#গল্পগুচ্ছ_সমগ্র
#হাতে_রেখো_হাত (৬)
কাজ শেষে বাড়ি ফিরে অবাক ই হলো আবরাজ। ওর এক রুমের বাসাটার সামনে বসে থাকা চারজন মানুষ। আনিসুল সাহেব, ওনার স্ত্রী রেবেকা বেগম আর দুই মেয়ে রুবি আর রুস্মি। বিস্মিত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ভদ্রমহিলার কণ্ঠ “আব্বা, কেমন আছিস তুই?”
“ভালো আছি চাচি।”
“শুকায় গেছে শরীর। কেমন ভালো আছিস দেখাই যাচ্ছে।”
“এটা এমনিই। আপনারা কখন এসেছেন?”
“সেই বিকেলে।” পাশ থেকে উত্তর দেয় রুস্মি। আবরাজ ফিরে তাকায় ওদের পানে। দুই বোন বড় হয়েছে। অনেক বছর আগে দেখা হয়েছিল। তখন ওরা খুব ই ছোট। রুস্মির এখন কলেজে পড়ার কথা।
ইষৎ হেসে ওদের ভেতরে নেয় আবরাজ। খুব ছোট একটা ঘর। তবে নেই কোথাও বাহ্যিক সৌন্দর্যের অভাব। একজন মানুষের জন্য পার্ফেক্ট। তবু কোথাও একটা বিষণ্ণতার দেখা মিলে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেসব ই দেখে রুশ্মি। এক পর্যায়ে আবরাজের ছোট বুক স্লেফে নজর আসে। কতগুলো উপন্যাসের বই। একদম ই নতুন। পাশে থাকা বাবল পেপার বলে দিচ্ছে বেশি দিন হয়নি অর্ডার করেছে। রুস্মি বুদ্ধিমতি। সে খুব দ্রুতই বুঝে গেল। আবরাজ নিয়ম করে উপন্যাস পড়ে। কাজের শেষে বাড়ি ফিরে। আপন বলতে কেউ নেই। সেই একাকিত্ব দূর করতেই বই পড়ে ছেলেটা। রুবা একটু খিটখিটে। এই সুন্দর রুমটা ও ওর মন ছুঁতে পারল না। বরং মুখ ফসকে বলে ফেলল ‘
খুব ই ছোট একটা রুম। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।”
চা নিয়ে ফিরছিল আবরাজ। রুবির কথা স্পষ্ট শুনতে পেল। রেবেকা বেগম মেয়ের উপর ভীষণ বিরক্ত। সব সময় এমন করে রুবি। ফলে বিব্রত হতে হয় ওনাদের। এই তো কিছুদিন আগের কথা। আনিসুল সাহেবের এক বন্ধু বাড়ি এলেন। ভদ্রলোককে নাস্তা দেওয়া হয় রুবির জন্য বরাদ্দকৃত প্লেটে। সেই জন্য সে প্লেট ব্যবহার ই ছেড়ে দিলো মেয়েটা। প্লেট না ব্যবহার করাটা দোষের না। কারো স্বভাবে এমন বৈশিষ্ট্য থাকতেই পারে। তবে সমস্যা হলো যখন ভদ্রলোকের সামনেই চেচিয়ে উঠে রুবি। শুধু তাই নয় চাপা স্বরে কিছু কথাও বলে। সেসব কানে আসে লোকটার। তারপর থেকে তিনি আর এ বাড়িতে আসেন নি কখনো। এর কারণ কারোই অজানা নয়। এমন নানান ঘটনা রয়েছে। ভদ্রমহিলা রাগ হয় এসবে। আজ ও তেমনি হলো। তিনি কিছু বলার জন্য উদ্যত হতেই আবরাজ বলল “রুমটা ১৮০ স্কয়ার ফিট। তাই তোমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিন্তু একটা সত্য জানো রুবি,আমাদের শেষ স্থান মাত্র সাড়ে তিন হাত।” নড়েচড়ে উঠে রুবি। ক্লাস নাইনে পড়ে সে। এই সময়টায় মানুষ বাস্তবতা থেকে বহু দূরে হারিয়ে যায়। চোখে ভাসে বিলাশবহুল জীবনযাপন। রুবি বোধহয় ভয় পেল। সে আর একটি কথাও বলল না। এরই মাঝে কিছু বই তুলে নিল রুস্মি। বই গুলো দেখিয়ে বলল “ভাইয়া এগুলা কি আমার পড়ার জন্য নিতে পারি?”
“রুস্মি কি হচ্ছেটা কি।” আনিসুল সাহেবের রাশভারী কণ্ঠ! রুস্মি তবু তাকিয়ে রয় জবাবের অপেক্ষায়। সাতটা বই নিয়েছে রুস্মি। আবরাজ বই গুলো থেকে ফিপটি সেড অফ গ্রে বইটি সরিয়ে নিল। তারপর বলল “এগুলা নিতে পারো।”
সবাই গল্পে মজেছে। রেবেকা বেগম বার বার বলল আবরাজ যেন একটি বারের জন্য হলেও আসে ওনাদের বাড়িতে। পুরনো দিনের ক্ষত ভুলে যেন আপন করে নেয় ওনাদের। অন্তত এই অনুরোধটা রাগে যেন।না হলে ভীষণ কষ্ট পাবে ওনারা। আবরাজের মন সায় দিচ্ছিল না। তবে এক পর্যায়ে বাধ্য হয়েই বলল’সে যাবে।’
অবশ্য সন্ধ্যাটা মন্দ কাটে নি আবরাজের। এই সময়টা খুব সামান্য হলেও সুখ দিয়েছে। অরির জন্য মন কাঁদে সারাক্ষণ। কোনো ভাবেই স্বস্তি মিলে না। এই সময়টুকু হয়তো খুব দরকার ছিল। একটু বেশিই দরকার। সেই কৃতজ্ঞতা থেকে হলেও সময় করে চাচার বাড়ি ঘুরতে যাবে আবরাজ।
.
উইকেন্ডের দিনগুলোতে শুয়ে বসে পার করে আবরাজ। কিন্তু আজ হঠাৎ ই বের হতে হচ্ছে হয়। কাছে পিঠেই লেক। আসা যাওয়ার পথে চোখে পরলেও সময় নিয়ে যাওয়া হয়নি কখনো। যেহেতু নতুন বই গুলো রুস্মি নিয়েছে সেহেতু বই পড়ার মতো সুযোগ ও নেই। আর না আছে ইচ্ছা। হাল্কা হাল্কা শীত পড়েছে। ধোঁয়া উঠা বিকেলে লেকের পারে নেমেছে কপোত কপোতির দল। কেউ কেউ হাত ধরে ডুবে আছে প্রেমনেশায়। কখনো কখনো সেসব দেখতে ভালোই লাগে। মনে হয় এই তো জীবন। পরিবার পরিজনের বাহিরেও হয়তো একটা নিজের মানুষের খুব দরকার। অন্তত এই বয়স তেমনি বলে। আবার কখনো বা বুজে আসে চোখ। বিষাদের তরী এসে নিয়ে যায় ওকে। মনে হয় এই দুনিয়ার মিছে সব। না হলে রাই কেন ফাঁকি দিবে ওকে? তবে কি সত্যিই সামান্য টাকার কাছে হেরে যায় ভালোবাসা! নাকি এসব কেবল ভালোলাগার মোহটাকে আবডাল করার প্রয়াস। আবরাজের বয়স খুব বেশি নয়। সেই হিসেবে জীবনকে অনেক ভাবে উপলব্দি করা হয়ে গেছে। চোখের সামনে দিয়ে নেমে গিয়েছে কতো সব ভালোবাসার স্রোত। আবার কত বিচ্ছেদ বেদনার সঙ্গী সে।
একটু দূরেই ভীড় জমেছে। আগ্রহ জাগে। দু পা এগিয়ে যায় ছেলেটা। শুটিং চলছে। কোনো নতুন প্রডিউসারের সিনেমার। সেই জন্য প্রচারণাও বেশি। আবরাজ দেখে বেশ স্বাস্থ্যবান এক লোক চেচাচ্ছেন। বার বার নির্দেশনা দিচ্ছেন। ভুল হলেই বেশ রাগ দেখাচ্ছেন। আবরাজ বুঝতে পারে লোকটা রগচটা। চারপাশে থাকা মানুষ হেসে চলেছে অবিরত। সরে এসে একটা বেঞ্চেতে বসে। পাতা ঝরেছে কিছু। পায়ের নিচে সারি সারি। একটা পাতা তুলে নিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পরে ছেলেটা। খানিক বাদেই চোখে পরে রাই আর রকিকে। বেশ ঘনিষ্ঠভাবে। বিষয়টা চোখে পরাতে আবরাজের রাগ হলো। হাজার হোক, মেয়েটার সাথে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল ওর। খারাপ লাগা স্বাভাবিক। ছেলেটা উঠে যেতেই একটা বাচ্চা ছেলে এসে বলে’ভাইয়া ভাইয়া দশ টাকা দিবা? একশ টাকা জমিয়ে ভাইরে নিয়া বিরিয়ানি খাবো।’ চমকে তাকালো আবরাজ। একবার দেখে নিয়ে ফের পিছে তাকালো। রাই আর রকি একে অপরে হাত ধরে। ফুচকার স্টলের সামনে নানান ভঙ্গিতে ছবি তুলে। ছেলেটার গলা শুকিয়ে এসেছে। আর তারপর ই নিজেকে সামলে ফেলে। ফেলে আসা অতীতের দিকে তাকানো মানে এক পা পিছিয়ে আসা। যা গেছে তা নিয়ে ভেবে ভবিষ্যৎ কিংবা বর্তমানকে বিষণ্ণ করার মানেই হয় না। সকল কষ্টকে লুকিয়ে ইষৎ হেসে বলে ‘কি?’
“দশ টাকা দিবা? একশ টাকা জমিয়ে ছোট ভাইকে নিয়ে বিরিয়ানি খাবো। ছোট ভাই বিরিয়ানি খাইতে চাইছে। দিবা দশ টাকা?”
“বিরিয়ানি খেতে চেয়েছে?”
“হুম। দিবা দশ টাকা?”
“চলো আমার সাথে আমি তোমাকে বিরিয়ানি কিনে নেই।”
“বিরিয়ানি কিনে দিবা ভাইয়া?” ছেলেটার উদ্বিগ্ন কণ্ঠ। আবরাজ বলে”হুম দিবো আসো আমার সাথে।”
পাশেই স্টল। বাচ্চা ছেলেটার বয়স খুব বেশি হলে দশ কি এগারো হবে। চলতে চলতে বাচ্চাটি বলে ‘দুইটা বিরিয়ানি কিনা দিবা?’
“দুইটা? আচ্ছা ঠিক আছে।”
ফের চলতে থাকে ওরা। ছেলেটার পায়ের গতি বেশ। মনে হচ্ছে চাঁদ পেয়েছে হাতে।মনের ভেতর ভালো লাগা কাজ করে আবরাজের। অন্যকে সহযোগিতা করার অভ্যাসটা বাবার থেকে পাওয়া। ভদ্রলোক মানুষ হিসেবে খুব ই ভালো ছিলেন। আর তাই হয়তো জীবনের অর্ধেক সময়েই চলে যেতে হলো। শ্বাস ফেলে আবরাজ। মিনমিনে গলায় প্রশ্ন করে “বাসায় কে কে আছে তোমার?”
“মা আমি আর ছোট ভাই। বাবা গাড়ির নিচে চাপা পরে মা*রা গেছে।”
থেমে যায় আবরাজ। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মায়া হয়। আবরাজ তিন প্যাকেট বিরিয়ানি পার্সেল করে দিতে বলে। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা। পার্সেল হাতে দিতেই বলে “একটা কোক।”
কোক দেয় আবরাজ। ছেলেটা চলে যায়। বিল মিটিয়ে একবার পেছন ঘুরতেই আবরাজের চোখে পরে ছেলেটার ছোট ছোট পায়ের পথচলা। মানুষের জীবন কতো বিচিত্র!
*** সাধ্যমতো রেসপন্স করার অনুরোধ। ***
কলমে~ ফাতেমা তুজ
চলবে…..
নতুন পর্ব পেতে পেজে ফলো করে রাখলে পোস্ট করলেই নোটিফিকেশন পেয়ে যাবেন প্লিজ ফলো 👍👍গল্পগুচ্ছ সমগ্র