#হাতটা_রেখো_বাড়িয়ে
#পর্ব-৮
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি
লাল রঙের একটা গামছা দিয়ে ধারা দ্রুতগতিতে মাথা মুছে চলেছে। একটু আগেই সে গোসল সেড়েছে। এই অবেলায় সন্ধ্যা পানে গোসলে অবশ্যই শরীর ঠান্ডা হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার ক্ষেত্রে হয়েছে বিপরীত। তার মাথা প্রচন্ড গরম। মেজাজ সপ্তম ডিগ্রীতে চড়ে আছে। খোঁচারাজের উপর রাগ তো তার আছেই, তার সাথে সাথে আছে নিজের উপরেও। কত সুন্দর করে খোঁচারাজের খোঁচার উত্তরে ভাব নিয়ে একটা কথা বলেছিল আর শেষে কিনা কি হলো! পা পিছলে পড়ে গিয়ে কাঁদায় মাখামাখি হলো। আর তারপর উনার গা জ্বালা হাসি তো ফ্রিতে কপালে জুটেছেই। মান ইজ্জত আজ ঐ পুকুর পাড়ের কাঁদার সাথেই লুটোপুটি খেলো। ধুর! দাঁত কিড়মিড় করে মাথা মুছতে মুছতে ধারা বিড়বিড় করতে লাগলো, ‘কি মনে করে সে নিজেকে! সবসময় শুধু আমার পেছনে পড়ে থাকা! আর এতো চালাক! প্রত্যেকটা কথা যেন মাথার মধ্যে সাজিয়ে রাখে৷ সেদিন রাতে শোবার কথা নিয়ে করলো? যে ‘আপনার যদি মনে হয় আমার পাশে ঘুমালে আপনার নিজের উপর কন্ট্রোল থাকবে না তাহলে আপনি আলাদা ঘুমাতে পারেন!’ এখন এরকম একটা কথা বলার পর কেউ কিভাবে আলাদা ঘুমাতে পারে? আর যদি আমি ঘুমাতাম তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়াতো? তাকে দেখলে আমার নিজের উপর কন্ট্রোল থাকে না! হুহ! নেহাৎ হাসলে একটু সুন্দর লাগে…আচ্ছা ঠিকাছে একটু না অনেকটাই সুন্দর লাগে। তাতে কি হয়েছে? সে কি সবার মাথা কিনে নিয়েছে?’
এভাবেই কখনো নিজের রাগ ঝেড়ে, শুদ্ধ’র বলা কথা নকল করে, আবার নিজের মনেই কথার কাটাকাটি করে বারন্দায় দাঁড়িয়ে ধারা একমনে মাথা মুছতে মুছতে বিড়বিড় করতে লাগলো। রুমের ভেতরে বুকে দু হাত গুঁজে দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ধারার রাগে গজগজ করার এই সুন্দর দৃশ্যটি উপভোগ করতে লাগলো শুদ্ধ। তার মুখে মিটিমিটি হাসি বিরাজমান। ধারা খুব শান্ত শিষ্ট, লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। কথা বার্তাও বলে যেন নিজের ভেতরটা আড়ালে রেখে। খুব কম। আজ যেন নিজের ভেতরটা সম্পূর্ণ মেলে ধরেছে সে। যেটা মনে আছে সরাসরি প্রকাশ করছে। রাগ দেখাচ্ছে, অভিমান করছে, ঝগড়ার সুরে কথা বলছে। শুদ্ধ’র দেখে ভালো লাগলো। ভীষণ ভালো লাগলো। মুখের কাছে হাত নিয়ে একটু খুকখুক করে কেশে ধারার ধ্যান কেড়ে নিল শুদ্ধ। কটমট করে শুদ্ধ’র দিকে তাকিয়ে ধারা গামছাটা বারান্দার রশির উপর রেখে দিয়েই ভেতরে চলে এলো। শুদ্ধকে পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে আসতেই তার মাথায় আসলো একটা বুদ্ধি। খোঁচারাজের লুঙ্গি ভীতির সুযোগ নিয়ে যদি তাকে একটু জব্দ করা যায় তাহলে তো ব্যাপারটা মন্দ হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ! কিছুক্ষণ পরই আবার রুমে গিয়ে ধারা দেখলো শুদ্ধ নেই। এক মিনিট সময়ও নষ্ট না করে শুদ্ধ’র সব কয়টা জিন্স, ট্রাউজার নিয়ে একটা পানি ভরা বালতিতে চুবিয়ে রাখলো ধারা। কাঁথা সেলাইয়ের জন্য খোদেজা পাশের বাড়ির থেকে যে আধো পুরনো লুঙ্গি এনে রেখেছিল। তারই একটা রেখে দিল সামনে। কাজ শেষ হতেই নিজের বুদ্ধিতে পুলকিত হয়ে উঠলো ধারা। প্রসন্ন মুখে ভাবতে লাগলো, ‘ব্যাস! খোঁচারাজ, আজকে এই ধারা তোমাকে দেখাবে কয়টা ধানে কয়টা চাল হয়। সবসময় শুধু আমাকে জব্দ করা! আজকে তোমার পালা। সব কাজ শেষ। এখন শুধু তোমার পরনের প্যান্টটাই ভিজিয়ে দেওয়ার পালা!’
রাত গাঢ় হতে লাগলো। আর ধারা রইলো সুযোগের অপেক্ষায়। কখন শুদ্ধ’র পরনের ট্রাউজারটা ভিজিয়ে দিতে পারবে! অন্যদিকে ব্যস্ত থেকেও সদা দৃষ্টি মেলে ধরে রাখলো শুদ্ধ’র দিকেই। কিন্তু আফসোস এমন কোন সুযোগই ধারার কাছে এলো না। পাশের বাড়ির আবুল যখন শুদ্ধ’র সাথে আলাপের জন্য সামনের বারান্দায় বসে ছিল। তখন তাদের দুজনকে শরবত দেওয়ার বাহানাতেও ধারা একটা গ্লাস ইচ্ছে করে শুদ্ধ’র হাঁটুর উপর ফেলতে চাইলো। কিন্তু হলো না। পায়ে হোচট খেয়ে সেই গ্লাস ভুলে পড়লো আবুলের উপর। প্লান তো ভন্ডুল হলোই। তারউপর নিজের কাজের জন্য লজ্জিত হয়ে ধারা দ্রুত বারবার আবুলকে সরি বলে একপ্রকার দৌঁড়েই সেখান থেকে চলে এলো। তারপর যখন রাতের খাবার সময়ও সবাই একসাথে খেতে বসলো, তখনও শুদ্ধকে পানির জগ দেবার বাহানা করে ধারা জগটা কাত করে শুদ্ধ’র পা বরাবর ফেলে দিল। সঠিক সময়ে পা সরিয়ে নেওয়ায় সেবারও বেঁচে গেল শুদ্ধ। জগ সহ ই মেঝেতে পড়ে গেল ধারা। পানি পড়ে মেঝে তলিয়ে গেলো। ধারা এবারও অসফল। উপস্থিত সবাই বিস্মিত। আজ বারবার ধারার হাত থেকে এমন পানি পড়ছে কেন? খোদেজা উদ্বিগ্ন মুখে বলল,
‘বৌ, তোমার শরীরটা কি খারাপ লাগতাছে? মাথা ঘুরায়?’
ধারা লজ্জিত মুখে বলল, ‘না মা, আমি ঠিক আছি। ঐ একটু হাত ফসকে যাচ্ছে বারবার!’
এই বলে একটা ন্যাকড়া নিয়ে ধারা মেঝে মুছতে লাগলো। চুমকি খেতে খেতে বলল,
‘ভাবী, তোমার হাতে কি তেল ভরানো?’
শুদ্ধ হেসে বলল, ‘তোর ভাবীর মনে হয় তখন কাঁদায় পড়ে গিয়ে চোখে সমস্যা হয়ে গেছে চুমকি? মাথাতেও হতে পারে। সেটা হলে আবার একটু চিন্তার বিষয়ই।’
ধারা সরু চোখে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। যতবারই প্লান ভন্ডুল হোক ধারা হার মানবে না। এই খোঁচারাজকে আজকে একটা শিক্ষা তো ধারা দিয়েই ছাড়বে। মনে মনে আবারও কিছু একটা ভাবলো সে। এবার আর ধারা তার প্লানে বিফল হবে না। এবার করেছে একদম মোক্ষম প্লান। শুদ্ধ না ফেঁসে পারবেই না। প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে শুদ্ধ একবার দরজার সামনে রেখে দেওয়া বালতির পানি দিয়ে হাত মুখ ধোয়। সেই সুবিধা মতোই ধারা ওডা’র উপরের বাঁশের সাথে ফিক্সড করে একটা পানি ভর্তি মগ রেখে দিয়েছে। তার হাতলের দড়ি বেঁধে সেট করেছে সিঁড়ির কাছে। অন্ধকারে এর মধ্যে পা বেজে একটু নাড়া লাগলেই মগ উপর হয়ে সব পানি পড়বে সোজা শুদ্ধ’র মাথার উপর। তারপর নিশ্চয়ই খোঁচারাজকে পরনের ট্রাউজারটা পাল্টে আর কোন প্যান্ট খুঁজে না পেয়ে শেষমেশ লুঙ্গিই পড়তে হবে! তার চেহারাটা তারপর হবে একদম দেখার মতো! কল্পনায় ভাবতেই নিজের মনে লাফিয়ে উঠলো ধারা। এইবার কিছুতেই ফেইল হওয়া যাবে না। রাতে ঘুমানোর সময় হলে ধারা বারবার শুদ্ধকে তাগাদা দিতে লাগলো বাইরে গিয়ে হাত মুখ ধোবার জন্য। শুদ্ধ যতই বলে একটু পরে যাবে, ধারা যেন ততোই নাছোড়বান্দা। শুদ্ধ’র খানিক খটকা লাগলো। তবুও তা পাত্তা না দিয়ে সে গিয়ে ভালো মতোই হাত মুখ ধুয়ে আসলো। ফিরে আসতেই ধারা চোখ কপালে তুলে ফট করে জিজ্ঞেস করে ফেললো,
‘একি! আপনি এমন শুকনো কেন?’
শুদ্ধ বুঝতে না পেরে বলল, ‘কোথায় শুকনো? আমার মুখ তো ভেজাই। এই যে!’
এই বলে সে ধারার দিকে আঙ্গুল দিয়ে এক ফোঁটা পানি ছুঁড়ে মারলো। ধারা সেদিকে খেয়াল না করে তৎপর হয়ে বলল, ‘আপনার শরীর তো শুকনো!’
‘আমি কি গোসল করতে গিয়েছি যে সব ভেজা থাকবে! শরীর তো শুকনো থাকবেই।’
এই বলে শুদ্ধ চলে গেলো। বিরক্তিতে ধারা সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুই বুঝতে পারলো না। এইবারের প্লানটাও কিভাবে কাজ করলো না! সে নিজে গিয়ে একবার সেই জায়গায় দাঁড়ালো। পা দিয়ে দড়িটা খোঁচা দিতে লাগলো। দেখলো দড়িটা অনেক টাইট হয়ে আছে। নড়ছে না। বোধহয় ভালো মতো দড়িটা সেট করতে পারেনি। আরো কিছুক্ষণ দড়িটা নিয়ে টানাটানি করার পর শেষমেশ বিরক্ত হয়ে ধারা পা দিয়ে দড়িটা একবার জোরেই টান দিল। আর সাথে সাথে পানি ভর্তি মগের সব পানি তার মাথার উপর পড়লো। মুখ হা হয়ে গিয়ে ধারা নিজের ভেজা শরীর নিয়ে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আর তারপরই কানে ভেসে এলো শুদ্ধ’র কান ফাঁটানো হাসির আওয়াজ। হাসতে হাসতে শুদ্ধ পেছন থেকে বেড়িয়ে এলো। সে মূলত সন্দেহ বশতই ধারার পেছন পেছন এসেছিল ধারা এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন বোঝার জন্য। কিন্তু এসে যে এমন একটা দৃশ্য দেখবে তা স্বপ্নেও ভাবে নি। হাসতে হাসতে শুদ্ধ বলল,
‘আপনি আমাকে ভেজাবার জন্য এসব কিছু করেছেন! কিন্তু কেন?’
ধারা কিছু না বলে গটগটিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আজকে সন্ধ্যার পর এই নিয়ে তার দু বার জামা পাল্টানো হলো। আর যার জন্য এসব করেছে তার হলো না কিছুই। আবারও গামছা নিয়ে ধারা মাথা মুছতে লাগলো। মুখে তার আমাবস্যার অন্ধকার। শুদ্ধ রুমে এসে খেয়াল করলো তার একটা প্যান্টও আলমারিতে নেই। নিচে বাথরুমে গিয়ে দেখলো সব একটা বালতিতে ভেজানো। তারপর আবার রুমে এসে খেয়াল করলো বিছানার উপর একটা লুঙ্গি রাখা। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে শুদ্ধ’র বিচক্ষণ মস্তিষ্ক এবার ধারার উদ্দেশ্য ধরতে পারলো। আবারও এক দমক হেসে উঠে শুদ্ধ বলল,
‘সিরিয়াসলি আপনি আমাকে লুঙ্গি পরানোর জন্য এতক্ষণ এতো কিছু করেছেন? আই কান্ট বিলিভ!
শেষমেশ কি হলো সেই আপনার নিজের উপরেই পানি পড়ে গেলো।’
ধারা ছোট ছোট চোখ করে শুদ্ধ’র দিকে তাকালো। শুদ্ধ সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে বলল,
‘আচ্ছা ঠিকাছে, আপনার যেহেতু আমাকে লুঙ্গি পরানোর এতোই ইচ্ছা তাহলে আমি এমনিই পরছি। আপনাকে এর জন্য এতো কিছু করতে হবে না।’
ধারা উচ্ছ্বাসিত হয়ে বলে উঠলো, ‘সত্যি!’
‘হুম।’
ধারা হাসিমুখে বিছানা থেকে লুঙ্গিটা তুলে শুদ্ধ’র দিকে বাড়িয়ে ধরলো। শুদ্ধ লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে নিল। ধারা আবারও বলল, ‘আপনি কি সত্যিই পরবেন?’
শুদ্ধ নিজের হাসি চেঁপে রেখে বলল,
‘হ্যাঁ, সমস্যা কি? ভয় তো পাই অন্যদের সামনে থাকলে। আপনার সামনে আমার লুঙ্গি খুলে যাওয়া নিয়ে কিসের ভয়! আপনি তো আমার বউ ই। আপনার কাছে আর লজ্জা পাওয়ার কি আছে? আপনার যদি কোন সমস্যা না থাকে তাহলে আমারও কোন সমস্যা নেই।’
ধারার মুখের হাসি সব এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে, শুদ্ধ যখনই লুঙ্গি পরার জন্য প্রস্তুত হতে নিলো ঠিক তখনই একটা ‘না’ বলে চিৎকার দিয়ে ধারা দ্রুত চোখ বন্ধ করে পেছনে ঘুরে বলল,
‘প্লিজ! লুঙ্গি পরবেন না।’
চলবে,