হাতে রেখো হাত (১২)
হসপিটালের করিডোর দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটছে সীরাত ও আবরাজ। দুজনের মুখাশ্রীতেই এক গম্ভীর ভয়ার্ত ভাব ফুটে উঠেছে। রিসিপশনে বসে থাকা মেয়েটা প্রায় বিচলিত হয়ে বলল “আপনারা সুজিতের গার্ডিয়ান?”
সীরাত চটপট জবাব দেয়। “জী। ওকে কোথায় নেওয়া হয়েছে।”
“আমার সাথে আসুন।”
সীরাত আর আবরাজ যাচ্ছিল। ওমন সময় কলটা এলো। আবরাজ পিছে পরে গেল। রুশ্মি কল করেছে।
“রুবির কোনো খোঁজ পেয়েছ?”
“শান্ত হও রুশ্মি। পাই নি তবে পেয়ে যাব।”
“এমন পরিস্থিতিতে শান্ত কি করে হব। আমার মাথা কাজ করছে না। মা সবে ফোন করে জানিয়েছে আমায়। আমি এখনও ভার্সিটি থেকে বের হতে পারি নি। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। রুবি ছোট মানুষ, স্বভাব আর জ্ঞানে বড় কাঁচা। না জানি কি অবস্থায়!”
“রুশ্মি! কেঁদে লাভ হবে বলতে পারো? তুমি বরং চাচির কাছে যাও। আমি দেখছি।”
কান্না থামায় রুশ্মি। “তুমি কোথায়?”
তৎক্ষণাৎ উত্তর দিতে পারল না আবরাজ। একটু ভেবে নিয়ে বলল “রেল স্টেশনের দিকে যাচ্ছি।”
“আমি বুঝতে পারছি না কি করব।”
“চাচির কাছে যাও। তোমার সাপোর্ট টা ভীষণ জরুরী।”
আই সি ইউ রুমে শুয়ে আসে সুজিত। মুখে অক্সিজেন মাস্ক। ছেলেটার গঠন বেশ ভালো। হাতের বেশি গুলো ফোলা। বোঝা যায় নিয়মিত জিম করে। এমন ছেলেটা যখন হসপিটালের বেডে জীবন মরণের লড়াই করে তখন বলতেই হয় নিশ্বাসের ভরসা নেই। আবরাজ প্রবেশ করতেই ব্যথা নিয়ে তাকায় সীরাত। সুজিতের এই অবস্থা ওকে দ্বিধায় ফেলে দেয়।
“ডাক্তারের সাথে কথা বলতে হবে।”
“ওর বাবা মা যখন জানতে পারবে তখন কি হবে আমি সেটাই ভাবছি।”
“ভাবলে আদৌ কি সমাধান হবে? যা হবার হবে। আগে সুজিতের বেঁচে উঠা দরকার। তাছাড়া আমরা জানি না রুবি কোথায়, কী অবস্থায়! ভাবতে পারছ কত ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে।”
নিরুত্তর আবরাজ। দুজনে করিডোর দিয়ে হেঁটে চলেছে। আবরাজের মুখের একাংশ বার বার ফুলে ফেপে উঠছে। মনে হচ্ছে রাগের চোটে ভ*স্ম করে দিবে সব।
সারাদিনব্যাপী খোঁজার পর বাড়ি ফিরে আবরাজ। আনিসুল সাহেব ব্যবসায়ীক কাজে দেশের বাহিরে। টিকেট পান নি বিধায় আজ আসতে পারছেন না। তবু পরিচিত বড় বড় আইনের লোকদের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছেন। মাথায় হাজার চিন্তা। আবরাজের শুষ্ক মুখ দেখে ফের কেঁদে ফেললেন রেবেকা বেগম। মা কে সান্ত্বনা দেবার শক্তি নেই রুশ্মির। কেঁদে কেটে সে নিজেও চোখ মুখের হাল করেছে বেহাল। আবরাজ বসল পাশে। মাথাটা ব্যথায় ফেঁটে যাবে যেন।
“চা করে দিব?”
“না,থাক। চাচি কে খাওয়াতে হবে কিছু। না হলে অসুস্থ হয়ে যাবে।”
“বুয়া এসেছিল,মা চলে যেতে বলেছে। রান্না হয় নি আজ।”
“খাবার এনে দিচ্ছি।”
“ঠিক আছে।”
সবে এসেছে আবরাজ। একটা ক্লান্তির শ্বাস ফেলে উঠতেই রুশ্মির ডাক আসে
“শোনো।”
“হু?”
“আমি ও আসি?”
অন্যসময় হলে আবরাজ বারন করত। তবে আজ নীরব রইল। যাওয়ার পূর্বে মা কে ঘরে পৌছে দিল রুশ্মি। ভদ্রমহিলার শরীরে যেন শক্তি নেই। রুগ্ন চেহারায় হুট করে নেমে আসা জল অনেকটাই বেমানান। অথচ এই জলের ক্লান্তি নেই। নেই কোনো অবকাশ।
.
সুজিতের বাবার নাম সুফিয়ান করিম। ভদ্রলোকের পাওয়ার আছে। নামীদামি সব বিজনেসে শেয়ার থাকাতে লোকজন ও চিনে ভালো। আবরাজ আর সীরাত বলেছিল সুজিতের ঘটনা যেন এখন না জানানো হয়। যদিও এটা অন্যায় তবু এই নিয়মেই চলছিল চিকিৎসা। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। ঘটনার চব্বিশ ঘটনা পেরানোর পূর্বেই সুফিয়ান করিমের কাছে খবর পৌছে গেল। তখন সীরাত আর আবরাজ রুবিকে খোঁজাতে মত্ত। ওমন সময় এলো কলটা। সুফিয়ান করিম হসপিটালে এসেছেন। এক প্রকার ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছেন। ওনার ভাষ্যমতে এই হসপিটাল অযোগ্য। তাছাড়া ছেলেটা হসপিটালের বেডে শুয়ে। বাবা মা কে না জানানোটা অন্যায় নয় বরং পাপ। ডাক্তাররা তবু রিকোয়েস্ট করল। এই অবস্থায় টানাটানি ঠিক নয়। চিকিৎসা চলছে। যদি কোনো প্রকার ক্রুটি লক্ষ্য হয় তখন আরও টেক কেয়ার করা হবে। এসব ছেলে ভোলানো কথায় রাজি নন তিনি। ছেলেকে এক সেকেন্ডের জন্যও রাখবেন না স্বস্তার এই হসপিটালে। খবর গুলো শুনে সীরাত তৎক্ষণাৎ চলে এলো। সুফিয়ান করিমের সামনে আসতেই ক্ষোভটা মেটালেন। “তোমার সাহস কি করে হয় আমার ছেলের খবর আমার থেকে লুকানোর।”
“স্যার প্লিজ শান্ত হোন।”
“আই সি ইউ রুমে আমার ছেলে। আর তুমি বলো শান্ত হতে।”
“আমি বুঝতে পারছি বিষয়টা তবে দেখেন ঘটনা ছোট নয়।”
এবার চোটে গেলেন সুফিয়ান করিম। সীরাতের দিকে লাল চোখে তাকিয়ে বলে দেখে নিবে সবাইকে। যত দূর যাওয়ার প্রয়োজন যাবেন তিনি। ক্রমশ জটিল হচ্ছিল পরিস্থিতি। সীরাত বুদ্ধি খাটায়।
“আপনি কি মনে করেন পুলিশ প্রশাসন আপনার ছেলের পক্ষে যাবে? ভিকটিম কিন্তু এখনো নিরুদ্দেশ।”
“ঐ মেয়েটা ভিকটিম? ফালতু মেয়ে। ভিকটিম তো আমার ছেলে। হসপিটালের বেডে মৃ*ত্যুর সাথে লড়াই করছে আমার বাবা।”
ভেঙে পরলেন ভদ্রলোক। সীরাত বুঝে সবটা। তিনি একজন বাবা। সেই দিক থেকে ওনার আচারণ এক চুল পরিমাণ অযাচিত নয়। তবে পরিস্থিতি কি তা জানে না সীরাত। সবটা সামনে না আসা আবধি কিছু করা যাচ্ছে না।
ফুটেজ দেখতে দেখতে আচমকা চেচিয়ে উঠল আবরাজ। “স্টপ,ভিডিওটা পজ করেন।”
ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখে আবরাজ। রুবিকে চিন্তে অসুবিধা হয় না। সাথে সুজিত ও রয়েছে। ডিটেলস নিয়ে তৎক্ষণাৎ বাস স্টপ আসে আবরাজ। রাস্তায় সীরাতকে জানানো হয়েছে ঘটনা। সীরাত ওর পরিচিত এক পুলিশ আঙ্কেলকে ফোন করে জানায় সবটা। পুলিশ বাস স্টপে আসে। আবরাজ কে সাথে নিয়েই বাস স্টপের এন্ট্রি চেক করে। ঢাকা টু চট্টগ্রামের দুটো টিকেট কাঁটা হয়েছিল সোমবার সন্ধ্যার। একই সময়ে আরও আট চল্লিশ জন যাত্রী বাস টিকেট কেটেছে। এন্ট্রি চেইক করে জানা যায় দুজন যাত্রীই ঢাকা টু চট্টগ্রাম গিয়েছে। যদি তেমনি হয়ে থাকে তবে সুজিতের আ*হত দেহ ঢাকায় এলো কি করে!
রাতে ফিরে নি আবরাজ। চোখে ঘুম নেই রুশ্মির। বোনের চিন্তায় নাজেহাল। তার উপর প্রিয় মানুষটি এধার ওধার ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠিকানাহীন ব্যস্ত শহরে।রুশ্মি চাইলেও সঙ্গ দিতে পারছে না। বাসায় মা কে ফেলে রেখে এক চুল ও যাওয়া সম্ভব না। রুশ্মির শুকিয়ে যাওয়া চোখে ফের জল নামে। হাতের তালুতে মুছে কল করে।
“কোথায় আছো তুমি?”
“সীরাতের সাথে আছি রুশ্মি। কিছু প্রয়োজন?”
“না আসলে মা বলছিল তোমার কথা। ফিরবে না কাল?”
“মনে হচ্ছে পারব না। জানোই তো সুজিতের বাবা খুব রেগে। অবশ্য ওনার জায়গায় আমি হলেও তাই করতাম।”
“রুবি কে কি পাব না আমরা?”
“এমন বলতে নেই। নিশ্চয়ই পাব রুবিকে।”
ফুপিয়ে উঠে রুশ্মি। মেয়েটার স্বভাবে কান্না নামক শব্দটি অস্তিত্বহীন প্রায়। সেই মেয়ে যখন কান্নায় ডুবে যায় তখন বলতে বাকি থাকে না কতখানি যন্ত্রণা যাচ্ছে। আবরাজ সান্ত্বনা দিতে পারল না। সীরাত খাবার নিয়ে এসেছে। আবরাজ কে চুপ থাকতে দেখে বলল “কে?”
“রুশ্মি।”
এখনো কাঁদছে রুশ্মি। নীরব এক গুমোট কান্না। সীরাত শ্বাস ফেলল। রাত প্রায় দুটো বাজে। “রুশ্মি! ঘুমাও নি এখনো?”
“ঘুম আসবে কেমন করে!”
“সুস্থ থাকতে হবে রুশ্মি। তুমি এভাবে ভেঙে পরলে বাকিরা ঠিক থাকবে কি করে।”
উত্তর করে না রুশ্মি। সীরাত আরও বলে “ঘুমানোর ট্রাই কর। আবরাজকে সকালেই পাঠিয়ে দিব।”
রুশ্মি কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করে। কল রাখতেই আবরাজ বলে “কি বললে তুমি?”
“বললাম তোমাকে পাঠিয়ে দিব সকালে।”
“মানে! তুমি কি একা যাবে চট্টগ্রাম?”
“হুম।”
“কিন্তু সীরাত।”
“শোনো, মনের অসুখ করেছে রুশ্মির। তুমি না গেলে সারবে না। আমি পারব সবটা সামাল দিতে।”
চলবে…..
কলমে~ফাতেমা তুজ