#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৩২
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
দূর দূরান্ত থেকে লোকজন শুদ্ধ’র ক্ষেতের ধান দেখতে আসলো। ধানের ফলন দেখে তারা সবাই বিস্মিত। খবর পেয়ে কৃষি বিভাগ থেকেও লোক আসলো। তারাও খুব প্রশংসা করলো। কিছু ধান সংগ্রহ করে পাঠানো হলো গবেষণাগারে। এ নিয়ে কিছু পত্র পত্রিকায় লেখালেখিও হলো। যেমনটা দেখা যাচ্ছে প্রতিবার এই ধানের ফলন যদি এমনই হয় তাহলে কৃষকদের জন্য ব্যাপক লাভজনক হবে এই ধান। উৎপাদনে খরচ কম। সারের অধিক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। খুবই উচ্চ ফলনশীল। ধান কাটার পর দেখা গেলো অনুমানের চাইতেও পরিমাণ বেশি। রান্না করে দেখলো এই ধানের ভাতও সুস্বাদু। অন্য চালের তুলনায় চিকন। শুদ্ধ ধান বিক্রি করে মাত্র এক বিঘাতেই পাঁচ লাখের মতো আয় করলো। মোট দেঢ় বিঘার মতো সে এই ধান চাষ করেছিলো। লাভ হলো প্রচুর। কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধি পেলো। শুদ্ধ অনেকের মাঝে বিনা টাকায় ধানের বীজ দিতে লাগলো। সে চায় সবাই এই ধান লাগিয়ে সফল হোক। কৃষকদের দারিদ্র্যতা ঘুচে যাক। কৃষি অধিদপ্তর থেকেও এই পরিকল্পনা করা হলো। তারা ধান গবেষণায় পাঠিয়েছে। মোক্ষম ফলাফল আসলে তারা এই ব্যাপারে আরো বিশদ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তাদের এখন দেখার বিষয় এই ধান সব মৌসুমেই চাষ করা সম্ভব কিনা। আর প্রতিবারই এরকম বাম্পার ফলন হবে কিনা। যদিও এবার এই ধান চাষ তাদের পর্যবেক্ষণে ছিল না তাই ঠিক করা হলো পরেরবার শুদ্ধকে এই ধান আবারো চাষ করিয়ে তারা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ পর্যবেক্ষণে রাখবে। যদি ফলাফল আশাজনক ভাবে হয় তাহলে এই ধানের বীজ বাংলাদেশের সকল কৃষকদের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হবে। আর এই ধান চাষের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। তার আগেই শুদ্ধ একটি কৃষি ক্লাব গঠন করে সপ্তাহে একদিন গ্রামের সাধারণ কৃষকদেরকে কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার আর অধিক ফলনের চাষাবাদের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে শেখাতে থাকে। শুদ্ধ’র নাম অনেকটা ছড়িয়ে যায়। অনেক স্থান থেকে ইন্টারভিউও নিতে আসা হলো তার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা একজন শিক্ষিত যুবকের কৃষিতে হাত আর নতুন উদ্ভাবন সাধারণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেললো। সেবছর শুদ্ধ’র ফলের খামারেও ব্যাপক লাভ হলো। ব্যাংক থেকে নেওয়া লোন ধীরে ধীরে শোধ করে দিল সে। তার উপরে খানিক সঞ্চয়ও হতে লাগলো। সবাই বলতে লাগলো শুদ্ধ’র সোনার কপাল। কিন্তু এই সোনার কপাল অর্জনের পেছনে কতোটা আত্মত্যাগ আর পরিশ্রমের ছাপ আছে তা বোধগম্য হলো খুব কম লোকেরই। এরপরের সময়গুলো খুব দ্রুত কাটতে লাগলো। এর মাঝে অনেককিছুই পরিবর্তন হলো। পরিবর্তন হলো তাদের জীবনধারাও। গ্রামে তাদের সেই দোচালা ঘর পুরনো হতে হতে একসময় থাকার অযোগ্য হয়ে পড়লো। শহুরে শাখায় সেই সময় শুদ্ধ’র কাজের চাপও ভীষণ বাড়তে লাগলো। ধারার কলেজে যেতে সুবিধা আর শুদ্ধ’র কাজ সবকিছু সার্বিক বিবেচনায় নিয়েই তারা মূল শহরের মধ্যে একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করলো। শুদ্ধ’র মস্তিষ্ক তুখোড়। সাথে সে প্রচন্ড পরিশ্রমীও। কাজ এবং কাজের পদ্ধতি দুটোই সে ভালোমতো বোঝে। তার বিচক্ষণ ভাবনার সাথে সে সঠিক পন্থাই অবলম্বন করতে থাকে। আস্তে আস্তে তার কাজের পরিধি বাড়তে লাগলো। লাভের অংশ দিয়ে সে ফলের খামারের পরিসর আরও বৃদ্ধি করলো। আরও নানাজাতের ফলের চাষ বাড়ালো সেই সাথে আরও লোক নিয়োগ করলো। বিচক্ষণতার সাথে অর্থের সঠিক প্রয়োগ ঘটানো শুদ্ধ জানতো। তথাপি শুধু লাভ বৈকি আর ক্ষতি তার হলো না। এরপর সে নিজের পুঁজি আর ব্যাংক থেকে আরও কিছু লোন তুলে সে তার খামারের টাটকা ফলের রস প্যাকেটজাত করার একটি ছোটখাট ফ্যাক্টরি তৈরির সিদ্ধান্ত নিল। যেখানে কোন ভেজাল মেশানো হবে না। দেশের মানুষ যেন নির্ভেজাল বিশুদ্ধ ফলের রস গ্রহণ করতে পারে সেই সম্পূর্ণ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই মুহুর্তে একা তার পক্ষে এতো বড় উদ্যেগ নেওয়া সম্ভব না। তাই সে অন্য একজনের সাথে শেয়ারে এই প্রজেক্টে নামার প্রস্তুতি নেয়। আর সেই অন্য একজন আর কেউ নয় বরং ধারার ছোট চাচা শাহেদ। সেদিনের পর থেকে সময়ের সাথে সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে সব ঠিক যায়। যেই শাহেদ শুদ্ধ’র পরিকল্পনাকে নিছক বেকুবের কাজ ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতো না, এখন সেই শাহেদই শুদ্ধ’র কাজের গতি আর সাফল্য দেখে নিজ থেকেই সেধে শুদ্ধ’র ফ্যাক্টরিতে থার্টি পার্সেন্ট শেয়ার হিসেবে থাকার অফার দেয়। শুদ্ধও মুচকি হেসে পেছনের সব ভুলে সব স্বাভাবিক করে নেয়। একটার পর একটা সুযোগ এসে শুদ্ধ’র হাতে ধরা দিতে থাকে। সাফল্য ত্বরান্বিত হয়। এরপরে কেটে যায় আরো একটি বছর।
__________________________________________
সিএনজি থামতেই ধারা মাথা বের করে আশপাশটা দেখে নিলো। আকাশ আজকে একদম ঝকঝকে। মেঘের ছিটেফোটাও নেই। রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সুন্দর। আর সুন্দর হবেই বা না কেন? আজ যে ধারার জীবনের একটা বিশেষ দিন। আজ তারা তাদের নতুন বাসায় উঠবে। অবশেষে শহরের মাঝে তাদের সম্পূর্ণ নিজের একটা বাসা হয়েছে। শুদ্ধ’র পরিশ্রমের টাকায় কেনা নতুন ফ্লাট। তাদের নতুন ঠিকানা। ধারা সিএনজি থেকে নেমে দাঁড়ায়। তার পরনে ধবধবে সাদা রঙের সেলোয়ার কামিজ আর গাড় নীল রঙের ভারী ওড়না। চোখের সামনের লোহার গেইট টার পরেই ছয় তলায় একটা বিশাল বিল্ডিং। তার ঠিক চার তলাতেই ধারাদের ফ্লাট। শুদ্ধ বলেছে। ধারা হাত উঠিয়ে অনুমান করে ঠিক এই অংশটুকুতেই হয়তো তাদের ফ্লাটটা হবে। বিল্ডিংটা এতো সুন্দর। নিশ্চয়ই তাদের ফ্লাট আরো সুন্দর হবে। চুমকি আর খোদেজা ইতিমধ্যেই লোহার গেইটের মধ্যে ঢুকে গেছে। শুদ্ধ ঢুকতে গিয়ে দেখে ধারা না এসে উপরে তাকিয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুদ্ধ গিয়ে ধারার হাত ধরে টেনে তার সম্বিৎ ফিরিয়ে দ্রুত ভেতরে নিয়ে যায়। লিফট দিয়ে চার তলায় পৌঁছানোর পর তারা সবাই বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মালপত্র আগেই নিয়ে আসা হয়েছে। শুধু তাদের আসাই বাকি ছিল। শুদ্ধ চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেয়। ভেতরের দিকে তাকিয়ে সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। সব ঝকঝকে, নতুন। একদম পরিপাটি ভাবে সাজানো। মেঝের সাদা টাইলসগুলো গ্লাসের মতো চকচক করছে। বাসা সবারই খুব পছন্দ হয়। শুদ্ধ এতদিন কাউকে আসতে দেয়নি। একেবারে সব একসাথে দেখাবে বলে। খোদেজা আল্লাহ’র নাম নিয়ে বাসার ভেতরে প্রবেশ করলে চুমকিও উৎফুল্ল হয়ে লাফাতে লাফাতে ভেতরে ঢুকে পড়ে। ধারা যখনই ভেতরে যাবার জন্য এক পা বাড়াতে যাবে তার আগেই শুদ্ধ হাত ধরে আটকে দেয়। ধারা অবাক হয়ে তাকাতেই শুদ্ধ মিষ্টি করে হেসে বলে,
‘এভাবে না। একসাথে। ডান পা আগে দিবা আর বিসমিল্লাহ বইলো।’
ধারা মৃদু হেসে শুদ্ধ’র হাত ধরে। তারপর বিসমিল্লাহ বলে দুজনে একসাথে পা বাড়ায়, তাদের নতুন ঠিকানায়, নতুন যাত্রায়। ভেতরে ঢুকে ধারা আনন্দের সাথে বাসার আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে। সামনে অনেকটা জায়গা জুড়ে সোফা সেট বসানো। ভেতরে চারটা বেডরুম। একটা গেস্টরুম। মাঝে ডাইনিং হল। আর একটা সুন্দর রান্নাঘর। ধারা একটু প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়। এতদিন সেই দু কামরার ভাড়া বাসায় থাকতে তার দম বন্ধের মতো লাগতো। গ্রামে অর্ধপাকা পুরনো ঘর থাকলেও ভেতরে খোলামেলা ছিল। যখন তখন বাইরে বরে হতো। তাজা হাওয়া নিতো। সেখানের ব্যাপারটাই ছিল আলাদা। এরপর তাদের যেতে হয় শহরের ভাড়া বাসায়। সেখানে জায়গাও ছিল কম। আর গ্রামের মতো ওমন বেরও হওয়া যেত না। সর্বক্ষণ ঘরের মধ্যেই ধাকতে হতো। গ্রামের সেই বাড়িটাকে ধারা ভীষণ মিস করতো। গ্রামের সেই সুন্দর দিনগুলোও স্মৃতিতে এসে তাকে উদাস করে তুলতো। শুধু ভাবতো আবার কবে ফিরে যাবে সেখানে। ফিরে যাবার অপেক্ষায় ধারা অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে থাকতো। কিন্তু জীবনের তাগিদেই তাদের আর সেখানে ফেরা হয় না। জীবন চলমান। আর প্রচন্ড পরিবর্তনশীল। আমাদের অগোচরেই ইচ্ছার বিপরীতে কখন কোন পরিবর্তন স্থায়ীভাবে ঘটে যায় আমরা টেরও পাই না। শুধু হঠাৎ করে ঠাওর হলে অবাক হয়ে রই। ধারা ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর আবার মাথা থেকে মন খারাপের সব কথা ঝেড়ে ফেলে। আজ সে ভীষণ খুশি। কারণ এই বাসাটাও খুব স্পেশাল। শুদ্ধ’র নিজের অর্জনের প্রতিচ্ছবি এটি। তাদের নিজেদের বাসা। গ্রামের বাড়িটাও তাদের হলেও সেটা ছিল দাদা শ্বশুর আমলের বাড়ি। আর তারপরেরটা তো ছিল ভাড়া বাসাই। কিন্তু এইবারের টার অনুভূতিই আলাদা। শুদ্ধ’র নিজের টাকায় কেনা এটা তাদের বাসা। চোখের সামনে একটু একটু করে গড়ে উঠা এই গৃহ। এই অনুভূতি…বর্ণনাতীত।
মালপত্র আগের থেকে এনে গোছানো হলেও অনেককিছুই আবার গোছানোর মতো থেকে যায়। নতুন বাসায় কাজ কি কম! ধারা কোমরে ওড়না বেঁধে সব ঠিক করতে নেমে যায়। এতদিনে সেও পাকা গৃহিণীর মতো হয়ে গেছে। সেই নড়বড়ে অপটু ধারা নিজের সংসার এখন নিজেই সামলায়। খোদেজার এখন এতে একটু বিশ্রাম হয়। ধারা সেই সারাটাদিন ধরে সব গোছগাছ করে। খোদেজাও সাথে সাহায্য করে। সব ঠিকঠাক হতে হতে রাত হয়ে যায়। সব কাজ শেষ হলে ক্লান্ত হয়ে নিজের বেডরুমে ঢোকে ধারা। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় আয়েশ করে বসতেই হালকা গোলাপি রঙের একটা ফর্মাল শার্ট প্যান্ট গায়ে শুদ্ধ আসে। তার হাতে কিছু একটা প্যাকেটের মতো দেখা যায়। ভেতরে এসেই আশেপাশে চোখ বুলিয়ে শুদ্ধ বলতে থাকে,
‘কি দরকার ছিল তোমার এসব করার? আমি সারাদিন বাইরে ছিলাম। তুমি শুধু শুধু একা একা এগুলো করতে গেলে কেন? একটা লোক রেখেই তো করানো যেতো।’
ধারা বিছানায় হেলান দিয়ে বলল,
‘নিজেদের কাজ করতে আবার লোক রাখতে হবে কেন? আর আমি তো সব একা করিনি। মাও সাহায্য করেছে।’
শুদ্ধ বিছানায় বসতে বসতে বলল,
‘খেয়েছো কিছু?’
ধারা মাথা নাড়ালো। হাতের প্যাকেটটা খুলতে খুলতে শুদ্ধ বলল, ‘জানতাম এই শুনবো। বিরিয়ানী নিয়ে এসেছি। তোমার না পছন্দ! হা করো।’
ধারা মিটিমিটি হেসে মুখ হা করলো। শুদ্ধ নিজের হাতে একটু একটু করে ধারাকে খাইয়ে দিতে লাগলো। খাওয়ার মাঝখানে শুদ্ধ বলল,
‘এতটুকু কি হা করো! বড় করে হা করো।’
শুদ্ধ’র কথামতো ধারা বড় করে হা করলো। খাবার ধারার মুখে দিতেই ধারা একটা কামড় দিলো শুদ্ধ’র আঙ্গুলে। আচমকা এমন হওয়ায় শুদ্ধ আঁ করে চেঁচিয়ে উঠলো। ধারা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। শুদ্ধ বাম হাত থেকে বিরিয়ানীর প্যাকেট বিছানায় রেখে ‘তবে রে’ বলে ধারাকে কাতুকুতু দিতে থাকে। ধারা হাসতে হাসতে বিছানায় শুয়ে পড়ে। একসময় খাওয়া শেষ হলে হাত ধুয়ে এসে শুদ্ধ আবারো ধারার সামনে বিছানায় বসে। সেই প্যাকেটটা আবারো টেনে নিয়ে ধারাকে বলে তোমার হাতটা দাও তো। ধারা মজা করে বলে,
‘কিভাবে দেবো? কেটে?’
‘আমি মজা করছি না। সিরিয়াস।’
ধারা হাসি সংযত করে শুদ্ধ’র দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। শুদ্ধ প্যাকেট থেকে একটা লাল রঙের বক্স বের করে তার মধ্য থেকে দুটো সোনার বালা বের করে ধারার দুই হাতে পড়িয়ে দেয়। ধারা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
‘এগুলো কি?’
শুদ্ধ স্বাভাবিক স্বরে বলে, ‘চুড়ি।’
‘সোনার?’
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,
‘না রূপার।’
‘আমি মজা করছি না। সিরিয়াস।’
‘আমিও সিরিয়াস।’
‘তুমি কিনেছো?’
‘না আমাদের পাশার বাসার ভাই কিনে দেয়েছে।’
ধারা মুখ দিয়ে একটা বিরক্তিসূচক শব্দ করলো। ধারার দেখাদেখি শুদ্ধও অবিকল তেমন শব্দ করলো। ধারা বলল,
‘কবে কিনলে?’
‘আজকে।’
‘এটা কিনতেই বাইরে গিয়েছিলে?’
‘হুম।’
ধারা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করে বলল, ‘শুধু শুধু এখন এই সোনার চুড়ি কিনতে গেলে কেন? কতো দাম হবে! এমনিতেই নতুন ফ্লাট রেখেছো। তোমার ফ্যাক্টরিও সবেই চালু হলো। তারউপরে তোমার ব্যাংকের লোন এখনো বাকি। তা শোধ না করেই আগে ফ্লাট কিনে ফেললে। এখন আবার এসব…কি দরকার ছিল!’
শুদ্ধ ধারার হাত ধরে স্পষ্ট গলায় বললো,
‘দরকার ছিল। তার জন্যই কিনেছি। একটা নিজের ঘরের যেমন প্রয়োজন ছিল তেমনই প্রয়োজন ছিল নিজের বউয়ের অলংকার কেনার। আমার জন্য দুটোর গুরুত্বই এক। তোমাকে বিয়ের সময় তেমন কিছুই দিতে পারিনি। নতুন নতুন বিয়ের পর মেয়েরা কতোকিছু কিনে, একের পর এক নতুন ড্রেস কিনে, সাজসরঞ্জামের জিনিস কিনে। কিন্তু তোমাকে আমি তেমন কিছুই দিতে পারতাম না। তোমার কোন শখ আহ্লাদই আমি তেমন পূরণ করতে পারিনি। তুমিও কখনো এর জন্য কোন অভিযোগ করোনি৷ কখনো মুখ ফুটে কিছু বলোনি আমার এটা লাগবে ওটা লাগবে।’
কথাটা বলতে বলতে শুদ্ধ’র কেমন গলা ধরে এলো। শুদ্ধ’র কথার মাঝেই ধারা বাধা দিয়ে বলে উঠলো,
‘কারণ তুমি আমাকে কখনো সেই সুযোগই দাওনি। আমার যা যা প্রয়োজন ছিল সব না বলতেই তো তুমি এনে দিতে।’
শুদ্ধ মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘ওতটুকুতে কিছু হয় না। তোমাকে ওভাবে দেখতে আমার কতো খারাপ লাগতো জানো? আমার তখন ছিল না। এখন যখন আছে, এখন যখন পারছি, আমাকে করতে দাও। আমি করতে চাই। আমার বউকে আমি সব কিছু দিয়ে সাজিয়ে রাখতে চাই। তুমি বারণ করতে পারবে না। বারণ করলেও আমি শুনবো না। এটা আমার শখ। আমার ইচ্ছা।’
ধারার চোখ ছলছল করে উঠলো। সে বলল,
‘জানো, এই পৃথিবীর মধ্যে সবথেকে সুখী মেয়ে আমি। আমার থেকে বেশি সুখী আর কোন মেয়ে হতে পারবে না। কারণ কোন মেয়ে আরেকটা শুদ্ধ পাবে না।’
শুদ্ধ হেসে ফেললো। ধারার হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল,
‘তুমি চিন্তা করো না ধারা। লোন আমি আস্তে আস্তে শোধ করে ফেলতে পারবো। প্রোফিট হচ্ছে। আর ফ্লাট আগে একারণেই কিনেছি কারণ ভাড়া বাসায় তোমাদের সবার কষ্ট হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম। তাই টাকা জমতেই কিনে ফেলেছি। লোনেরও একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
ধারা উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার হাত নেড়ে নেড়ে সোনার চুড়ি দেখতে লাগলো। শুদ্ধ পেছন থেকে দেখতে লাগলো সেই দৃশ্য। জানালার কাছে গিয়ে ধারা চাঁদের দিকে মুখ করে দু হাত উঁচু করে ধরলো। শুদ্ধ এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
‘কি করছো?’
ধারা বলল, ‘চাঁদের আলোতে দেখছি কেমন লাগে। চাঁদটা কতো সুন্দর লাগে তাই না!’
শুদ্ধ পেছন থেকে ধারাকে জড়িয়ে ধরে তার কাঁধে থুতনি রেখে বলল, ‘ইশ, কে বলেছে! আমার বউয়ের থেকে বেশি না।’
ধারা লজ্জা পেয়ে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে রইলো। খানিক পর শুদ্ধ বলল, ‘আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পড়। এমনিতেই আজকে তোমার অনেক খাটাখাটনি গেছে। তোমার না কয় দিন পর একটা এক্সাম আছে? সিট পড়েছে এইবার কোথায়?’
ধারা যেই কলেজের নাম বলল তা শুদ্ধ শুনে বলল, ‘এটা তো আমাদের এখান থেকে অনেক দূরে। পরীক্ষা শেষ হবার পর আসতে আসতে রাত হয়ে যাবে। আচ্ছা তুমি পরীক্ষা দিতে যেয়ো। আসার সময় আমি গিয়ে নিয়ে আসবো।’
ধারা মাথা দুলালো।
ধারার পরীক্ষার দিন এসে পড়লে সেদিন শুদ্ধ তার কাজে আটকা পড়ে গেলো। তবুও ঝটপট কাজ শেষ করে পরীক্ষার কেন্দ্রে পৌঁছাতে তার একটু দেরি হয়ে যায়। তখনও সেখানে কিছু শিক্ষার্থী বাসায় ফেরার তোর জোড় করছিলো। মোটামুটি মানুষ ছিল। শুদ্ধ ভেবে নিলো তার মধ্যে ধারাও আছে। চারিদিকে একটু একটু করে অন্ধকার নামতে শুরু করলো। শুদ্ধ ধারাকে পেলো না। বিশাল বড় ক্যাম্পাস। সে ভাবলো অন্য কোথাও আছে। খুঁজে দেখলো তবুও পেলো না। ফোন করে দেখে ফোন বন্ধ। শুদ্ধ’র খানিক অস্থির বোধ হলো। এদিকে মাগরেবের আযান পড়ে গেছে। আস্তে আস্তে চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে গেলো। শুদ্ধ আরও দুই ঘন্টা যাবৎ পুরো ক্যাম্পাস তন্ন তন্ন করে খুঁজলো। ধারাকে আর পেলো না মানে পেলোই না। শুদ্ধর বুকের মধ্যে ধড়ফড় করতে লাগলো।
চলবে,