হারানো সুর পর্ব-১৫

0
778

হারানো সুর-১৫ তম পর্ব
©শাহরিয়ার

বাড়িতে ঢুকতেই সোফার উপর মা আর সাবাকে দেখতে পেলাম।

মা: কিরে আজ এতো দেরী হলো কেন?

আর বলবেন না আপনার ছেলে থানায় গিয়েছিলো, সেখান থেকে আসতে দেরী করেছে আর আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। তাই দেরী হয়ে গিয়েছে। সাবা কি জ্বালিয়েছে খুব?

মা: আরে না সাবা জ্বালায়নি, আর আমার ছেলেটাও হয়েছে ওর কোন দায়িত্ব বলতে কিছুই নেই দেখছি। আসুক আজ বাসায়।

না মা স্যারকে কিছু বলবেন না। থানায় খুব জরুরি দরকার ছিলো, তাই সেখানে আটকে গিয়েছিলো।

মা: তাই বলে একটা মেয়েকে দাঁড় করিয়ে রাখবে?

ইচ্ছে করেতো রাখেনি, কাজ ছিলো তাই একটু দেরী হয়েছে। আপনি বসুন আমি ফ্রেশ হয়ে আপনাকে চা করে দিচ্ছি। বলে সাবাকে কোলে নিয়ে নিজের রুম চলে আসলাম। সাবা আর আমি বেশ কিছুটা সময় দুষ্টমি করে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। মা আর আমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসলাম। মাথাটা খুব ব্যথা করছিলো। মায়ের সাথে গল্প করতে করতে চা খেয়ে নিলাম।

রাতে খাবার টেবিলে মা আর ছেলে দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া শুরু করলো। আমি বেশ উপভোগ করছিলাম তাদের ঝগড়া। সাবাকে কোলে বসিয়ে খাবার খাওয়াচ্ছি আর তাদের ঝগড়া দেখছি। বেশ ভালোই ঝগড়া করতে পারে মা আর ছেলে।

দেখতে দেখতে বেশ কিছু দিন কেটে গেলো, কলেজ থেকে পরীক্ষার রেজাল্ট দেবার সময় হয়ে এসেছে। আমার খুব ভয় ভয় লাগতেছিলো। আর মাত্র একটা দিন তার পরেই রেজাল্ট দিবে যদি খারাপ হয়? এসব কথা ভেবে চলছি আমি। হঠাৎ নাস্তার টেবিলে স্যার আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো।

জাহাঙ্গীর: তোমাকে এতো চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

কিছুনা স্যার কাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। তাই একটু ভয় ভয় লাগছে।

জাহাঙ্গীর: কেন ঠিক মত লেখনি? যে এখন এতো ভয় ভয় লাগছে?

জ্বি লেখেছি, তারপরেও ভয় ভয় লাগছে।

জাহাঙ্গীর: ভয়ের কোন কারণ নেই, তুমি যে টিচারের কাছে পড়ালেখা করেছো, তার ছাত্র ছাত্রীরা কখনো ফেইল করে না।

মা: মাইর খাবি কিন্তু। বেশী কথা বলিস।

জাহাঙ্গীর: সত্যি কথাইতো বললাম।

বলে নাস্তা শেষ করে টেবিল থেকে উঠে পরলো।

মা: কাল তুই ছুটি নে অফিস থেকে, রত্নাকে নিয়ে কলেজে যাবি ওর সাথে। রেজাল্ট দেবার পর নিয়ে আসবি সাথে করে।

জাহাঙ্গীর: এর জন্য ছুটি নিতে হবে কেন? আমি যাবার পথে নামাইয়া দিয়া যাবো। পরে নিয়ে আসবো।

মা: না তা হবে না, কারণ কালকে বেশী সময় লাগবে না। আর গতবার কি করেছিলি তার মনে নাই?

মা স্যারের ছুটি নিতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো সমস্যা নেই। অযথাই প্রয়োজন ছাড়া ছুটি নিয়ে কি করবে স্যার।

জাহাঙ্গীর: আচ্ছা ঠিক আছে আমি দেখি ছুটি নিতে পারি কিনা।

বলেই স্যার বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলো। আমি আর মা বসে গল্প করছি, আর নাস্তা খাচ্ছি। মা মন খারাপ করে বলতে শুরু করলো।

মা: জানিস রত্না ছেলেটা আমার কেমন জানি হয়ে গেছে। ছোট বেলায় বেশ চঞ্চল ছিলো। দৌড়া দৌড়ি হাসি আর আনন্দে একাই পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। স্কুল লাইফ কলেজ লাইফে শুধু বন্ধু বান্ধবিদের নিয়ে মেতে থাকতো। ভার্সিটিতে যাবার পরেও বেশ কিছুদিন ভালোই যাচ্ছিলো হাসি খুশি আনন্দে ওর দিন গুলো। তারপর হঠাৎ দেখতে পাই আমার প্রাণ চঞ্চল ছেলেটা আর আগের মত নেই। কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। আমার খুব খারাপ লাগতো ওর জন্য, পরে আস্তে আস্তে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসে। তবে তার মাঝে অনেকটা সময় কেটে গেছে। এখন ও কতটা চঞ্চল এর থেকে অনেক বেশী চঞ্চল ছিলো ছেলেটা।

আমি মায়ের চোখের কোনে পানি দেখতে পেলাম। এই প্রথম উনার চোখে পানি দেখে কেমন জানি অস্থিরতা কাজ করতে লাগলো নিজের ভিতরে। এই মানুষটাকে সব সময় হাসি খুশি দেখেছি আজ প্রথম এমন অবস্থায় দেখে প্রচন্ড মন খারাপ হচ্ছে। নিজেকে যতটুকু সম্ভব সামলে নিয়ে বললাম মা মন খারাপ করবেন না। স্যারতো এখন বেশ ভালো আছে। আপনি মন খারাপ করলে কি চলবে?

মা মুখে হাসি ফুটিয়ে সাবাকে আমার কাছ থেকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো। আমি টেবিল পরিষ্কার করে নিজের রুমে চলে আসলাম।

রাতে স্যার বাসায় এসে জানালো সে ছুটি নিয়ে এসেছে। মা বেশ খুশি হলো, বললো ঠিক আছে কাল সকালে সাথে করে নিয়ে যাবি আবার সাথে করে নিয়ে আসবি।

জাহাঙ্গীর: জ্বি প্রফেসর মেডাম যা আদেশ।

মা: মাইর খাবি কিন্তু বেশী কথা বললে।

এরপর তিনজনই এক সাথে হেসে উঠলাম। রাতের খাবার শেষ করে যে যার মত রুমে চলে আসলাম। অতিরিক্ত চিন্তায় দু’চোখের পাতা এক হচ্ছিলো না। গভীর রাতে ঘুমিয়ে পরলাম।

সকালে নাস্তা করো স্যারের সাথে বের হলাম। অনেক বেশী টেনশন হচ্ছিলো। কি হবে যদি রেজাল্ট খারাপ হয় তবে আমার সব স্বপ্ন নিমেষেই ধূলোয় মিশে যাবে। স্যার হয়তো আমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছিলো তাই আমাকে বললো

জাহাঙ্গীর: এতো চিন্তা করার কিছু নেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

আমিও মনে মনে বলতে থাকলাম তাই জেনো হয়। এতো দিনের একটা লম্বা গ্যাপের পর পড়ালেখাটা একটু কঠিনই মনে হয়। স্যার কলেজের সামনে আমাকে নামিয়ে দিলো। বললো সে এখানেই থাকবে। রেজাল্ট দেবার সাথে সাথেই যেনো বের হয়ে চলে আসি। আমি মাথা নেড়ে জানালাম ঠিক আছে। কলেজের ভিতর ঢুকে পরলাম। রেজাল্ট দেয়া শুরু হলো। এক সময় রেজাল্ট হাতে আসলো। যতটা খারাপ ভেবেছিলাম ততটা খারাপ হয়নি আমার রেজাল্ট খুবই ভালো হয়েছে আমি পাশ করেছি। কি যে আনন্দ লাগছে। কলেজের অন্য মেয়েদের মত বয়স হলে ওদের সাথে আমিও আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠতাম। কিন্তু ওদের আর আমার বয়সের বেশ তফাৎ রয়েছে। তাই নিরবে কলেজ থেকে বের হয়ে আসলাম।

স্যার গাড়ি নিয়ে সত্যি সত্যিই সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলো। আমি কাছে যেতেই স্যার প্রশ্ন করলো কি রেজাল্ট কেমন হয়েছে?

মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম খুব ভালো হয়েছে আমি পাশ করেছি।

জাহাঙ্গীর: ওয়াও অভিনন্দন! এবারতো তাহলে তোমাকে পার্টি দিতে হয়।

কিসের পার্টি স্যার?

জাহাঙ্গীর: এই যে তুমি পাশ করছে তোমাকেতো কিছু খাওয়াতে হয়।

না না স্যার কিছুই লাগবে না। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলুন নয়তো মা চিন্তা করবে।

জাহাঙ্গীর: আরে কিছু হবে না। মা কোন চিন্তা করবে না। মা জানে আমি যেহেতু সাথে আছি চিন্তার কোন কারণই নেই।

তবুও স্যার বাড়ি চলুন, সাবা যত বড় হচ্ছে ততই জ্বালাতন করছে। না জানি মাকে কতটা জ্বালাচ্ছে।

জাহাঙ্গীর: চুপ করে গাড়িতে বসো।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে যেয়ে বসলাম।

জাহাঙ্গীর: আমরা হালকা নাস্তাতো করতে পারি তাই না?

জ্বি পারি।

স্যার গাড়ি নিয়ে এসে একটা কফিশপের সামনে দাঁড় করালো। তারপর বলতে শুরু করলো।

জাহাঙ্গীর: এখানের কফি আর ফুচকা খুব মজার আমি মাঝে মাঝেই এখানে এসে খেতাম আগে।

আমাকে সঙ্গে নিয়ে স্যার ভিতরে ঢুকলো দুই প্লেট ফুচকার অর্ডার করলো। আমার গ্রামের কথা ছোট বেলার কথা বেশ মনে পরতে শুরু করলো। ছোট বেলায় মেলায় বেড়াতে যেতাম আমি আর রুমন তখন ঘুরাঘুরি শেষে বাড়ি ফেরার আগে ফুচকা খেতাম দুই ভাই বোন মিলে। জানি না রুমন কেমন আছে কোথায় আছে। ভাবতে ভাবতে টেবিলে ফুচকা চলে আসলো। দু’জন ফুচকা আর কফি খেয়ে সেখান থেকে সোজা বাড়িতে চলে আসলাম।

বাড়িতে ঢুকতেই মা প্রশ্ন করলো রেজাল্টের কি খবর আমি মাকে জানালাম খুবি ভালো হয়েছে। মা খুশি হয়ে বললেন দেখতে হবে না স্টুডেন্টস কার।

জাহাঙ্গীর: হুম হুম দেখছিতো কার স্টুডেন্টস। এবার তোমার স্টুডেন্টসকে বলো চা বানিয়ে দিতে আমার মাথাটা ব্যথা করছে।

মা: সে কিরে হঠাৎ করে কি হলো?

জাহাঙ্গীর: তেমন কিছুই হয়নি শুধু মাথাটা ব্যথা করছে।

আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন স্যার আমি চা করে দিচ্ছি। কথাটা বলেই রান্না ঘরের দিকে রওনা হলাম। চা রেডি হতে হতে স্যার ফ্রেশ হয়ে চলে আসলো। আমি চা বানিয়ে নিয়ে স্যারকে দিয়ে, দোতলায় মায়ের রুমে যেয়ে সাবাকে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। স্যারকে বললাম চা খেয়ে যেয়ে নিজের রুমে রেস্ট নিন সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে আমি নিজের রুমে চলে আসলাম।

দেখতে দেখতে খুব দ্রুত দিন গুলো কেটে যেতে থাকলো। এক দিকে পড়ার প্রচুর চাপ আরেক দিকে সাবার জ্বালাতন। মেয়েটা এখন প্রচুর জ্বালায়। কখনো কখনো স্যার আর মা সাবাকে তাদের কাছে রাখে তখন কিছুটা শান্তিতে কাজ বা পড়ালেখা করতে পারি। অথবা সাবা ঘুমালে গভীর রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করতে হয়। তবুও আল্লাহর রহমতে সব কিছুই ভালো ভাবে হচ্ছিলো। এটা ভেবেই শান্তি লাগছিলো। নিজে কিছুটা শিক্ষিত হতে পারছিলাম এটাই সব চেয়ে বড় কথা।

প্রায় আরও এক বছর এ বাড়িতে কেটে গেলো। সাবাও এখন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছে চার বছর বয়স হয়ে গিয়েছে ওর। আর এদিকে আবারও আমার এক্সাম চলে এসেছে। গত বছরের মত এ বছরও মা আমাকে সাথে নিয়েই পরীক্ষার হলে আসে। এ বছর আমার প্রস্তুতি আল্লাহর রহমতে খুবি ভালো। এবং আমি বিশ্বাস করি আল্লাহ সহায় হলে আমার রেজাল্ট ও ভালো আসবে। মা আমার প্রস্তুতি দেখে খুব খুশি হয়েছেন।

দেখতে দেখতে পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। আর এ বাড়িতে আমার দুই বছরের বেশী সময় পার হয়ে গিয়েছে। রাতে খাবার টেবিলে বসে মা আমার দিকে তাকিয়ে বললো রত্নার যদি পরীক্ষা ভুল করেও খারাপ হয় তাহলে কোথাও থেকে একটা পাত্র খুঁজে নিয়ে এসে বিয়ে দিয়ে দিবো।

আমি হাসতে হাসতে বললেই হলো। আমাকে বিয়ে দিয়ে তাড়াতে পারবেন না আপনারা। কারণ আমি জানি আমার পরীক্ষা ভালো হয়েছে আর রেজাল্ট ও খুব ভালো হবে।

জাহাঙ্গীর: হলেই ভালো না হলে আম্মুর সাথে আমিও একমত তোমার বিয়ে দিয়ে দিবো।

দু’জনের কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সাবা আমার জামা টান দিয়ে বললো আম্মু পানি খাবো। আমি সাবাকে পানি ঢেলে দিলাম গ্লাসে। আর মনে মনে বলছি সত্যিই যদি পরীক্ষা খারাপ হয়?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here