ইশ! মোটেও না।’
শুদ্ধ ধারার সামনে এসে বলল, ‘মোটেও না মানে! এই মাত্রই তো আবার বললেন। সোজা সাপ্টা বললেই হয়, আপনার মধ্যে আজকাল বউ বউ ফিলটা খুব ভালো করেই জাগছে। সমস্যা নেই, আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।’
‘তাহলে আপনি আমাকে আপনি আপনি করেন কেন?’
‘সেটা তো বলি আপনি বলেন বলে। ইকুয়ালিটি!’
‘আমি বললেই আপনাকে বলতে হবে! অনেক ওয়াইফরা তো হাজবেন্ডদের ‘আপনি’ করে বলেই। এর জন্য কি হাজবেন্ডরাও ‘আপনি’ বলে? এমন ভাবে আপনি আপনি করতে থাকেন যেন মনে হয় আপনি নিজের বউয়ের সাথে না কোন অ্যান্টির সাথে কথা বলছেন।’
ধারার ভোতা মুখের কথা শুনে শুদ্ধ’র খুব হাসি পেলো। সে মুচকি হেসে বলল,
‘আমার তো সেটাই মনে হয়।’
ধারা আকাশ থেকে টপকে পড়ার মতো করে বলল, ‘সেটাই মনে হয় মানে? আমি অ্যান্টির মতো? একটা ঊনিশ বছরের মেয়েকে আপনার অ্যান্টির মতো মনে হয়? এটা আপনি বলতে পারলেন!’
কপট রাগ দেখিয়ে ধারা শুদ্ধ’র থেকে মুখ ঘুরিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে রইলো। শুদ্ধ পেছন থেকে ধারার কানের কাছে মুখ নিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আচ্ছা সরি! ভুল বলেছি। আপনাকে অ্যান্টির মতো লাগে না। বউয়ের মতোই লাগে। আর এখন থেকে আমি আমার বউয়ের মতো করেই কথা বলবো। সহ্য করতে পারবে তো?’
লজ্জায় ধারার গালদুটো লাল হয়ে এলো। সে দ্রুত কথা কাটিয়ে ঘুরে বলল, ‘এখন সারাদিন কি এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকবেন? আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন না?’
এই বলে ধারা বাইকের কাছে এসে দাঁড়ালো। শুদ্ধ বাইকে উঠতে উঠতে অলস ভঙ্গিতে বলল,
‘বাহ! ভালো সুবিচার করলে। আমাকে প্রথমে রাজী করিয়ে এখন নিজেই পাল্টি মেরে নিলে। এখনও ‘আপনি!’
ধারা পেছনে বসতে বসতে রক্তিম মুখে খুবই সময় নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আস্তে চালিয়ো।’
শুদ্ধ একটা দুষ্ট হাসি দিয়ে জোরে বাইক স্টার্ট দিলো। মাঝে যতোটুকুও বা দূরত্ব ছিল সবটা পূরণ হয়ে ধারা একদম আকস্মিক শুদ্ধ’র গায়ে লেপ্টে পড়লো। কপালে হাত দিয়ে ভাবলো, এই ছেলে এখনই যা শুরু করেছে। এখনও তো সারাটা দিনই বাকি। না জানি তখন কি করে!
চলবে,