হাতে রেখো হাত (১৩)

0
89

হাতে রেখো হাত (১৩)

চট্টগ্রাম শহরে আছে সীরাত। চেহারায় চিন্তার রেখা। মনে ভয়। পুলিশ খুঁজে যাচ্ছে। তবে কোথাও কোনো সন্ধান নেই। মেয়েটা নিজেই যাবে বলে স্থির করেছিল। আর তারপর শুরু হয় বিভিন্ন হোটেল,মোটেল খোঁজা। লাভ হলো না। ফলাফল সেই শূন্য। হতাশাজনক ভাবে বসে ছিল বেঞ্চে। পাশে বসে সৌমিত্র। চিকন শ্বাসে ভরে উঠেছে চারপাশ। সীরাতের নরম তুলতুলে পা দুটো বালির সাথে খেলা করছে। চোখ সেখানেই। একটা বিতৃষ্ণা চাহনী। সৌমিত্র মন পড়তে পারে এমন নয়। তবে সীরাতের ক্ষেত্রে ভিন্ন। মেয়েটার সব কিছু বুঝতে পারে কেমন করে যেন। প্রায় এক যুগ ধরে এমনটাই হয়ে চলেছে। “ভেঙে যাচ্ছ তুমি।”

চোখ মেলে তাকায় সীরাত। সৌমিত্র কে দেখে ঠোঁটের অগ্রভাগ প্রসারিত হয়। আকাশের বুকে রংধনুর মত এক চিলতে হাসি উঠে। ফের মিলিয়ে যায় মেঘের আড়ালে। সৌমিত্র গত বারোটা বছর ধরে সীরাতের পাশে। বন্ধুর মত আগলে রাখে। অথচ সীরাত জানে ছেলেটা শুধু ওর বন্ধু নয়। বন্ধুর থেকে একাংশ এগিয়ে।
“খাবার খেয়েছ?”

“উহু।”

“এভাবে থাকলে চলবে? অসুস্থ হয়ে যাবে। এসো আমার সাথে।”

“পরে খাব। তুমি খেয়ে নিও। অপেক্ষা করলে কিন্তু অভুক্ত থেকে যাওয়ার সম্ভবনা থাকবে।”

“তুমি কি করে জানলে আমি না খেয়ে?”

“এটা তো নতুন নয় স‍ৌমিত্র। আমার সাথে থাকলে কখনোই আগে খাও না। এমনকি কাছে পিঠে না থাকলে ফোন করে জানতে চাও খেয়েছি কি না। আমি সেসব বুঝি।”

বিব্রত বোধ করার কথা থাকলেও অপ্রত্যাশিত ভাবে, সৌমিত্র চুল পরিমানে বিব্রত হলো না। বরং নীরব মুখে বসে রইল। সীরাতের এখন খারাপ লাগছে। ছেলেটা কেন এমন করে?

রুস্মি চোখের জল আড়াল করে বলল “মা, খুব ই ভেঙে পড়েছে। তুমি ও নেই। বুয়া থাকলে একটু আরাম লাগে। সেও চলে যায়।আমি আসলে সামলাতে পারছিলাম না। একা অনুভব হচ্ছিল।”

“রুবিকে খুঁজতে এধার ওধার ঘুরতে হচ্ছে। তুমি জানো আমি গত তিন দিন ধরে ঢাকার অলি গলি ঘুরে চলেছি। আর সীরাত চট্টগ্রাম।”

“আমাকে সাথে নিবে প্লিজ?”

“চাচির কাছে থাকা জরুরী।”

রুস্মি এবার কেঁদে ফেলল। গত তিন দিনে আবরাজ কে কয়েকশ বার বলেছে, সঙ্গে নেওয়ার কথা। ছেলেটা প্রতিবার ই নানান ছলে বলে কৌশলে নাকোচ করেছে।
“বাচ্চাদের মত করলে চলবে না রুস্মি। খেয়ে ঘুম দাও।”

“তুমি খাবে না?”

“হু খাব।”

খাবারের প্লেট নিয়ে কেবল নড়াচড়া করে আবরাজ। সেদিকেই চেয়ে আছে রুস্মি। খাবার নামছে না গলা দিয়ে। ছেলেটার মুখের গম্ভীর ভাব ওকে যন্ত্রণা দেয়। ইচ্ছে করে মিশে যেতে। কাছে টেনে নিয়ে ভরসা দিতে।’আমি আছি’ বলে নির্ভরতা হতে। সেসব কেবল কিশোরী মনের কল্পনা। উঠে গেছে আবরাজ। ভাতের প্লেটের বেশি অংশই রয়ে গেছে। সেসব পরিষ্কার করে উঠে গেল রুস্মিও। আবরাজ এবার ঘুমের তৌড়জোড়ে ব্যস্ত হবে। আবার ভোর হতে না হতে ছুটে পালাবে। আসবে রাত দশটার পর। এভাবে চলেছে গত দিন গুলো। রুস্মি তো এমন জীবনে অভ্যস্ত নয়। সর্বদা সাদামাটা জীবন পছন্দ। অথচ ওর জীবনটা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলে রূপান্তরিত হয়।

চোখ মুখ শক্ত করে রেখেছে আবরাজ। ঘটনা গুলো কেমন গোলকের মত। যে পথেই যাও ফল শূন্য। দিশাহীন ভাবে চলছে কেবল। সারাটা রাত এপাশ ওপাশ করে গেল। সবে ভোর নেমেছে। আবরাজ ফজরের নামাজ শেষ করে বেরিয়ে পরল। হসপিটালের কাছে আসতেই সীরাত কে দেখতে পেল। মেয়েটার ভাঙা চাহনি।
“রুবির জীবনের নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারব না। তবে সুজিতের জীবন ও সাধারণ নয়। সবাই সমান।”

“জানি আমি। এবার সত্যিই আমাদের কিছু করার নেই। এর বেশি হলে ছেলেটা মা*রা যাবে।”

হতাশার এক পাহাড় এসে ধসিয়ে দিল সব। অবশেষে সিদ্ধান্ত হলো সুজিতকে বাঁচাবে। রুবির ভাগ্যে যা আছে তাই হবে।

সুজিতের শ্বাসগুলো ক্রমশ বেড়ে চলেছে। হসপিটালের বেডে কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়। চোখের কোণ বেয়ে নেমে যায় নোনাজল। সীরাত চোখ বন্ধ করে ফেলল। খামচে ধরল দেয়াল। অন্য হাত আবরাজের হাতে রেখে বলল “মানুষ নয়,এরা জা*নোয়ার।”

“স্থির হও সীরাত। আমাকে শক্তি দিয়ে তুমি হারিয়ে যেও না।”

“খারাপ লাগছে আমার। ছেলেটার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া ওর জীবন কতটা প্যাঁচ মাখা!”

“আর একটু,প্রুফ কালেক্ট হলেই আমরা সবটা সামনে নিব।”

সীরাত আর আবরাজ আড়ালেই রইল। সুজিত যন্ত্রণায় পা দাপাচ্ছে। জা*ন বেরিয়ে আসার জন্য লাফালাফি করছে যেন। ইনজেকশনটা বের করতেই নিজের সর্বশক্তি দিয়ে আঘা*তটা করল আবরাজ। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পরল লোকটা। পুলিশ,ও এসে পরেছে। লোকটা পালানোর চেষ্টা করে ও পালাতে পারল না। অবেশেষে ধরা পরল এক পাপী।
.

বুয়া সব কাজ শেষ করে দিয়েছে। এবার যাওয়ার পালা। রুস্মির খুব একা লাগে। রেবেকা বেগম ঘুমে। খাবারে ঔষধ মিশিয়ে দেওয়া হয় রোজ। না হলে যত সময় জেগে থাকে চেচামেচি করবে। কান্নায় ডুবে থাকে। আবরাজ সেই সকাল বেলায় বেরিয়েছে। বেলা শেষে ফিরবে তবে সামনের একাকিত্বে ভরা সময়টা রুস্মিকে কাঁদাবে। আগে এ সময়ে বই পড়ত। তারপর রুবির জন্য শরবত করত। খাবার নিয়ে মেয়েটার চয়েজের শেষ ছিল না। রূপচর্চার হরেক প্রসাধনী ঘরের কোণে। ফুরিয়ে গেলেই বায়না ধরবে ‘আপু শপিং করব, সাথে যাবে প্লিজ।’ রুস্মি ব্যস্ত সময়গুলোতে নাকোচ করত। আর রুবি তখন নাক ফুলিয়ে বসে থাকত। দুদিন অবধি কথা বলত না। সেসব খুব সুন্দর ছিল। আনন্দের স্মৃতি গুলো আমাদের জীবনের কঠিন সময়ে বি*ষ হয়ে নামে। মনে হয় কেন এত সুন্দর ছিল সেসব?

কাজ নেই কোনো। তাই রুস্মি চাইল বই পড়তে। পারল না। বারং বার ঘেটে যাচ্ছে ঘটনা। এখন সন্ধ্যা। টিভিতে নতুন নিউজ চলবে। সেসবে যদি একটু আগ্রহ আসে।
সন্ধ্যার টিভির নিউজটা খুলল রুস্মি। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভিডিও আর কিছু লাইন দেখেই আঁতকে উঠল প্রায়! তখুনি ফোন করল আবরাজকে। আবরাজ বলল ঘটনাটা খুলে জানাতে। অথচ মেয়েটা কেবল চেচামেচি করছে! ভয়ার্ত কণ্ঠ। যেন এখনি জান বেরিয়ে যাবে। অগত্যা তখনি আসতে হলো আবরাজের। রুস্মি ড্রয়িং রুম জুড়ে পায়চারি করছিল। চিন্তা আর ভয়ে যেন পাগলপ্রায়। আবরাজকে দেখেই ছুটে গেল। “সুজিত, সুজিতের বাবাকে পুলিশ এরেস্ট করেছে। আমার ভয় হচ্ছে। বুঝতে পারছি না কিছু। রুবি, রুবি কোথায়, কেমন আছে, ও ঠিক নেই নিশ্চয়ই।”

“শান্ত হয়ে শুনো প্লিজ।”

“শান্ত, শান্ত হই কি করে? মা জানে না এসব। ম*রে যাবে শুনলে। আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে।”

“এভাবে সবটা ঠিক হবে রুস্মি?”

মাথার হেলমেট খুলতে খুলতে সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করল সীরাত। রুস্মি বুঝল আবরাজের সাথেই এসেছে।
“তোমাকে জানতে হবে, বুঝে শুনে সামলাতে হবে সবটা।”

“কি?”

“আগে স্থির হও বোন। ভেঙে পড়া যাবে না।”

“রুবি কি ঠিক আছে সীরাত? উত্তর আছে তোমার কাছে।” রুস্মির উদ্বিগ্ন ভরা কণ্ঠটা ঝিম ধরিয়ে দেয়। সীরাত গোপনে শ্বাস ফেলে। আবরাজ পানি এগিয়ে দিল। “পানি খাও। তুমি চটপটে আর বুদ্ধিমতি বলেই জানতাম আমি। অথচ এভাবে, যাই হোক তোমার জীবনের বড় সত্য জানতে চলেছ তুমি।”

এখন রুস্মির ভয় বেড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা চাতক পাখির মত তাকিয়ে। সীরাত পাশে বসল। আগলে নিল দু হাতে। “নিউজে কি কি শুনেছ?”

“সুজিতের বাবা সুফিয়ান কামাল গ্রেফতার।”

“আর কিছু?”

“উঁহু।”

সীরাত আবরাজের দিকে তাকাল। আবরাজ খুব স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে। সীরাত চোখের ইশারা করল কিছু। যা রুস্মির চোখ এড়ায় নি।

“তোমরা কি লুকাচ্ছ?”

“কিছু লুকাব না রুস্মি। তুমি আগে শান্ত হও।”

এবার রুস্মির কণ্ঠ দৃঢ় হলো। “কি করে শান্ত হব বলতে পারও। আমার বোন নিখোঁজ। পরিবারটা ভেঙে যাচ্ছে। ঐদিকে সুজিতের বাবা নিজ ছেলেকে হ*ত্যার চেষ্টায় কারাগারে। এসব স্বাভাবিক নয়। আমি বুঝতে পারছি খুব বড় কিছু হয়েছে। তোমরা প্লিজ বলবে আমায়।”

**আমি বেশ কিছু স্থানে রুস্মির নাম গুলিয়ে রুশ্মি লিখে ফেলেছি। মূলত ওর নাম হবে রুস্মি।**

চলবে..
কলমে~ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here