#হাতে_রেখো_হাত (৩)
পু*ড়ে যাওয়া লা*শের সামনে নির্বিকার হয়ে বসে আছে আবরাজ। ছেলেটার গাঁয়ের বেশ কিছু স্থানেই পু**ড়ে গেছে। তবে মজার ব্যপার হচ্ছে কোনো ব্যথা নেই ওর। ব্যথা তো রয়েছে মনের গভীরে। প্রিয় বোনটা জ্বল*ন্ত কয়লা এখন। লা*শ চেনার উপায় নেই। শুধু পরে আছে হাড় গুলো। কতো সুন্দর ছিলো মেয়েটি। মাত্র তেরো বছরেই নিজের জীবনের অন্তিম পাতা পড়তে হবে কে জানতো? আবরাজের মনে বিষণ্ণতার পাহাড় জমেছে। বুকের ভেতর অশান্ত সমুদ্রের কলতান বাজে। ঢেউ গুলো উথালপাতাল হয়ে নেমে যায় কানের পাশ বেয়ে। হৃদয়ে জ্বালাপোড়া হয়। মাথার উপর চমকায় বিদ্যুৎ। যেন মেতেছে কোনো ধ্বংসযজ্ঞে। নিজেকে চিনতে পারে না ছেলেটা। মাত্র কিছু সময়ের ব্যবধানে বদল ঘটে গেল জীবনের। শুকিয়ে যাওয়া চোখ গুলো চারপাশে খোঁজ চালায়। উহু নেই কোনো চিহ্ন। যন্ত্রণায় মনের কোণ থেকে একটি শব্দ ভেসে আসে ‘ আমি কেন আ*গুনে পু*ড়ে গেলাম না? ‘
ছেলেটা বাক শক্তি হারিয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। এখন বিকেল চারটা বাজে। প্রায় চারটা ঘন্টা পর আ**গুন নিভাতে সক্ষম হলেন দমকল বাহিনী। তবে বাঁচাতে পারে নি কাউকেই। একটা প্রা*ণ ও রেহাই পেলো না। কারন যতোক্ষণে দমকল বাহিনী পৌছায়, ততক্ষণে ঘরের ভেতর আটকে পরা মানুষ গুলো কুচকুচে কয়*লায় পরিনত হয়েছে। বলতে গেলে প্রতিটা লা**শ ই ছিন্ন ভিন্ন। সব গুলো লা**শকে এক সাথে করার চেষ্টা করতেই তেঁতে উঠলো আবরাজ। নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে হা*ড় গুলোকে জড়িয়ে ধরলো বুকে। চার পাশে থাকা পো*ড়া মাং**সের গন্ধে অবস্থান করা যাচ্ছে না। একদম নাকে এসে বাজে গন্ধটা বুকের ভেতর অবধি ছেয়ে যাচ্ছে। আর ছেলেটা কতো সহজেই জড়িয়ে নিলো সেসব। একজন কর্মী লা**শটার অংশ নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই চেঁচিয়ে উঠলো ফের। কণ্ঠে উন্মাদ, দিগহীন পাগলের মতো আর্তনাদ
” একদম নয়। আমার বোনকে টাচ করবে না একদম। আমার বোন , আমার অরি। সুন্দর বোনটা আমার। কোথায় গেলি তুই। বোন, কষ্ট হচ্ছে তোর? ভাইয়া আছি। এই তো আমি। তোর কাছে। ”
ছেলেটার দু চোখ বেয়ে অশ্রুর ধারা নেমেছে। গলায় কথা আটকে যাচ্ছে। ক্রন্দনরত অবস্থাতে ছেলেটাকে ভীষণ বিক্ষিপ্ত দেখায়। সুন্দর মুখ খানি বেশ নেতিয়ে পরা গোলাপের মতো রূপ বদল করেছে। জামা কাপড়ে ময়লা আর শুকিয়ে যাওয়া র**ক্তের ছোঁ*প ছোঁ*প দাগ। মেয়েটির লা**শকে ছাড়বেই না কিছুতে। অথচ অবশিষ্ট নেই এক টুকরো মাং**স। তবু হা*ড় গুলোই যেন ভীষণ আপন।
কর্মীরা উপায় না পেয়ে ছেলেটাকে সরানোর চেষ্টা করলো। একা না পারায় অনেক গুলো মানুষ এসে সরানোর চেষ্টা চালালো। সৃষ্টিকর্তা যেন প্রাণ ভরে সমস্ত শক্তি প্রদান করে দিয়েছে আবরাজের দেহে। কিছুতেই ছেলেটাকে সরাতে পারছে না কেউ। আর্তনাদ করে বলছে শুধু ” আমি যেতে দিবো না আমার বোনকে। আমার বোন আমার সাথে থাকবে। আজ আমার বোনের জন্মদিন। দিবোও না যেতে। অরি, আছি আমি। তোর ভাই। ”
না পেরে একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছেলেটার পিঠে লাঠি দিয়ে আঘা*ত করলো। তবু ও পারছে না ছাড়াতে। বা হাতে আঘা*ত পরতেই ছেলেটার হাত ফঁসকে এলো। চিৎকার করে বলতে লাগলো ” আমি তোকে বাঁচাতে পারলাম না বোন। পৃথিবীর সেরা ভাই হতে পারলাম না আমি। পারলাম না তোকে বাঁচাতে। আমি কি করে থাকবো? এই দুঃখ যে আজন্মকালে ও সইবে না। আমি বাজে ভাই। খুব বাজে। ”
কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পরেছে আবরাজ। চোখ দুটো জলে ভরা কোনো বিল যেন। সমস্ত মেঘেরা বাসা বেঁধেছে ওর দু চোখে।অরিতার মুখ ভাসছে শুধু। কোনো মেঘের দেশ থেকে ভেসে আসবে কি অরিতার খিল খিল হাসি? নাকি এভাবেই শেষ হবে অরিতা নামের মেয়েটি। আবরাজ চোখ বন্ধ করার আগে ফের একটাই শব্দ কানে আসলো ‘ আমার পৃথিবীর সেরা ভাই তুমি। ‘
আট দিন,আট দিন পর পূর্ণ জ্ঞান ফিরলো আবরাজের। এই আট দিনে বহু বার জ্ঞান ফিরেছে। প্রতি বার ই অরি , অরি বলে চিৎকার করে আবারো অচেতন হয়ে পরেছে। বোনের প্রতি অসীম ভালোবাসা সবাইকে মুগ্ধ করেছে। তবে হায় এ যন্ত্রণা কখনো কি লাঘব হয়?
মাথা চেপে ধরে আবরাজ। কেমন ভারী ভারী মনে হয়। প্রচন্ড ব্যথায় ঘাড় নাড়ানো যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে কোনো শক্ত পোক্ত ঝোলা চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। ঘাড় যেন এখনি বেঁকে যাবে। ডান হাতটা বেড শিটের সাথে ঘসা লাগতেই আহ বলে আর্তনাদ করে উঠলো ছেলেটা। অনেকটা পু**ড়ে গেছে। ছেলেটার আর্তনাদ শুনে ছুটে আসেন নার্স। বিগত দিন গুলোতে বেশ পাগলামি করেছে আবরাজ। সেই কারনেই নার্স ভয় পেয়ে যান। বিলম্ব না করে ছুটে যান ডাক্তারের কাছে। কয়েক মুহুর্তেই সাথে নিয়ে আসেন দুজন স্টাফকে। তবে আজ পাগলামি করলো না আবরাজ। কেমন যেন হয়ে গেছে। দেহে শক্তি নেই বললেই চলে। থাকবেই বা কেমন করে। স্যালাইনের মাধ্যমে বেঁচে আছে! মৃদু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে কয়েক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছেলেটা বোঝার চেষ্টা করে বিষয়টা। তবে ঠিক ঠাওর করতে পারে না। আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এটা হসপিটাল। ধীর পায়ে নামতে যেতেই একজন নার্স বললেন ” আপনি অসুস্থ। এখন উঠবেন না প্লিজ। ”
নার্সের দিকে তাকিয়ে রইলো আবরাজ। ফ্যালফ্যালে রুগ্ন চাহনি। হাতের ইশারায় ক্যানেলা খুলতে বললো। নার্স খুলে দিলেন সন্তপর্ণে। হাত খানা কয়েক বার উঠা নামা করলো। প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হয়। হাত বোধহয় অবশ হয়ে রয়েছে।
তিন ঘন্টা পর নিজের অতীতকে মনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। নিজ ব্যক্তিত্বকে ফিরে পেলে ও আবেগ আর অনুভূতিকে লুকাতে অক্ষম। ডুকরে কেঁদে উঠলো পুরো হসপিটালের সম্মুখে। একজন ডাক্তার ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ” শান্ত হও বাবা, শান্ত হও।”
” স্যার আমার বোন। মাত্র তেরো বছর ওর। জন্মদিন ছিলো সেদিন। মেয়েটা একা করে চলে গেলো। কেউ নেই আমার। এই পৃথিবীর বুকে আমি একা। মূল্যহীন আমার বেঁচে থাকা। ”
চুল মুঠোতে এনে ধপ করে বসে পরলো। বেশ কিছু সান্ত্বনার বানী শুনতে হলো ওকে। তবে সান্ত্বনাতে কি জীবন চলে?
পো**ড়া বাড়ির কাছে এসে দাঁড়ালো আবরাজ। হায়রে মানুষ! বিধ্বস্ত বাসাটা দেখে মৃদু হাসলো। এই বাসাতে জড়িয়ে ছিলো ওর পুরো পরিবারের স্মৃতি। শেষ সম্বল যাকে বলে। সরকারের থেকে সামান্য কিছু টাকা প্রদান করা হয়েছে ঘরের ক্ষতিপূরন হিসেবে। টাকা গুলোর দিকে তাকালো। জীবন কতোটা অদ্ভুত তাই না?
চারপাশ থেকে এখনো আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে।কেউ কেউ পরিবারের মানুষ হারিয়ে কেউ বা ঘর বাড়ি হারিয়ে। চাঁপা আর্তনাদ গুলো এই ভরা সন্ধ্যাতে অশরীর চিৎকার মনে হচ্ছে। কয়েকটা পুরনো ল্যাম্পপোস্টের আলোতে চিক চিক করছে রাস্তা। সে পথ ধরেই হেঁটে চলেছে ছেলেটা। প্রাণহীন দেহ। আর এলেবেলে মস্তিষ্ক।
হাঁটতে হাঁটতে পায়ের মাঝে কিছু একটা ঠেকে যায়। মাথাটা নিচু করে দেখে খবরের কাগজ। কাগজটা এরিয়ে যেতে গিয়ে ও পারলো না। কারন এর হেডলাইন এ ঝলমল করছে সেদিনের সেই ঘটনা। না চাইতে দু চোখ ভরে উঠলো। কাঁপা হাতে খবরের কাগজটা তুললো। বড্ড যন্ত্রনা হচ্ছে। বুক যেন চিরে যাবে। আলগোছে পকেটে তুলে নিলো কাগজটা। পথিমধ্যে আবরো থমকে গেলো। গুটি কয়েক মানুষের আওয়াজ কানে আসছে। একটি কথা ছিলো এমন ‘ টাকাটা পাইছিস? আমাদের কাজ এবার পরের কলোনিতে বো*মা আঘা*ত করা। প্রবাস থেকে খবর আসছে, হেলিকপ্টার দিয়া বো*মা আঘা*ত করায় আন্তজার্তিক অঙ্গনে মামলা হইছে। এবার দেশের অভ্যন্তরীণ মসলা
পাতিতেই যা করার করতে হইবো ‘
লোকগুলোর কণ্ঠে সর্তকতা। আবরাজের দু চোখে জ্বলন্ত দাবানল ।র*ক্ত চক্ষু দুটোতে হালকা পানির মালা। দেশদ্রোহি, এই হা*রামির জাতের জন্যই এতো গুলো প্রাণ চলে গেল। শরীরে তেমন শক্তি নেই। তবু ও পিছু নিয়ে এগিয়ে গেল ছেলেটা। হাতে মোটা শক্ত পাইপ। আবরাজের দিকে তাকিয়ে লোক গুলো বলল
” ঐ কে তুই? ”
” কু*ত্তার বা*চ্চা দেশে থেকে দেশের ক্ষতি করিস। দেশদ্রো*হি, মিরজাফর। ”
কথার মাঝেই পাইপ দিয়ে একজনের গাঁয়ে আঘা*ত করে বসলো ছেলেটা। রেগে গিয়ে সবাই মিলে চেপে ধরে আবরাজকে। ছেলেটা এতো গুলো লোকের সাথে পেরে উঠে না। মাথায় আঘা*ত পরতেই লুটিয়ে পরে মাটিতে। পুলিশের গাড়ির শব্দ আসতেই লোক গুলো পালাতে লাগলো। দূর্বল, র*ক্তা*ক্ত শরীর নিয়েও আবরাজ বলতে লাগলো ” মিরজাফরের বা*চ্চা , দেশদ্রো*হি, ছাড়বো না তঁদের। ”
পুলিশ গুলো ওকে উঠালো। টলমল শরীর নিয়ে ইশারা করলো আবরাজ। কয়েক জন পুলিশ সেই দিকে চলে গেছে। একজন কর্মকর্তা ঘনঘন শ্বাস ফেলে বললেন
” কারা ছিলো ওরা? ”
“দেশদ্রো*হি। ”
ছেলেটার গাঁয়ে দুটো ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। এমনিতেই অসুস্থ তারপর আবার আঘা*ত পেয়েছে। শরীরে শক্তি নেই একদম। বড় কর্মকর্তারা এসেছেন আবরাজের সাথে দেখা করতে। ছেলেটা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে। ওর ধারালো মস্তিষ্ক অনেক কিছুই বুঝতে পারে। এদেশে এখনো কিছু দেশদ্রো*হি রয়েছে। যাঁরা অভ্যন্তরীন উপায়ে দেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে। অন্য দেশের সাথে হাত মিলিয়ে দেশে লুটপাত করছে। তাই কাউকে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। অফিসার আবুল বললেন “সৈয়দ আবরাজ। তোমার নাম তাই তো? ”
দু দিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানালো আবরাজ। আবুল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে। ছেলেটার পাশে এসে বসলেন তিনি। সিগারেট জ্বালালেন ওর সামনেই। এক টান দিয়ে অফার করলেন সিগারেট খাওয়ার জন্য। হাতটা উঠিয়ে, না বললো আবরাজ। দুর্ভেদ্য হাসলেন আবুল। সময় নিয়ে সিগারেটটা শেষ করলেন।খুব যত্নে ফিল্টার ফেললেন। সবটাই তীক্ষ্ম চোখে দেখলো আবরাজ। যাওয়ার পূর্বে ভদ্রলোক ছেলেটার মাথায় স্পর্শ করলেন। অবাক হতে হলো ওকে। হাত সরিয়ে মৃদু হাসলেন আবুল। ” জীবন অনেক বড়। স্বার্থকতা কি জানো? প্রেম, ভালোবাসা। সেটা পরিবারের প্রতিই হোক কিংবা দেশপ্রেম। নিজের দেশকে যে ব্যক্তি ভালোবাসে তাঁকে আল্লাহ ও পছন্দ করেন। তোমার জীবনে আপন বলতে এই দেশটাই রয়েছে। নিজের জীবনের পরবর্তী ধাপ টুকু দেশের সাথে জোড়ার চেষ্টা করো। ”
লোকটা দরজার কাছে এসে আবারো ফিরে এলেন। এখনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আবরাজ। পকেট থেকে কার্ড বের করে ওর হাতে গুঁজে দিলেন তিনি। আশ্বস্ত করতে বললেন ” যে কোনো প্রয়োজনে আমার সরনাপর্ণ হবে। আমি তোমাকে সাহায্য করবো ইনশাআল্লাহ। পারলে আমার কথাটা মাথায় রেখো। তোমার ভেতরে আমি আগুন দেখেছি। পারবে, তুমিই পারবে এ দেশের কিছু অভ্যন্তরীণ শত্রুকে শেষ করে দিতে। ”
** প্রতিদিন সন্ধ্যার পর গল্প আসবে ইনশাআল্লাহ। সাধ্য মতো রেসপন্স করার অনুরোধ। **
চলবে…..
কলমে ~ ফাতেমা তুজ