হাতে_রেখো_হাত (২১)

0
90

#হাতে_রেখো_হাত (২১)

সেনাবাহিনীতে সিলেক্ট হয়ে যেন পৃথিবীর সমস্ত সুখ হাতে পেয়ে গেছে সীরাত, আবরাজ। দুজনের চোখেই পানি। পূর্ণ ভাবে দেশকে রক্ষা করার মর্যাদা পেল ওরা। এর থেকে ভালো খবর আর কিই বা হতে পারে? সব থেকে বেশি খুশি হয়েছেন অফিসার আবুল। আবরাজ কে সন্তানের মতো সমীহ করেন তিনি। ছেলে মেয়ের এই সফলতা যেন ওনার বুক ফুলিয়ে তুলে। দুজন কে জড়িয়ে ধরেন তিনি। অশ্রু ভেজা পল্লব ফেলেন। গলার স্বর ইষৎ ভাঙা। “আমি গর্বিত বাচ্চারা। এই বাবাকে এত বড় পাওয়া এনে দিয়েছ তোমরা।”

সীরাতের চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠল। আবরাজ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। সীরাতের মাথায় এখন দুষ্টুমি। বাবার বুকে মাথা রাখা অবস্থাতেই আবরাজকে চোখ মেরে দিল। ছেলেটা সামান্য বিব্রত হয়। পরক্ষণেই মৃদু হাসির রেখা ফুটে।

বিকেলে বেশ জমকালো আয়োজন করা হলো। প্রেগনেন্ট অবস্থাতেই কাজ করে চলেছে রাই। যাঁর ফলে বকে যাচ্ছে রকি। ছেলেটার এমন ধারার পাগলামি দেখে হেসে কুটি কুটি সীরাত আর আবরাজ। লজ্জায় পরে হয় রাই। ইদানিং মেয়েটির মাঝে বিশাল পরিবর্তন এসেছে। নম্রতা দেখা যায় প্রতি সেকেন্ডে।
“থাকবোই না আমি। তুমি বাচ্চাদের মত করছ রকি।”

“আরে রাগ করলে কেন? শোনো আমার কথা। আমার বাচ্চার মা তুমি। একটু তো খেয়াল রাখতে হবে।”

কোনো কথাই কানে নিল না রাই। এগিয়ে গেল। পিছু নিয়েছে রকি। আবরাজ আর সীরাতের দৃষ্টিতে রয়ে গেল সুন্দর এই মুহুর্তটি। এতক্ষণ দূরে দূরে থাকলে ও এখন কাছে এসে দাঁড়িয়েছে আবরাজ। মেয়েটিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই ক্ষীন কেঁপে উঠে। গলার স্বরে লজ্জা এসে জটলা পাকায়। ছেলেটির চোখে মুখে মাদকতা ছড়িয়ে আছে। যাঁর নেশায় মত্ত হয় সীরাতের চিত্ত। কিছু বোঝার পূর্বেই মেয়েটির ওষ্ঠাধরে নিজের ওষ্ঠাধর ছুঁয়ে দিল। উষ্ণতায় ভরে উঠে মুখাশ্রী। লজ্জায় যা তা অবস্থা সীরাতের। আজ যেন লাজ লজ্জার মাথা খেয়েছে আবরাজ। সীরাতের থুতনির ধরে উঁচু করে বলে। “তুমি একা নয় আমি ও ভালোবাসতে পারি। প্রচন্ড রকমের ভালোবাসা জমিয়েছি। কিছু দিন পর সব ভালোবাসায় জড়িয়ে নিব তোমায়। এই যে ধরেছি হাত রেখেছি অন্তরে। বুক চিরে দেখ যাও কতখানি পুড়েছে।”

সীরাতের ঘন শ্বাস আবরাজের কানে পৌছাতেই কিছু টা দুরুত্ব নিয়ে নিল। সেই সুযোগেই পালিয়ে গেল সীরাত। হো হো করে হেসে উঠল আবরাজ। মেয়েটা আস্ত এক পাগলী। ভালোবাসলে ও সহ্য হয় না, না বাসলে ও চলে না। মোট কথা সহ্য হয় না কোনো কিছুই।

রাতের খাবার শেষ হতেই আবুল বললেন “তোমাদের সকলের মতামত চাচ্ছি।”

“কোন বিষয়ে বাবা?”

“সীরাত আর আবরাজের বিয়ের ব্যপারে। দুজনকে আলাদা দেখতে ইচ্ছে হয় না। যেহেতু সিলেকশন হয়ে গেছে তাই ভাবছি চার হাত এক করে দিব।”

সামান্য লজ্জায় পরল আবরাজ আর সীরাত। সেই সুযোগ টাই গ্রহন করল রাই। “আমার বাবু আসার আগে আরেকটা বাবু আসার খবর শুনতে চাই আমরা। তাই দ্রুত বিয়ের ব্যবস্থা করা হোক।”

মেয়েটির কথা শুনে সীরাত কিংবা আবরাজ কেউ ই থাকতে পারল না। দুজনেই যেন মুখ লুকিয়ে বাঁচল। চাঁপা হাসির আওয়াজে মেতে উঠল পুরো বাড়ি। আর ওদিকে প্রেমময় অনুভূতির জোয়ারে ভাসতে লাগল দুই কপোত কপোতি।

ছাঁদের কাছে আসতেই খপ করে হাত ধরে ফেলল আবরাজ। একদম কাছে নিয়ে আসল ওকে। চোখে লেগে আছে তীব্র নেশা। মনের অনুভূতি যেন তড় সইছে না আর। শুকনো ঢোক গিলল সীরাত। “এত ভালোবাসা দেখিও না। আমি শেষ হয়ে যাব।”

“আর আমি তো শেষ হয়েই গেছি। তোমার প্রেমের আগুনে এ বুক পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কতটা ভালোবাসি জানো কি?”

“উহু জানতে চাই ও না, আর না ম’রতে চাই। এই ভালোবাসাতেই আমি ঝলছে যাচ্ছি। অধিক প্রেমে
ম ‘রে না যাই।”

মেয়েটার মুখে হাত দিয়ে দিলো আবরাজ। চাঁপা রাগ দেখিয়ে বলল “ম ‘রার কথা বলবে না একদম। এ বুকে পিষে রাখব তোমায়। হাতে রেখেছি হাত ছাড়ার জন্য নয়। আমার অন্তরে তুমি সর্বদা থাকবে সীরাত। তুমি না থাকলে আমিও যেন না থাকি।”

কথা গুলো বলার সময় চোখ দুটো হালকা ভেজা অনুভব হলো। সীরাতকে জড়িয়ে কেঁদে উঠে আবরাজ। হতভম্ব সীরাত বলল “কি হলো তোমার?”

“আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বল না প্লিজ। আমি মরে যাব। খুব ভালোবাসি, অনেক বেশি ভালোবাসি। থেকে যাও প্লিজ। হাতে রেখো হাত। কথা দিচ্ছি কোনো দিন কষ্ট দিব না। আমার তো কেউ নেই।”

.

বিয়েটা সম্পূর্ন হয়ে গেল কিছুক্ষণ পূর্বে। দুজন কে ঘরে রেখে চলে আসলো সবাই। লজ্জা যেন রাঙিয়ে তুলেছে সীরাতকে। ছেলেটা চাঁপা হাসিতে মত্ত। মেয়েটার অবস্থা বেশ ইনজয় করছে। ওর হাসি দেখে রেগে গেল সীরাত। বেডে চেপে ধরে বলল “এত হাসি কেন হু? বউ পছন্দ নয়। আরও বিয়ে করবে?”

“আরও বিয়ে করাতে চাইলে করব বিয়ে। আমার অসুবিধা নেই। বরং বেশ সুবিধা হবে তখন।”

জ্বলন্ত আগুনের মতো তেঁতে উঠে সীরাত। মেয়েটার রাগ দেখে ভয় পায় আবরাজ। তাই এক হাতে জড়িয়ে ধরে। বুকে সাথে মিশিয়ে ফেলে। সীরাত নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে “চাই না এমন ভালোবাসা।”

“কিন্তু আমার যে চাই। খুব করে চাই তোমায়।”

“আরেকটা বিয়ে কর।”

“এক অভিমানীকে নিয়েই পারছি না। আরও বিয়ে করব? বাপ্রে এত কলিজা নেই।”

ফুঁপিয়ে উঠল মেয়েটি। মেয়েটির চোখের পানি টুকু ঠোঁটের সাহায্যে শুষে নিল আবরাজ। সময়টুকু কে অনুভূতিরা জড়িয়ে নিল। এ পৃথিবীকে স্বাক্ষী করে ধরার বুকে প্রহরটা হয়ে গেল প্রেমময়।

চার বছর পর

বি এস সি পাস করেছে আবরাজ আর সীরাত। দুজনেই বেশ ভালো মার্ক পেয়েছে। সেনাবাহিনীর বিশেষ পদ পেয়েছে দুজনে। আবরাজকে সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স এর প্রধান পদ দেওয়া হয়েছে। আর ওর সহধর্মিনী কে ওর সহকারী করা হয়েছে। দুজনের সফলতা যেন পুরো দেশে ছেয়ে গেল। ইতিহাসের পাতায় ছেপে গেলে এই খবর। স্বামী স্ত্রী দুজনেই সেনাবাহিনীর বড় কর্মকর্তা সেটা ও সেইম ডিপার্টমেন্টে!

রকি আর রাই এর ছেলে বেবি হয়েছে। কিছু দিন পর ই চার বছর পূর্ণ হবে। দুজনের ভালোবাসার অংশ টি যেন এক নিমিষেই চারটি বছর পার করে ফেলল! বেডে বসে ফোন ঘাটছিল সীরাত। দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ করল রাই। “আসব সীরাত?”

“আরে ভাবী আসো তো। এত অনুমতি নেওয়ার কি প্রয়োজন?”

“প্রয়োজন আছে গো ননদিনী। তা তোমার আশিক কোথায়?”

“এতিম খানায় গেছে। কাল একটা আয়োজন করবে।”

“ওহ আচ্ছা। ছেলেটা বড় ভালো। নিজের পরিবারের শেষ স্মৃতির জমিটুকু তে এতিম খানা করল। কত গুলো বাচ্চা এখন থাকতে পারছে বলো তো।”

মৃদু হাসল সীরাত। রাই বলল “আমাদের নতুন সদস্যের খবর কবে দিবে সীরাত?”

মাথাটা নিচু করে ফেলল সীরাত। হাসতে হাসতে রাই বলল “সামনেই রিদুর জন্মদিন। আশা রাখছি খুব দ্রুত আরেকটা খুশির সংবাদ পাব।”

“উফ ভাবী তুমি ও না।”

বালিশে মুখ লুকায় সীরাত। সন্ধ্যায় আবরাজ আসতেই সীরাত বায়না ধরল। “আমার বেবি চাই।”

“মানে?”

“একটা বেবি চাই আমার। প্লিজ, প্লিজ একটা বেবি।ছোট ছোট হাত পা নিয়ে খেলব। পড়াশোনার ধাপ তো শেষ বাবা।”

প্রফুল্লতা ছড়িয়ে পরল ঘরময়। স্মিত হাসে আবরাজ। লজ্জায় লাল টুক টুকে হলো সীরাত।

দুই বছর পর
সীরাত আর আবরাজের ঘর আলো করে এসেছে মিষ্টি এক কন্যা সন্তান। পুরো বছরটা বেড রেস্ট করে করেই পার করল সীরাত। আবরাজ নিজে ও ছুটি নিয়েছে। তবে ঘরে বসে নতুনদের জন্য মোটিভেট সেশন করে যাচ্ছে। সীরাত বলল “এখন তো জয়েন হতে পারি আমরা?”

“তোমার শরীর পুরোপুরি সুস্থ নয় সীরাত।”

“প্লিজ আবরাজ।”

“আচ্ছা জয়েন হবো আমরা। তবে নেক্সট ইয়ার।”

“ওকে।”

খুশি মনে বেরিয়ে পরল সীরাত। মিষ্টি মেয়ে তিহুনকে নিয়ে খেলছে রিদু। আর বাচ্চাটা ও খিল খিল করে হেসে চলেছে। স্বস্তির শ্বাস ফেললো সীরাত। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আবরাজ সে দিকে খেয়াল ই নেই। ফিস ফিস করে আবরাজ বলল “সুন্দর তাই না?”

“হু।”

হেসে উঠল আবরাজ আর সীরাত। দুজনেই এখন সেনাবাহিনীতে জয়েন হবে। অবশ্য এর জন্য ত্যাগ স্বীকার করল দুজনেই। বাচ্চাটির বয়স মাত্র এক বছর।

এক বছর পর
বাসা থেকে বের হচ্ছিল সীরাত আর আবরাজ। পূর্ন ভাবে জয়েন হচ্ছে দুজনে। তিহু কেঁদে অবস্থা খারাপ করে ফেলেছে। সীরাত যেন কেঁদেই দিবে। আবরাজ হালকা হাতে মেয়েটির মাথায় স্পর্শ করে বলল “আমরা দেশের অংশ বিশেষ সীরাত।”

“মনে আছে আমার।”

তিহুনকে কোলে তুলে নিল আবরাজ। দুই বছর বয়স, কতটুকুই বা বয়স হলো ওর। তিহুন এর হাতে চুমু একে সীরাত বলল “মাই ডিয়ার গার্ল। আমার ব্রেভ বাচ্চাটা। এভাবে কাঁদে কেন মা? তোমাকে তো মনে রাখতে হবে তোমার মাম্মা পাপা দেশের সাথে জড়িত। তোমাকে এই ছোট বয়সেই অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে সোনা।”

“মাম্মা। আমি আমি ”

মাম্মা মাম্মা করে কেঁদে চলেছে মেয়েটি। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ওরা। রিদু এসে আবরাজ কে বলল “আঙ্কেল আমাকে কোলে তোলে।”

রিদু কে ও কোলে তুলল আবরাজ। তিহুন এর দিকে তাকিয়ে বলল “আমি আছি তো তিহুন। তোকে আমি দেখে রাখব। আমার সাথে থাকবি না?”

রিদুর কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেল সকলে। তিহুন কি বুঝল কে জানে। তবে কান্না থামিয়ে দিল। স্বস্তির শ্বাস ফেলে সকলকে বিদায় জানালো দুজনে। বুকের ভেতর চাঁপা কষ্ট কাজ করছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না এদেশের জন্য নিজের জীবনকে বহু আগেই উস্বর্গ করেছে ওরা।

চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here