#গল্পগুচ্ছ_সমগ্র
হাতে রেখো হাত
পর্ব১+২
‘ব্রেকআপ! কলেজের বেতন দিতে পারে না যেই ছেলে সেই ছেলের কি যোগ্যতা আছে আমার সাথে রিলেশন করার? ‘
একটা ঘড়ি আর কিছু কাগজের প্রেম পত্র আবরাজের মুখে ছুঁড়ে চলে গেল রাই। তিন মাস, মাত্র তিন মাস রিলেশন ছিলো ওদের। মূলত রাই ই প্রপোজ করেছিলো আবরাজকে। ছেলেটা কঠিন ধাতুতে তৈরি না হলে রাই কে অপমান করে দিতো বিনা সংকোচে। হয়তো ভাগ্য বিড়ম্বনাকে আপন করেই মেয়েটা কে অপমান করে নি। কলেজের অন্যতম মেধাবী ছাত্র আবরাজ। সেই সুবাদে কলেজ থেকে অনুদান পায়। তবে প্রাইভেট কলেজ হওয়ার দরুন বেতন দিতেই হবে। সে যত ভালো স্টুডেন্ট ই হোক না কেন। পার্ট টাইম জব করে নিজের খরচ চালাতো ওহ। তবে এই মাসের বেতনটা কোনো কারনে এখনো হাতে আসে নি। এ দিকে বেতন না দেওয়ায় একটা নোটিশ আসে ওর কাছে। সেটাই যেন ওকে হাসির পাত্র করে দিলো। সাথে রিলশনের সমাপ্তি ও ঘটালো। আবরাজ এর ধারালো ব্যক্তিত্ব আর মেধা দেখেই প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো রাই। প্রথমে না করলে ও কোন কারনে যেন রাইকে অ্যাকসেপ্ট করে নিলো। তবে কল্পনা ও করতে পারে নি এভাবে ভেঙ্গে যাবে সম্পর্ক। অবশ্য ওর ই ভুল ছিলো। সামান্য সরকারি বেতন ভোগী বাবার ছেলে হয়ে একজন উঁচু মাপের বাবার মেয়ের সাথে রিলশনে জড়ানো উচিত হয় নি। মৃদু হাসে। মাটিতে পরে থাকা ঘড়িটা তুলে নেয়। খুব দামি নয় তবে বেতন পেয়ে মাসের প্রথমে এই ঘড়িটা কিনেছিল ঢাকার বেশ জমকালো শো রুম থেকে। তবে এটাই ছিলো সেই শো রুম এর সব থেকে কম দামি ঘড়ি। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবরাজ। পকেটে পুরে নেয় ঘড়ি। চিঠি গুলো কুঁড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। এই নাম করা শহরে সামান্য চিঠির প্রেমের কোনো মূল্য নেই। টাকার মূল্য টাকা তেই। চিঠির স্বস্তা প্রেমকে আপন করা হয় না এখানে। শুধু দেখা হয় স্ট্যাটাস। কে কতো বিলাসিতার মধ্যে বড় হয়। মানুষ বড়ো অদ্ভুত জীব। এরা টাকা ছাড়া এক পা ও চলতে পারে না। ভালোবাসা নিয়ে মুখে বেশ কিছু লাইন বললে ও মনে মনে সেগুলো কে স্বস্তা বলে ফেলে রাখে আস্তাকুঁড়ে।
এক পা দু পা করে এগিয়ে চলছে আবরাজ। চেহারায় সামান্য মলিনতা।থাকবেই বা না কেন?একটু আগে যে ব্রেকআপ হলো। তবে কে বলবে এই ছেলেটার সাথে তিন মাসের প্রিয় প্রেমিকার বিচ্ছেদ ঘটেছে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সে। নেই কোনো ব্যথার ছাপ।
ক্যান্টিনে এসে পকেটে হাত দিলো। বিশ টাকা রয়েছে মাত্র। পায়ে জোড় নেই একদম। বাসে করে গেলে দশ টাকা ভাড়া লাগবে। আবার না খেয়ে ও চলছে না শরীর। ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসে তৎক্ষণাৎ। এখানে এক বোতল পানির মূল্যেই বিশ টাকা। সর্বনিম্ন খাবারের মূল্য ত্রিশ টাকা। তা ও আবার ডিম ছাড়া স্যান্ডউইচ। গলা কাঁ**টা দাম নিচ্ছে। বাইরের ছোট খাটো চায়ের দোকানে এসে বসে। দশটা টাকা সন্তপর্ণে পকেটে পুরে বাকি দশ টাকা দিয়ে দুই স্লাইস রুটি কিনে নেয়। খেতে মন্দ নয় তবে টাটকা রুটি ও নয়। রুটি খেয়ে টাকা টা বাড়িয়ে দেয়। পানি খাওয়া প্রয়োজন। সামান্য আশংকা গ্রস্ত হয়েই বলল ” মামা টাকা ছাড়া পানি হবে? ”
লোকটি ময়লা গামছা তে হাত মুছতে মুছতে বলল ” কি কন মামা। পানির জন্য আবার টাকা লমু। লন লন বইসা খান।
কৃতজ্ঞতার চোখে তাকায় ছেলেটি। টিনের গ্লাসটা তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করে। এই ব্যস্ত দামী শহরে থেকে ভুলেই গিয়েছিলো টাকা ছাড়া ও পানি পাওয়া যায়। অবশ্য ওর ই বা দোষ কিসের। আজকাল যা পরিস্থিতি। পানির গ্লাসটা দোকান দারের হাতে দিয়ে আবরাজ বলল “কৃতার্থ হলাম মামা। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুক। ”
লোকটা শীতল দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইলো। মানুষ এতোটা বিনয়ী হয় তা জানা ছিলো না ওনার। ভাগ্য বড় অদ্ভুত। ভালো মানুষ গুলোই রাস্তায় পঁচে ম**রছে। আর সমাজের নোংরা কীট গুলো হলো হাই সোসাইটির গন্য মান্য ব্যক্তি। আসলে এরা গন্য মান্য তো বটেই, তবে বেশির ভাগ ই জঘন্য ব্যক্তি।
প্রাইভেট কলেজ এন্ড ইউনিভার্সিটি। সরকারি কলেজ দূরে হওয়ায় প্রাইভেট কলেজ এন্ড ইউনিভার্সিটি তেই পড়া শোনা শুরু করেছিলো ছেলেটা। তখন অবশ্য টাকার টানা পোড়ন ছিলো না। মাথার উপর বাবা নামক ছায়া ছিলেন। না হলে এই দামের বাজারে কজন মধ্যবিত্ত সাহস করে প্রাইভেট কলেজে এডমিশন নেওয়ার?
তবে বছর খানেক যেতেই কপালে দুঃখ নামক হতাশা এলো। মধ্য বিত্ত পরিবারের সেই ছেলেটা দেখতে পেলো গরিব অবস্থান। বাবা নামক মানুষটির মৃত্যু ওকে সমাজ কে চিনতে সাহায্য করেছে। ছোট থেকেই ধারালো আর বিনয়ী মস্তিষ্কের অধিকারী বটে। না হলে পঞ্চাশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার পর ও চাচার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ করলো না। নিঃসেন্দহে ছেলেটা শক্ত মনের একজন।
রাস্তা দিয়ে হাটছিলো। হাতে দশ টাকা। যেহেতু এখন কিছুটা সুস্থ লাগছে তাই দশ টাকা বাস ভাড়া দিয়ে লাভ কি? ঝড়ের গতিতে পাশ কাঁটিয়ে যায় একটি গাড়ি। পাশের নোংরা ময়লা ড্রেনের সমস্ত পানি এসে লাগে আবরাজের শরীরে। ছেলেটার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই কথা শোনাতো। অন্তত বিরক্তি প্রকাশ করতো। গাড়ি থেকে লোকটা নেমে আসে। ইয়ং বয়সের একটি ছেলে। ওর কাছে এসে বলল ” স্যরি। ”
” ইটস ওকে। ”
সামান্য হেসেই কথাটা বলল আবরাজ। তবে গাড়ি থেকে নেমে আসা সুন্দরীর দিকে তাকিয়ে ভ্রুটা কুঁচকে গেল। বড় বড় চোখ করে এগিয়ে আসে রাই। ছেলেটার হাত চেপে ধরে বলল ” হোয়াট হ্যাপেন বেইবি? এই রা**সকেল, লো ক্লাসের ছেলের সাথে কি কথা থাকতে পারে তোমার? ”
” ওকে তুমি চেনো রাই? আসলে আমার ভুলের কারনেই ওর কাপড়টা নোংরা হয়ে গেছে। ”
পূর্ন দৃষ্টিতে তাকায় রাই। আবরাজের শার্ট থেকে একটু গন্ধ নাকে এসে লাগতেই নাক চেপে ধরে। চেঁচিয়ে বলে
” তোমার ক্লাস কোথায় নেমে এসেছে রকি? ওর শার্টটা দেখেছো?নোংরা ,তেল চিটচিটে আর দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে ফুটপাতের। ”
” বাট রাই। ”
ছেলেটাকে এক প্রকার টেনেই নিয়ে গেল রাই। শক্ত মন ধারী আবরাজ মৃদু হাসলো। যেই মেয়েটা দুদিন আগে ও ওকে জড়িয়ে ধরার বায়না করেছে কতোশত ভাবে।সেই মেয়েটা আজ নোংরা বলে বিদ্রুপ করে গেল! ভাবতেই অবাক লাগে, মানুষ কতোটা দ্রুত বদলে যায়। অবশ্য সঙ্গী জোগাতেও টাইম লাগে না। বড়লোক আর সুন্দরী হলে তো বা হাতের খেল। আর ছেলেদের টাকা হলেই যথেষ্ট। মিনিটে মিনিটে গার্লফ্রেন্ড জুগিয়ে নিবে!
.
পাশের রুম থেকে কাশির শব্দ কানে এসে ধরা দেয়। ছেলেটা বুঝতে পারে অরিতার ঠান্ডা লেগেছে। মেয়েটার ঠান্ডার ধাঁচ প্রচুর। একটু বৃষ্টি হলেই ঠান্ডা লেগে যায়। কম্বল মুরি দিয়ে শুয়ে আছে অরিতা। আদুরে হাতে বোনের মাথায় হাত রাখে আবরাজ। ঘন্টা খানেক পর ই অরিতার জন্মদিন। গুনে গুনে বারো বছর পূর্ন করবে মেয়েটি। মায়ের স্নেহ পাওয়া হয় নি। মা কি জিনিস জানা নেই। জন্মের সময় ই মা মা**রা যায়। ভাই আর বাবার হাত ধরেই বেড়ে উঠছিলো। অনাকাঙিক্ষত ঝড় এসে আবার বাবা নামক ছায়াকে তুলে নিলো। বিগত দেড় বছর ধরে ভাইকে জড়িয়ে বেঁচে আছে। রুগ্ন শরীর টা কোনো মতে মলিন কম্বলে ঢেকে দিলো আবরাজ। স্নেহের হাতটা মাথায় রেখে বলে ” খুব খারাপ লাগছে অরি? ”
” না ভাইয়া আমি ঠিক আছি। তোমার না কাল থেকে পরীক্ষা। যাও পড়তে বসো। ”
” উহু ঠিক আছে বোন। আগে তোর সুস্থতা প্রয়োজন। ”
মেয়েটার কপালে হাত রাখে আবরাজ। জ্বরের শরীর পুরে যাচ্ছে একদম। বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। মেয়েটার অসুস্থতা ওকে চঞ্চল করতে বাধ্য করে। দিক ভ্রান্তের মতো এদিক সেদিক তাকায়। কি করবে বুঝতে পারে না। মলিন মুখে রুগ্ন শরীর নিয়ে ধীরে উঠে বসে অরিতা। আবরাজের হাতটা মুঠো বন্দী করে বলল ” আমি ঠিক আছি ভাইয়া। তুমি পড়তে বসো। না হলে অনেকটা দেড়ি হয়ে যাবে। তোমাকে বেস্ট রেজাল্ট করতে হবে তো। ”
” চুপ। একদম পাকা পাকা কথা বলবি না। তুই শুয়ে থাক, আমি আদা চা আর পানি নিয়ে আসছি। কপালে পানি পট্টি দিবো। ”
” কিন্তু ভাইয়া ”
মেয়েটার কথাটা অগ্রাহ্য করে কিচেনের পথে আসলো আবরাজ। চিনির কৌটায় অবশিষ্ট এক চামচের মতো চিনি। ফলে ছেলেটা হালকা হাসে। এতেই হয়ে যাবে। তবে চা পাতার কৌটাটা খুলতেই বুকটা ভারী হয়। এক টা দানা ও নেই। পেছন থেকে পদধ্বনি শুনতে পেয়ে কৌটাটা লুকিয়ে ফেলে ঝটপট। অরিতা বলে ” কি হয়েছে ভাইয়া? ”
” একি অরি,এখানে কেন এসেছিস? যাহ আমি চা নিয়ে আসছি। ”
শেষোক্ত কথা বলার সময় ছেলেটার গলা ধরে আসে। অরিতার চোখ কান এড়ানো দায়। দু চোখের কার্নিশে জমে থাকা পানি টুকু মুছে নিয়ে বলল ” আমি চা খাবো না ভাইয়া ”
“কেন খাবি না?”
মাথাটা নিচু করে ফেলে অরিতা। দু চোখ ফেঁটে কান্না আসতে চায়। হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলে মেয়েটা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভাইকে। ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে
” আমি দেখেছি চা পাতা নেই। তুমি এতো ভেবো না ভাইয়া। ”
দীর্ঘশ্বাস টা কোনো মতে লুকিয়ে অরিতা কে বুকে চেপে ধরে। মনে মনে শক্ত হওয়ার মনোভাব পোষন করে বলে
” আরে পাগলি এর জন্য কাঁদে কেউ? কাল বাদে পরশু ই বেতন পাবো। দেখবি সব নিয়ে আসবো। একদম ই টেনশন করবি না, ভাই আছে তো। আর চা পাতা নেই তো কি হয়েছে আমি আছি না। ”
ছেলেটার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারলো না অরিতা। চাঁপা কান্নাটা দমিয়ে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। তাতেই হেঁসে কুটি কুটি আবরাজ। হাসি থামিয়ে বলল ” আমি আছি মানে এই নয় যে আমাকে চা পাতা বানিয়ে চা বানাবো। ”
” ভাইয়া! ”
আবারো কেঁদে উঠে মেয়েটি। র*ক্তক্ষ*রণ বোধহয় একেই বলে। তীব্র র*ক্ত ক্ষরন হচ্ছে বুকে। অসহায়ের মতো চেয়ে থাকে আকাশের পানে। বুক চিরে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। মা বাবা ম*রা মেয়েটিকে ভালো রাখতে পারছে না আবরাজ। মনে মনে প্রশ্ন করে ভাই হিসেবে কতোটা যোগ্য আমি?
চলবে……
#হাতে_রেখো_হাত
#পর্ব_১
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
👍👍👍গল্পগুচ্ছ সমগ্র
#হাতে_রেখো_হাত (২)
পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছে আবরাজ। বেশ ধকল গেলো ওর উপর। পড়াশোনা কমপ্লিট করে মধ্য রাতে বসেছিল কাজ নিয়ে। পরীক্ষা চলাকালীন সময়টা ছুটি পেয়েছে ঠিক। তবে নিয়মিত বাড়ি থেকে কাজ করতে হবে এমন ই নির্দেশনা ছিলো। তাই দীর্ঘ একটি মাস ঠিক মতো ঘুম হয় নি। এইচ এস সি পরীক্ষাটা বেশ ভালোই ভালোই পার করেছে। মোটামুটি ভালোই রেজাল্ট হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে টপ ওহ করতে পারে। কড়া রোদ্দুর আজ। ফাইলটা উঁচু করে হেঁটে চলেছে ছেলেটা। পাশের দোকানে রাখা ছোট্ট টেডি বেয়ার খানা ওর মন কেড়ে নেয়। মাথায় আসে অরিতার কথা। আজ বাদে কাল মেয়েটার জন্মদিন। আগের বার শোকে শোকেই দিন পেরিয়েছে। কোনো উপহার দেওয়া হয় নি। দেখতে দেখতে একটা বছর পেরিয়ে গেল। আজ ইচ্ছে হচ্ছে উপহার দেওয়ার। পকেট হাতরিয়ে বুঝতে পারলো টেডি বেয়ার কেনার মতো টাকা নেই ওর নিকটে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো মুহুর্তেই। কতো শখ করেছিলো ছেলেটা। তবু ও দোকানে গিয়ে সফট টয়ের দাম জিজ্ঞাসা করলো। দোকান দার জানালো ৪৫০ টাকা। ৩৩০ টাকা আছে ওর কাছে। এখান থেকে হেঁটে বাসায় যেতে হলে সন্ধ্যা নেমে যাবে। তাই ত্রিশ টাকা রেখেই যা কেনার কিনতে হবে। ৩০০ টাকা দিয়ে চকলেট বক্স কিনতে গিয়ে ও কিনলো না। অরিতা অন্য সব বাচ্চা দের মতো চকলেট পছন্দ করে না। সফট টয় পেলে বেশ খুশি হবে। ছেলেটা যেন কিছুতেই মনের ভেতরে শান্তি পাচ্ছে না। ধীর পায়ে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো কোনো কাজ ই ছোট নয়। তারপর ই এগিয়ে গেল খাবারের হোটলের দিকে। দোকান দার বেশ চেঁচাচ্ছেন। অর্ধ শতাধিক মানুষের ভীর জমিয়েছে এখানে। তবে বাসন মাজার লোক আসে নি আজ। সেই কারনে কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। কাঁপা স্বরে দোকানে এসে দাঁড়ালো আবরাজ। লোকটা এক পলক তাকিয়ে আবারো কাজে মত্ত হলো। চাপ ভাজতে ভাজতে বললেন ” এই রন্টু, কই গেলি তুই। দ্রুত প্লেট নিয়ে আয়। ”
পরক্ষনেই ক্ষীন গলা টা নরম করে বলল “আপনাকে কি দিবো স্যার? চিকেন চাপ নিবেন নাকি চিকেন ফ্রাই? ”
ছেলেটা ভারী অবাক হলো। নিজেকে যথারীতি সামলে নিয়ে বলল ” একটা কাজ দরকার। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে বাসন মাজার কাজটা করে দিতে পারি আমি। ”
গাঁয়ে কলেজ শার্ট। লোকটা যেন বিশ্বাস করলো না ওকে। খিটমিট করে হেসে উঠলো। রসিকতার কণ্ঠে বলল ” বুঝছি স্যার আপনি মজা করছেন। এখন বলেন কি নিবেন?”
” না না আমি মজা করছি না। আমি সিরিয়াস, দয়া করে আমাকে কাজটা দিন। ”
এদিকে লোক জন তাড়া দিয়ে যাচ্ছে।অপেক্ষা করতে করতে কয়েক জন উঠে ও গেল। লোকটা তাঁদের বসতে বললে তাঁরা জানালো যে দোকানে প্লেটের পর্যাপ্ততা নেই সে দোকানে বসে থেকে কোনো লাভ ও নেই। দীর্ঘশ্বাস টেনে লোকটি আবার শুধালো ” আপনি কি সত্যি মজা করতেছেন না? ”
” আমি মজা করছি না। ”
ভ্রু কুটি করে তাকায় লোকটি। হাতের ইশারায় রুন্টু কে ডাকে। গামছা দিয়ে কপালে ঘামের শেষ বিন্দু টুকু মুছে রুন্টু বলল ” কন স্যার। ”
“এই ছেলেটা কে বাসন পরিষ্কারের জায়গায় নিয়ে যা। ”
হা হয়ে যায় রুন্টুর মুখ। আবরাজ কে আগা গোড়া দেখে নিয়ে বলে ” কি কইতেছেন স্যার। এ তো কলেজ স্টুডেন্ট। তা ও বড় সড় কলেজের। ”
” আহহ যাহ কইতেছি তা কর তো। ”
” হ যাইতেছি। আপনি আসেন আমার সাথে। ”
কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নিচু করে আবরাজ। দোকানদার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এটা কি সত্যি?
হাতে দুশত টাকা পেয়ে ভারী আনন্দ অনুভব হচ্ছে ছেলেটার। মাস শেষ হতেই টাকা পয়সা শূন্যের খাতায় নেমেছে। পরীক্ষার জন্য কতো গুলো টাকা দিতে হলো।সব কিছু মিলিয়ে যেন চলছিলো না। বোনের জন্য সফট টয় কিনতে পেরে বেশ শান্তি অনুভব হচ্ছে। রিক্সা নিয়ে বাসায় এলো। কতো দিন পর রিক্সাতে উঠলো ঠিক ঠাওর হচ্ছে না। হবে কি করে? রোজ এই চার পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছে এতো দিন। হাতে বই নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে এগিয়েছে রাস্তার ফুটপাত ধরে। কথায় আছে কষ্ট করলে সফলতা আসে। আর পরিশ্রম নাকি বিফলে যায় না। তেমনি এক সফলতার অপেক্ষায় রয়েছে আবরাজ।
.
সামান্য ৪৫০ টাকার একটি সফট টয় কাউকে এতোটা আনন্দ দিতে পারে তা ছিলো কল্পনার অতীত। অরিতার মাথায় চুমু খায় আবরাজ। একটু আগে ঠিক বারো টার সময় জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা ও সফট টয়টা উপহার দিয়েছে আবরাজ। তখন থেকে কতো বার যে অরিতা থ্যাংকস বলেছে জানা নেই ওর। মেয়েটার চোখ দুটো চকচক করছে এখনো। খুব ভালোবাসে ভাইকে। ঠিক তখনি ওর ছোট্ট মস্তিষ্ক জানান দিলো মাস তো শেষের দিকে। তেরো বছরের এই কিশোরীর মস্তিষ্ক ও বুঝতে পারে টাকাটা ঠিক কতোখানি প্রয়োজনীয় ছিলো। মুহুর্তেই মুখে ভর করে এক রাশ কালো মেঘ। আবরাজ বুঝতে পারলো না হঠাৎ মুখটা গোমড়া করার কারন। আদুরে কণ্ঠে বোনকে শুধালো ” কি হয়েছে অরি? ”
” এটার দাম কতো ভাইয়া? ”
” উপহারের দাম জিজ্ঞাসা করতে হয় না বোন। ”
সফট টয় টা নাড়িয়ে দেখে মেয়েটা। দামটা ভেবে বলল
” ৪০০ , ৫০০ টাকা তো হবেই। এতো গুলো টাকা নষ্ট করা উচিত হলো না? ”
” নষ্ট কোথায় করলাম? ”
“এটার প্রয়োজন ছিলো না ভাইয়া। তুমি ই আমার কাছে যথেষ্ট। ”
আবরাজকে জড়িয়ে ধরে অরিতা। বাবা মাকে খুব মনে পরছে ওর। সৃষ্টিকর্তা ওর থেকে বাবা মাকে তো তুলে নিয়েছেন তবে ফেরেস্তা রূপী ভাইকে দিয়েছেন। যেই ছেলেটা দুনিয়া তোলপাড় করা ভালোবাসা দিয়ে এতো দিন ধরে আগলে রেখেছে ওকে।
আকাশে অর্ধ চাঁদ। বিষণ্ন রাত্রীটা কে উপভোগ করছে আবরাজ। পাশেই বেঘোরের ঘুমিয়ে আছে অরিতা। জন্মদিনের, দিনে ও মেয়েটা চোখের পানি ঝরালো। তেমন কিছুই দিতে পারে নি ওকে। তবু ও মেয়েটা বললো ‘ তুমি আমার পৃথিবীর সেরা ভাই ‘।
আনমনেই হেসে উঠে আবরাজ। স্বার্থকতা বোধহয় একেই বলে। অন্তর থেকে স্বস্তি নেমে আসে। জীবনে কতো কি হারাতে হবে জানা নেই। তবে বোন নামের প্রাপ্তিটা যেন কখনো না হারায় এই প্রার্থনাই থাকবে।
পরীক্ষা শেষ হওয়াতে অনেক টা সময় পেল আবরাজ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো প্লে গ্রাউন্ডের দিকে। ঠিক তখনি গো*লাগু*লির শব্দ কানে আসে। কোনো শত্রু পক্ষ আক্রমন করেছে। বো**মা আঘা*ত করা হচ্ছে সর্বত্র। বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো। চোখ দুটো ও কেমন ছলছল করছে। হঠাৎ করেই অরিতার কথা মনে হলো। বাসায় একা রয়েছে মেয়েটা। এক সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে কলোনিতে এগিয়ে গেলো ছেলেটা। পা যেন চলছেই না। মোটা দঁড়ির সাহায্যে যেন কেউ বেঁধে রেখেছে ওর পা। চারপাশে আগুনের ছড়াছড়ি। হঠাৎ করে কোন দেশ থেকে আক্রমন হলো আবার?
মহল্লায় ঢুকতেই একটা বো*মের শব্দ শুনতে পেলো আবরাজ। এক পলক পিছে তাকালো। পেছনে থাকা ঘর গুলো থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। চোখ দুটো ঘোলাটে হলো কেমন। শুকনো ঢোক গিলে আবার ও ছুট লাগালো। ঘরের কাছে আসা মাত্র ই অনাকাঙিক্ষত সেই বো**মটি পরলো ওদের ঘরের কাছে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পরলো পুরো ঘর জুড়ে।এক মুহুর্তের জন্য হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো আবরাজ। মৃদু চিৎকারের শব্দ কানে আসতেই ফের সচকিত হলো ছেলেটা। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে চিৎকার করছে অরিতা। বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হলো। মৃদু শব্দে উচ্চারন করলো ” অরি, বোন আমার। ”
কথাটা কানে পৌছালো না মেয়েটার। ছুট লাগলো আবরাজ। তবে এই কয়েক পায়ের পথ যেন হাজার মাইলের মতো হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করতেই চিৎকার করে উঠলো অরিতা। আবরাজ বলল
” অরি, ভয় পাস না বোন। আমি আসছি, কিচ্ছু হবে না তোর। ”
দু চোখের কার্নিশে পানির ফোয়ারা নেমে যায়। মৃদু হাসে মেয়েটা। আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে এখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব! বরং আবরাজ এখানে আসলে ওর মৃ*ত্যুটা ও নিশ্চিত হবে। শেষ বারের মতো আদুরে কণ্ঠে ভাইয়া ডাকটা বললো মেয়েটা। আবরাজ জানালার কাঁচ ভে*ঙে ফেলেছে। প্রবেশ করবে তখনি চিৎকার করে উঠলো অরিতা। ” আমার কসম লাগি ভাই। যদি আর এক পা আগাও তাহলে আমি এই আ*গুনে ঝাঁপ দিবো। ”
থমকে যায় আবরাজের পা। কয়েক সেকেন্ড থমকে থাকার পর আবারো ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। তবে তাঁর আগেই কোথা থেকে আগুনে ফুলকি এসে জড়িয়ে নেয় ছোট্ট অরিতাকে। মৃদু আর্তনাদ করে উঠে অরিতা।শেষ বারের মতো পৃথিবীর বুকে অরিতার কণ্ঠে শোনা যায় ‘ তুমি আমার,পৃথিবীর সেরা ভাই ‘
**সাধ্যমতো রেসপন্স করার অনুরোধ**
চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ
নতুন গল্প পেতে পেজে ফলো করে রাখলে পোস্ট করলেই নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন প্লিজ ফলো 👍👍👍গল্পগুচ্ছ সমগ্র