হাতে_রেখো_হাত (২)

0
226

#হাতে_রেখো_হাত (২)

পরীক্ষা দিয়ে বের হয়েছে আবরাজ। বেশ ধকল গেলো ওর উপর। পড়াশোনা কমপ্লিট করে মধ্য রাতে বসেছিল কাজ নিয়ে। পরীক্ষা চলাকালীন সময়টা ছুটি পেয়েছে ঠিক। তবে নিয়মিত বাড়ি থেকে কাজ করতে হবে এমন ই নির্দেশনা ছিলো। তাই দীর্ঘ একটি মাস ঠিক মতো ঘুম হয় নি। এইচ এস সি পরীক্ষাটা বেশ ভালোই ভালোই পার করেছে। মোটামুটি ভালোই রেজাল্ট হবে। ভাগ্য ভালো থাকলে টপ ওহ করতে পারে। কড়া রোদ্দুর আজ। ফাইলটা উঁচু করে হেঁটে চলেছে ছেলেটা। পাশের দোকানে রাখা ছোট্ট টেডি বেয়ার খানা ওর মন কেড়ে নেয়। মাথায় আসে অরিতার কথা। আজ বাদে কাল মেয়েটার জন্মদিন। আগের বার শোকে শোকেই দিন পেরিয়েছে। কোনো উপহার দেওয়া হয় নি। দেখতে দেখতে একটা বছর পেরিয়ে গেল। আজ ইচ্ছে হচ্ছে উপহার দেওয়ার। পকেট হাতরিয়ে বুঝতে পারলো টেডি বেয়ার কেনার মতো টাকা নেই ওর নিকটে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে গেলো মুহুর্তেই। কতো শখ করেছিলো ছেলেটা। তবু ও দোকানে গিয়ে সফট টয়ের দাম জিজ্ঞাসা করলো। দোকান দার জানালো ৪৫০ টাকা। ৩৩০ টাকা আছে ওর কাছে। এখান থেকে হেঁটে বাসায় যেতে হলে সন্ধ্যা নেমে যাবে। তাই ত্রিশ টাকা রেখেই যা কেনার কিনতে হবে। ৩০০ টাকা দিয়ে চকলেট বক্স কিনতে গিয়ে ও কিনলো না। অরিতা অন্য সব বাচ্চা দের মতো চকলেট পছন্দ করে না। সফট টয় পেলে বেশ খুশি হবে। ছেলেটা যেন কিছুতেই মনের ভেতরে শান্তি পাচ্ছে না। ধীর পায়ে রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়ালো। মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো কোনো কাজ ই ছোট নয়। তারপর ই এগিয়ে গেল খাবারের হোটলের দিকে। দোকান দার বেশ চেঁচাচ্ছেন। অর্ধ শতাধিক মানুষের ভীর জমিয়েছে এখানে। তবে বাসন মাজার লোক আসে নি আজ। সেই কারনে কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে। কাঁপা স্বরে দোকানে এসে দাঁড়ালো আবরাজ। লোকটা এক পলক তাকিয়ে আবারো কাজে মত্ত হলো। চাপ ভাজতে ভাজতে বললেন ” এই রন্টু, কই গেলি তুই। দ্রুত প্লেট নিয়ে আয়। ”

পরক্ষনেই ক্ষীন গলা টা নরম করে বলল “আপনাকে কি দিবো স্যার? চিকেন চাপ নিবেন নাকি চিকেন ফ্রাই? ”

ছেলেটা ভারী অবাক হলো। নিজেকে যথারীতি সামলে নিয়ে বলল ” একটা কাজ দরকার। যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে বাসন মাজার কাজটা করে দিতে পারি আমি। ”

গাঁয়ে কলেজ শার্ট। লোকটা যেন বিশ্বাস করলো না ওকে। খিটমিট করে হেসে উঠলো। রসিকতার কণ্ঠে বলল ” বুঝছি স্যার আপনি মজা করছেন। এখন বলেন কি নিবেন?”

” না না আমি মজা করছি না। আমি সিরিয়াস, দয়া করে আমাকে কাজটা দিন। ”

এদিকে লোক জন তাড়া দিয়ে যাচ্ছে।অপেক্ষা করতে করতে কয়েক জন উঠে ও গেল। লোকটা তাঁদের বসতে বললে তাঁরা জানালো যে দোকানে প্লেটের পর্যাপ্ততা নেই সে দোকানে বসে থেকে কোনো লাভ ও নেই। দীর্ঘশ্বাস টেনে লোকটি আবার শুধালো ” আপনি কি সত্যি মজা করতেছেন না? ”

” আমি মজা করছি না। ”

ভ্রু কুটি করে তাকায় লোকটি। হাতের ইশারায় রুন্টু কে ডাকে। গামছা দিয়ে কপালে ঘামের শেষ বিন্দু টুকু মুছে রুন্টু বলল ” কন স্যার। ”

“এই ছেলেটা কে বাসন পরিষ্কারের জায়গায় নিয়ে যা। ”

হা হয়ে যায় রুন্টুর মুখ। আবরাজ কে আগা গোড়া দেখে নিয়ে বলে ” কি কইতেছেন স্যার। এ তো কলেজ স্টুডেন্ট। তা ও বড় সড় কলেজের। ”

” আহহ যাহ কইতেছি তা কর তো। ”

” হ যাইতেছি। আপনি আসেন আমার সাথে। ”

কৃতজ্ঞতায় মাথাটা নিচু করে আবরাজ। দোকানদার অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এটা কি সত্যি?

হাতে দুশত টাকা পেয়ে ভারী আনন্দ অনুভব হচ্ছে ছেলেটার। মাস শেষ হতেই টাকা পয়সা শূন্যের খাতায় নেমেছে। পরীক্ষার জন্য কতো গুলো টাকা দিতে হলো।সব কিছু মিলিয়ে যেন চলছিলো না। বোনের জন্য সফট টয় কিনতে পেরে বেশ শান্তি অনুভব হচ্ছে। রিক্সা নিয়ে বাসায় এলো। কতো দিন পর রিক্সাতে উঠলো ঠিক ঠাওর হচ্ছে না। হবে কি করে? রোজ এই চার পাঁচ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসেছে এতো দিন। হাতে বই নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে এগিয়েছে রাস্তার ফুটপাত ধরে। কথায় আছে কষ্ট করলে সফলতা আসে। আর পরিশ্রম নাকি বিফলে যায় না। তেমনি এক সফলতার অপেক্ষায় রয়েছে আবরাজ।

.

সামান্য ৪৫০ টাকার একটি সফট টয় কাউকে এতোটা আনন্দ দিতে পারে তা ছিলো কল্পনার অতীত। অরিতার মাথায় চুমু খায় আবরাজ। একটু আগে ঠিক বারো টার সময় জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা ও সফট টয়টা উপহার দিয়েছে আবরাজ। তখন থেকে কতো বার যে অরিতা থ্যাংকস বলেছে জানা নেই ওর। মেয়েটার চোখ দুটো চকচক করছে এখনো। খুব ভালোবাসে ভাইকে। ঠিক তখনি ওর ছোট্ট মস্তিষ্ক জানান দিলো মাস তো শেষের দিকে। তেরো বছরের এই কিশোরীর মস্তিষ্ক ও বুঝতে পারে টাকাটা ঠিক কতোখানি প্রয়োজনীয় ছিলো। মুহুর্তেই মুখে ভর করে এক রাশ কালো মেঘ। আবরাজ বুঝতে পারলো না হঠাৎ মুখটা গোমড়া করার কারন। আদুরে কণ্ঠে বোনকে শুধালো ” কি হয়েছে অরি? ”

” এটার দাম কতো ভাইয়া? ”

” উপহারের দাম জিজ্ঞাসা করতে হয় না বোন। ”

সফট টয় টা নাড়িয়ে দেখে মেয়েটা। দামটা ভেবে বলল
” ৪০০ , ৫০০ টাকা তো হবেই। এতো গুলো টাকা নষ্ট করা উচিত হলো না? ”

” নষ্ট কোথায় করলাম? ”

“এটার প্রয়োজন ছিলো না ভাইয়া। তুমি ই আমার কাছে যথেষ্ট। ”

আবরাজকে জড়িয়ে ধরে অরিতা। বাবা মাকে খুব মনে পরছে ওর। সৃষ্টিকর্তা ওর থেকে বাবা মাকে তো তুলে নিয়েছেন তবে ফেরেস্তা রূপী ভাইকে দিয়েছেন। যেই ছেলেটা দুনিয়া তোলপাড় করা ভালোবাসা দিয়ে এতো দিন ধরে আগলে রেখেছে ওকে।

আকাশে অর্ধ চাঁদ। বিষণ্ন রাত্রীটা কে উপভোগ করছে আবরাজ। পাশেই বেঘোরের ঘুমিয়ে আছে অরিতা। জন্মদিনের, দিনে ও মেয়েটা চোখের পানি ঝরালো। তেমন কিছুই দিতে পারে নি ওকে। তবু ও মেয়েটা বললো ‘ তুমি আমার পৃথিবীর সেরা ভাই ‘।

আনমনেই হেসে উঠে আবরাজ। স্বার্থকতা বোধহয় একেই বলে। অন্তর থেকে স্বস্তি নেমে আসে। জীবনে কতো কি হারাতে হবে জানা নেই। তবে বোন নামের প্রাপ্তিটা যেন কখনো না হারায় এই প্রার্থনাই থাকবে।

পরীক্ষা শেষ হওয়াতে অনেক টা সময় পেল আবরাজ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো প্লে গ্রাউন্ডের দিকে। ঠিক তখনি গো*লাগু*লির শব্দ কানে আসে। কোনো শত্রু পক্ষ আক্রমন করেছে। বো**মা আঘা*ত করা হচ্ছে সর্বত্র। বুকের ভেতরটা মোচর দিয়ে উঠলো। চোখ দুটো ও কেমন ছলছল করছে। হঠাৎ করেই অরিতার কথা মনে হলো। বাসায় একা রয়েছে মেয়েটা। এক সেকেন্ড সময় ব্যয় না করে কলোনিতে এগিয়ে গেলো ছেলেটা। পা যেন চলছেই না। মোটা দঁড়ির সাহায্যে যেন কেউ বেঁধে রেখেছে ওর পা। চারপাশে আগুনের ছড়াছড়ি। হঠাৎ করে কোন দেশ থেকে আক্রমন হলো আবার?

মহল্লায় ঢুকতেই একটা বো*মের শব্দ শুনতে পেলো আবরাজ। এক পলক পিছে তাকালো। পেছনে থাকা ঘর গুলো থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। চোখ দুটো ঘোলাটে হলো কেমন। শুকনো ঢোক গিলে আবার ও ছুট লাগালো। ঘরের কাছে আসা মাত্র ই অনাকাঙিক্ষত সেই বো**মটি পরলো ওদের ঘরের কাছে। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পরলো পুরো ঘর জুড়ে।এক মুহুর্তের জন্য হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো আবরাজ। মৃদু চিৎকারের শব্দ কানে আসতেই ফের সচকিত হলো ছেলেটা। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে চিৎকার করছে অরিতা। বুকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা অনুভব হলো। মৃদু শব্দে উচ্চারন করলো ” অরি, বোন আমার। ”

কথাটা কানে পৌছালো না মেয়েটার। ছুট লাগলো আবরাজ। তবে এই কয়েক পায়ের পথ যেন হাজার মাইলের মতো হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করতেই চিৎকার করে উঠলো অরিতা। আবরাজ বলল
” অরি, ভয় পাস না বোন। আমি আসছি, কিচ্ছু হবে না তোর। ”

দু চোখের কার্নিশে পানির ফোয়ারা নেমে যায়। মৃদু হাসে মেয়েটা। আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে এখান থেকে বের হওয়া অসম্ভব! বরং আবরাজ এখানে আসলে ওর মৃ*ত্যুটা ও নিশ্চিত হবে। শেষ বারের মতো আদুরে কণ্ঠে ভাইয়া ডাকটা বললো মেয়েটা। আবরাজ জানালার কাঁচ ভে*ঙে ফেলেছে। প্রবেশ করবে তখনি চিৎকার করে উঠলো অরিতা। ” আমার কসম লাগি ভাই। যদি আর এক পা আগাও তাহলে আমি এই আ*গুনে ঝাঁপ দিবো। ”

থমকে যায় আবরাজের পা। কয়েক সেকেন্ড থমকে থাকার পর আবারো ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে। তবে তাঁর আগেই কোথা থেকে আগুনে ফুলকি এসে জড়িয়ে নেয় ছোট্ট অরিতাকে। মৃদু আর্তনাদ করে উঠে অরিতা।শেষ বারের মতো পৃথিবীর বুকে অরিতার কণ্ঠে শোনা যায় ‘ তুমি আমার,পৃথিবীর সেরা ভাই ‘

**সাধ্যমতো রেসপন্স করার অনুরোধ**
চলবে……
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here