হারানো সুর-১৪তম পর্ব
©শাহরিয়ার
সকালে নাস্তার টেবিলে ঝর্ণা এলো না। স্যার রেগে না খেয়েই চলে গেলো। বাড়িতে কি হচ্ছে? সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেছে দুই দিনের মাঝেই। এ মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে আসলে সত্যিই অশান্তির শেষ রবে না স্যারের জীবনে। কথা গুলো মনে মনে ভাবছিলাম এমন সময় ঝর্ণা নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। মা খাবার টেবিল থেকে দাঁড়িয়ে গেলো। ঝর্ণা নিচে নামতেই মা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলতে শুরু করলো।
মা: কিরে মা তুই কি পাগল হয়ে গিয়েছিস? কাল রাত থেকে না খেয়ে আছিস। আর এই সকাল সকাল ব্যাগ গুছিয়ে কোথায় রওনা হলি?
ঝর্ণা: আমার ক্ষিদে নেই খালা মনি, আমি চলে যাচ্ছি ভেবেছিলাম কয়েকটা দিন এখানে থাকবো। কিন্তু তা আর হলো না।
মেয়েটা সারা রাত কেঁদেছে ওর চোখ দু’টো দেখেই বুঝা যাচ্ছে। সত্যিই কি ঝর্ণা স্যারকে অনেক ভালোবাসে? কিন্তু স্যারতো ওকে ভালোবাসে না। এতো সুন্দর একটা মেয়েকে স্যার ভালোবাসে না, কিন্তু কেন? এই মেয়েকে যে কেউ ভালোবাসতে চাইবে। যদিও একটু অহংকারি কিন্তু চেহারাটা সত্যিই মায়াবী।
মা: দেখ মা জাহাঙ্গীরতো এমনই তুইতো জানিস। তারপরেও কেন রাগ করিস। আয় খালামনি তোকে খায়িয়ে দেই।
ঝর্ণা: তোমার ছেলে যদি জিদ্দি হয়, তবে আমিও কম জেদি না, তোমার ছেলেকে বলে দিও, একদিন সে আমারি হবে।
কথা গুলো বলে ঝর্ণা হেঁটে চলে গেলো বাড়ির বাহিরে। মা পেছন থেকে বহুবার ডাকার পরেও আর থামলো না। মা একা একাই বলতে শুরু করলো আজ কালকার ছেলে মেয়ে সব সমান। কেউ কাউকে একটুকুও ছাড় দিতে চায়না। উফ আমি যে কি করি। বলতে বলতে মাথায় হাত দিয়ে ডাইনিং এর চেয়ার টেনে বসে পরলো।
মা মন খারাপ করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে একদিন দেখবেন। স্যারতো একটু রাগি আমরা সকলে জানি। আসলে দু’জনই রাগি সমস্যা এই জায়গায়। একজন রাগ করলে আরেক জনকে নরম হতে হয়। তাহলেই সব কিছু ঠিকঠাক থাকে।
কিন্তু এদের দু’জনেরই মাথা গরম। সময় হোক দেখবেন সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আর তাছাড়া ঝর্ণার পড়ালেখাও তো এখনো শেষ হয়নি। পড়ালেখা শেষ হোক তখন দুই পরিবার বসে কথা বলে বিয়ে দিয়ে দিবেন দু’জনকে।
মা: চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমার কোন কিছুই ভালো লাগছে না। আমি একটু বিশ্রাশ করবো। বলতে বলতে সিঁড়ি ধরে উপরে উঠতে শুরু করলো।
আমার ও মাথাটা কেমন ঘুরছে। এমন বদ মেজাজি মানুষ এরা দু’জন। যে এদের সাথে কেউ থাকলে সত্যি সত্যি মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। সত্যিই যদি এদের দু’জনের বিয়ে হয় তাহলে এই ডাইনিং এ একটাও কাঁচের প্লেট গ্লাস থাকবে না। কথা গুলো ভাবতেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। সাবাকে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে আমি টেবিলে থাকা খাবার গুলো ঢেকে রেখে সাবাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম।
আজ খুব করে শাকিলের কথা মনে পরছে, আমাদের পাঁচ বছরের সংসারে কোন দিন ঝগড়া লাগেনি। বিয়ের কিছুদিন পর আমার জন্য লুকিয়ে লুকিয়ে শাড়ি চুড়ি সাজুগুজু করার নানান রকম জিনিস কিনে এনে দিতো। আমি আবার তা আম্মাকে দেখাতো। আম্মা দেখে শাড়ির আঁচলে মুখ ডেকে বলতো পাগল ছেলে হয়েছে আমার একটা বউ পাগলা। আচ্ছা শাকিল কি এখনো বউয়ের জন্য পাগল? কথা গুলো ভাবতে ভাবতে দু’ফোটা চোখের পানি টপটপ করে বইয়ের পাতার উপর পরলো। দ্রুত চোখের পানি মুছে নিয়ে একা একাই বলতে থাকলাম আমি তার কেউ না। আমি তার কেউ না, তার জীবনে নতুন কেউ এসেছে সেই সব।
সন্ধ্যার পর স্যার এসে যখন জানতে পারলো ঝর্ণা চলে গিয়েছে। তখন হাসতে হাসতে বললো ভালোই হয়েছে, পাগলটা চলে গিয়েছে। তা না হলে মাথাটা পুরোপুরি নষ্ট করে দিবে। চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে কথা গুলো বলছে স্যার। পাশের চেয়ারে গাল ফুলিয়ে বসে রয়েছে মা। চায়ের মগের চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই মার। ঝর্ণার জন্য মায়ের খুব মন খারাপ এটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। তার উপর স্যারের কথা শুনে আরও রেগে যাচ্ছে মা।
তাই আমি বাধ্য হয়েই স্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম, মেয়েটা খুবি ভালো মিষ্টি আপনি অযথায় ঝর্ণাকে উল্টা পাল্টা কথা বলে মেয়েটার মন খারাপ করে দেন? চলে গেলো তারজন্য পুরো দোষটাই আপনার। আমার সাথে মা ও সুর মিলিয়ে স্যারকে অনেক কথা বললো স্যার শুধু হেসেই চলেছে। কোন কথা বা প্রতিবাদ করছে না। আমি ভাবছি মানুষটা এমন কেন? মুহূর্তেই রাগের অগ্নিমূর্তি আবার মুহূর্তেই মানুষটা অপরিচিত মনে হয়। ঠিক শিশু বাচ্চার মত, যেমন এই মুহূর্তে সাবাকে কোলে নিয়ে বসে চা খাচ্ছে আর মা আর আমার কথা শুনে হেসে চলছে।
মানুষটাকে বুঝতে পারা সত্যিই খুব কষ্ট কর। খুবি ভয়ংকর একজন মানুষ। আমার প্রচন্ড রাগ উঠে গেলো। নিজেকে অনেক চেষ্টা করেও কন্ট্রোল করতে না পেরে বলেই ফেললাম আপনার কি কোন প্রেমিকা রয়েছে? নাকি আগে ছিলো যাকে কথা দিয়েছিলেন জীবনে তাকে ছাড়া অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করবেন না। আমার কথা শুনে মনে হয় স্যার আরও বেশী আনন্দ পেলো। হাসির শব্দ আরও বাড়িয়ে দিলো। মা কানে হাত দিয়ে বলে উঠলো এই ছেলে পাগল হয়ে গেছে এখানে আর থাকা যাবে না। স্যারের কোলে বসে সাবাও হাসছে। আমার খুব অসহ্য লাগছে। আমি স্যারের কাছ থেকে সাবাকে চেয়ে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। অদ্ভুত একজন মানুষ একে বুঝার সাধ্য আমার নেই।
হাসি আনন্দ আর পুরনো স্মৃতির কষ্ট সব মিলিয়ে আরও অনেক গুলো দিন কেটে গেলো। কলেজে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো। মা খুব কড়া করে বলে দিলো পরীক্ষা খারাপ হলে আমার আর এ বাড়িতে থাকা হবে না। যেদিন যেদিন পরীক্ষা থাকে মা আমাকে সাথে করে নিয়ে যায়। সাবাকে নিয়ে পুরো সময় মা কলেজে বসে থাকে। পরীক্ষা দিতে আসার সময় আমার সমস্ত শরীর বোরখা আর হিজাবে আবৃত্ত থাকে। শুধু চোখ দু’টোই দেখা যায়। এই বুদ্ধিটা মা দিয়েছে, যেনো কেউ বুঝতে না পারে আমার বয়স কত। সবাই যেনো তাদের সম বয়সী মনে করে আমাকে। সহজেই যেনো পরীক্ষার হলে সকলের সাথে মিলে যেতে পারি সে জন্য মা এই বুদ্ধি করেছেন। আমারও এই বুদ্ধিটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে।
আজ আমার শেষ পরীক্ষা এদিকে মায়ের শরীরটা ভালো না। তাই মা স্যারকে বলে দিলো আমাকে কলেজে নিয়ে যাবার জন্য আর পরীক্ষা শেষে দিয়ে যাবার জন্য। মা সাবাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকবে। স্যার বললো তার পুলিশের চাকরি কখন কোথায় যেতে হয় ঠিক নেই।
আমি একাই যেতে পারবো কোন সমস্যা নেই। রিক্সা নিয়ে নিলেই যেতে পারবো আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না মা।
মা: তুই বললেই হলো নাকি চিন্তা করতে হবে না? কি চিনিস আর কি জানিস এই শহর সম্পর্কে? এখানে প্রতি পদে পদে বিপদ থাকে। তাই সাথে একজন মানুষ থাকা ভালো। আমি চাইলেইতো তোকে এতোদিন একাই পাঠাতে পারতাম। কই আমিতো তোকে পাঠাইনি।
মা স্যার ব্যস্ত মানুষ, কাজের মানুষ, সত্যিই কখন কোথায় থাকে ঠিক নেই। আমি সামলে নিতে পারবো।
জাহাঙ্গীর: হয়েছে হয়েছে আপনাদের আর অভিনয়, ঝগড়া মান অভিমান দেখাতে হবে না। ঠিকমত নাস্তা করে নেন আমিই নিয়ে যাবো।
মা খুশি হয়ে নিয়ে যাবি তা এতো অভিনয়ের কি আছে? এতোদিনতো আমিই নিয়ে গিয়েছি। আজ অসুস্থ বলে না তোকে নিয়ে যেতে বলেছি। নয়তো তোকে কি এতো বার বলতাম।
জাহাঙ্গীর: বললামতো নিয়ে যাচ্ছি। আর বলতে হবে না।
সকলে খাওয়া শেষ করে যার যার রুমে চলে আসলাম। জামা কাপড় পরে রেডি হয়ে বের হয়ে আসলাম। দু’তলায় যেয়ে মায়ের কাছে সাবাকে দিয়ে নিচে নেমে আসলাম। একটু পর স্যার ও নিচে নেমে আসলো। দু’জন মিলে বের হয়ে গেলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। রাস্তাতেই বেশ কয়েক বার স্যারের ফোন আসলো। আমাকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে স্যার বললো পরীক্ষা শেষে এখানেই এসে দাঁড়িয়ে থেকো। একটা ইমার্জেন্সী কেস এসেছে আমি দেখেই। তোমাকে নিয়ে বাড়িতে পৌছে দিয়ে আসবো। আচ্ছা ঠিক আছে বলে কলেজের ভিতর ঢুকে চলে আসলাম।
পরীক্ষা শেষে বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে রয়েছি। স্যারের কোন খবর নেই। কি করবো বুঝতে পারছি না।
এদিকে থানায় প্রচন্ড ঝামেলা সৃষ্টি হয়েছে এক আসামি নিয়ে। অবশেষে সকল ঝামেলা শেষ করে থানা থেকে বের হয়ে দ্রুত গাড়ি নিয়ে কলেজের পথে ছুটলো জাহাঙ্গীর।
প্রায় এক ঘন্টা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর স্যারের গাড়ির দেখা পেলো রত্না। গরমে আর রাগে ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে রত্না।
জাহাঙ্গীর: গাড়ি থেকে নেমে সরি সরি তোমাকে অনেকটা সময় দাঁড় করিয়ে রেখেছি। খুব ঝামেলা হয়েছিলো থানায় তাই আসতে দেরী হয়ে গেলো।
ঠিক আছে কোন সমস্যা নেই বলে গাড়িতে উঠে বসে মুখ থেকে হিজাবটা খুলে নিলাম। পুরো মুখ গরমে ঘেমে একাকার। স্যার গাড়ির এসি ছেড়ে দিয়ে টিসু এগিয়ে দিয়ে।
জাহাঙ্গীর : ঠান্ডা কোথাও যেয়ে বসলেই পারতে। এই গরমের ভিতর যেখানে বলছি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এমন কোন কথা কি কোথাও লেখা রয়েছে?
না যদি এসে খুঁজে না পেলেন তাই সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম।
স্যার একটা দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে আমাকে বসতে বলে নিজে নেমে গেলো। একটু পর দু’টো আইসক্রিম নিয়ে স্যার ফিরে এসে একটা আইসক্রিম আমার দিকে এগিয়ে দিলো। আমি তা হাতে নিতে স্যার বললো এটা খেয়ে নাও ভালো লাগবে।
দু’জন আইসক্রিম খেতে খেতে গাড়ি বাসায় চলে আসলো। স্যার গেটের বাহিরে আমাকে নামিয়ে দিয়ে আবার থানার পথে রওনা হয়ে গেলো। আমি আস্তে আস্তে বাড়ির ভিতর ঢুকে পরলাম।
চলবে…