হারানো সুর পর্ব-১৬

0
731

হারানো সুর-১৬ তম পর্ব
©শাহরিয়ার

অনেকটা ভয় নিয়েই রাতে ঘুমাতে আসলাম। সেই সাথে মনটাও কেন জানি খারাপ হয়ে গেলো। এই দুই বছরে কখনো আমার এতো খারাপ লাগার অনুভূতি হয়নি। আজ মা আর স্যার বিয়ের কথা বলাতেই এমনটা হয়েছে সে আমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি। হয়তো মানুষ গুলোকে অনেক বেশী আপন মনে করি বলেই এতোটা খারাপ লাগছে। সাবা ঘুমিয়ে পরেছে, আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। মেয়েটা সেই ছোট ছিলো যখন এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম। আর এখন পুরো বাড়ি সহ দৌড়ে বেড়ায়। সারাদিন মা মা করে ডাকতে থাকে। স্যারকে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে আংতেল আংতেল ( আংকেল) করে ডাকতে থাকে। আর মাকে নানু নানু বলে ডেকে বেড়ায়।

দু’টো বছরের বেশী সময় শাকিল, মা, রুমন, চাচা, চাচী কারো সাথে কোন যোগাযোগ নেই। মানুষ গুলোকে মাঝে মাঝেই মনে পরে। জানি না এই মানুষ গুলো আমাকে মনে করে কিনা। এক সময় ঘুমিয়ে পরলাম।

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে স্যার বলে উঠলো

জাহাঙ্গীর: রত্নাকে আমি সাথে করে নিয়ে যাচ্ছি, আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছি।

মা: আমি আর সাবাও যাবো তাহলে সাথে।

জাহাঙ্গীর: বেশতো যাবে, ভালোই হবে অনেক দিন সকলে এক সাথে বের হইনা।

মা: নাস্তা শেষ করে আমি রেডি হয়ে আসছি। আমার জন্য অপেক্ষা কর।

স্যার বসেন আমি সাবাকে রেডি করে নিয়ে আসছি। বলে ডাইনিং থেকে চলে আসলাম নিজের রুমের দিকে। ড্রয়ার খুলে সাবার জন্য নতুন জামা কাপড় বের করে পরাচ্ছি এমন সময় দরজার সামনে এসে স্যার দাড়িয়ে।

জাহাঙ্গীর: রত্না একটু বাহিরে আসবা।

জ্বি স্যার আসছি, সাবাকে খাটের উপর রেখে খুব দ্রুত দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম। স্যার বলেন।

জাহাঙ্গীর: কিছু না।

তাহলে ডাক দিলেন কেন? কিছু লাগবে?

জাহাঙ্গীর: না না তেমন কিছু না এমনিতেই ডাক দিয়েছি। কথাটা বলেই একটা শপিং ব্যাগ আমার দিকে এগিয়ে দিলো।

এটা কি স্যার?

জাহাঙ্গীর: এটা তোমার জন্য উপহার, জানি পরীক্ষায় পাস করবে তাই অগ্রিম দিয়ে রাখলাম। এটা পরেই আজ বের হবে।

বলেই হাঁটা শুরু করলো, খুব বলতে ইচ্ছে করছিলো, যদি সত্যি সত্যি পরীক্ষা খারাপ হয়। তখন কি সত্যি সত্যি আমাকে বিয়ে দিয়ে দিবেন? তার আগেই মানুষটা চলে গেলো। আমি আবার রুমের ভিতর ঢুকে শপিং ব্যাগটা খুলতেই আকাশি আর সাদা রঙের একটা সুতির শাড়ি বের হয়ে আসলো। খুবি সুন্দর দেখতে শাড়িটা।

সাবাকে রেডি করে দিয়ে বললাম বাহিরে আযকেল বসে আছে তুমি তার কাছে যাও। মা রেডি হয়ে আসছি।

সাবা দৌঁড়ে বের হয়ে গেলো রুমের ভিতর থেকে। আমি স্যারের দেয়া শাড়িটা পরতে শুরু করলাম। শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কাঁচের চুড়িও পরে নিলাম। এরপর রুম থেকে বের হলাম। স্যার আর সাবা ডাইনিং এ বসে আছে। মা এখনো নিচে নামেনি। আমি ডাইনিং এর সামনে আসতেই স্যার বলে উঠলো।

জাহাঙ্গীর: আরে বাহ বাহ আজতে তোমাকে বেশ।সুন্দর লাগছে। কপালে কালির ফোটা দেয়ার দরকার ছিলো যাতে কারো নজর লেগে না যায়।

স্যারের মুখে এমন কথা শুনে প্রচন্ড লজ্জা পেয়ে গেলাম। আমি স্যারকে বললাম ধন্যবাদ আপনি পছন্দ করে কিনে দিয়েছেন, তা সুন্দর হবে না তা কি করে হতে পারে।

কথা বলতে বলতে মা চলে আসলো, আমাকে দেখে মা ও বলতে শুরু করলো রত্না তোকেতো আজ খুব সুন্দর লাগছে। আমি মা কি যে বলেন না, আমি সেই আগের রত্নাই আছি থাকবো চিরকাল।

চারজন বের হলাম কলেজের উদ্দেশ্যে। আজ স্যার সাবাকে গাড়ির সামনে বসিয়ে সিট বেল্ট পরিয়ে দিয়েছে। আমি আর মা পেছনে বসে গল্প করছি। গাড়ি এগিয়ে চলছে কলেজের দিকে। মা বলে চলছে রেজাল্ট ভালো হলে আমাকে ভালো প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিবে। তাহলে কোন ঝামেলা ছাড়াই পড়ালেখা এগিয়ে যাবে। কথা বলতে বলতে গাড়ি চলে আসলো কলেজের সামনে। আমি আর মা পেছন থেকে নেমে দাঁড়ালাম। স্যার বের হয়ে এ পাশে এসে সাবাকে বের করে নিয়ে আমাদের সাথে দাঁড়ালো।

মা: চল সবাই প্রিন্সিপালের রুমে যেয়ে বসি। এখনো বেশ কিছুটা সময় বাকি রয়েছে রেজাল্ট বের হতে।

সকলে মিলে যেয়ে অফিস রুমে বসলাম। মা আর প্রিন্সিপাল স্যার গল্প জুড়ে দিলো। আমি আর স্যার খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের গল্প শুনছি। বেশ কিছুক্ষণ পর পিয়ন এসে স্যারকে ডাক দিলো। স্যার অফিস রুম থেকে বের হয়ে গেলো। পুরো কলেজ স্টুডেন্টস দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে গেলো।

কিছুক্ষণ পরেি হই হুল্লোড় শুরু হয়ে গেলো। মা বললো আস্তে আস্তে বের হই। কিছুটা ভিড় কমুক। এতো ভিড়ের ভিতর যেতে পারবো না। প্রায় দশ মিনিট পর সকলে রুমের ভিতর থেকে বের হলাম। কিছুটা ভিড় কমার পর। আমার বুকের ভিতর দুরুদুরু শব্দ হচ্ছে, তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি শুধু আল্লাহ আল্লাহ করছি কি হবে এটা ভেবেই। না বিয়ে নিয়ে আমার কোন চিন্তা নেই। কারণ আমি বিয়ে করতে চাইনা। একবারতো জীবনে বিয়ে করেছি। কিন্তু আমাকে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য পড়ালেখাটা চালিয়ে নিতে হবে আর তার জন্য আমাকে পাশ করতেই হবে। নয়তো এতো পরিশ্রম এতো কষ্ট সব বৃথা যাবে। ভাবতে ভাবতে এসে দাঁড়ালাম বোর্ডের সামনে যেখানে রেজাল্ট টাঙ্গানো রয়েছে। ভয়ে যেনো আমি চোখ খুলতে পারছিলাম না।

অনেক কষ্টে যখন চোখ মেলে তাকালাম তখন আমার চোখের কোনে পানি জমে গিয়েছে। আমি রোল নাম্বার মিলাতে শুরু করলাম। স্যার পেছনে দাঁড়িয়ে বললো ভয় পেওনা সব ভালোই হবে। এক সময় রোল নাম্বার খোঁজে পেলাম। আমি পাশ করেছি। এবং খুব ভালো করেই পাশ করেছি, আমি আরও কয়েকবার ভালো করে মিলিয়ে নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরো কান্না করে দিয়ে বললাম আমি পাশ করেছি। মা আর স্যার দু’জনই বেশ খুশি হলো।

মা: কান্না করছিস কেন? আজতো তোর আনন্দের দিন। আজতো খুশি হবার দিন। তোর পরিশ্রম স্বার্থক হয়েছে।

আমি মাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম সব আপনার জন্যই হয়েছে। আপনাদের ঋণ আমি এ জীবনে শোধ করতে পারবো না।

জাহাঙ্গীর: আজ খুব আনন্দ করবো। ঘুরে বেড়াবো সারাদিন। চলো সকলে চলো।

স্যারের কথা মত আমরা কলেজ থেকে বের হয়ে গেলাম। সারাদিন ঘুরাঘুরি করলাম বাহিরে খাবার খেলাম। রাতে বাসায় ফিরে আসলাম। রুমে যাবার আগে আগে মা বললো এবার ভালো একটা ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিতে পারলেই আমার দায়িত্ব শেষ।

মা আপনি কি বলেন এসব? ভার্সিটিতে ভর্তি হতে তো অনেক টাকি পয়সা লাগবে। দরকার নেই আমার ভালো ভার্সিটিতে ভর্তি হবার তার চেয়ে বরং সরকারি ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে যাবো। আমি জানি আমি চেষ্টা করলেই কোথাও না কোথাও চান্স পেয়ে যাবো।

মা: ঐসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। সরকারি ভার্সিটিতে ভর্তি হতে হলে কোথায় না কোথায় চান্স মিলবে তখন কোথায় থাকবি কোথায় খাবি? আমি আসেপাশে ভালো একটা ভার্সিটি দেখে ভর্তি করিয়ে দিবো। এখনতো সাবাও বড় হচ্ছে তুই ভার্সিটিতে যেয়েও রেগুলার চাইলে ক্লাশ করতে পারবি। বলতে বলতে উপরে উঠে গেলো।

আমি সাবাকে নিয়ে নিজের রুমে চলে আসলাম। ফ্রেশ হয়ে সাবাকে নিয়ে বিছানায় শুয়ে চিন্তা করলাম। মা যা বলেছেন ঠিকই বলেছেন, কেননা আমারতো আর কোন আশ্রয় নেই এখন। বা আমার লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবার মতও কেউ নেই। তাই আমাকে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু অনেক গুলো টাকার ব্যাপার। ভাবতে ভাবতে এক সময় সাবাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।

বেশ কিছু দিন কেটে গেলো এভাবেই। অবশেষে মা আমাকে ভালো একটা প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। বাড়ির খুব কাছে হেঁটে যেতে দশ মিনিটের মত সময় লাগে। আমার জন্য বেশ ভালোই হলো। মা কথা বলে রেখেছেন আমি সপ্তাহে তিন দিন করে ক্লাশ করবো। স্যার ও বাড়ির কাছে হওয়াতে বেশ খুশি হয়েছেন।

আমি ভার্সিটিতে ক্লাশ করতে শুরু করলাম। যে কয়দিন ক্লাশ করি সে কয়দিন সাবাকে মা দেখে রাখেন। মাঝে মাঝে স্যার আমাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যান যেদিন আমার সকালে ক্লাশ থাকে। মানুষটার প্রতি আমার বিশেষ এক ধরনের মায়া জন্মে গিয়েছে এ মায়ার নাম কি আমি জানি না। তবে মানুষটার জন্য সত্যিই মায়া জন্মে গিয়েছে। এই মায়ার নাম ভালোবাসা কিনা আমি জানি না। যদি ভালোবাসা হয় তবে সে মায়া সে ভালোবাসাকে যে আমার গলাটিপে হত্যা করতে হবে। কারণ আমি যে তার যোগ্য না। দু’জনের মাঝে আসমান জমিনের ফারাক।

আমি বিবাহিত এক সন্তানের জননী। আর স্যার অবিবাহিত, দেখতে সুদর্শন। সব চেয়ে বড় কথা আমি এ বাড়িতে একজন আশ্রিতা। আসমান আর জমিন কখনোই এক হতে পারে না যেমন আমি আর স্যান। তাই প্রতিনিয়ত নিজের মনকে বুঝিয়ে রাখি। ইদানীং স্যারের আশে পাশে যেতে ভিষণ ভয় আর লজ্জা লাগে। মানুষটার চাহনীতে এক প্রকার ভালোবাসা আমি দেখতে পাই। তাই প্রচন্ড ভয় লাগে আমার।

মা এখন মাঝে মাঝেই বলে ঝর্ণার পড়ালেখা আর কিছু দিনের ভিতরই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু ছেলেটাকে কোন ভাবেই রাজী করাতে পারছি না বিয়ে করানোর জন্য। এদিকে আমার ও বয়স হচ্ছে। আমার কিছু হয়ে গেলে ছেলেটা যে একবারে একলা হয়ে যাবে। ছেলেটা কোন ভাবেই যেন বুঝতে চায়না।

মায়ের কথা শুনলে হৃদয়টা ফেটে যায়, নিজেকে শান্তনা দিয়ে বলি এটাই বাস্তবতা আজ হোক কাল হোক ঝর্ণা আর স্যারের বিয়ে হবেই।

দেখতে দেখতে এভাবেই আরও দু’টো বছর কেটে গেলো। মা ইদানিং আমারও বিয়ে দিতে চায়। আমি মাকে অনেক বার বলেছি আমি বিয়ে করতে চাইনা। আল্লাহ আমাকে যেভাবে রেখেছেন ভালো রেখেছেন। মা আমার সে সব কথা শুনতে চান না। মা বলেন মেয়ে মানুষ আর কত কাল একলা থাকবি। যদি কখনো এখান থেকে তোকে চলে যেতে হয়। তখন একলা একটা মেয়ে মানুষ তুই পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করে টিকে থাকতে পারবি না। পৃথিবীটা অনেক কঠিন।

দেখতে দেখতে জানুয়ারি মাস চলে আসলো। স্যার আর মা মিলে সাবাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলো। সাবা এখন অনেক কিছু বুঝে। আমি অনেক বুঝিয়ে রাখার চেষ্টা করি। তবুও মেয়ে সারাদিন নানু নানু করে বাড়ি মাতিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে এ নিয়ে মা বলেন আমার ছেলেটা সময় মত বিয়ে করলে হয়তো সাবার বয়সী নাতি নাতনী থাকতো আমারও।

মা আপনার অনেকদিন কুমিল্লা যান না আপনার বোনের বাড়িতে। যেয়ে ঘুরে আসুন, ঝর্ণার ও পড়ালেখা শেষের দিকে। ঝর্ণাও রাগ করে এ বাড়িতে আসে না। যাওয়ার পর স্যারের মন পরিবর্তন হতেও পারে।

মা: এটা তুই ভালো বলেছিস। দেখি জাহাঙ্গীরকে বলে।

কথাটা যতটা সহজে বলেছি, ঠিক ততটা সহজে হৃদয়টিকে মানাতে পারছি না। প্রচন্ড খারাপ লাগলেও আল্লাহর নিকট প্রতিটা মোনাজাতের প্রার্থনায় বলি নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আমার মায়া বাড়িয়ে দিও না। যা আমার নয় তার প্রতি আমাকে আকৃষ্ট করো না।

তিন চার কেটে গেলো হঠাৎ মা এসে আমাকে বললো, স্যার রাজী হয়েছে কুমিল্লা যাবার জন্য। মাকে খুশি দেখে আমার ও ভীষণ ভালো লাগলো। আমি বললাম এবার কিছু একটা হবে।

মা: খুশি মনে বললো আমিওতো চাই কিছু একটা হোক।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here